ছোট গল্প
কবিতা
Mobile Photography
প্রিয় কবি, প্রিয় কবিতা ...
একটি সুইসাইড
‘ জ্যোৎস্নায়
সবকিছু আলোকিত, কিন্তু সে বসে আছে ঠিক অন্ধকারের মাঝে।‘
কোন একটা
উপন্যাসে এই লাইনটা আমি পরেছিলাম মনে আছে, কিন্তু কি পরিপ্রেক্ষিতে এ অবতারণা – কিছুই ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে আমার সময়ের সাথে এর
মিল আছে বলে উল্লেখ করলাম এখানে। আজ পূর্ণিমা। তবে পূর্ণিমা একাদশী না দ্বাদশী, এ হিসাব
নিকাশ আমি কিছুই করতে পারব না; চাঁদটা পূর্ণরূপে মধ্যগগনে – এ থেকেই বলছি, আজ পূর্ণিমা।
হয়তবা আমার বলার ভুলও হতে পারে। ‘ কিন্তু সে বসে আছে ঠিক অন্ধকারের মাঝে ‘ – এ নিয়ে
আমার কিছু বলবার আছে এবং আমি আপনাদের বলব।
ধলেশ্বরী
নদীর পারে আমার এ ছোট্ট বাড়ি। আজ বছর খানিক হতে চলল আমি এখানে পাকাপোক্ত ভাবে বসাবস
করছি, যদিও প্রথমে এটা ছিল আমার অবকাশ যাপন কেন্দ্র । বলতে পারেন জগৎ সংসার থেকে স্বেচ্ছায়
নির্বাসন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছি এখানে। না না, আমার কোন পিছুটান নেই, নেই খাওয়া-পড়ার ভাবনা।
আসলে শেষ বছরগুলো …।
আজ আমি পূর্ণ
বিশ্রাম নিয়েছি এবং ডুবে আছি ঠিক নিজের মাঝে। জোসনার আলো পরে ধলেশ্বরীর পানি যখন চিকচিক
করে, আমি আমার উঠোনে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিক তাকিয়ে থাকি এবং আপন মনে ভাবি কতকিছুই
না। ভাবি নিজেকে নিয়ে – এই আমি ; আমার অবস্থান, চিন্তা চেতনা, আমাকে ঘিরে সমাজ, সমাজের
মানুষগুলি কিংবা সে ভাবনা ছাড়িয়ে ধলেশ্বরীর এই পাড়ের শত সহস্র জোনাকির মেলার ‘পরে পূর্ণিমার
শেষ সীমানা আমার চোখে- আমার ভাবনার কোন সীমারেখা নেই। কিন্তু আজ সব ভাবনা আমার হারিয়ে
গেছে ; সেখানে কেবল অবস্থান নিয়েছে একজন, একটি নারী – নিশু।
আমার সামনে
একটি টেবিল। টেবিলের এক পাশে জীবনান্দের একটি কবিতার বই – মহাপৃথিবী, আলোর পৃথিবী।
এখানে বসে প্রতিদিন আমি আবেগিত কণ্ঠে কবিতা আবৃতি করি – মহাপৃথিবী আলোর পৃথিবীকে বুঝতে
চেষ্টা করি এবং মহাপৃথিবীর মাঝে হারিয়ে যাই, ফিরে আসি আলোর পৃথিবীর হাত ধরে। আর হারিয়ে
যাওয়ার এই সময়টাকে মনে হয় জীবনের সর্বশ্রেষ্ট সময় আমি পার করছি – বুঝতে পারি জীবনান্দকে।
অথচ আজ কবিতার বইটি ছুয়েও দেখিনি। জীবনান্দ এই মুহূর্তে আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।
আজ নিজের
সাথে একটা খেলা খেলব। কি নাম দিব এই খেলার ? আচ্ছা, এর নাম দিলাম ‘ভালোবাসার খেলা’।
হ্যাঁ, ভালোবাসার শেষ খেলাই খেলব নিজের সাথে। খেলোয়াড় এখানে আমি একা। একটু ভুল বললাম
কি ? নিশুও কি এর সাথে জড়িত না ? হ্যাঁ, সে জড়িত এবং তার উপলক্ষেই আমার এ আয়োজন। যাই
হোক, খেলার প্রথম অংশে আমি একাই খেলাব । দ্বিতীয় অংশেও আমি একাই যদিও খেলব তবে তা হবে
নিশুর সামনে – এখনের মত একাকী না। অবশ্য প্রথম ভাগের উপর নির্ভর করছে ‘ভালোবাসার খেলার’
শেষটা।
আমার সামনে
একটি রিভলবার। জীবনান্দের কবিতার বইয়ের পাশে ওটা পরে আছে। আগ্নেয়াস্রটির অর্ধেক চেম্বার
বুলেটে ভরা, বাকি অর্ধেক খালি। চেম্বারও আমি ঠিকভাবে সাজিয়েছি অর্থাৎ, ব্যারেলে একটি
চেম্বারে বুলেট তারপরেরটি ফাঁকা, তারপর আবারও বুলেট – আবার খালি। চান্স এখানে ফিফটি
ফিফটি।
নিজের সমন্ধে
আরও কিছু বলার আছে আমার। নিশুর কথাও বলব। বলব আমি আরও অনেক কিছুই। আচ্ছা, রাজবন্দী
এই নামটা কি চিনতে পারছেন ? আমি কিন্তু ‘রাজবন্দীর’ কথা বলছি না। বলছি, এই নামের কোন
এক মানুষের কথা। আপনি যদি সাহিত্যপ্রেমী হন, তাহলে হয়তবা চিনতে পারেন, আর না চিনলেও
আপনাকে কোন দোষ দিতে পারব না। কেননা, বাজারে কত শত লেখক-কবি আছেন, তাদের কয়জনের খবর
কে রাখে। হ্যাঁ, আমি একজন সাহিত্যিক । খুবই সাধারন মানের একজন কবি-সাহিত্যিক। অবশ্য
লেখকদের জাত এক, কে ছোট আর কে বড় এটা কোন বিষয় না – আমরা সবাই সাহিত্যিক, এটাই আমাদের
বড় পরিচয়।
‘রাজবন্দী
? কিন্তু রাজবন্দী তো আপনার নাম না।‘
হ্যাঁ, রাজবন্দী
আমার ছদ্দনাম। এ নামেই বাজারে দু চারটা বই বেরিয়েছে। কেউ জানেনা, হয়তবা কোনদিন জানবে
না, রাজবন্দী নামের আসল মানুষটাকে। আর এই আসল মানুষটার আশে পাশের কেউ ধারনা করতে পারবে
না যে সে ‘রাজবন্দী’ হতে পারে। আমার এক হাতে
রিভলবার, অন্যহাতে কবিতার বই- আমার মানসিকতা এ ধরনেরই। অবশ্য আমার পরিচিতজনেরা শুধু
রিভলবারটাই দেখেছে, কবিতার বই নয়। আসলে আমিও কবিতার বই নিজেই আড়াল করে রেখেছি – এটা
শুধু একান্তই আমার, দশজনকে দেখানোর মত কিছু নেই এতে। একটু মনে হয় ভুল বললাম ? আচ্ছা,
তাহলে বলছি ; আমরা আসলে রিভলবার আর কবিতা এ দুটো এক সাথে দেখে অভ্যস্ত নই।
আমি এক হাতে
সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠি, অন্যহাতে ধ্বংসের উল্লাস। জীবনান্দের কবিতা পড়তে পড়তে আমি
গুলি চালাই কপালের ঠিক মাঝ বরাবর, সেখানে ফুটো ; গলগল করে বের হওয়া তাজা রক্ত – সে
রক্ত নিয়েই আমি আবার কাব্য রচনা করি …
‘ আমাদের কক্তে ভেজা তোমাদের এই শহরে –
আমরা রঞ্জিত, তবুও সুখী।
আমাদের ফিনকি দিয়ে বের হওয়া তীরস্রোতা ‘ধারা
তোমাদের আকাশ ছোয়া অট্রালিকা থেকে ফের চুইয়ে পড়ে
–
শহরের পিচঢালা কালো রাস্তাটা
রক্তিম হয়ে উঠে কৃষ্ণচূড়ার মত –
তোমরা মেতে উঠ বসন্তের হলি উৎসবে।
তোমাদের শহরে উড়ে লাল সবুজের পতাকা
আমাদের বুকের লাল জমিনের মাঝখানে
সবুজ হয়ে শুধু বেঁচে আছে একচিলতে ভালোবাসা –
আমরা এতেই সুখী … । ‘
আপনাকে
এবার একটা ধাঁধা দিচ্ছি। আচ্ছা বলুন তো, আমার হাতে সর্বপ্রথম কোনটা উথেছিল – কবিতা,
নাকি রিভলবার ? নাকি দুটোই একসাথে ? তবে এটা বলবেন না যে মানুষ জন্মগত ভাবেই কবি, খুনি
নয়। স্বীকার করছি, আপনার কথা ঠিক আছে ; কিন্তু
সবাই তো আর ‘কবি’ না।
মনে
পড়ে, কলেজে বার্ষিক প্রকাশনা উৎসবে একবার একটি কবিতা দিয়েছিলাম, কিন্তু প্রকাশ হয়নি
। আমাদের সিরাজ স্যার বলেছিলেন, উল্টোপালটা ভাবের আবোল তাবোল কিছু লেখার নাম কবিতা হয়। সেদিন স্যারের কথায় অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম,
প্রতিজ্ঞা করেছিলাম – জীবনে আর কোনদিন একটা কবিতাও লিখব না। আমার প্রতিজ্ঞা আমি রাখতে
পারিনি, কিন্তু নিজেকে আড়াল করে জন্ম দিয়েছি ‘ রাজবন্দীর’ ।
বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনেই আমার প্রথম বই প্রকাশিত হল। জীবনে প্রথম প্রকাশিত বইকে ঘিরে যে কত আবেগ-আনন্দ
থাকে, এটা একমাত্র সেই কবি সাহিত্যিকরাই বুঝতে পারবেন। অথচ এই আনন্দটাকে আমি কারও সাথে
ভাগাভাগি করিনি। মনে পড়ে, কবিতার বইয়ের একটা কপি শুধু নিশুকে উপহার দিয়েছিলাম। বলেছিলাম
– ‘ আমার পরিচিত একজনের প্রথম প্রকাশিত বই। পড়ে দেখ, ভালো লাগবে’।
এক
সপ্তাহ নিশুর সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না। তারপর যেদিন সে বিশ্ব বিদ্যালয়ে এল, বিকেল
বেলা ওকে নিয়ে বসলাম ক্যাম্পাসের সামনের মাঠের এক কোনায় – সবুজ ঘাসের উপর। আমার হাতটা
সে কোলের উপর নিয়ে চুপচাপ বসে রইল। ওর দৃষ্টি ছিল মাঠের পাশের বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছের
উপর। গাছটিতে ফুলে ফুলে পূর্ণ।
‘একটা
কবিতা শুনবি ?’- নিশু আমার দিকে চেয়ে বলল।
‘বল’
– আমি বললাম।
‘ কাঁদলে যদি জল ঝরে চোখে
তবে বৃষ্টির কান্না কত ?
দুঃখ পেলে হৃদয় ভাঙ্গে যদি
তবে নদীর দুঃখ কত ?
বিরহে যদি নীল নীল ছবি বুকে
তবে আকাশের বিরহ কত ?
তুমি কাঁদছ তোমার দুঃখ বিরহ নিয়ে –
বৃষ্টির জন্য, আকাশ-নদীর জন্য কেউ কাঁদে না।
তুমি
ভাবছ বসে আনমনে
কতটা
পথ পেড়িয়ে তবুও পথের ঠিকানা তুমি পেলে না।
রূপালী
চাঁদের আলোয় আলোকিত পৃথিবী
কতদুরে
চাঁদ – তুমি জাননা।
তুমি
ভাবছ তোমার ক্ষুদ্রতা নিয়ে
অনুতে অনুনে বিশাল ধরণী … ‘।
‘নিশু,
তোর কি মন খারাপ ?’
‘
কই না তো ।‘ সামান্য একটু হাসল সে, তারপর বলল, ‘ কবিতাটি কেমন লাগল বললি না তো?’
আমার
নিজের লেখা কবিতা আর আমাকেই বলছে কেমন লাগছে !
‘তোর
কাছে কেমন লাগছে ?’ আমি বললাম।
‘ভালো।‘
‘শুধুই
ভালো?’
‘হ্যাঁ,
তবে নতুন হিসাবে অনেক ভালো। সবচেয়ে বড় কথা কবিতাগুলোর ভাব সহজ আর ভাষাও সাবলীল।‘
‘তুই
বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী, তাই তুই ভালো বললেই ভালো। আমি রসায়নের ছাত্র, আমার মাঝে অতটা
রস নেই যে বলতে পারব ভালো না খারাপ।‘
‘এই
কবিতা বুঝতে রস এর দরকার হয়না গাধা!’
‘তাহলে
কি দরকার হয় ?
‘একটা
নিরেট উর্বর মস্তিষ্ক, যা তোর মত গাধাদের আছে !’
‘বলিস
কি রে ! তাহলে কাল থেকেই কবিতা রচনা শুরু করা যাক। কারন আমি জানি, নিরেট উর্বর মস্তিষ্ক
ছাড়া কবি হওয়া যায় না !’
কথাগুলো
বলার পড়েই কিল এসে পড়ল আমার পিঠে ! কবিতা প্রীতি ওর প্রবল। একই সাথে নিজেও যে দু চারটা
কবিতা লিখে না, তা না। ওর নিজের লেখা কবিতাগুলোও খুব সুন্দর, হয়তবা আমার থেকেও ভালো।
ও যখন ওর কবিতা পড়ে শোনায়, আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। কিন্তু ভাবটা গোপন রেখে ফাজলামি করি
কবিতা নিয়ে। আর ওর কিল এসে পড়ে আমার পিঠে ! একদিন মজা করে বললাম,-
‘আমাকে
কিলাতে কিলাতে তো তোর হাত শক্ত হয়ে গেছে। এই শক্ত হাত দিয়ে আর কবিতা লিখে কি হবে !
এক কাজ কর, জুডোর কোর্সে ভর্তি হয়ে যা – ভালোই নাম করতে পারবি।‘
‘তুই
ভেবে বলছিস এ কথা ?’
‘ক্যান
?’
‘তখন
যদি আমি একটা পাঞ্চ মারি, তোকে যে আর কিছুই দেখতে হবে না !’
‘অ্যাঁ
?’
আমার
নাকটা টিপে দিয়ে ও বলল ‘ হ্যাঁ ‘।
সেদিন
নিশুর মন সত্যই অনেক খারাপ ছিল; আমি তা জানতে পারলাম ওর বন্ধু পারুলের কাছে। আমার মাথায়
খুন চেপে গেল।
হলে
ফিরে এলাম। রিভলবারটা গুজে নিলাম কোমরে। একাই চলে গেলাম সি এস হলের ১০৭ নাম্বার রুমে।
অরা চারজন বসে তাস খেলছিল –
‘
তুই নিশুকে কি বলেছিস ?’ একটু থেমে বললাম, এর আগেও আমি তোকে দুইবার সাবধান করে দিয়েছিলাম।
আমার কথায় তোর কিছু আসে যায় না, না ?’
ওই
খা*কি মা*র পোলা, তুই ক্যাডারে ?’ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলল সামান্য সময়। একসময় রানা বলল, ‘ ধর শালারে। শালারে আইজক্যা বানামু ।‘
আমি
দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক দরজা বরাবর। আর অরা বসে ছিল রুমের মাঝখানে। রানার কথা শেষ হওয়া মাত্র
চারজন বিদ্যুৎ বেগে উঠে দাঁড়াল। তোষকের নিচে রাখা চাপাতি চলে এল রানার হাতে। একজন লকার খুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল; অন্য
তিনজন দৌড় দিল আমার দিকে।
আমার
ডান হাতে কখন যে রিভলবার চলে এসেছে আমি নিজেও জানি না। এটাও মনে নেই ঠিক কখন আমি গুলি
চালালাম। শুধুমাত্র দেখতে পেলাম বা হাটুতে গুলি খেয়ে রানা হুমড়ি খেয়ে পড়ল আমার একহাত
সামনে। অন্য দুজন দুপাশে সরে পড়েছে। চতুর্থজন যে লকার খুলতে ব্যাস্ত ছিল তার হাতে উঠে
এসেছে পিস্তল।
দ্বিতীয়
বারের মত আগ্নেয়াস্ত্রের কান ফাটানো শব্দ এল এবং একই সাথে আমার বা হাতের পেশিতে তীক্ষ
ব্যাথা অনুভব করলাম। নিজেকে রক্ষার জন্য এক পা পিছে এসে বা পাশে ড্রাইভ দিলাম এবং সেকেন্ড
বিলম্বে দ্বিতীয় বারের মত গুলি ছুড়লাম।
আমার
তখন হিতাহিত জ্ঞান নেই। রিভলবার সমেত ডানহাত দিয়ে বা হাতের পেশী শক্ত করে চেপে ধরে দৌড়াচ্ছি
দিকভ্রান্তের মত। এক সময় এসে উপস্থিত হলাম আপন হলে।
উত্তরা
– ৪ অর্থাৎ আমার হলের সামনে উৎসুক ছাত্ররা জমা হয়ে গেছে। আমাকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে
সবাই পথ ছেড়ে দিল। একটু পরে সবাই যখন ঘটনা জানলো- স্থির হয়ে গেল আতঙ্কে।
মাসুদ,
তাহের, শিপন, বেলাল ওরা আমার সাথে রুমে চলে এল। দরজা বন্ধ করে শিপন ব্যাস্ত হয়ে পড়ল
আমার হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধতে। গুলিটি এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে চলে গেছে।
যদিও
ঘটনা পুরোটাই ঘটেছে নিশুকে কেন্দ্র করে, আর
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির মাঠে ওরা আমাদের বিরোধী পার্টি। ওদের দল এখন ক্ষমতায়
তাই ধরাকে সরাজ্ঞান করছে এবং প্রতিশোধ নিতে ওরা আমাদের হল আক্রমন করতে পারে। সাধারন
ছাত্র যারা, তারা গোলমালের আশঙ্কায় তড়িৎ হল ত্যাগ করতে শুরু করল কিংবা দরজা জানালা
বন্ধ করে চুপ মেরে রইল রুমের ভিতর। আমাদের দলের ক্যাডারাও প্রস্তুতি নিল আক্রমন প্রতিহতের।
একটু পরে ইমতিয়াজ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল রুমের মাঝে।
কয়েকবার দম নেয়ার পর ইমতিয়াজ যে কথাটি বলল, ‘ পিন্টু মারা গেছে।‘
রুমের মাঝখানে পিনপতন নিরবতা। কেউ কোন কথা বলছে না। সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
‘
খালিদ, তুই পালা।‘
‘
হ্যাঁ, তারাতারি, এক্ষুনি।‘
‘
জলদি, হাতে সময় নেই। এদিকের সবকিছু আমরা সামলাবো। তুই চলে যা দ্রুত।‘
হলের
পিছনের বাউন্ডারি টপকে পালালাম আমি। দুশো গজের মত দৌড়ে পার হয়েছি মাত্র, এমন সময় গুলির
শব্দ কানে এল। দু গ্রুপের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
গুলির
শব্দে আমার হাতে আপনা আপনি রিভলবারে চলে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের পাশে একটি খাল,
খালের ওপাশেই মফস্বল শহর। করটিয়ার মানুষ কোনদিন ভুলবে না যে রক্তে রঞ্জিত সার্ট পরিহিত
একজন যুবক আগ্নেয়াস্র হাতে ব্যাস্ত রাস্তায় হাজার মানুষের সামনে উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়াচ্ছে
যার অন্যহাতের ব্যান্ডেজ চুইয়ে চুইয়ে ফোটায় ফোটায় রক্ত পরছে পিচঢালা রাস্তায়।
ইন্ডিয়াতে
বসে আমি সংবাদটি পড়লাম।
ছাত্রনেতা
পিন্টু হত্যাকে কেন্দ্র করে দু দলের মাঝে ব্যাপক সংঘর্ষ, নিহত দুই, আহত অর্ধ শতাধিক।
বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা। ছাত্রদের অবিলম্বে হল ত্যাগের নির্দেশ।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কারফিউ জারি। পুলিশ ও আর্মি মোতায়েন। পিন্টু হত্যাকারী ঘাতক খালিদ
পলাতক।
আমার
মাঝে কোন ভাবান্তর হল না খবরটি পড়ে। শুধুমাত্র তাহেরের জন্য কষ্ট লাগল। ওর শরীরে কয়েকটা
গুলি লেগেছে, মৃত সে। অন্য একজন যে মারা গেছে সে প্রতিপক্ষের ইমতিয়াজ। তাহের ছিল ইতিহাসের
ছাত্র। সেই সাথে আমাদের প্যানেলের একনিষ্ঠ কর্মী। খুব ভাল বন্ধু ছিল আমার।
গতবারের
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা। আমাদের দল তখন ক্ষমতার আসনে। আমরা তাই
আশাবাদী ছিলাম। ভিপি হিসাবে স্বাধীন ভাই মনোনয়ন পেলেন। এ জি এস আখতারুজ্জামান। যদিও
এ প্রার্থিতা নিয়ে আরও দুজনের সাথে মনোনয়নের যুদ্ধে সামিল হতে হল তাকে। জি এস এই পদটা
আমার। ক্রীড়া সম্পাদকের জন্য আহমেদ রাসেল। কিন্তু সমস্যা হল দপ্তর সম্পাদক নিয়ে। স্বাধীন
ভাইকে বললাম। সে বলল, ওটার জন্য মনোনয়ন দেওয়া হবে পারভেজকে। আমি বললাম, ‘সে ক্ষেত্রে
আমি প্যানেল থেকে সরে দাঁড়াব।‘
স্বাধীন
ভাই সেই সাথে দলের সাথে আমার মনোমালিন্য শুরু হল। তবে ওরা বুঝতে পারল, আমাকে ছাড়া প্যানেল
পঙ্গু হয়ে যাবে। অবশেষে মনোনয়ন পেল তাহের। সেবার নির্বাচনে আমাদের প্যানেল জয় লাভ করল
বিপুল ব্যাবধানে।
সেদিনের
কথা ঘুরেফিরে বারবার মনে পড়ছে। রিভলবার হাতে উদ্ভ্রান্তের মত মফস্বল শহরের রাস্তা ধরে
দৌড়াচ্ছি আমি। লিচু বাগান রোডের সিনেমা হলটি পার হয়েছি মাত্র, একটি ট্যাম্পু আমার পাশে
এসে থামল। আমি ট্যাম্পুতে উঠে বসলাম। চালক শিবা কোন কথা না বলে আমাকে নিয়ে হাজির হল
তার বাড়িতে। সে আমার পূর্ব পরিচিত।
আমি
গোসল, পরনের কাপড় পরিবর্তন করে শিবাকে বললাম, ‘ আমাকে বাড়ি নিয়ে চল।‘
ঘণ্টা
দুয়েক পরে আমি আমার গ্রামের বাড়িতে পৌছালাম। আমার মা মারা গেছেন আমার জন্মের সময়ই।
বাবা মারা গেছেন আজ প্রায় চার বছর হল। আমার কোন ভাই বোন নেই, অর্থাৎ সংসারে আমি পুরোপুরি
একলা।
বাবা
মারা যাওয়ার সময় এই বসতবাড়ি আর সামান্য চাষাবাদের জমি রেখে গিয়েছিলেন। চাষাবাদের সেই
জমিটা বিক্রি করে দিয়েছি কয়েক বছর পূর্বে – কোন উপায় ছিল না বলে। আমার বড় চাচার কাছেই
জমিটা বিক্রি করে দিয়েছি বাজার দরের চেয়ে কম মুল্যে, কেননা চাচাকে শর্ত দেওয়া হয়েছে
ভবিষ্যতে যখন আমার অর্থকরি হবে তখন চাচা জমিটা ফের বাজার মুল্যে আমার কাছেই হস্তান্তর
করবেন।
বসতবাড়িটা
গাছ-গাছালিতে পুর্ন। মা’র নাকি খুব সখ ছিল গাছ লাগানোর। বাড়ির উত্তরপাশের বিশাল কাঠাল
গাছ থেকে শুরু করে নারিকেল, জাম, জলপাই, চালতা ইত্যাদি আরও হরেক রকমের গাছ- সবই আমার
মায়ের অবদান। বসতবাড়ির উত্তরে চৌচালা কাঁচা একটি পুরনো টিনের ঘর- যার সবটুকুই নষ্ট
হয়ে গেছে মরিচা পরে। বর্ষাকালে শতছিদ্র চাল থেকে পানি পরে মেঝেতে বন্যা বয়ে যায়- তারপরেও
এই ঘরটিই আমার বাবার শেষ স্মৃতিচিহ্ন ।
একদিন
নিশুকে নিয়ে এসেছিলাম বাড়িতে। তাকে আমার অবস্থা সম্পর্কে আগেই বলেছিলাম। কিন্তু বাড়ি
দেখে নিশু মহাখুশি। পুরো বাড়ি সে ঘুরে ফিরে দেখল। আমাকে বলল, ‘ তুই আমাকে বিয়ে করলে
বিয়ের পর আমি কিন্তু এখানেই থাকব। ‘
‘তোকে
বিয়ে করতে আমার বইয়ে গেছে ! আমি কি তোকে কখনও বলেছি যে আমি তোকে বিয়ে করব ?’
‘তাহলে
আমার সাথে প্রেম করলি ক্যান ?’
‘আমি
প্রেম করেছি নাকি তুই?’
‘আচ্ছা,
আমিই প্রথম বলেছি যে আমি তোকে ভালবাসি। কিন্তু এটা তো মিথ্যা না যে তুই আমাকে ভালবাসিস না ?’
‘আচ্ছা
বাপ, তোকে আমি ভালবাসি, ভালবাসি, ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসলেই যে বিয়ে করতে হবে এ রকম
কি কোন চুক্তি হয়েছে তোর সাথে আমার ?’
‘তাহলে
তুই আমাকে বিয়ে করবি না ?’
‘না
।‘
‘ভেবে
বলছিস তো ?’
আমি
হাসি মুখে বললাম, ‘হ্যাঁ’।
‘তাহলে
শুনে রাখ নরাধম পাপিষ্ঠ, তোর সাথে আমার বিয়ে কোনদিন হবে না।‘
‘আচ্ছা,
শুনে রাখলাম।‘
আমি
মজা করছিলাম বরাবরের মত নিশুর সাথে। কিন্তু এতে যে ও মন খারাপ করে ফেলবে – আমি বুঝতে
পারিরি। নিশুর হাত ধরে ওকে টেনে ঘরের ভিতরে নিয়ে এলাম। ঠিক ওর সামনে দাঁড়িয়ে তার চোখে
চোখ রাখলাম। বললাম,
‘আমাকে
তুই বিয়ে করতে চাষ ? ভেবে উত্তর দিবি।‘
নিশু
আমার চোখে চোখ রেখেই বলল, ‘হ্যাঁ ।‘
‘যদি
বলি আজ এখানেই তোর সাথে আমার বিয়ে হবে, তুই রাজি ?’
নিশু
সেকেন্ডও সময় নিল না, বলল, ‘হ্যাঁ ।‘
আমি
নিশুর ঠোটে চুমু খেলাম। তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম চেয়ারে।
আনোয়ার
হোসেন, জেলা শহরের একজন গনমান্য ব্যাক্তি, ব্যাবসায়ী – নিশুর বাবা। নিশুর কোন ভাইবোন নেই, আনোয়ার সাহেবের একমাত্র আদরের
মেয়ে সে। অঢেল অর্থ সম্পত্তির মালিক সে, সেই সাথে একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সক্রিয়ভাবে
জড়িত। আর খালিদ ! আনোয়ার সাহেবের জামাই হিসাবে কল্পনা করতেও আমার হাসি পেল। অথচ এই
বাড়িতে বসেই আমি কতশত কল্পনা করেছি নিশুকে নিয়ে। পুরনো বাড়িটা ভেঙ্গেচূড়ে নতুন করে
সাজাব। এখানে থাকবে শুধু দুটো প্রাণী – আমি আর নিশু। আমাদের ঘিরে থাকবে বিশাল আকাশসম
অফুরন্ত ভালোবাসা।
বড়
চাচার সাথে দেখা করলাম, বললাম, ‘আমার অনেক টাকা লাগবে।‘
চাচা
বললেন, ‘ টাকা লাগবে ভালো কথা, কিন্তু কত টাকা ?’
আমি
বললাম, ‘এক লাখ।‘
‘এক
লাখ !’ চাচা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ‘ আমি তোমাকে তুই চার পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য
করতে পারি, কিন্তু তাই বলে এক লাখ ।‘
‘শোনেন
চাচা’ – আমি বললাম, ‘ পুরো এক লাখ টাকাই আজ এক্ষুনি চাই আমার। আপনাকে আমার বাড়ির দলিলপত্র সব দিচ্ছি, ওগুলো বন্ধক রেখে আপনি আমাকে টাকা দিবেন।
আপনার সাথে আমার চুক্তিপত্র হবে – যদি দু বছরের মোধ্য আমি এই টাকা আপনাকে ফেরত দিতে
না পারি তবে আমার বাড়িটা আপনার হয়ে যাবে।‘
আসলে
আমার এ ছাড়া কোন উপায়ও ছিল না, কেননা বন্ধুদের কাছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন, দোকান
– সব যায়গায় সব মিলিয়ে পঁচিশ-ত্রিশ হাজার টাকার মত ঋন হয়ে গেছে। আর এখন আমি ফেরারী
আসামী। কতদিন যে আমাকে পালিয়ে থাকতে হবে আমি জানি না।
শিবার
হাতে ঋনের টাকা ও তালিকা তুলে দিয়ে সেদিন রাতেই আমি রওনা হলাম সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে।
এখানে আমার এক দুঃসম্পর্কের খালু সীমান্তুরক্ষী বাহিনীতে চাকুরি করেন। তিনিই সব ব্যাবস্থা
করে দিলেন আমার জন্য। পরদিন দুপুরবেলা ভোমরা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করলাম ইন্ডিয়ার চব্বিশ
পরগণাতে, সেখান থেকে কোলকাতা।
কত
বড় বড় সন্ত্রাসী পুলিশের নাকের ডগায় তেল লাগিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ আমি সন্ত্রাসী
নই – একজন রাজনৈতিক ক্যাডার মাত্র, আমাকে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হল ইন্ডিয়াতে। অবশ্য আমি
এখন একজন খুনি। এমন একজন আমার হাতে খুন হয়েছে যে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিপির
আপন খালাতো ভাই। এখন সবাই আমার পিছনে ছুটবে – পুলিশ, রাজনৈতিক দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসী,
বিরোধী ছাত্রদলের নেতা কর্মী সবাই। অবশ্য ইন্ডিয়া আসার আমার আরেকটি উদ্দেশ্য আছে –
বেশ কিছু দিনের জন্য আমি মুক্ত স্বাধীন জীবন যাপন করব।
আমি
পথে নামলাম। সেই পথ কলিকাতা থেকে কাশ্মীর কিংবা ব্যাঙ্গালোর থেকে উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত
প্রসারিত। এই পথে পাড়ি দিতে আমার পুরো একটা বছর সময় কেটে গেল। এরই মাঝে নিজের জন্য
আরও একটা কাজ করলাম – আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হল আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।
একটা সময় ভাবলাম, আমার তো কোন পিছুটান নেই, থেকে যাব নাকি ইন্ডিয়াতে। নাহ, সেটা সম্ভব
নয়, বাবার শেষ স্মৃতিচিহ্ন গ্রামের বাড়িটা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নিশু, সে বসে
আছে আমার পথপানে চেয়ে।
ইন্ডিয়াতে
বসে সবার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা না করলেও নিশুর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি অনেকবার।
কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। আচ্ছা, যদি দেশে ফিরে
আসি তবে নিশু কি আমাকে আগের মতই গ্রহন করবে,
নাকি প্রত্যাখান করবে একজন খুনি-ফেরারি বলে ? না, না, কি আবোল তাবোল ভাবছি আমি। আমাকে
প্রত্যাখান করা ওর পক্ষে সম্ভব নয় ; অনেক বেশি ভালোবাসে আমাকে।
ঠিক
দেড় বছর পর ফিরে এলাম দেশে, আমার গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু এটা কি আমার বাড়ি ? সত্যিই
আমার অবাক হওয়ার পালা । দিগম্বর বাড়িটা এখন টিনের বাউন্ডারী দিয়ে ঘেরা। আমি খোলা গেট
দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। আমার বাড়ি সংলগ্ন উত্তর পাশেই চাচার বাড়ি। দু বাড়িকে চাচাই
পৃথক করে রেখেছিলেন টিনের বেড়া দিয়ে। সে বেড়াও এখন আর নেই। দুটো বাড়ি এখন পরিনত হয়েছে
বিশাল এক বাড়িতে।
বাবার
জীবিত অবস্থায় চাচার সাথে তার সম্পর্ক কোনদিনও
ভালো ছিল না। কিন্তু আমার সাথে তেমন খারাপ সম্পর্ক ছিল না। বাবার মৃত্যুর পরে চাচাই
আমার অভিভাবক, আমিও মনে প্রানে সেটাই স্বীকার করতাম। বড়চাচীকে দেখতাম আমার মায়ের যায়গায়,
চাচাতো বোন গুলোও আমার আপন বোন ; কিন্তু চাচার ছেলে গুলোকে আমি দুই চোখে দেখতে পারতাম
না। চার মেয়ে আর পাঁচ ছেলে নিয়ে চাচার বিশাল সংসার। বড় তিনটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে,
সবার ছোটটি পড়ালেখা করছে স্থানীয় গার্লস স্কুলে। বড় ছেলে দুটো বিয়ে করেছে দুই তিন বছর
পূর্বে। একটি যায়গায় ভাইগুলোর মাঝে বেশ মিল – তারা কেউ লেখাপড়ায় স্কুলের গণ্ডী পার
হতে পারে নি এবং তারা সবাই গ্রামের মানুষের অনিষ্ট কর্মে মত্ত। বখাটেপানা থেকে শুরু
করে ঝগড়া বিবাদ – অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়া এবং চড়া সুদের কারবার। আমার বড়
চাচাও মনে হয় গর্বিত তার গুণধর ছেলেদের নিয়ে, কেননা তাদের কল্যানেই গ্রামে তার প্রতিপত্তি
আগের চেয়ে বেশি।
দেড়
বছরে একজন মানুষ কতটা পরিবর্তন হতে পারে যে তাকে কেউ চিনতে পারে না ? অবশ্য আমার দাড়ি-গোফ
কিংবা বাবরি লম্বা চুল দেখতেও কেউ অভ্যস্ত নয়। তাছাড়া এই অল্প সময়টা আমার ভিতরে বাহিরে
– সবক্ষেত্রেই বিশাল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তারপরেও আমি তো সেই আমিই আছি – অন্য কেউ
হয়ে যাইনি। চাচী তাই আমাকে ঠিকই চিনতে পারলেন, যদিও তাকে সামান্য সময় নিতে হল।
‘
তুই খালিদ না ?’
‘
জী চাচী । আপনি ভালো আছেন তো? চাচা কই, চাচাকে দেখছি না ? চাচার শরীর ভালো তো ?’
‘হ্যাঁ
বাবা ভালো। তোর চাচা একটু আগে ক্ষেতে গেছে, দাড়া আমি খবর পাঠাচ্ছি। তুই ভিতরে এসে বস।‘
‘ইয়ে
চাচী, বাড়ির এতসব পরিবর্তন, আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না … ।‘
আমার
বলা মাত্রই চাচীর মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। বললেন, ‘তোর চাচা আসুক, তার সাথেই কথা বল।
আমি কিছুই বলতে পারব না।‘ চাচী একছুটে ঘরের ভিতর চলে গেলেন, যেন পালিয়ে বাঁচলেন আমা
থেকে।
আমি
ঘুরে ফিরে বাড়ি দেখছি। লক্ষ্য করলাম, মায়ের হাতে লাগানো গাছগুলোর মাঝে দুটো আমগাছ আর
বহু পুরনো একটা কাঁঠাল গাছ নেই। পৈত্রিক ঘরটা অবশ্য ঠিকই আছে। কিন্তু কাঁচা ঘরটা পাকা
করা হয়েছে ; যতটুকু প্রয়োজন মেরামত করা হয়েছে। এবং ঘরটিতে সংসার পেতেছে চাচার বড়ছেলে আনোয়ার।
এই
দিনটা আমার জীবনের স্মরণীয় একটা দিন হয়ে থাকবে।
চাচা
এলেন তার ছেলেরাও এল। এল গ্রামের আরও দু চারজন মুরুব্বী। না, ভিটে বাড়িটা আর আমার নেই,
ওটা চাচার কাছে দেড় বছর পূর্বে পাঁচ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছি। চাচা এই
কাজটা কিভাবে কেন করলেন এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে চুপচাপ চলে এলাম বাড়ি ছেড়ে।
দেশে
তখন নির্বাচনী হাওয়া বইছে জোরেশোরে। পোস্টার প্লাকার্ডে ছেয়ে গেছে রাস্তা ঘাট, যায়গায়
যায়গায় বসেছে প্রচারনী ক্যাম্প। মিছিল মিটিং সমাবেশ – স্লোগান এসবের মাঝেই আমি প্রবেশ
করলাম আমার সেই বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পুরনো শহর করটিয়াতে।
বন্ধুদের
অনেকের সাথেই দেখা হল। দেখা হল আরও অনেকের সাথে যাদের প্রত্যাশায় আমি মোটেই ছিলাম না।
নিশুর খবর পেলাম, যদিও সে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনেক কম আসে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে গিয়ে
নিশুর সাথে দেখা করা সম্ভব না কিংবা তাদের বাড়িতে গিয়েও। অবশেষে বন্ধু বেলালের সাহায্য
নিতে হল আমাকে।
আমার
হাতে একটি কবিতার বই – আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের একটি কপি যা আমি নিশুর জন্য নিয়ে
এসেছি। প্রথম বারের মত ওকে বলব, ‘ আমার সেই বন্ধু রাজবন্দীর দ্বিতীয় বই এটা। পড়ে দ্যাখ,
ভালো লাগবে।‘ আমি বসে আছি করটিয়া শহরের অদুরে
ঝিনাই নদীর পাড়ে। এখানেই নিশু আসবে। আহা, কতদিন পরে আজ নিশুকে দেখব।
বেলালের
বাইকে চেপে নিশু এল ঘণ্টা খানিক পরে। ওকে রেখেই বেলাল চলে গেল। আমি দাঁড়ালাম নিশুর
সামনাসামনি।
‘
কেমন আছিস নিশু ?’
‘
ভালো। আপনি ভালো আছেন তো ?’
সামান্য
একটা ধাক্কা খেলাম আমি। নিশু আমাকে আপনি করে বলছে। মজা করে যে বলছে তা নয়। আসলে কোথাও
একটা পরিবর্তন হয়েছে এই সময়ের মাঝে, কিন্তু পরিবর্তনটা যে কি আমি বুঝতে পারলাম না।
এতক্ষন
বসে বসে ভাবছিলাম নিশু এলে প্রথমে ওকে জড়িয়ে
ধরে চুমু খাব ওর কপালে, তারপর তার হাত ধরে বসব পাশাপাশি। এখন এসবে বাধা দিল আমার মন।
তাই শুধুমাত্র বললাম, ‘ বসবে না ?’
আমরা
দুজন বসলাম – পাশাপাশি, কিন্তু মাঝখানে কিছুটা দূরত্ব। এই দূরত্বটা আমি তৈরি করিনি,
নিশুই করেছে। নাকি আমার কারনেই সে করেছে ?
‘তোর
পড়াশোনা কেমন চলছে ?’
‘ভালো।‘
‘আমার
তো আর মাস্টার্স করা হল না … জাকগে, কপালে নেই তাই কি আর করা যাবে। ও আচ্ছা শোন, তোর
জন্য একটা কবিতার বই এনেছি, পড়ে বলবি কেমন লাগল।‘
আমার
বাড়ানো কবিতার বই নিতে হাত বাড়াল নিশু, আমি ওর হাত খপ করে ধরে টেনে আনলাম নিজের দিকে।
আলতো করে চুমু খেলাম হাতে। বললাম, ‘নিশু, কি হয়েছে তোর ?’
‘না
কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।‘
‘না,
তুই ঠিক নেই। আসলে সবকিছু কেমন যেন উল্টাপাল্টা হয়ে গেল …।‘
নিশু
তাকিয়ে আছে নদীর শান্ত জলরাশির দিকে, আর আমি চেয়ে আছি তার মুখপানে। বললাম, ‘নিশু, তুই
আমাকে ভালোবাসিস না ? ‘ নিশু আমার দিকে ফিরে চাইল, চোখে চোখ রাখল একটা মুহূর্ত, কিন্তু
কিছুই বলল না।
আরও
ঘন্টা খানিক রইল সে । তারপর চলে গেল বেলালের সাথে।
আমার
সামনে শান্ত ঝিনাই নদী, তার শুকিয়ে যাওয়া সরু জলধারার পরেই বিস্তৃত বালুচর। সেখানে
অনেকগুলো শিশু কিশোরেরা খেলা করছে। তাদের মাথার উপরে উড়ে চলেছে নাম না জানা কোন পাখির
দল – দিবাসনের সমাপ্তিকল্পে তাদের এ যাত্রা। দিগন্তের শেষ প্রান্তে অর্ধাকৃতি অস্তমিত
লাল সূর্য। তার আভায় রক্তিম ঊর্ধ্বাকাশ। একটু পরে তার শেষ চিহ্নটুকুও মুছে যাবে, ধরিত্রীর
এ প্রান্তে নেমে আসবে আধার। প্রকৃতির এ পরিবর্তিত ধারায় সবকিছুই চলবে ঠিক আগের দিনের
মত ; কিন্তু কেউ একজন নিজেকে সে ধারায় সপে না দিয়ে এখানে, এই ঝিনাই নদীর পাড়ে এভাবেই
একলা বসে রইবে চুপচাপ। আজ সে হিসাব নিকাশ করবে নিজের সাথে। আগামীকাল যখন নতুন সূর্যোদয়
হবে সে সূর্যোদয়ের সাথে শুরু হবে তার নতুন দিন – নতুন ভাবে।
আমার
জীবনের অন্ধকার অধ্যায়ের বীজ আমি রোপণ করলাম সেদিন রাত্রে ; সেই সাথে নিশুর সাথে পরবর্তীতে
দু তিন বার সাক্ষাতের পর সেটি অংকুরোদ্গমিত হল। আমার এ ফেরারি জীবন নিশুর জন্য নয়
; নয় অন্য কারও জন্য। সহায় সম্বলহীন পথের ভিখারীর মত শুধুমাত্র নিশুর ভালোবাসা বুকে
নিয়ে বেঁচে থাকা আমার জন্য নয়। সবার উপরে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব আমি – নিজেকে ধ্বংস
করে দিব, কিন্তু তারপরেও সেটা আমার চাই।
খুব একটা বেশি সময় লাগল না নিজেকে এই মফস্বল শহরটির
একছত্র অধিপতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে। বারেক আমার হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পরে রইল হাসপাতালে - যে কিনা পুরো মফস্বল শহরটির ত্রাস ছিল। সেই সাথে আরও কয়েকটি গ্রুপকে নিয়ন্ত্রন করতে
হল বুলেটের মাধ্যমে। নির্বাচনের আগেই আমার নাম মফস্বল শহরটির সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেল
জেলা শহর পর্যন্ত। নির্বাচনের ঠিক দিন কয়েক আগে আমার ডাক পড়ল জেলা শহরের এক প্রভাবশালী
নেতার । তার নিজ দলের একজন এবং বিরোধী দলের দুজনকে খুন করলাম টাকার বিনিময়ে, এবং নির্বাচনের
ঠিক আগের দিন তার শো ডাউনে গুলি চালিয়ে হত্যা করলাম একজন এবং আহত হল গোটা দশেক , আর
সেটা সেই নেতার হুকুমে।
সেই
নেতা যখন বন ও পরিবেশ মন্ত্রালয়ের মন্ত্রিত্ব নিয়ে ক্ষমতায় এল তখন পুরো জেলার আন্ডারওয়ার্ল্ডের
আমিই একছত্র ডন। আমার নামে তখন অনেকগুলো হত্যা মামলা সহ গোটা বিশেক পরোয়ানা জারী হয়েছে
পুলিশের এখতিয়ারে ; যদিও পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের হামেশাই আসা যাওয়া হয় আমার
দুয়ারে নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে।
এর
অনেক আগেই একদিন আমি গিয়েছিলাম আমার গ্রামের বাড়িতে। বড় চাচাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে
সরাসরি বললাম, ‘ আমি আপনাকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি, আমার সেই বিক্রি করা জমি এবং
বাড়ির দলিলপত্র হস্তান্তর করতে। সেই সাথে আমার বাড়ির অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদেরও। চাচা
টাকাগুলো রাখলেন ঠিকই, কিন্তু মনে হয় আমার
কথার অতটা গুরুত্ব দিলেন না যা আমি বুঝতে পারলাম চব্বিশ ঘণ্টা পরেই।
সেদিন
বাইকে চেপে একাই গিয়েছিলাম। বাড়িতে প্রবেশ করেই বুঝতে পারলাম, ওরা তৈরি হয়েই আছে। চাচার
ষন্ডামার্কা ছেলেগুলোর সাথে তাদের সাগরেদ সহ সবাই যেন অপেক্ষায় রয়েছে আমার আগমনের।
উঠোনে একটা খালি চেয়ার ছিল, সেটা টেনে বসলাম।
চাচাকে
বললাম, ‘ কই আমার দলিলপত্র নিয়ে আসুন। আর আপনাকে বলেছিলাম আমার বাড়ির সব অবৈধ স্থাপনা
সরিয়ে ফেলতে, মনে হয় সময় পাননি। সমস্যা নেই, আমি সব ব্যাবস্থা করছি।‘
চাচা
কিছু বলার আগেই তার বড় ছেলে বলল, ‘ ভালোয় ভালোয় চলে যা খালিদ, না হলে কিন্তু জান নিয়ে
ফিরতে পারবি না ।‘
‘
ও আচ্ছা আচ্ছা আচ্ছা। জান নিয়ে ফিরতে পারব না ? ভাল, খুবই ভাল কথা ! কি আর করা যাবে,
দেখি পিতৃদত্ত প্রানটা কতক্ষন পরে আমাকে ছেড়ে চলে যায়।‘
একটা
সিগারেট ধরালাম। চাচার সামনে কোনদিন সিগারেট খাইনি, আজ একবুক ধোঁয়া ছাড়লাম চাচার চোখে
চোখ রেখে। চাচা চোখ নামিয়ে নিলেন, কিছু না বলে বড় ছেলেকে টেনে নিয়ে চলে গেলেন ঘরের
ভিতরে।
আমার
সমন্ধে মনে হয় এরা কিছুই জানে না তাই এতটা আস্ফালন দেখানোর সাহস পাচ্ছে। বুঝতে পারছি
না কখন এরা খেলাটা শুরু করবে। আমারও তাহলে একটু প্রস্তুতি নিতে হয়।
‘
একটু ঝামেলায় পরেছি বাপ। চলে আয় আমার গ্রামের বাড়িতে। ‘ মোবাইলে বললাম সঞ্জয়কে।
বড়
চাচা আসে পাশে নেই, কিন্তু তার দুই ছেলে সহ আর দু তিনজন এগিয়ে এল আমার দিকে।
আমার
ঠিক চার পাঁচ হাত সামনে ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। বড়
রাম দা, গরু জবাই করার বড় ছুরি, লাঠি – এ সব শোভা পাচ্ছে ওদের হাতে হাতে। বড় চাচাও
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়লেন বড় ঘরের দরজার ঠিক সামনে।
‘
জীবনে কোনদিন আর এ বাড়ির ত্রি সীমানায় আসবি না। আর এখন যদি না যাস … ।‘ চাচার বড় ছেলে এক পা সামনে এগিয়ে রাম দা উঁচু করে
ধরল মাথার উপর।
আমার
মাঝে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হল না। যে রকম বসে ছিলাম, সে রকমই রইলাম। শুধু কোমরে গোজা রিভলবারটি আপনা আপনি চলে এল হাতে।
আগ্নেয়াস্র
দেখে চাচার ছেলে একলাফে তিন হাত পিছিয়ে গেল ! দৌড়ে এলেন চাচা।
‘
আমি আধ ঘণ্টা না, ঠিক পনের মিনিট সময় দিচ্ছি …।‘ বললাম চাচার উদ্দেশ্য।
পনের
মিনিট পার হয়ে গেল । দলিলপত্র নিয়ে চাচা এল না, কিন্তু হাজির হল পুলিশ দলবল নিয়ে।
ওসি
আকরাম মোল্লা চাচার সব কথা শুনলেন, চা খেলেন, তারপর চলে গেলেন। আমি বসেই রইলাম রিভলবার হাতে। আমার সাথে ওসি সাহেবের খুবই সুসম্পর্ক এবং লেনদেনও নিয়মিত।
আট-দশটা মোটর সাইকেল চেপে সঞ্জয়রা এল। খেলা চাচাই শুরু করেছিলেন, এখন আমি এর শেষ টানব। এরপর আর কোন কথা চলে না, চাঁচা আমার জমি এবং বাড়ির দলিলপত্র বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার যে আরও একটু বাকী আছে। চাচাকে বললাম, ‘ আপনি কৌশলে আমার বাড়ি দখল করেছিলেন, ভেবেছিলেন প্রতিবাদ করার মত সাহস বা প্রতিপত্তি কোনটাই খালিদের নেই। আজ এখন এই মুহূর্তে আমি আপনার বাড়ি দখল করলাম এবং আপনাকে একঘণ্টা সময় দিচ্ছি, আপনার সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে বিদেয় হন তারাতারি। আচ্ছা যান, আমার ছেলেরা আপনাকে সাহায্য করবে।‘
আমার
বলার পরে চাঁচা পাথরের মত স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইবেন
কিনা সেটাই হয়ত ভাবছেন মনে মনে। আমি তাকে সে সুযোগ না দিয়ে সঞ্জয়কে বললাম, ‘ কাজে লেগে
পর বাপ !’
ঘণ্টা
দুয়েক লাগল চাচার বাড়ি খালি করতে। কেউ কোন প্রতিবাদ করার সাহস পেল না। সবাই জানে প্রতিবাদ
করলে রক্তের বন্যা বইয়ে দিব। আমার সামান্য খারাপ লাগল চাচীর কান্নাকাটি দেখে ; কিন্তু
ওসব আমি প্রশ্রয় দেয়া বাদ দিয়েছি অনেক আগে থেকেই।
শিবা
ও তার পরিবারকে পাকাপোক্ত ভাবে বাড়িতে বসিয়ে আমি চলে এলাম।
নিশুকে
প্রায় ভুলেই গেছিলাম, অথচ আমি কোনদিন ভাবতে পারিনি তাকে ভুলে আমি থাকতে পারব। আসলে
আমি আমার ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি নিয়ে এতটা ব্যাস্ত হয়ে পরেছিলাম যে নিশুর কথা মনেই পড়ত
না। প্রথমদিকে অবশ্য আমি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যেতাম নিশুকে একপলক দেখার জন্য – ওকে
দূর থেকে শুধুমাত্র দেখতাম আমি, কিন্তু কখনও মুখোমুখি হতাম না। নিশুকে দেখতাম ও আমাকে
দেখলেই পালিয়ে যেত, কিন্তু আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে তাকিয়ে থাকত অপলক আমারি দিকে।
আমি মনে মনে হাসতাম। আমি জানি, নিশু আজও আমাকে ভালোবাসে এবং বাসবে। ওর পরিবার – পারিপার্শিকতা
হয়তবা তাকে বাধ্য করেছে আমা থেকে দূরে থাকতে। কোন বাবা তার মেয়েকে তুলে দিবে একজন টপ
টেরোরিস্টের হাতে ? আমার সময় শুধুমাত্র এর জন্য দায়ী নয়, নিশুও – কিন্তু নিশুকে আমি
আমার জীবন অধ্যায় থেকে বাদ দিয়ে দিলাম শুধুমাত্র তার ভালোর জন্যই।
আমার
লেখালেখি কিন্তু থেমে নেই। এই তিন বছরের মাঝে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ, নিজের জীবনের
আলোকে লেখা উপন্যাস শঙ্খচিলের সীমানা এবং আরও একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হল সেই ছদ্দনামেই।
দেশে
আমার প্রকাশিত সর্বমোট বইয়ের সংখ্যা চার, অথচ
কোলকাতা থেকে একটি মাত্র যে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, সেটিই আমাকে খ্যাতি এনে দিল।
আমার দেশের বিদগ্ধ পাঠকের কেউ কেউ জানতে পারেন সে কথা। একটি পুরস্কার পেলাম আমি সেখান
থেকে। আর তার পরেই আমি ভাবতে বসলাম নিজেকে নিয়ে নতুন করে।
নিশু
পড়ে রইল, সেই সাথে পড়ে রইল আমার বিগত পাঁচ বছরের কলঙ্কিত ইতিহাস। আমি জানি, এখন পর্যন্ত
আমি আইনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু যেদিন এই ক্ষমতার চেয়ারেবিষ্ট মানুষটির পরিবর্তন
হবে , সেদিনই আমার স্থান হবে ক্রসফায়ারে অথবা ফাসির বেদীতে।
আমি
সব ছেড়ে আত্মগোপন করার সর্বোৎকৃষ্ট স্থান হিসাবে বেছে নিলাম ধলেশ্বরীর পাড়ের এই বাড়িটি
যা আমি দুই বছর পূর্বে নির্মাণ করেছিলাম। যতদিন বেঁচে থাকব, আমার শুধুই একটাই ধ্যান-জ্ঞান
– আমার লেখালেখি।
আমার
সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল না কেননা আমার একটি উপন্যাসের জন্য বাংলা একাডেমীর পুরস্কার
ঘোষণা করা হয়েছে। আর সেটি আমার চতুর্থ প্রকাশিত উপন্যাস নয়, আমার প্রথম উপন্যাস যা
আমি নিশুকে কেন্দ্র করে লিখেছিলাম।
ইদানীং
নিশুর কথা বেশ মনে পড়ছে।
নিশুর
বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আমেরিকা প্রবাসী এক উচ্চবিত্ত যুবকের সাথে। সপ্তহা খানিক পূর্বে
ওর গায়ে হলুদ হয়ে গেছে এবং আজ রাতে নিশুর বিয়ে।
আমি
বসে আছি ধলেশ্বরীর তীরে আমার বাড়ির একচিলতে উঠোনে। নিশুর সাথে পরিচয়ের প্রথমদিন থেকে
শেষ দিন পর্যন্ত সবই আমার ঘুরে ফিরে মনে পড়ছে, সেই সাথে আমার বিগত বছরগুলির অন্ধকার
সময়।
আজ
এতদিন পরে আমি নতুন করে বুঝতে পারছি, নিশু যদি অন্য কারও বউ হয়ে যায় তবে আমি খালিদ
সইতে পারব না। কি করব তাহলে ? নিশুকে জোর করে তুলে আনব বিয়ের আসর থেকে ? তারপর বিয়ে
করব ?
না,
না, নিশুকে চুল পরিমান কষ্ট বা যন্ত্রণা কোনটাই দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না কারন ওকে
আমি সত্যিকারেই ভালোবাসি, অনেক বেশী ভালোবাসি।
বিধাতা
আমার ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন আমি জানি না, কিন্তু আমি সেই ভাগ্য নিয়েই আজ একটি খেলা
খেলব – ভালোবাসার খেলা অথবা একটি সুইসাইড।
টেবিলের
উপরে রাখা রিভলবারটি তুলে নিলাম আমি। ডান কানের ঠিক ইঞ্চি খানিকে উপরে আগ্নেয়াস্রের
নল ঠেকালাম, হ্যামার টানলাম - ।
এখন
ট্রিগার চাপার পরেই যদি বুলেট আমার মস্তিষ্ক বিদীর্ণ করে তবে ভালোবাসার এই খেলার এখানেই
সমাপ্তি হবে। পরদিন পত্রিকার শিরোনাম হবে – ‘ শহরের আন্ডার অয়ার্ল্ডএর শীর্ষ সন্ত্রাসী
আবু খালিদ এর আত্মহত্যা। কিন্তু কেউ কোনদিন জানবে না যে বাংলা একাডেমীর পুরস্কার প্রাপ্ত
বিশিষ্ট লেখক-কবি আবু খালিদ – ছদ্দনামে রাজবন্দীর আত্মহত্যা।
পৃথিবীর
সাথে সব লেন্দেন চুকিয়ে ট্রিগার টানলাম আমি।
আলোকসজ্জায়
পরিপূর্ণ বিয়ে বাড়ি। ভিতর থেকে হাজারো মানুষের কোলাহল ভেসে আসছে। নিশুদের বাড়ির সামনের
রাস্তাটার দু পাশ ভরে আছে হরেক রকম প্রাইভেট কার, মোটর সাইকেল সমেত নানা যানবাহনে।
মাইক্রটাকে সেখানে রেখে আমি একা এসে দাঁড়ালাম গেটের সামনে। নাহ, নিশুদের বাড়ির দাড়োয়ান
আমাকে বাধা দেওয়ার সাহস দেখাল না, ভীত বিহব্বল দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে রইল খোলা গেটের একপাশে
দাঁড়িয়ে। আমি ভিতরে প্রবেশ করলাম।
বিয়ে
বাড়ির অতিথিদের বেশীরভাগই আমাকে চেনেন, আচমকা
আমাকে দেখে তাদের কলরব থেমে গেল। বাড়ির উঠোনের একপাশে বিয়ের প্যানেল সাজানো
হয়েছে, সেখানে আসনে উপবিষ্ট হয়ে বসে আছে নিশু বধু সাজে। বরটিও সেখানে আছে, আছে কাজী
সাহেব, নিশুর বাবা সহ সবাই। বিয়ে পরানোর কাজ এখনও শুরু হয়নি, হয়তবা একটু পরেই শুরু
হবে। যাক, আমি ঠিক সময়মতই এসেছি।
চেয়ারে
অসীন অতিথি সারির মাঝখান দিয়ে আমি সোজা চলে এলাম প্যানেলের নিচের উঁচু জায়গাটিতে, ঠিক
নিশুর সামনে এসে দাঁড়ালাম।
‘এই
রিভলবারটা গুলিতে পূর্ণ। যদি তুই প্রতিবাদ করিস তাহলে এর একটা বুলেট তোর জন্য, একটা
তোর বাবার , আর একটা রইল আমার জন্য। আমাকে তো তুই ভাল করেই চিনিস ।‘ বাম হাত দিয়ে বসা
অবস্থায় থাকা নিশুকে টেনে দাড় করিয়ে ডান হাত দিয়ে কোমরে গোজা রিভলবার বের করে সোজা
নিশুর কপালে ঠেকিয়ে কথাগুলো বললাম আমি।
নিশু
এতটাই বিহব্বল হয়ে পড়েছে যে আমাকে কিছু বলতেও পারল না। তবে কোন প্রতিবাদও সে করল না।
আমি ওকে টানতে টানতে নিয়ে এলাম মাইক্রোবাসের সামনে, ঠেলে বসিয়ে দিলাম সিটে। আমাদের
গাড়ি চলল, পিছনে পরে রইল হাজারো মানুষের হাজারো কৌতূহল পূর্ণ অবাক দৃষ্টি।
নিশু
আর আমি এখন বসে আছি সামনাসামনি – ধলেশ্বরীর বাড়ির সেই উঠোনের সেই যায়গায়, যেখানে বসে ছিলাম আমি ঘন্টা দুয়েক পূর্বেও। এখন পর্যন্ত নিশু
একটি কথাও বলেনি – আমিও কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। একটি সিগারেট ধরালাম।
‘
কেমন আছিস নিশু ?’
শেষ
কয়েকবারের ব্যাতিক্রমতা ছাড়া অতীতে যখন আমি ওর মুখোমুখি হয়েছি আমার সন্মোধন
শুরু হত এই বাক্য দ্বারা। আর ও সরাসরি উত্তর না দিয়ে শুরু করত পাল্টা প্রশ্ন দিয়ে,
- ‘তুই কেমন আছিস রে ?’ এর শেষে কখনও যোগ করত ‘গাধা’, কখনও ‘ভ্যাবলা’ ইত্যাদি। আমি
তখনি বলে উঠতাম, ‘তোর জামাইকে এসব কথা বলতে লজ্জা করে না ?’ অতপর ধুপধাপ কিল। সে সময় নিশু ছিল খুবই ছেলে মানুষ।
আর আজ - ।
আমার
প্রশ্নের কোন উত্তর নিশু দিল না। জ্যোৎস্নার মৃদু আলোয় আমি তার অশ্রুসজল চোখদুটো দেখতে
পেলাম না, কিন্তু ওর কান্নার সব্দ শুনতে পেলাম পরপরই।
‘প্লিজ,
কাঁদবি না।‘
‘আমার
জীবনটা তুই নষ্ট করে দিলি ক্যান ?’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল সে।
আমি
হাসলাম। বললাম, ‘না, আমি তোর জীবন নষ্ট করিনি কিংবা করবও না।‘
‘একটা
মেয়েকে বিয়ের আসর থেকে একটা কুখ্যাত সন্ত্রাসী তুলে আনলে তার জীবনের আর কিইই বা বাকী
থাকে ?’
‘বাহ,
খুব ভাল বলেছিস। কুখ্যাত সন্ত্রাসী ! হ্যাঁ, আজ আমাকে কুখ্যাত সন্ত্রাসী হিসাবেই সবাই
চিনে, একজন খুনি আমি। আর জীবনের প্রথম খুনটা আমার দ্বারা হয়েছিল শুধুমাত্র তোর জন্যই।
নাহ, আমি তোকে দোষারোপ করছি না। আসলে আমার নিয়তিতে এইই লেখা ছিল।‘
একটু
থেমে আমি বললাম, ‘ আসলে সেটা ছিল একটা দুর্ঘটনা। আর সেই দুর্ঘটনা আমার জীবনটা ধ্বংস
করে দিল। ফেরারি হলাম আমি। যখন ফিরে এলাম, পথের ভিখারির সাথে পার্থক্য ছিল না আমার।
তোর প্রতি আমার ভালোবাসা কিন্তু ঠিকই আছে তখন। কিন্তু কৌশলে তুই আমাকে প্রত্যাখ্যান
করলি। না, আমি তোর দোষ কখনও দিব না। একদিকে ভিটেমাটি হীন পথের ভিখারি আমি ; একদিকে
আইন- অন্যদিকে তোর প্রত্যাখ্যান। জীবনটাকে একটা কন্টকিত যন্ত্রণা মনে হল আমার। সেই ঝিনুক নদীর পাড়ে বসেই ভাবলাম আমি,
নাহ – আমার এই জীবনের কোন আশা নেই, নেই কোন অবলম্বন কিংবা ঠিকানা। ব্যাস, আজকের এই
আমির রুপান্তর হল সেদিন থেকেই।‘
নিশু
এখন কাঁদছে না, কিন্তু কিছুও বলছে না। থাকুক
ও চুপ করে, আজ আমি একলাই বলব, বলব আমার যত কথা সব তাকে।
‘আচ্ছা,
যখন আমি ফিরে এলাম ইন্ডিয়া থেকে, মুখোমুখি হলাম তোর – আমাকে তখন তুই ভালোবাসতি না
? আজকের কথা বাদ দে। আমাকে শুধু এইটুকু বল – আমাকে কি ভা্লোবাসতি ?’
‘বাসতাম।‘
‘তাহলে
আমার সাথে এমন আচরণ করলি কেন তুই – যেন আমাকে তুই চিনিসই না ?’
একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিশু। আমি বললাম, ‘ প্লিজ বল। কিন্তু তার আগে বলে নিচ্ছি তোকে এখানে নিয়ে আসার পিছনে আমার কোন খারাপ উদ্দেশ্য
নেই। যাকে সত্যিকারে ভালোবাসা যায়, তার ক্ষতি করা কখনও সম্ভব না। আসলে আজ আমি নিজের সাথে ফয়সালায় বসেছি – আর সেখানে তুই
জড়িত। বড়জোর ঘণ্টাখানিক এখানে থাকতে হবে তোকে, তারপর … , আচ্ছা, সেটা পরে বলছি। এখন
তুই তোর কথা বল আমাকে। ‘
‘কি
শুনতে চাস তুই ? তোর আর আমার ব্যাপারটা তো পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ওপেন সিক্রেট ছিল, তাই
না ? আমার জন্য তুই খুন করলি, তারপর পালালি ; বিশ্ববিদ্যালয়ে গোটা ব্যাপারটা আমার জন্য
কতটা কাল হয়ে দাঁড়াল তা কি তুই ভেবে দেখেছিস ? তারপর ধর আমার পরিবারের কথা। এতদিন তোর
আর আমার সম্পর্কের কেউ জানত না, কিন্তু এরপরে তারা জেনে গেলেন। বাবা আমার পড়ালেখা পর্যন্ত
বন্ধ করে দিলেন, মাস দুয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হল না আমার। তারপর অবশ্য অনুমতি মিলল
সর্ত সাপেক্ষে – তোকে বাদ দিতে হবে আমার জীবন থেকে। আর তাদের অবাধ্য হবার সাধ্য আমার
নেই।‘
একটু
বিরতি নিল নিশু, ‘অথচ আমাদের পরিকল্পনা ছিল, ,তুই পড়ালেখা শেষ করবি – আমিও, ভালো একটা
চাকরি হবে তোর, আমি তোকে নিয়ে দাড় করাব বাবার সামনে। আশা ছিল, বাবা তখন তা মেনে নিতেন।‘
‘যাক,
ও প্রসঙ্গ বাদ দে। সময় আমাদের দুজনকে ঠেলে দিয়েছি দু প্রান্তে। তবে তুই যা করেছিস
– ঠিক আছে নিশু ; ভুল সবটুকু আমারই। আর সব ভুলের অবসান হবে আজ। আচ্ছা, তুই একটু বস,
আমি আসছি।‘
আমার
প্রকাশিত সবগুলো বই নিয়ে এলাম। কোন বইয়েই উৎসর্গ পত্র নেই, যদি থাকত তবে বেশীরভাগই
নাম থাকত নিশুর। বইগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় একটি কথাই লিখেছি আমি – ‘আমার ভালোবাসার নিশুকে।‘
নীচে আমার নাম লেখা – রাজবন্দী।
বইগুলো
নিশুর সামনে টেবিলে রাখলাম। বললাম, ‘এগুলো তোর জন্য। আজ তোকে আমি একটু চমকে দিব। বইগুলো
দ্যাখ।‘
নিশু
একটা বই হাতে নিল – পড়ল সে লেখাটা, চমকে মুখ তুলে চাইলো আমার পানে।
‘রাজবন্দী
?’
‘অন্য
বইগুলোও দ্যাখ।‘
নিশু
অবাক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আমি বললাম, ‘কিছু বলবি না ?’
‘তুইই
রাজবন্দী ?’
‘রাজবন্দীর
জন্ম খালিদ থেকে। সেই খালিদকেই তুই এতদিন প্রত্যাখ্যান করেছিস। এখন যদি তুই ফিরে আসিস
তো তোর ফিরে আসা মানে রাজবন্দীর জন্যই ।‘ রাজবন্দী
অমর, খালিদের মৃত্যু হলে তাই কি বা এসে যায় । ‘
সামান্য
হাসলাম আমি।
‘নিশু
তোকে ভালোবাসি এবং সময়ের শেষ পর্যন্ত বাসব ।‘
নিশু
কাঁদছে, কিন্তু ওর কান্না আমি শুনতে পাচ্ছি না। ধলেশ্বরী নদীর এপাড়ে আমার বাড়ির ঠিক
সামনেই ওযুৎ নিযুৎ জোনাকির মেলা। ওরা নিজেদের মোধ্য গুঞ্জন করছে – আমি শুনতে পাচ্ছি,
যা কোনদিনই পাইনি। জ্যোৎস্নার অপার্থিব আলোয় আমি যেন ভেসে চলছি সেই জোনাকিদের সাথে।
পরমুহুর্তেই রিভলবারের ট্রিগারে আঙ্গুল চেপে বসল আমার ।
শামীম
আল মামুন
রিয়াদ,
সৌদি আরব
২৪.০২.২০১০
পিচাশপ্রেম ।
8th April.
টাকসন শহরে যখন পৌছালাম তখন সূর্য ঠিক মাথার উপরে। সময়টা গ্রীষ্মকাল। ঘন্টার পর ঘন্টা এসি বিহীন টয়োটা চালিয়ে গ্রীষ্মের দাবদাহে গাড়ির মধ্য যেন ‘ডিম সিদ্ধ’
হয়ে গেছি। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যেতে চাইছে। মন আনচান করছে ঠাণ্ডা পানীয়র জন্য।
সুতরাং বারে ঢুকে প্রথমেই অর্ডার করে বসলাম লেমন সোডার।
সপ্তাহ খানিক পূর্বে সানফ্রান্সিসকোতে গিয়েছিলাম একটা অপরাধ চক্রের পিছু
নিয়ে। মাদকদ্রব্যের বিশাল এক গ্যাং। সানফ্রান্সিসকো পুলিশের সহায়তায় অপরাধ
চক্রটিকে ধরার কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছি, এমন সময় ‘উপরওয়ালার’ জরুরি তলব। অবশ্য তাতে
অসুবিধার কিছু নেই, কেননা হ্যারিসন ওখানেই থাকছে। হ্যারিসনকে আমা থেকে কোন ভাবেই
খাটো করে দেখার উপায় নেই।
ওকলাহোমাতে যখন পৌছালাম, সময় প্রায় বিকেল। রাস্তার ধুলোবালিতে আমার অবস্থা
বেশ শোচনীয়। গোসল সেরে মাত্র সিগারেট ধরিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছি- এমন সময় আমার
সহকারী বাঙ্গালি অফিসার অমিত ভট্টাচার্য এসে বলল, উপরওয়ালা অর্থাৎ চীফ এক্ষুনি
আমাকে তলব করেছেন।
চীফের উপর অসম্ভব মেজাজ বিগড়ে গেল। বুড়ো আমাকে এক মিনিটের জন্যও বিশ্রাম
দিতে নারাজ। খালি কাজ আর কাজ ! কাজ ছাড়া এই বুড়ো কিছুই বোঝে না। বুড়োটাকে যদি
সানফ্রান্সিসকো থেকে এই দাবদাহে গাড়ির হুইল ধরিয়ে দিয়ে ওকলাহোমা পর্যন্ত আনতে
পারতাম, তবে বুড়ো বুঝত- কাজ কাকে বলে, ও কত প্রকার ও কি কি !
অফিসে এসে চীফের রুমে প্রবেশ করলাম। বুড়ো উল্টো দিকে বসে আপন মনে চুরুট টানছে।
সম্ভাষণ জানিয়ে শুরু করব, কিন্তু তার আগে আমার দিকে না ঘুরেই বুড়ো বলল-
‘তোমাকে আজই এলপেসো যেতে হবে’।
অন্য কোন কথা নয়, এমনকি যে দায়িত্ব নিয়ে সানফ্রান্সিসকোতে গিয়েছিলাম- তার
অগ্রগতি নিয়েও নয়। একটু থতমত খেয়ে বললাম-
‘আজকেই যেতে হবে?’
‘হ্যাঁ, এবং এক্ষুনি’।
‘কিন্তু কেন?’
‘এলপেসোর ইন্সপেক্টর তোমাকে সব গুছিয়ে বলবে’।
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলাম। কিন্তু বুড়ো নির্বাক। বুঝতে পারলাম, এতদূর
এসেছি শুধুমাত্র বুড়োর হুকুম শুনতে।
রাস্তায় নেমে অসম্ভব রাগ হল। অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে একমিনিটও বিশ্রামের
সুযোগ পাইনি, অথচ এক্ষুনি আবার যাত্রা শুরু করতে হবে। ইচ্ছে হচ্ছে চাকুরি ছেড়ে
দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই- হারামজাদা বুড়োটা পরে থাক। কিন্তু এর আগেও দু দুবার ইস্তফাপত্র
নিয়ে বুড়োর কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু ওই রুমে যাওয়া পর্যন্তই- সাহস আর হয় নি।
9th April.
গতকাল পৌছাতে বেশ
রাত হয়েছিল। পুরো সময় ছিলাম রাস্তার ‘পরে। বিশ্রামের জন্য শরীরের সমস্ত পেশীগুলো
যেন বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছিল। সুতরাং এসেই দিয়েছিলাম লম্বা ঘুম। ঘুম ভাঙ্গল সকাল
নয়টার দিকে। ‘ঘুম ভাঙ্গল’ বললে ভুল হবে, কারন অমিতই জাগিয়ে তুলল আমাকে।
‘ইন্সপেক্টর
ভিক্টর রিও আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন।'
‘কোথায়?’
‘ড্রইং রুমে
আছেন।'
‘ঠিক আছে। ইন্সপেক্টরকে
আরেকটু অপেক্ষায় থাকতে বল ।'
শরীরের উপর ঘুমের
শেষ চিহ্নটুকু দূর করে দশ মিনিটের মোধ্য ড্রইং রুমে প্রবেশ করলাম। ইন্সপেক্টর
দাড়িয়ে বুটের গুরুগম্ভীর শব্দ তুলে সম্ভাষণ জানাল আমাকে।
‘আপনাকে অনেকক্ষণ
বসে থাকতে হল বলে দুঃখিত।'
‘না স্যার, আমি
ক্ষমাপ্রার্থী আপনাকে বিরক্ত করার জন্য।'
একটুপরে ধোঁয়া
উঠা গরম কফির সাথে স্যান্ডউইচ এল। অমিতকে বললাম, আমার ব্রেকফাস্ট এখানেই পাঠিয়ে
দেয়ার- নাস্তা সারতে সারতে ইন্সপেক্টর এর নিকট থেকে জেনে নেয়া যাবে সবকিছু।
আপাত, পুলিশ
ষ্টেশন সংলগ্ন অতিথিশালায় উঠেছি। ইন্সপেক্টর কাছেই পুলিশ ষ্টেশনে থাকেন। গতকাল
রাতে একটা খুনের তদন্তে শহরের বাইরে গিয়েছিলেন, তাই রাতে আমাদের সাথে দেখা করতে
পারেন নি- ইন্সপেক্টর বলছিলেন এ কথা।
পাউরুটির উপর
পিনাট বাটার এবং জেলি মাখাতে মাখাতে ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করলাম-
‘ইন্সপেক্টর, দয়া
করে বলবেন কি কেন এত জরুরী ভিত্তিতে আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে?’
‘অবশ্যই স্যার’।
স্লাইস পাউরুটির
খন্ড মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে বললাম- ‘তাহলে শুরু করুন’।
‘গত তিনদিনে
এলপেসো এবং ফিনিক্স শহরে চার চারটি খুনের লাশ পাওয়া গেছে ।'
আমার পাউরুটি
চিবানো বন্ধ হল। বড় বর চোখে তাকালাম তার দিকে। ইন্সপেক্টর এসব বলছে কি !
ইন্সপেক্টর বলতে
লাগলেন-
‘প্রথম লাশটি
পাওয়া যায় এলপেসোতে মিস্টার রজার কুকের খামারের শেষ মাথায়- তারকাটার বেড়ার ওপাশে। ভদ্রলোক
সকাল বেলায় খামারে পায়চারির সময় আবিষ্কার করেন লাশটি। সংবাদ পেয়ে দশ মিনিটের
মোধ্যে পৌঁছে যাই ঘটনাস্থলে। লাশটি রাস্তার পাশে, খামারের বেড়ার প্রান্ত ঘেসে
অনেকটা ঝোপের মাঝে পরে ছিল। মিস্টার রজারের সাথে আলাপচারিতায় জানতে পারি, তার পোষা
কুকুর সঙ্গে নিয়ে এদিকটায় যখন যাচ্ছিলেন; হঠাৎ কুকুর প্রচন্ড ঘেউ ঘেউ করে ছুটে যায়
ওদিকটায় এবং তিনি দেখতে পান লাশটি। কিভাবে লাশটি এখানে এল তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে
ধারনা করা হয়, গাড়ি থেকে এখানে ফেলে দেয়া হয়েছে।'
ইন্সপেক্টর এটুকু
বলে থামলেন। সামান্য বিরতি নিয়ে আবার শুরু করলেন-
‘ লাশটি আট-দশ
বৎসরের এক কৃষ্ণাঙ্গ বালকের। প্রথমে ভেবেছিলাম, বর্ণবাদ কিংবা কোন শত্রুতার জের
হিসাবে এ হত্যাকাণ্ড। কিন্তু উল্টো হয়ে থাকা লাশটা যখন সোজা করা হয়, তখন আমার
ধারনা ভুল বলে প্রমানিত হয়। বর্ণবাদ কিংবা শত্রুতার জের হিসাবে যদি হত্যাকান্ড
খুনি ঘটিয়ে থাকে, তবে সে অবশ্যই তড়িৎ কাজটি সেরে ফেলবে। হয়তবা তাকে নির্যাতনও করতে
পারে, কিন্তু তা এরকম কখনও নয়।'
‘লাশের দেহে কি
রকম হত্যাকাণ্ডের আলামত পাওয়া গিয়েছিল?’
‘সেটা খুবই
অমানবিক স্যার। লাশের বক্ষপিঞ্জরে গভীর কালো গর্ত ছিল। পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে
পাওয়া যায়, লাশের বক্ষপিঞ্জর ধারালো ছুরির সাহায্যে চিড়ে ফেলা হয়েছে এবং সবচেয়ে
অমানবিক যেটা- লাশের কোন হৃৎপিণ্ড ছিল না, সমূলে উৎপাটন করা হয়েছে। লাশের
নাভিমূলের চতুপাশে উল্কিদিয়ে সূর্য আকা এবং বৃত্তের ভিতরে ছিল কালো পোড়া দাগ। মনে
হয় হত্যার পূর্বে এখানে কিছু জ্বালানো হয়েছিল এবং পোস্টমর্টেমে এর অস্তিত্ব প্রমান
হয়েছে।'
‘আপনার কি ধারনা
এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে?’
‘আমার যতদূর
ধারনা- সয়তানের কোন উপাসকের কাজ এটি।‘
পুরো ত্রিশ
সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম ইন্সপেক্টরের মুখপানে। তারপর প্রশ্ন করলাম-
‘কি ভাবে
বুঝলেন?’
‘এ বিষয়ে আমার
সামান্য ধারনা আছে’- ইন্সপেক্টর একটু থেমে বললেন-
‘লাশের কোন
হৃৎপিণ্ড ছিল না। উপাসক হৃৎপিণ্ড খুবলে নিয়ে উৎসর্গ করে বেদীতে- সয়তানের প্রভুত্ব
লাভের জন্য। উপাসনাপর্বে নাভিমূলে অজ্ঞাত কোন পদার্থও জ্বালানো হয়। আমরা
নাভিমূলে যে পোড়াদাগ পেয়েছি।'
‘লাশের হাতের
কব্জি কিংবা পায়ে কোন দাগ পেয়েছিলেন?’
‘কিসের দাগ স্যার
?’
‘এই ধরুন, বেঁধে
রাখার।'
‘না স্যার ।'
‘আপনি বলতে
চাচ্ছেন, লাশের জীবন্ত অবস্থাতেই হৃৎপিণ্ড তুলে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু সেটা কিভাবে
সম্ভব?’
‘সম্ভব স্যার।
কারন আগেই সেন্সলেস করে নেয়া হয়েছিল।'
‘পোস্টমর্টেমে সে
ধরনের কোন আলামত পেয়েছেন ?’
‘পাওয়া গেছে।
লাশের টিস্যু বিন্যাসে এবং রক্তে একধরনের রাসয়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে, যার সাথে
পরিচিত কোন রাসয়নিকের মিল নেই। ধারনা করা হয় এহা কোন অজ্ঞাত শক্তিশালী মাদক এবং
প্রবেশ করানো হয়েছে লোমকূপের মধ্য দিয়ে ।'
‘লাশ যেখানে
পাওয়া গেছে, সেখানে কোন সুত্র-টুত্র পেয়েছিলেন?’
‘না স্যার। অন্য
কোন আলামতই পাওয়া যায়নি। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টদের দ্বারা লাশ এবং উক্তস্থান
উভয়ই পরীক্ষা করানো হয়েছিল, কিন্তু কোন ছাপই পাওয়া যায়নি। কোন বিশেষ উপায়ে সব মুছে
ফেলা হয়েছে।'
‘লাশ যখন
পেয়েছিলেন তার কতক্ষণ পূর্বে হত্যা করা হয়েছিল ?’
‘বিশেষজ্ঞদের
ধারনা, বিশ ঘণ্টা পূর্বে। অর্থাৎ আগেরদিন দুপুরবেলা।' একটু থেমে ইন্সপেক্টর আবার
শুরু করলেন-
‘দ্বিতীয় লাশটিও
পাওয়া যায় এলপেসোতে। তবে এবার শহর থেকে একটু দূরে- পাহাড়ের পাদদেশে। তৃতীয় এবং
চতুর্থটি পাওয়া যায় ফিনিক্সে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় লাশটি দুজন নিগ্রো বালিকার।
চতুর্থজন এক কৃষ্ণাঙ্গ বালক। প্রত্যেকটি লাশের হত্যাকাণ্ডের আলামত একই এবং সবকয়টি
লাশের বয়স সাত থেকে বারোর মাঝে। হত্যাকাণ্ডের আরেকটি নির্দেশনা- প্রত্যেকেই
কৃষ্ণাঙ্গ বালক কিংবা বালিকা।'
‘পরবর্তী
খুনগুলোর ক্ষেত্রে কোন দিক নির্দেশনা পাননি?’
‘পাওয়া যায়নি
স্যার। অপরাধী খুবই চালাক প্রকৃতির বলে ধরে নেয়া যায়।'
‘হু, বুঝতে
পেরেছি।'
‘তবে স্যার, ধরা
পরতেই হবে। প্রত্যেকটি স্থানে গোয়েন্দা পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে।‘
ইন্সপেক্টর চলে
যাওয়ার পর রুমে এসে সিগারেট ধরিয়ে তার কথাগুলোই ভাবতে লাগলাম-
প্রতি ক্ষেত্রেই
ব্যার্থ হয়েছে পুলিশ। তদন্তের অগ্রগতি হবে এ ধরনের কোন গুরুত্বপূর্ণ সূত্র
আবিষ্কার হয়নি। এটা অপরাধীর জন্য বড় প্লাস পয়েন্ট। পুলিশ পুরোপুরি তদন্তে নামার
আগেই এই চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তৃতীয় এবং চতুর্থ লাশটি পাওয়া গেছে নির্জন স্থানে।
ইন্সপেক্টরের ভাষ্যমতে দুদিন যাবত লাশ দুটি আলাদা স্থানে পরে ছিল। লাশের অনেক অংশই
ছিল নষ্ট। দু দিন ধরে পরে থাকলে তা জন্তু জানোয়ারের খোরাক হত, বিশেষ করে হায়েনার-
কারন এখানে সর্বত্রই এই প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু তা হয়নি। এটা একটা রহস্য
বটে।
প্রথম লাশটি
পাওয়া গেছে চারই এপ্রিল এবং একই দিনে পাওয়া যায় দ্বিতীয়টি। প্রথম লাশটি হত্যা করা
হয়েছিল ২ই এপ্রিল এবং দ্বিতীয়টি ১লা এপ্রিল। পরবর্তী লাশদুটো পাওয়া যায় ছয় এবং সাত
তারিখে এবং হত্যা করা হয়েছিল মোটামুটি পাঁচ এবং ছয় এপ্রিলে।
এপ্রিলের
প্রথমদিন থেকেই শুরু হয়েছে এই হত্যাকাণ্ড- এর পূর্বে ঘটেনি একটিও। হটাৎ করে
ধারাবাহিকভাবে এত হত্যাকাণ্ডের কারন কি ? যতদূর জানি, গত তিন বছরে এ রকম ঘটনা
একটিও ঘটেনি। আচানক মনে পরে গেল বছর পাঁচেক আগে এলপেসোর পাশের রাজ্য সানএন্টেনিওতে
এ ধরনের একটি লাশ পাওয়া গিয়েছিল। বর্তমান হত্যাগুলির সাথে প্রচুর মিল ছিল লাশটির।
গোয়েন্দা পুলিশ সেই লোকটিকে ধরে ফেলেছিল। বিচারে তার ফাঁসি হয়। সে সময় ঘটনাটি
পত্রিকায় বেশ আলোড়ন তুলেছিল। সবচেয়ে আশ্চর্য, ফাঁসি হবে জেনেও লোকটি বিস্তারিত মুখ
খুলেনি। তবে স্বীকার করেছে, তার সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য ঘটিয়েছিল হত্যাকাণ্ড
এবং তার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং সয়তান!
তবে কি ভিক্টর
রিয়োর ধারনা সত্য? আপাত প্রমানাদি তো তাই বলে।
অমিতকে নিয়ে
একবার ফিনিক্সে যেতে হবে।
10th April.
ছবির মত সাজানো
সুন্দর ছোট্ট শহর ফিনিক্স। অবশ্য এমেরিকার কোন শহরই ছোট নয়। শহরের অদূরে প্রচুর
খামারের ছড়াছড়ি। বেশিরভাগই ডেইরী ফার্ম। এলপেসো থেকে ফিনিক্স চল্লিশ কিলোর মত পথ।
রাস্তাটা সানফ্রান্সিসকো থেকে সানডিয়াগো, টাকসান, ফিনিক্স হয়ে সরাসরি সানএন্টেনিওর
দিকে গিয়েছে। অবশ্য এলপাসোতে এসে রাস্তা দুভাগ হয়ে আরেকটি চলে গেছে ওকলাহামার পথে। ফিনিক্স থেকে আরেকটি রাস্তা একেবেকে চলে গেছে ডেনভারের পার্বত্য অঞ্চলের দিকে।
ফিনিক্স পুলিশ
ষ্টেশনে যখন পৌঁছালাম তখন পুরোপুরি বিকেল। সূর্যাস্তের আরও ঘণ্টা দুয়েক বাকি। সাব
ইন্সপেক্টর রিচার্উ রিওমি জানতেন আমার আগমনের খবর। পৌঁছানো মাত্র তাই সাদর
অভ্যর্থনা জানালেন।
ফিনিক্স পুলিশ
ষ্টেশনে কোন ইন্সপেক্টর নেই। পদটি খালি আছে পুরো এক সপ্তাহ যাবৎ। বদলীকৃত
ইন্সপেক্টর অসুস্থ থাকার কারনে তার দায়িত্ব এখন রিওমিকেই পালন করতে হচ্ছে।
সাব ইন্সপেক্টর
মধ্যবয়সী হাসিখুশি টাইপের মানুষ। তার কাছে ফিনিক্স শহরের শেষ দুটো হত্যাকাণ্ড
সমন্ধে জানতে চাইলাম। কিন্তু তার বর্ণনায় নতুন কিছুই পেলাম না। ঘুরে ফিরে
ইন্সপেক্টর ভিক্টর রিয়োর কথারই বহিঃপ্রকাশ।
সন্ধ্যায় চলে যাব
শুনে রিওমি ঘোর আপত্তি জানালেন। ‘একদিনের জন্য হলেও আথিথিয়তা গ্রহন করতে হবে
আমাদের’- রিওমির সরল উক্তি। বেচারার মুখের দিকে চেয়ে ‘না’ করতে পারলাম না। কিন্তু
তাই বলে বিকেলটা এখানে নষ্ট করতে চাই না।
সমস্ত বিকেল ফিনিক্সের অলি গলি সবখানেই ঘুরে বেড়ালাম। শহরটাকে ভালো মত চিনে রাখা দরকার।
ভবিষ্যতে এ থেকে সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া আরও একটি কারন ছিল- ফিনিক্সে খুন
দুটি সমন্ধে যদি নতুন কিছু জানা যায়। অবশ্য তার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
তদন্তের স্বার্থে সন্ধ্যার পরপরই অমিত চলে গেল অন্যত্র।
আমি প্রবেশ করলাম জরাজীর্ণ এক কফি হাউসে।
ভেতরে তেমন একটা
ভীর নেই। এক কোনার চার পাঁচজন লোক কফির পেলালায় ঝড় তুলে গল্প করছে। তাদের গল্পের
বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিশ্চয়। অঙ্গভঙ্গি এবং মুখের চাউনির ভাষা দেখেই
অনুমান করলাম।
ওদের থেকে একটু
দূরত্ব রেখে বসলাম খালি জায়গাটাতে।
একটু পর কফি এল।
পেয়ালায় চুমুক দিয়ে মনোনিবেশ করলাম ভেসে আসা কণ্ঠস্বরগুলোর দিকে। বক্তা একজন
বৃদ্ধ, আর স্রোতা মাঝবয়সী চার জন। কথাবার্তার প্রসঙ্গ সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে।
‘আমি জানি’-
বৃদ্ধ বলতে লাগলেন, ‘এগুলো স্বয়ং সয়তানের কাজ। কোন মানুষের পক্ষে এতটা নির্মম হওয়া সম্ভব না। আর সয়তান যদি কোন মানুষের উপর ভর করে তবে তো কথাই নেই।'
‘সয়তানের কাজ?’ উৎসাহী
একজন স্রোতা প্রস্ন করল।
দেখা যাচ্ছে
হত্যাকাণ্ডগুলো জনমনে বেশ প্রভাব ফেলছে। আর ফেলবেই বা না কেন ? এ তো সাধারন কোন
ঘটনা নয়। সুতরাং এই স্বাভাবিক।
একটু পরে লাশের
প্রসঙ্গ পাল্টে বৃদ্ধ ফিরে গেল সূর্যগ্রহন প্রসঙ্গে। আড্ডা কিংবা আলোচনার ক্ষেত্রে
এক বিষয় বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না।
মাসখানেক পূর্বে
পত্রিকাতে এই সূর্যগ্রহন সংক্রান্ত সংবাদ যখন ছাপা হল, তার পর থেকেই বেশ মেতে আছে
লোকজন এ নিয়ে। তার সাথে হত্যাগুলো মিলে আড্ডা কিংবা আলোচনার পরিবেশ আরও ভারী
করেছে। সূর্যগ্রহনের দিন যতই এগিয়ে আসছে, এ সংক্রান্ত আলোচনা জমজমাট হচ্ছে তত
বেশি। যে কোন আড্ডাতে এ দাঁড়িয়েছে মূল আলোচনা হিসাবে। তাছাড়া আমেরিকার লোকজন একটু
বেশি হুজুগে প্রকৃতির। মনের মত একটা বিষয় পেলে তা নিয়ে মেতে উঠা চাইই চাই। জনগনের
দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাছাড়া এই সূর্যগ্রহন নিয়ে আলোচনা হবেই বা না কেন ? সামনের এই
সূর্যগ্রহন হবে শতাব্দীর দীর্ঘতম পূর্ণ সূর্যগ্রহন। পূর্ণগ্রহন চৌদ্দ মিনিট
তেত্রিশ সেকেন্ড স্থায়ী হবে এবং শেষ হবে দুপুর একটা পঞ্চান্ন মিনিটে। সূর্যগ্রহন
শুরু হবে সকাল দশটায় এবং দুপুর ঠিক বারোটায় শুরু হবে পূর্ণ গ্রহন। পৃথিবীর সব
জায়গা থেকে পূর্ণ সূর্যগ্রহন দেখা যাবে না। কেবল মাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশ,
কানাডা, মেক্সিকো, ব্রাজিল এবং গুয়েতেমালা থেকে দেখা যাবে পূর্ণ সূর্য গ্রহন।
আমেরিকা সহ অন্যান্য দেশের বড় বড় বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সাধারন মানুষ- সবাই অধীর
অপেক্ষায় সেই দিনটির জন্য।
ক্যাফে থেকে
রাস্তায় নামলাম। ড্রাইভ বরাবর অমিতই করে থাকে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে এখন আমাকেই
করতে হচ্ছে।
মগজ এখন ‘সূর্য গ্রহন’ নিয়ে খেলছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সূর্য গ্রহন প্রকৃতি এবং প্রাণীর উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। অবশ্য মানুষের উপর প্রভাব পরে কিনা তা জানা যায় নি। সূর্য গ্রহনের সময় কিছু কিছু প্রাণী অদ্ভত আচরন করে। তারা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে এক অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম, এক অলস সিংহকে দুই দিন ক্ষুধার্ত রেখে পূর্ণ গ্রহনের সময় আস্ত একটি মোষের রান দেওয়া হয়, কিন্তু সিংহটি মাংসের দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে আশ্চর্য ভাবে পায়চারী করতে থাকে খাঁচার শক্ত লোহার বেড়ার ভিতরে। কিন্তু সূর্য গ্রহন শেষ হওয়ার সাথে সাথে সিংহটির অস্থিরতা একদম থেমে যায় এবং এতক্ষণে ঝাঁপিয়ে পরে মাংসের উপরে। বিজ্ঞানীরা পশুর এ আচরন নিয়ে গবেষণা করেছেন বিস্তর, কিন্তু সঠিক মতৈকে পৌঁছাতে পারেনি।
আমাদের উপর এর
প্রভাব হয়তবা আছে, কিন্তু আমরা সেটা অনুভব কিংবা বুঝতে পারি না। তবে এ নিয়ে অনেক
কুসংস্কার প্রচলিত আছে। অনেক বিবিধ ধর্মালম্বীর অনুসারীরা সূর্যের অর্চনা করে।
প্রাচীন লোক পুরাণেও এ নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক কাহিনীর। একদল লোক আছে যারা একে অশুভ
মনে করে। পৃথিবীতে যে কত কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোক আছে, সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
আচ্ছা, সামনে
সূর্য গ্রহন। এর সাথে কি হত্যাযজ্ঞের কোন যোগাযোগ আছে ? হয়তবা থাকতে পারে। এক
হিসাবে একে খুনের মোটিভ কল্পনা করা যায়। সূর্যগ্রহণকে সামনে রেখে খুনগুলো ঘটছে।
পরিষ্কার মনে পড়ে সানএন্টিনিওতে যে খুনটা সংগঠিত হয়েছিল তা রাত্রিবেলা এবং সেদিন
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহন ছিল। ধরে নিই, খুনি খুনগুলো করেছে এই সূর্য গ্রহণকে সামনে রেখে
এবং সানএন্টেনিওতে পূর্ণ চন্দ্র গ্রহনের রাতে সংগঠিত হয়েছিল হত্যাকাণ্ড। একটা
গ্রহনের দিন এবং অন্যগুলো গ্রহণকে সামনে রেখে। অবশ্য দুটোর মাঝে যথেষ্ট তফাৎ
রয়েছে। তফাৎটা ঘোচানো যায় যদি সানএন্টেনিওর খুনি গ্রহনের পূর্বে আরও খুন করে থাকে।
কিন্তু তা করেনি। আবার, হয়তবা করেছিল- কিন্তু কেউ জানতে পারেনি বা প্রকাশ হয়নি।
আপাত, যথেষ্ট
মিলও কিন্তু আছে উভয় হত্যাকাণ্ডে। প্রথমত, দুটোই গ্রহণকে সামনে রেখে। দ্বিতীয়ত,
হত্যাকাণ্ডের নমুনায় উভয়ই যথেষ্ট মিল আছে।
বর্তমান খুনি
(এখানে খুনী ব্যাবহার করছি- প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের নমুনা এক হওয়ায় খুনী সম্ভবত
একজন কিংবা একটি দলের। দ্বিতীয় কোন ব্যাক্তির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।) লাশগুলো
বাইরে ফেলে দিল কেন? সে তো লাশগুলো গুম করতে পারত। এখানেও দুটো ব্যাখ্যা দেয়া যায়।
গুম করার মত অবস্থা বা অবস্থান তার ছিল না। অথবা খুনি অতিমাত্রায় সাহসী কিংবা
আত্মপ্রত্যয়ী- তার নাগাল কেউ পাবে না। ঘটনাচক্রে এই মনে হচ্ছে।
16th April.
সকালবেলা
মর্নিংওয়াকে একটা কথাই চিন্তা করছিলাম, খুনি তাহলে ক্ষান্ত দিয়েছে। গত পাঁচ দিনে
একটি লাশও পাওয়া যায় নি। খুনি নিশ্চয়ই পুরোপুরি সতর্ক হয়ে গেছে। পুলিশ
ডিপার্টমেন্টে সবাই এতে বেজায় খুশি। কে চায় খুনোখুনি হোক। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম।
সত্যিকথা বলতে কি, যে কাজের জন্য এখানে আগমন; তার বিন্দুমাত্র অগ্রসর হয়নি। তাই
মনেপ্রানে চেয়েছিলাম- আরেকটি খুন হোক। আরেকটি লাশ পাওয়া যাক। তাতে নিশ্চয়ই কোন
সূত্র মিলবে। যেখান থেকে নতুন করে তদন্ত করা যেত। এর আগের লাশগুলোর অবস্থানে তেমন
কোন সূত্র পাওয়া যায় নি। হয়তবা কোন সুক্ষ সূত্র ছিল, কিন্তু তা সবার চোখ এড়িয়ে
গেছে।
ফিনিক্স থেকে
ফিরে এসেছি তার পরদিনই। নতুন কোন খুন কিংবা লাশ পেলে সাব ইন্সপেক্টর রিওমি অবশ্যই
জানাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোন বার্তা আসেনি।
রুমে ফিরতে
দৃষ্টি চলে গেল ড্রইংরুমে। ইন্সপেক্টর ভিক্টর রিয়ো এই সাত সকালে বসে আছেন। তার
উদ্ভ্রান্তের মত অববয় দেখে বুঝতে পারলাম নতুন কোন সংবাদ আছে।
ইন্সপেক্টর
দাঁড়িয়ে মুখ কালো করে যে কথাটি বললেন, তার জন্যই আমি প্রতীক্ষায় ছিলাম।
‘স্যার, আরও একটি
লাশ পাওয়া গেছে’।
‘কোথায়?’
‘হেরিং নদীর
তীরে’।
তৎক্ষণাৎ রওনা
দিলাম। পনের মিনিটের মাথায় যখন নদীতীরে পৌঁছালাম, ততক্ষণে লাশ বেলাভূমিতে তোলা
হয়েছে।
হাটুমুড়ে বসলাম
লাশের পাশে। বায়ুপ্রবাহের বিপরীত দিকে থাকা সত্ত্বেও ভক করে পচা দুর্গন্ধ নাকে
ধাক্কা খেল।
একজন কিশোরী নিগ্রো বালিকার লাশ। আগের লাশগুলোর মত সম্পূর্ণ নগ্ন। পেটটা ফুলে একদম ঢোল হয়ে গেছে। লাশ প্রায় নষ্ট হওয়ার পথে এবং নাভীমূলে পৈচাশিকতার নিদর্শন এখনও স্পষ্ট। খুনির পঞ্চম শিকার এটি।
তেরপেল দিয়ে
ঢেকে লাশ গাড়িতে তোলা হল। ইন্সপেক্টর চলে গেলেন লাশের সাথে।
‘অমিত, এখানকার
আবহাওয়া অফিসের ফোন নাম্বার বের কর’- আমি বললাম ।
পকেটে রাখা
ছোট্ট নোটবুকের পৃষ্ঠা ঘেঁটে বের করা হল ফোন নাম্বার। আবহাওয়া অফিসে ফোন করে জেনে নিলাম
এলপেসো শহরের গত চারদিনের বাতাসের গড় গতিবেগ। যন্ত্রপাতির সাহায্যে নদীর স্রোতের গড়
গতিবেগও বের করা হল। স্রোতের গতিবেগ এবং স্রোতের বিপরীতে বাতাসের গতিবেগের সাহায্য
নিয়ে বের করে ফেললাম কাঙ্ক্ষিত অনুমানিক দূরত্ব। লাশটি দুদিন যাবৎ পানিতে পরে আছে।–
পর্যবেক্ষণ থেকে বুঝতে পেরেছি। এবং তা যদি হয়ে থাকে তবে হিসাবমতে ফিনিক্সের উপশহর রংহাই
থেকে ফেলা হয়েছে লাশটি।
এলপেসো ফিরে
ইন্সপেক্টরকে জানিয়ে রাখলাম- ঘুর্নাক্ষরেও যেন লাশের কথা প্রকাশিত না হয়। যদিও অতি
সতর্কতার কারনে হত্যাকাণ্ডগুলোর খবর প্রেস কে দেয়া হয়নি, কিন্তু গত চারটি হত্যার ঘটনা
প্রকাশ হয়ে পরে এবং জনমনে বেশ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া এবার খুনিকে এবার একটি সুযোগ
দিতে হবে। খুনি জানবে, তার প্রথম চারটি প্রকাশ পেলেও পঞ্চমটি পায়নি। এ থেকে সে সামান্য
হলেও স্বস্তি বোধ করবে, ভুল করবে এবং সে ভুলের সুযোগ নিতে হবে পুরোমাত্রায়।
এলপেসো থেকে
রংহাই আসতে হলে ফিনিক্স হয়ে আসতে হয়। ফিনিক্স থেকে দশ কিমি দূরে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত
এ শহর। লোকসংখ্যাও এখানে ফিনিক্স অপেক্ষা অনেক কম।
রংহাইতে প্রথম
শ্রেণির দুটো হোটেল থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় শ্রেণির একটা হোটেলে অবস্থান নিলাম। এখান
থেকেই তদন্তের কাজে সুবিধা হবে। বাড়তি প্লাসপয়েন্ট হল হোটেলটি মূল রাস্তার পাশে। রুমে
বসেই পূর্ণ নজরদারি করা সম্ভব রাস্তার উপর।
হোটেল থেকে
রওনা দিলাম হেরিং নদীর উদ্দেশ্যে। শহরের শেষ মাথায় নদী- এখান থেকেই ফেলে আসা হয়েছিল
লাশ।
নদীতীরে এসে
তদন্তে সুবিধা হবে এমন কিছুই পাওয়া গেল না। এখান থেকে না ফেলে একটু অদুর থেকে লাশ ফেলতে
পারে খুনি। তীর ধরে সোজা হাঁটতে লাগলাম।
পনের মিনিট
পরে পৌঁছে গেলাম সেই স্থানে যেখানে লাশ ফেলা হয়েছে।
খুনি খুবই
সতর্ক। তাই একটু ঘুরপথে এখানে এসে ফেলেছে লাশটি। ঝোপের পাশে যেখানে সে গাড়িটি রেখেছিল,
সেখানে হালকা কাদার উপরে স্পষ্ট গাড়ির টায়ারের ছাপ- কাঁদা শুকিয়ে সযত্নে ধরে রেখেছে
খুনির চিহ্ন।
প্রতিক্ষেত্রেই
খুনি একই গাড়ি ব্যাবহার করে নিশ্চিত হলাম ছাপ দেখে। এলপেসোতে প্রথম লাশের পাশে যে টায়ারের
দাগ পেয়েছিলাম- তার সাথে এখানে হুবুহু মিল। অবশ্য আরেকটি মিল আছে।
দুটো টায়ারের
দাগই মাটির বেশ গভীরে। সুতরাং ভারী কোন যান ব্যাবহার করে খুনি। প্রথমবার নিশ্চিত হয়নি,
কিন্তু এবার হলাম।
বিরতি পথে
ফিনিক্সের সাব ইন্সপেক্টরের সাথে দেখা হল। আজ ছুটির দিন। স্বপরিবারে তাই কেনাকাটা করতে
বেড়িয়েছেন শহরে।
ভদ্রলোকের
স্ত্রীর নাম মারিয়া রিওমি। একমাত্র ষোড়শী কন্যা লুমেন রিওমি। রিওমি মা মেয়ে কেনাকাটায়
ব্যাস্ত। আমার দিকে দৃষ্টি পরতেই ভদ্রলোক দ্রুত এগিয়ে এলেন।
‘স্যার, আপনি
এখানে ?’
‘আপনার সাথে
সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছিলাম। ভাগ্য ভালো, এখানেই পেয়ে গেলাম।'
সাব ইন্সপেক্টর
একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘স্ত্রী ধরেছিলেন, তাই একটু… । '
‘এলপেসোতে
আরও একটি খুনের লাশ পাওয়া গেছে, জানেন নিশ্চয় ?’
‘বলেন কি
স্যার! আমি মাত্রই জানলাম ।'
লাশের বর্ণনা
দিয়ে সাব ইন্সপেক্টরকে যখন বললাম, লাশটি রংহাই থেকে ফেলা হয়েছে নদীতে- সে আরও অবাক
হলেন।
‘রংহাই থেকে
ফেলা হয়েছে !’
‘হ্যাঁ, দুদিন
পূর্বে নদীতে ফেলা হয়েছিল।'
‘তাহলে স্যার,
খুনি কি রংহাইয়ের বাসিন্দা?’
‘তা কিভাবে
বলব?’
‘মানে রংহাই
থেকে ফেলা হয়েছে তো…।’
‘হতে পারে।
তবে এতদিন ধারনা ছিল মাত্র- খুনি কোথাকার বাসিন্দা । তবে আজ মোটামুটি নিশ্চিত হলাম।
খুনি ফিনিক্স অথবা রংহাইয়ের বাসিন্দা। এলপেসো নয়; কারন এলপেসো থেকে রংহাই আসতে হলে
ফিনিক্স হয়ে আসতে হবে তাকে। কিন্তু তা সে করবে না, এতে পুলিশের নজরে পরার সম্ভাবনা
নব্বুই পার্সেন্ট।
তবে খুনি
রংহাইয়ের বাসিন্দা হবার সম্ভাবনাই বেশী। এলপেসো এবং ফিনিক্সে চব্বিশ ঘণ্টা অতন্দ্র
পাহারার ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে, যেটা রাংহাইয়ে নেই।
‘কিন্তু স্যার।
খুনি যদি রংহাইয়ের বাসিন্দা হয়ে থাকে তবে প্রথম চারটি লাশতো ফিনিক্স এবং এলপেসোতেই পাওয়া গিয়েছিল- রংহাইতে
হয়।‘
‘ফিনিক্স
এবং এলপেসোতে ইতিপূর্বে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটেনি, তাই পুলিশের চোখ ফাকি দিতে পেরিছিল
খুনি- কিন্তু এখন আর সম্ভব নয়। এ কারনে সে আর ওপথে যায়নি।‘
‘আমরা কি
তবে স্যার চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশ প্রহরারা ব্যাবস্থা করব রংহাইতে?’
‘ভুলেও এ
কাজ করবেন না। কারন খুনি টের পেয়ে গেলে তাকে আর ধরা সম্ভব হবে না। তবে হ্যাঁ, তদন্ত
চালাতে পারেন, কিন্তু ঘূর্ণাক্ষরেও খুনি যেন টের না পায় আমাদের সন্দেহের কথা। ‘
হোটেলে ফিরে
বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আয়েশ করে একটা সিগারেট
ধরালাম। এখান থেকে পুরো রাস্তাটাই দেখা যায়। সিগ্ধান্ত নিয়েছি, সারারাত জেগে নজর রাখব
রাস্তায়। খুনির গাড়ির দেখা পেলেও পেতে পারি। সর্বক্ষেত্রেই খুনি লাশ সরিয়ে ফেলেছে রাতের
বেলায়। দিনে কোন ভাবেই নয়।
চিন্তা করছি
খুনের বিষয়-বস্তু নিয়ে। আমার বদ্ধমূল ধারনা, সূর্য গ্রহনের সাথে খুনের অবশ্যই একটা
সম্পর্ক রয়েছে। এ মাসের বাইশ তারিখেই সূর্যগ্রহন। আর মাত্র পাঁচ দিন বাকী। আমার ধারনা
সত্যি হলে এই সময়ের মধ্যই খুনিকে পাকড়াও করতে হবে। বাইশ তারিখের পরে আর সম্ভব হবে না।
কিন্তু সমস্যা
হল, এমন কোন সুত্র হাতে নেই যা দিয়ে পাকড়াও করা যাবে খুনিকে। খুনির অবস্থান কিংবা ব্যাবহৃত
গাড়ি সমন্ধে ধারনা পাওয়া গেলেও এটুকু সুত্র দিয়ে তা সম্ভব নয়। ফিনিক্স এবং রংহাই শহরে
এক লক্ষ লোকের বাস এবং গাড়িও আছে হাজারের উপরে। এত লোকের মাঝে মূল আসামীকে বের করা
মুশকিল।
আপাত তাই
এটুকু সুত্র নিয়েই এগুতে হবে।
18th
April.
আমেরিকানদের
কাছে পৃথিবীর অন্যান্যদের মত সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত কোন নতুন ঘটনা নয়- তাই এর কোন
গুরুত্ব নেই। আমি জাতে আমেরিকান হলেও প্রতিদিনের সূর্যদয়কে উপভোগ করি নিজের মত করে।
কিন্তু, আজকে যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন সময় নির্দেশ করছে সকাল দশটা! সূর্য অনেক আগেই
উদিত হয়েছে এবং তা চলছে আপন যাত্রাপথে। সুতরাং আজকের দিনটা আমার শুরু হল ব্যাতিক্রম
ভাবে।
সকালবেলা
নাস্তা সেরে জানালার পাশে বসলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে দৃষ্টি রাখলাম রাস্তার উপর।
গত কয়দিন
ধরে রংহাইয়ের এই হোটেলটাতেই আছি। এবং দু তিন ধরে সেই একই কাজ- সর্বদা রাস্তায় নজর রাখা।
তবে এখন পর্যন্ত কোন সাফল্য পাইনি । অবশ্য এই দু তিন দিনে কোন খুনের ঘটনা ঘটেনি কিংবা
ঘটলেও লাশ পাওয়া যায় নি।
সাদা একটি
গাড়ি হোটেলের কার পার্কিং এ অবস্থান নিল। কালো স্যুট পরিহিত অমিত ভট্টাচার্য নামল গাড়ি
থেকে।
কলিংবেলের
সব্দ হতেই দরজা খুলে দিলাম।
‘ফিনিক্স
শহর থেকে এইমাত্র একটি ছেলে নিখোঁজ হয়েছে স্যার’।
‘বল কি ?
বয়স কত? দেখতে কেমন?’- একসাথে প্রশ্নোগুলো করলাম কেননা একটি সম্ভাবনা আমার মনে ধাক্কা
দিয়েছে এবং অমিতের উত্তরে নিশ্চিত হলাম।
‘দশ বছরের
নিগ্রো ছেলে। এই শহরের মিলিওয়ম্যান জেমস কুকারের একমাত্র ছেলে। সকাল বেলা গাড়িতে স্কুলে
যাচ্ছিল পরিচারিকার সাথে । একটি নির্জনস্থানে বড় একটি ভ্যান তাদের গতিরোধ করে এবং ছেলেটিকে
তুলে নিয়ে যায়। পরে অজ্ঞান অবস্থায় পরিচারিকাকে উদ্ধার করা হয় গাড়ি থেকে। সে লোকটিকে
চিনতে পারেনি কারন তার মুখ মুখোশে ঢাকা ছিল।
তবে তার বর্ণনামতে, শক্ত সামর্থ গড়নের প্রায় ছয় ফিট উচ্চতা লোকটির। তবে বয়স অনুমান
করতে পারেনি দস্তানা এবং মুখোশের কারনে। ' একটু থেমে আবার শুরু করল-
‘ এই পথ দিয়ে
যাচ্ছিলেন স্কুল শিক্ষক পিটার বেন। তিনিই প্রথম লক্ষ্য করেন নির্জনস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা
গাড়িটি এবং ভিতরের অজ্ঞান মহিলাকে। তার সহায়তায় পরিচারিকার জ্ঞান ফিরে আসে এবং দ্রুত
পুলিশকে জানায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। অতিদ্রুত শহরের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে
দেয় পুলিশ। কিন্তু আসামী ততক্ষনে পগারপার!
ছেলেটির পরিনতি
ভেবে প্রচণ্ড কষ্ট হল। বিলম্ব না করে বেড়িয়ে পরলাম রাস্তায়।
জেমস কুপারের
বাড়িতে পৌঁছালাম। শোকের রাহুগ্রাস যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে বাড়ির পরিবেশকে। ভদ্রলোক আমাদের
দেখে মিনতিতে ফেটে পরলেন তার ছেলের জন্য। একফাকে পরিচারিকার কাছ থেকে নতুন করে জেনে
নিলাম সম্পূর্ণ ঘটনা। নতুনত্বের মধ্য একটা জিনিসই পাওয়া গেল, যেটা অমিতের বর্ণনায় পাওয়া
যায় নি- লোকটা বা হাতি। অবশ্য সেটা তার ‘ভানও’ হতে পারে। কিন্তু এ তবুও একটা সুত্র বটে।
সমস্ত ফিনিক্স
এবং রংহাই চষে বেড়ালাম। সন্ধ্যায় চলে এলাম হোটেলে। রাত্রিবেলায় বুড়ো হোটেল ম্যানেজারের
সাথে অনেক কথা হল। আলাপচারিতায় প্রসঙ্গ তুললাম হত্যাকাণ্ড সমন্ধে। গত কয়েকদিনের ব্যাবহারে
আমার মনে হয়েছে, বৃদ্ধ কিছু বলতে চায়। হয়তবা আমার কর্মকান্ড সমন্ধে ধারনা পেয়েছে সে।
সুযোগ পেয়েই তাই বৃদ্ধ শুরু করল-
‘কিছু কিছু
লোক আছে যাদের বদ্ধমূল ধারনা, পৃথিবীতে ঈশ্বরের পাশাপাশি সয়তানের ক্ষমতাও অনেক বেশী।
তাই সয়তানের উপাসনা করলে সে তাকে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী করে দেয়। এই সব লোক সেই ক্ষমতা
অর্জনের তরে শুরু করে সয়তানের উপাসনা। এই উপাসনা অনেক রকম হতে পারে। এরকম এক রকম উপাসনার
প্রথম ধাপে এরা ডাকিনী বিদ্যার সাহায্যে সয়তানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। এতে
সফল হলে সয়তান এদের সামনাসামনি দেখা দেয়। তারা তখন সয়তানের সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ
হয়, এবং তার কাছে বিক্রি করে দেয় স্বীয় আত্মা। সয়তান খুশি হয়ে তার পিচাশতা এদের অন্তরে
গেথে দেয়। তৃতীয় ধাপে সয়তানকে খুশি করার জন্য উৎসর্গ করে জীবিত প্রান। এইসব জীবিত প্রান
হচ্ছে কালো বেড়াল অথবা পেঁচা। উৎসর্গের পরের ধাপে সয়তান তাকে কথা দেয় যে, সে তাকে অমরত্ব
প্রদান করবে যেহেতু সয়তান নিজেই সে ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু এ অমরত্বের কিছু নিয়ম এবং
সময় রয়েছে। পূর্ণ চন্দ্রগ্রহন কিংবা বিশেষ করে পূর্ণ সূর্যগ্রহন এর সময়ক্ষনে জীবিত
প্রান উৎসর্গ করতে হয়। এই সময় উৎসর্গকৃত প্রান হতে হবে একজোড়া বালক। অবশ্যই নিগ্রো
বালক, কারন সয়তানের রাজত্ব অন্ধকারের মাঝে- অন্ধকারের মধ্যই তার ক্ষমতা। অবশ্য এর পূর্বে
আরও অনেকগুলো প্রান উৎসর্গ করতে হয়। যে যতবেশি প্রান উৎসর্গ করবে, সে তত দ্রুত অমরত্ব
প্রাপ্ত হবে।‘
প্রচন্ড একটা
ঘোরের মধ্য যেন বৃদ্ধের কথাগুলো শুনলাম। বৃদ্ধের প্রতিটি কথাই এখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা
করছে – যখন প্রমাণাদি হাতেই। একটা সময় পর যেন বাস্তবে ফিরলাম। কিন্তু… জিজ্ঞাসা করলাম
বৃদ্ধকে-
‘আপনি এসব
কথা কিভাবে জানলেন?’
বৃদ্ধ কিছুক্ষন
চুপ থেকে বললেন, ‘ আমিও সয়তানের উপাসক ছিলাম, কিন্তু সয়তান আমাকে গ্রহন করেনি।'
20th
April.
সময়টা সন্ধ্যারাত্রি।
রাস্তায় প্রচুর লোকের আনাগোনা। জনসমুদ্রের এই ঢেউ আস্তে আস্তে শূন্য হয়ে একসময় নির্জনতায়
গ্রাস করে নিবে সমস্ত শহরকে। তারপরে হয়তবা সে আসবে এই রাস্তা দিয়ে, যার প্রতীক্ষায়
অনেকগুলো রাত বিনিদ্র কাটিয়েছি।
শত চেষ্টা
পর্যবসিত হয়েছে এই একটি লোকের কাছে। যে কিনা পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার চক্ষু এড়িয়ে এখনও
টিকে আছে হয়তবা এই শহরে।
কোন সন্ধান
পাওয়া যায়নি সেই ছেলেটির, যে কয়েকদিন পূর্বে নিখোঁজ হয়েছিল।
সময়ও দ্রুত
ফুরিয়ে আসছে। মাঝখানে মাত্র আরেকটি দিন। এর মাঝে কোন সমাধা না হলে কোনদিনও ধরা যাবে
না মানুষরুপী সেই পিচাশকে। হতাশা গ্রাস করে নিয়েছে আমায়। তবে কি একটা খুনির কাছে পরাজিত
হতে হবে সবাইকে?
জানালার পাশে
বসে আছি। রাত্রি এখন নয়টা হবে। রাস্তায় এই মুহূর্তে লোকজনের আনাগোনা অনেকটা কমে গেছে।
অবশ্য রাস্তায় গাড়ি চলছে একটু পরপরই। সব ধরনের যানই আছে। কিন্তু দেখা নেই সেই গাড়িটির।
তবুও একরাশ আশা-প্রত্যাশা, খুনি আসবে, অবশ্যই আসবে।
একটা সিগারেট
ধরালাম। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দৃষ্টি চলে গেল রাস্তার উপর থেকে। অগ্নি সংযোগ করে আবার
দৃষ্টি ফিরল চেনা রাস্তায়।
দূরে কোন
গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা যাচ্ছে। অপেক্ষায় রইলাম নিকটে আসার।
গাড়িটা আসছে-
স্বাভাবিক গতিতেই। চালকের কোন তাড়া নেই। একটা সময় পরে দূরত্ব এসে দাঁড়াল বিশ-ত্রিশ
গজের মত। গাড়ির ভেতরের ড্রাইভারকে এখন দেখা যাচ্ছে … ।
মধ্যবয়সী
চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারী নিগ্রো লোকটা একজোড়া কুতকুতে চক্ষু দিয়ে তাকিয়ে আছে রাস্তা
পানে। ডান হাতটা কোলের উপর ভাজ করে রাখা, বা
হাতে ধরে আছে স্টিয়ারিং … ।
ভারী একটা
মালগাড়ী। সচারচার যা এই রাস্তায় দেখা যায় না… ।
হ্যাঁ। মিলে
যাচ্ছে !
এক মিনিটেরও
কম সময়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রাখলাম । সামনের গাড়িটা বড়জোর দুশো
গজ দূরে হবে।
সেলফোনে দ্রুতগতিতে
নাম্বার টিপে ওপাশের অপারেটারকে কতগুলো কথা বললাম এক নিঃশ্বাসে।
এখন কাজ একটাই
– নিঃশব্দে ফলো করা। গাড়ির হেডলাইট বন্ধ।
দশ মিনিট
পরে অনেকদূরে কতগুলো সাইরেনের শব্দ ভেসে এল। শব্দের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে,
অর্থাৎ আসছে ফিনিক্স পুলিশ।
লাফ দিয়ে
গাড়ির গতি বেড়ে গেল। মিটারের কাঁটা এখন একশ দশ ছুঁই ছুঁই করছে। এ গতিতে হেডলাইট না
জ্বালিয়ে উপায় নেই।
খুনি বুঝতে
পেরেছে তাকে ধাওয়া করা হয়েছে। তাই সেও ছুটছে
সমান গতিতে। সামনেই একটা মোড়, তার কিছুদূর পরেই নদী। সুতরাং পালাবার পথ নেই।
টায়ারের কর্কশ
শব্দ তুলে এল আকৃতির বাকের ওপাশে পৌঁছে হারিয়ে ফেললাম গাড়িটিকে।
দশ সেকেন্ড
পরে নদীতীরে যখন পৌছালাম- ধু ধু শুন্য চারপাশ। কোথাও খুনির চিহ্ন নেই, এমনকি গাড়িও।
যেন শুন্যে মিলিয়ে গেছে।
অনেকগুলো
গাড়ি হেডলাইটের আলোর বন্যা তুলে পৌঁছে গেল আমার পাশে। সাব ইন্সপেক্টর রিউমি, অমিত এবং
বিশ-পঁচিশ জন সশস্ত্র পুলিশ নামল গাড়ি থেকে।
নির্দেশ পাওয়া
মাত্র পুলিশের দল ছোট ছোট গ্রুপে সার্চ পার্টি গঠন করে ছড়িয়ে পরল চারপাশে।
অমিত এবং
ইন্সপেক্টর নিয়ে ততক্ষণে নদীর একদম তীরে পৌঁছে গেছি। বেশিক্ষণ খুঁজতে হল না, পেয়ে গেলাম
নরম মাটির উপরে টায়ারের ছাপ । একদম নতুন ছাপ। শেষ হয়েছে নদীর ঢালুর প্রান্ত সীমায়।
তড়িৎ বুঝতে
পারলাম । খুনি অন্য কোন উপায় না পেয়ে চলন্ত গাড়ি সহ লাফিয়ে পরেছে খরস্রোতা হেরিং নদীতে।
পুলিশের আরেকটি
দল দু গ্রুপে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পরেছে তীরের দিকে।
খুনি গাড়ি সহ পানিতে নামলেও তাকে অবশ্যই তীরে আসতে হবে কিংবা পানির উপর ভাসমান
অবস্থায় তাকে পাওয়া যাবে।
নির্দেশ চলে
গেল ফিনিক্স শহরের ফায়ার ব্রিগেডে। বড়জোর পনের মিনিটের মধ্য পৌঁছে যাবে ডুবুরীর দল।
ভারী ক্রেনও আসছে গাড়িটি তীরে তোলার জন্য।
বিশ মিনিট
পর ডুবুরীর দল নেমে গেল নদীতে। তীব্র স্রোত, তারই মধ্য ডুবুরীর দল প্রানান্ত প্রচেষ্টা
চালাচ্ছে গাড়ির অবস্থান বের করার।
সকালের খুব
একটা দেরি নেই। সার্চ টিম এবং অন্যান্যরা ফিরে
এল, কিন্তু কোন হদিসই পাওয়া গেল না খুনির। ডুবুরীর দলও অবশেষ হাল ছেড়ে দিল। তবে ভোরের
দিকে এলপেসো থেকে আরেকটি দল আসবে এবং দিনের বেলায় আশা করি সবাই মিলে উদ্ধার করতে পারবে
গাড়িটি।
সকাল বেলা
আবার উদ্ধার কাজ শুরু হল। এবার প্রচুর সরঞ্জামাদি নিয়ে ছয়টি বোটের সহায়তায় চিরুনি তল্লাশি
শুরু হল নদীর তলদেশে।
তিন ঘণ্টা
পরে বের করা সম্ভব হল গাড়িটির অবস্থান। বিশাল ক্রেনের সাহায্যে টেনে তোলা হল গাড়িটি।
ড্রাইভিং
সিটের পাশের দরজাটি খোলা। ভেতরে কেউ নেই। অবশ্য থাকবে সেটাও আশা করিনি। তবে গাড়ির পেছনের
অংশে…।
বিশাল মালগাড়ি।
পেছনের দরজার পাট দুটো খুলে দিতে খানিকটা পানি গড়িয়ে পরল শুকনো বালির উপর।
হ্যাঁ। আমার
আশংকাই সত্য। পানি ছাড়াও আরও একটি জিনিস রয়েছে গাড়ির খালি অংশে। একটি মৃতদেহ। সম্পূর্ণ
উলঙ্গ দশ বারো বছরের কিশোর ছেলে। দুই তিনদিন পূর্বে যে নিখোঁজ হয়েছিল।
গাড়িটি নিয়ে
আসা হল ফিনিক্স পুলিশ স্টেশনে। পিছনের নেইমপ্লেটে লাইসেন্স ইস্যুর স্থান এবং নাম্বার
দেয়া আছে। সানফ্রানসিসকো থেকে ইস্যু করা হয়েছে গাড়িটি।
তড়িৎ যোগাযোগ
করা হল সানফ্রানসিসকোতে। আধঘণ্টা পরে তারা যে সংবাদ দিল, তা শুনে আমাদের মাথায় যেন
বাজ পড়ল।
গাড়িটির আসল
মালিক পাঁচ বছর পূর্বে রোড এক্সিডেন্টে নিহত হয়েছেন এবং পরপরই নিখোঁজ হয় গাড়িটি। এখন
পর্যন্ত তা নিখোঁজের তালিকায়ই আছে।
সানফ্রানসিসকোতে
নিহত সে ভদ্রলোকের পরিবারের সাথেও যোগাযোগ করা হয়েছে, কিন্তু তার স্ত্রী তেমন কিছু
জানাতে পারেনি গাড়িটি সমন্ধে। পুরো ব্যাপারটিই যেন রহস্যময়।
রংহাই, ফিনিক্স
কিংবা এলপেসোর কেহই কোন তথ্য দিতে পারল না গাড়িটি সমন্ধে। কেউ কেউ অবশ্য বলল, অমুক
দিন অমুক রাস্তায় গাড়িটি দেখেছে- এ পর্যন্তই। তাছাড়া এ রকম গাড়ি রংহাই, ফিনিক্স কিংবা
এলপেসোতে অনেকগুলো রয়েছে, তাই আলাদা ভাবে কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি গাড়ি বা তার ব্যাবহারকারীকে।
গাড়ির ভিতরের
প্রতিটি ইঞ্চি তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে , কিন্তু কোন সূত্রই মেলেনি।
জীবনে প্রথমবারের
মত অনুভব করলাম, এমন একজনের পিছে আমরা ছুটছি, যে মনে হয় সাক্ষাৎ সয়তান এবং সয়তানের
মতই তার গতিবিধি। সয়তানকে দেখা যায় না, কিন্তু তার অস্তিত্বের প্রমাণ সর্বত্রই। এ লোকটিও একের পর এক অপকর্ম করেই চলছে- আমরা তার
নিদর্শন পাচ্ছি, কিন্তু পাচ্ছি না তার ছায়ার দেখাও।
প্রচণ্ড উত্তেজনা
এবং নির্ঘুম কেটেছে গত ছত্রিশ ঘণ্টা। এভাবে আর কয়েকদিন চললে হয়তবা বদ্ধ উন্মাদ হয়ে
যাব। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। কয়েক সেকেন্ডের মোধ্যই পৌঁছে গেলাম ঘুমের গভীর রাজ্যে।
22th
April.
সকাল বেলায়
ঘুম থেকে উঠে একটা চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে- আজ বাইশে এপ্রিল। আজ সেই দিন। আজই
হয়তবা দুটো প্রান চিরতরে ঝরে যাবে- সেই পিচাশের হাতে।
অথচ, সবাই
নিরুপায়।
সকাল আটটা
নাগাদ পৌঁছে গেলাম ফিনিক্স পুলিশ স্টেশনে। আজ ডিউটি রুমেই বসে আছেন সাব ইন্সপেক্টর।
বড় বিমর্ষ আর ক্লান্ত মনে হল তাকে।
‘সেন্ট্রাল
ব্যুরো থেকে নির্দেশ এসেছে চব্বিশ ঘণ্টার মোধ্য আসামীকে পাকড়াওয়ের । অথচ এখন পর্যন্ত
কোন হদিসই মেলেনি হত্যাকারীর। ' একটু থেকে বললেন, ‘ ভাবছি, ব্যার্থতার দায়ভার নিয়ে
পদত্যাগ করব স্যার।'
ভারি মায়া
হল সাব ইন্সপেক্টর রিচার্ড রিউমির জন্য। ব্যার্থতার দায়ভার তার একার নয়, আমারও। পদত্যাগ
করতে হলে প্রথমে আমিই করব, যেহেতু পুরো দায়িত্বটাই আমার- রিওমিকে বললাম।
খুনির শেষ
প্রমানচিহ্ন হিসাবে আছে গাড়িটি। গতকাল রাতেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি, কিন্তু
কিছুই পাই নি। হয়তবা ক্লান্তি এবং উত্তেজনার কারনে সূক্ষ্ম কোন প্রমানচিহ্ন এড়িয়ে গেছে
নজর থেকে- আপন মনে বললাম।
আরও একবার
পর্যবেক্ষণে আনতে হবে গাড়িটিকে। প্রথম দর্শনে এড়িয়ে গেলেও দ্বিতীয়বার হয়তবা পাওয়া যাবে
এমন কোন সূক্ষ্ম প্রমান, যার সাহায্যে সম্ভব হবে হত্যাকারীকে পাকড়াওয়ের।
আবার আশার
আলো মনে মনে দেখতে পেলাম অন্ধকারের মাঝে।
ড্রাইভিং
সীটের নিচে, ড্যাসবোর্ড, বিবর্ণ স্টিয়ারিং হুইল, গাড়ির সামনে কিংবা পিছনের প্রতিটি
ইঞ্চিতে শকুনের দৃষ্টিদিয়ে খুজে ফিরলাম। কিন্তু ফের কিছুই পেলাম না।
গাড়ির বডি
সাদা রঙয়ের। অতি ব্যাবহারের কারনে সাদা রঙ পুরোটাই বিবর্ণ হয়ে গেছে। রঙ উঠেও গেছে কয়েক
যায়গায়। হঠাৎ দৃষ্টি আটকে গেল সেই বিবর্ণ সাদা জমিনের উপর। নিজের অজান্তেই কণ্ঠনালী
দিয়ে শব্দ বের হল- ইউরেকা !
বিশ্বাস করুন,
আর্কেমেডিস তার চৌবাচ্চার পানি উপচে পরা রহস্যের সমাধা করতে পেরে যেমন উদ্ভ্রান্তের
মত চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, আমিও ততটা শিহরিত হলাম সাদা জমিনের উপর ধুলিকনার মত সূক্ষ্ম অতি
সূক্ষ্ম রঙ কনার রহস্য আবিষ্কার করতে পেরে।
রঙের ছোপগুলো
আর কিছু নয়, স্প্রে মেশিনের সাহায্যে রঙ করা র সময় রঙের কণাগুলো বাতাসে ভর করে উড়ে এসে
বিদ্ধ হয়েছে গাড়ির বডিতে। সুতরাং গাড়িটি যেখানে রাখা হয়, সেটি কোন ওয়ার্কশপ হবে- যেখানে
স্প্রে মেশিনের সাহায্যে রঙ স্প্রে করা হয়। রঙের কনাগুলো বিভিন্ন বর্ণের- তাই ধারনাটা
মোটেই অযৌতিক নয়।
‘ ইউরেকা’
চিৎকারে রিওমি ছুটে এলেন। এক নিঃশ্বাসে তাকে বুঝিয়ে বললাম সবকিছু। এবং ডজন দুয়েক সশস্র
পুলিশ নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে।
বেশি সময়
খুঁজতে হল না। রংহাই শহরের শেষ প্রান্তে পাওয়া গেল একমাত্র ওয়ার্কশপ। সেখানে গাড়ির
বডিতে স্প্রে মেশিনের সাহায্যে রঙ করা হয়। গাড়ির বর্ণনা দিয়ে সেখানের প্রতিটি শ্রমিককে
জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। আশানুরূপ উত্তর কেউ দিতে পারল না। কারন বর্বণাক্ত গাড়ি তাড়া কস্মিনকালেও
দেখেনি। অবশ্য নতুন এক তথ্য পাওয়া গেল। ওয়ার্কশপের উত্তরপাশে অবস্থিত একমাত্র বাড়িটির
বাসিন্দা ভদ্রলোক প্রায়শই আসেন এখানে সরঞ্জামাদির প্রয়োজনে এবং তার নিজ বাড়ির ছোট্ট
ওয়ার্কশপে প্রায় সময়েই স্প্রে মেশিনের সাহায্যে রঙের কাজ করে থাকেন।
রিওমির সাথে
এক মুহূর্তের চোখাচোখিতে সিগ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। কিন্তু পুরোপুরি আশাবাদী তখনও হতে
পারিনি। ওয়ার্কশপ পুলিশের দায়িত্বে রেখে আমরা চললাম সে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
ওয়ার্কশপের
উতরে ঢালু যায়গা ক্রমশ নেমে গেছে নিচের দিকে। ঢালুর শেষ প্রান্তে কিছুটা সমতল ভূমি।
ভূমির শেষে গাছপালায় বেষ্টিত টিলার মত সামান্য উঁচু যায়গা। আসেপাশে কোন বাড়িঘর নেই।
নির্জন স্থানে একাকী দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি- দূর
থেকে মনেই হবে না এর অবস্থান। বেছে বেছে ভালো যায়গায়ই বাড়ি বানিয়েছে আসামী।
ঘড়িতে সময়
নির্দেশ করছে সকাল সাড়ে দশটা। সূর্য গ্রহন শুরু হয়েছে আধা ঘন্টা পূর্বেই। এই মুহূর্তে
সূর্যের একপাশ সামান্য ঢেকে গিয়েছে চাঁদের ছায়ায়। আর মাত্র দেড় ঘণ্টা পরেই শুরু হবে
পূর্ণ গ্রহন।
সমস্ত বাড়ি
ঘিরে ফেলল অস্র সজ্জিত পুলিশ। রিওমি এবং আট দশজন পুলিশ নিয়ে আমরা এগুতে শুরু করলাম
সতর্ক পদক্ষেপে।
প্রথমেই খোলা
উঠোন। উঠোনের দক্ষিণপাশে দু তিনটি গাড়ি রাখার মত গ্যারেজ। গ্যারেজটিই ছোটখাট ওয়ার্কশপ।
একপাশে ছোট-বড় যন্ত্রপাতির স্তুপে স্প্রে মেশিন পাওয়া গেল। তার বিপরীতে রাখা গাড়ি দুটিতেও
পাওয়া গেল রঙের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিন্দুর ছোপ। এবার নিশ্চিত।
সমগ্র বারিটাই
কেমন যেন ভৌতিক এবং নির্জন। আশংকা হল, বাড়িতে কেউ আছে কিনা। তবে আমি নিশ্চিত খুনি বাড়ির
ভিতরেই আছে- কারন তার শেষ কাজটি এখনও বাকী। এতদূর এসে সে অবশ্যই হাল ছেড়ে দিবে না।
তাছাড়া হেরিং নদী কিংবা নদীতীর থেকে কোন প্রমাণাদি রাখা ছাড়াই সে পালাতে পেরেছে। তবে
এতটুকু প্রমান নিয়ে আমরা পৌঁছে যাব এখানে- এটাও সে ধারনা করতে পারেনি হয়তবা।
টানটান উত্তেজনায়
ডানহাতে রিভলবার নিয়ে বা হাত দিয়ে দরজা ধাক্কা দিলাম। খুলল না কাঠের তৈরি পুরনো দরজা।
ভিতর থেকে বন্ধ।
রিওমির সাথে
চোখাচোখি হল। সে দরজার কলিংবেলের সুইচ চাপল। একবার, দুইবার, তিনবার…।
অনেকটা সময়
পরে ক্যাচ ক্যাচ করে খুলে গেল প্রাচীন দরজা। একই সাথে সবগুলো রাইফেল এবং রিভলবারের
নল ঘুরে গেল অগুন্তকের দিকে।
একটা মুহূর্ত।
আমরা সবিস্ময়ে দেখলাম, অগুন্তক একজন মহিলা। পঁয়ত্রিশ ঊর্ধ্ব নিগ্রো মহিলা। তার হতবিহব্বল
ভীত দৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম ভিতরে।
প্রতিটা রুম
তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। হত্যাকাণ্ডের কোন আলামত পাওয়া গেল না। দেয়ালে টাঙ্গানো একটি
ছবি। একজন নিগ্রো মহিলা- যাকে এই মুহূর্তে রুমে পুলিশ পাহারায় রাখা হয়েছে। নিগ্রো মহিলার
পাশে হাসিখুশি চেহারার একজন পুরুষ। হ্যাঁ, একেই সেদিন রাত্রিবেলায় দেখেছিলাম রাস্তায়
সামান্য সময়ের জন্য গাড়িতে- বা হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরা অবস্থায়। যে ঘুম হারাম করে
দিয়েছে ফিনিক্স, এলপেসো কিংবা রংহাইয়ের প্রতিটি বাসিন্দার। এই সেই নরাধম পিচাশ খুনী।
ছবির নিচের
অংশে নয় দশ বছরের দুটো বালক। ধারনা করলাম, তাদের সন্তান। নিষ্পাপ চেহারার শিশু দুইটি
কি জানে, তাদের পিতা একজন নিষ্ঠুর হত্যাকারী।
রিওমির চিৎকারে
চলে গেলাম পাশের রুমে। ওয়ার্ড্রোবটা সরানো হয়েছে কোনাকুনি। মাঝখানের সৃষ্ট ফাঁকের দিকে
ইঙ্গিত দিলেন রিওমি। দ্রুত চলে গেলাম সেখানে।
ওয়ার্ড্রোবের
পিছনে তিন ফিট বাই দুই ফিটের একটা ফোঁকর। সেখান দিয়ে লোহার একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের
দিকে। হ্যাঁ,এটা তাহলে বাড়ির গোপন বেসমেন্ট।
ওয়ার্ড্রোব
একপাশ সরিয়ে টর্চের আলোয় নিচে নামলাম রিওমি এবং দুজন পুলিশ সহ। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
টর্চের আলোয় পাওয়া গেল সুইচবোর্ড। নব চাপতেই একশ ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় আলোকিত
হল সমস্ত রুম।
পনের ফিট
বাই পনের ফিটের বর্গাকৃতি রুম। উচ্চতাও প্রায় একই সমান হবে। দেয়াল ঘেসে একপাশে একটা
র্যাক। রুমের মধ্য অজানা বেশ কিছু জিনিসপত্র, স্টাফ করা একটি পেঁচা, দুটো কালো বেড়াল,
বেশ কিছু মানব হাড় ইত্যাদি। একপাশে দুটো মানব করোটি। একটা পাত্রে আঠালো কালো পদার্থ-
ভক করে দুর্গন্ধ এল সেখান থেকে। রুমের ঠিক মাঝখানে ছ ফিট বাই আড়াই ফিটের একটি সিমেন্টের
বেদী। বেদীর বর্ণ কালচে- জমাট রক্ত শুকিয়ে এই রঙ ধারন করেছে। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের প্রবাহে
কালচে রেখার সৃষ্টি হয়েছে বেদীর দেয়ালে। বেদীর সন্মুখ ভাগে একটি চর্বির প্রদীপ এবং
মাঝখনে প্রায় নষ্ট হওয়া একটি মানব হৃৎপিণ্ড।
শিহরিত হয়ে
উঠলাম। মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুর মঞ্চে প্রবেশ করেছি। আসলে মৃত্যুর মঞ্চই। এখানেই কত নিষ্পাপ
প্রান হত্যা করা হয়েছে পিচাশপ্রেমের নিদর্শনে। কত আত্মা হয়তবা গুমড়ে কেঁদে উঠছে চার
দেয়ালের এই বদ্ধ প্রকোস্টে।
বেদীর সন্মুখের
দেয়ালের একপাশে ছোট্ট একটি দরজা। এপাশ থেকেই বন্ধ করা। ওপাশের কৌতূহল ঘোচানোর নিমিত্তে
এক ঝটকায় খুলে ফেললাম কাঠের দরজা। রুমের আলোয় সামান্য আলোকিত হল ওপাশ। তার পরেই যেন
রহস্যময় অন্ধকার।
টর্চের আলোর
বন্যায় উন্মোচিত হল অন্ধকার। পাশাপাশি দুজন যাবার মত একটা সুরঙ্গ। তীব্র আলোর রেখাও
নাগাল পেল না সে সুরঙ্গের শেষ প্রান্তের।
দরজাটা যেহেতু
ভিতর থেকে বন্ধ করা, সুতরাং খুনীর এ পথ দিয়ে পালাবার কারন নেই। তবুও দেখতে হবে এ পথের
শেষের।
রাইফেল বাগিয়ে
টর্চ হাতে দুজন পুলিশ চলল সুরঙ্গ সন্মুখে। অধীর অপেক্ষায় রইলাম সবাই। পাঁচ-সাত মিনিট
পরে ফিরে এল তারা। সুরঙ্গ শেষ হয়েছে বাড়ির পিছনের ঝোপের মধ্য। সুড়ঙ্গের নরম বালিতে
অনেকগুলো পায়ের ছাপ এবং সব একই আকৃতির। এ পথ দিয়েই তাহলে চলাচল করত খুনী।
মৃত্যুর সেই
মঞ্চ থেকে ফিরে এলাম রুমে, যেখানে প্রহরায় রাখা হয়েছে মহিলাটিকে।
মহিলাকে জিজ্ঞাসাবাদ
করে জানা গেল, লোকটি তার স্বামী এবং পাঁচ বৎসর পূর্বে তোলা ছবির শিশু দুটি তার ছেলে। বেসমেন্টের রুম এবং তার স্বামীর হত্যাকাণ্ডগুলোর
বর্ণনা দিতে মহিলা বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলেন। তার দৃষ্টি দেখে অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পারল,
তিনি ঘূর্ণাক্ষরেও জানতেন না স্বামীর পৈচাশিকতার কথা। অবশ্য তার নাকি মনে হয়েছিল, কোন
অপকর্মের সাথে সে জড়িত। কিন্তু সেই অপকর্ম যে এতটা ভয়ংকর লোমহর্ষক- দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে
পরা অশ্রুধারা বলে দিল তিনি কতটা আঘাত পেয়েছেন।
জানতে চাইলাম,
তার ছেলেদুটো কোথায়। উত্তরে জানালেন, ছেলেদের নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় সূর্য গ্রহন দেখবে
বলে গাড়িতে চেপে বেড়িয়ে গেছে ঘণ্টাখানিক পূর্বে।
রিওমির সাথে
আবার চোখাচোখি হল। আমি বুঝতে পারলাম , সেও বুঝতে পেরেছে চোখের ভাষা। মহিলা বুঝতে পারেনি,
যদি পারত… ।
হাইওয়ে ধরে
প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলছে গাড়ি। পেছনে সমান দূরত্ব বজায় রেখে আসছে আরও তিনটি। রাস্তার
পাশে ব্যাস্ত লোকজন অবাক চোখে তাকাচ্ছে গাড়ির হুইসেল শুনে। ভাবছে- ইদানীং পুলিশের ব্যাস্ততা
দেখে।
ঘড়িতে সময়
এগারোটা আটাশ। আর মাত্র বত্রিশ মিনিট। সূর্য এই মুহূর্তে প্রায় অর্ধাকৃতি চাঁদের মত।
বত্রিশ মিনিট পরে বিলীন হয়ে যাবে সে অংশটুকুও।
ফিনিক্স পুলিশের
আরেকটি দল রওনা দিয়েছে ইতিমধ্য। তাদের সাথে আছেন অমিত। সবার গন্ত্যব্য একটাই- ডেনভারের
পার্বত্য অঞ্চল।
নির্জন রাস্তা
সোজা একেবেকে চলে গেছে পার্বত্য অঞ্চলের দিকে। ক্রমশ নিচু আবার ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে
রাস্তা। সামনে, মূল রাস্তা থেকে বা দিকে চলে গেছে লাল মাটির কাঁচা রাস্তা। এই রাস্তা
সোজা চলে গেছে পর্বতশ্রেণীর পাদদেশে।
কাঁচা রাস্তায়
তরতাজা টায়ারের ছাপ। সেই চিহ্ন ধরে দ্রুত ছুটে চলছে গাড়ি। সামনে একটা বাক। বাকের একশত
গজ দূরে দেখা গেল খুনির গাড়িটিকে।
একরাশ ধুলোর
ঝড় তুলে থামল আমাদের গাড়ি। আর একটা সেকেন্ডও বিলম্ব নয়। গন্তব্য এখনও অনেকটা দূরে।
সময় এগারোটা
পঁয়তাল্লিশ। আর মাত্র পনের মিনিট। একফালি সরু চাঁদের মতই ক্ষীণ সূর্য আকাশ পানে। সন্ধ্যার
অন্ধকারের মত নামতে খুব একটা সময় বাকী নেই।
পৌঁছে গেলাম
পাহাড়ের পাদদেশে। অতি পরিশ্রমের কারনে হৃৎপিণ্ড বের হতে চাইছে বুক চিড়ে। কিন্তু থামলে
চলবে না… আরও দ্রুত এগুতে হবে। বা দিকে পাহাড়ের উপর সোজা উঠে গেছে পায়ে চলাচলের রাস্তা।
উন্মাদের মত আমরা সেই পথ ধরে দৌড়াতে লাগলাম। অনেকটা পিছনে পড়েছে রিওমি এবং পুলিশের
দল।। প্রায় ত্রিশ গজের মতন। যতই এগুচ্ছি, রিওমিদের সাথে ব্যাবধান আরও বেড়ে যাচ্ছে।
দশ মিনিটের মত আরও দৌড়ে পৌঁছে গেলাম পাছাড়ের চুড়ার সমভূমিতে।
সামনে দিগন্ত
প্রসারিত সমতল ভূমি। ভূমির শেষ প্রান্ত সোজা তিন হাজার ফিট নিচে নেমে গেছে। ঘড়ির কাঁটায়
সময় দেখছি বারবার। বারোটার আর সামান্য বাকী মাত্র। এমন সময় দেখতে পেলাম আমি … ।
আমার মোটামুটি
চারশ গজ সামনে, পাহাড়ের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে খুনী- ভদ্রমহিলা যাকে ডেমিয়েন
মার্টিন উল্লেখ করেছিলেন। তার দুপাশে তারই দু পুত্র রোহেন মার্টিন এবং রোভার মার্টিন।
একপানে তাকিয়ে আছে পূর্ব আকাশের দিকে।
বদ্ধ উন্মাদের
মত ছুটছি। রিওমিরা কত পিছনে আছে- দেখার অবকাশ নেই। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম ছেলে
দুটোর নাম ধরে। বাতাসে ভেসে সে শব্দ ছড়িয়ে পড়ল প্রান্তর হতে প্রান্তরে। কিন্তু কোন
ভ্রুক্ষেপ হল না ছেলে দুটোর। হয়তবা, গভীর সন্মোহনে সন্মোহিত তারা।
ঘড়ির কাঁটা
চলছে সমান গতিতে। সূর্য এগুচ্ছে নব্বই ডিগ্রী সমীরণের উদ্দেশ্যে। পাগলের মত দৌড়াচ্ছি।
এ চলার যেন কোন শেষ নেই – শেষ নেই।
সন্ধার অন্ধকারের
মত নেমে এসেছে। পাখিগুলোও অবাক হয়ে গেছে প্রকৃতির এই পরিবর্তন দেখে । উড়ে চলেছে তারা
আপন গন্তব্যে- ঠিক সন্ধ্যার মত।
আমার প্রায়
পঞ্চাশ গজ সামনে মার্টিনরা। ঈশ্বরের কাছে প্রানপন কৃপা ভিক্ষা চাইছি- আর কয়েকটা সেকেন্ড
সময় দাও। দুপুর বারোটা যেন না বাজে।
আমাকেই করতে
হবে এখন। যে করেই হোক, থামাতে হবে এই পৈচাশিক হত্যাকাণ্ড। মুহূর্তেই বের করে ফেললাম
রিভলবার।
ডেমিয়েন মার্টিন
হঠাৎ ঘুরে তাকাল আমার দিকে। লাল টকটকে অগ্নি-দীপ্তিময় সে চক্ষু দুটোকে মনে হল স্বয়ং
সয়তানের । এখন ডেমিয়েনের সাথে সয়তানের কোন পার্থক্য নেই।
অন্ধকার নেমে
এল ধরণীতলে।
এখন ত্রিশ
গজ সামনে মার্টিনিরা। রিভলবারের রেঞ্জের মধ্যই আছে। সূর্য এখন ঠিক মাথার উপর। শুরু
হয়েছে পূর্ণ গ্রহন। ডেমিয়েনের দু হাতে সন্ধ্যার অস্পষ্টতার মাঝেও চিকচিক করে উঠল ধারালো
ফলা।
দু হাত উপরে
তুলল ডেমিয়েন। হঠাৎ নেমে এল হাত দুটো …
প্রকৃতির
নিস্তব্ধতাকে খান খান করে গর্জে উঠল হাতিয়ার…
আহত পাখির
ন্যায় তিনটে প্রাণী একই সাথে শুন্যে ভেসে চলল তিন হাজার ফুট নিচের সমীরণের উদ্দেশ্যে।
( রচনাকাল ঃ ১৯৯৮ । টিনেজ বয়সে বা একাদশ শ্রেণীতে থাকতে লিখেছিলাম এ গল্পটি- হুবুহু তা তুলে দিলাম সাইটে। এ জন্য গল্পটি হাস্যকর লাগলে কিছু করার নেই- ক্ষমাপ্রার্থী !! গল্পটি এখানে দেয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আমার অনেক গল্পই সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে। তাই এখানে সংরক্ষণ করে রাখলাম। )