রাজার ঘুড়ি ।
(১)
হীরক রাজ্যের পাশের রাজ্য বা দেশ ছিল মালামা নগর। মালামা নগরের রাজা একদিন চিন্তিত মনে পায়চারি করছেন বিশাল রাজপ্রসাদের সামনে বাগানঘেরা রাস্তায়। রাজার মনে আজ নতুন একটি ভাবনা উদয় হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত না এ ভাবনার সমাধা হচ্ছে, রাজকার্য কিছুই পরিচালনা করবেন না তিনি। পরিষদের সভ্যরাও রাজার সাথে সমদূরত্ব বজায় রেখে পায়চারি করছে। চিন্তিত রাজা থেমে দাঁড়ালে সভ্যরাও থেমে দাঁড়ায়, আবার রাজা চলতে শুরু করলে তারাও শুরু করে চলা। রাজা যেমন চিন্তিত, সভ্যরা যেন একটু বেশি চিন্তিত।
রাজা চলা থামিয়ে ঘুরে
সভ্যদের দিকে চাইলেন, বললেন, ‘ কেউ কি আমায় বলতে পারবে, পাখি কিভাবে আকাশে উড়ে?’
‘ হুজুর, পাখির দুটো
ডানা আছে। বাতাসে ডানা ঝাপটে আকাশে উড়ে’।
‘ তাহলে, আমার যদি
দুটো ডানা থাকত আমি কি আকাশে উড়তে পারতাম?’
‘আলবৎ হুজুর’।
‘ কি ভাবে উড়তাম?’
‘ পাখির মত ডানা
ঝাপটে’।
‘ নাহ, এভাবে উড়া
সম্ভব না। চীন রাজ্যে একবার এ চেষ্টা হয়েছিল। একজন পাখির মত ডানা বানিয়ে পিঠের
সাথে লাগিয়ে পাহাড় থেকে লাফ দিয়েছিল। উড়তে পারেনি সে, মাটিতে আছড়ে পরে মারা গেছে’।
‘ হায় হায় হুজুর। একি
কথা বললেন!’
‘ কোনদিন কি শুনেছ,
মানুষ আকাশে উড়ছে?
‘ মহামান্য, আমরা তো
দূরের কথা, বাপ-দাদার আমলেও কেউ শুনেনি যে মানুষ আকাশে উড়ছে। আমাদের গুপ্তচর মারফত
আমরা এ খবরও জানি- আশে পাশের অন্য রাজ্যে অনেকবারই আকাশে উড়ার প্রচেষ্টা হয়েছে,
কিন্তু কেউ সফল হয়নি’।
‘আচ্ছা, আকাশ থেকে
পৃথিবী কেমন দেখায়?’
‘ হুজুর, কেউ কোনদিন
আকাশ থেকে পৃথিবী দেখেনি। উঁচু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে দেখলে যে রকম দেখা যাবে, আকাশ থেকে
দেখলে মনে হয় সে রকমই হবে’।
‘ আরও উঁচুতে। আহা,
মেঘগুলোকে যদি ছুঁয়ে দেখতে পারতাম...। পাখিরা কতটা ভাগ্যবান। রাজা না হয়ে যদি একটা পাখিও হতাম তবে কত ভাল
হত।’ হতাশ কণ্ঠে বললেন রাজা।
রাজার কথা শুনে
সভ্যদের মাঝে দীর্ঘশ্বাসের বন্যা বয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কি আর করা আছে।
মানুষের পক্ষে কি সম্ভব পাখির মত আকাশে উড়া।
রাজার মন বেশ খারাপ
হয়ে গেল। পায়চারী থামিয়ে ধুপ করে বসে পরলেন সবুজ ঘাসের উপরে! পরিষদেরা হতভম্ব হয়ে
ছুটে এল রাজার কাছে। ধুপ করে রাজার সামনে বসে পরা ঠিক হবে কি না, বুঝতে না পেরে
সভ্যরা সবাই দাঁড়িয়ে রইল!
‘ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে আমি
রাজ্যের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেতে পারি, কিন্তু প্রসাদ থেকে আমি রাজ্যের কততুকুই
বা দেখতে পারি। অবশ্য প্রসাদের উচু টাওয়ার থেকে অনেক দূর অব্দি দেখা যায়। রাজধানীর
পাশেই গঙ্গা নদী, কিন্তু প্রসাদের চুড়া থেকেও সে নদী দেখা যায় না। যদি অনেক উঁচুতে
উঠতে পারতাম, তবে প্রান ভরে দেখতে পারতাম মাতৃসম গঙ্গার বিস্তৃত রুপ...’ বলে
থামলেন রাজা।
‘ রাজ্যের কেউ যদি
আমাকে একটি উপায় বাতলে দিতে পারে, তবে তার জন্য আমি এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা
পুরষ্কার ঘোষণা করছি,’ রাজা মহাশয় থেমে একটু দম নিলেন, তারপর পরিষদদের দিকে আঙ্গুল
তুলে বললেন, ‘ যাও, রাজ্য জুড়ে ঘোষণা দিয়ে দাও’।
সভ্যরা সবাই লম্বা
কুর্নিশ হেকে দ্রুত প্রস্থান নিল। রাজা গালে হাত দিয়ে ফের উপায় ভাবতে বসলেন। আহা,
একটি বারের জন্য শুধু তিনি আকাশে উঠতে চান। ইতিহাসের প্রথম মানুষ হতে চান তিনি
যিনি সর্ব প্রথম আকাশ থেকে পৃথিবীকে দেখেছেন।
ঢাক-ঢোল পিটিয়ে
রাজ্যজুড়ে ঘোষণা দেয়া হল। নাওয়া-খাওয়া-কাজকর্ম ভুলে প্রজারা সবাই ভাবতে বসল কিভাবে
রাজার ইচ্ছা পূরণ করা যায়। এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা তো আর কম কথা নয়, তিন পুরুষ
রাজার হালে বসে খেলেও ফুরাবে না! রাজ্যের চিন্তাবিদরা মাথার চুল ছিঁড়তে লাগল
স্বর্ণমুদ্রার লোভে, কিন্তু কেউ উপযুক্ত উপায় বাতলে দিতে পারল না রাজা মহাশয়কে।
অনেকে অবশ্য নানা প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল, কিন্তু রাজা ভেবেচিন্তে সবগুলোই বাতিল করে দিয়েছেন।
এক জনের প্রস্তাব ছিল,
রাজ্যের সব বাঁশ কেটে বিশাল এক মই বানানো হোক। তারপর রাজামশাই মই বেয়ে আকাশে উঠে
পৃথিবী দেখবেন। রাজা মহাশয় তার বিশাল ভুঁড়িতে একবার হাত বুলিয়ে প্রস্তাব নাকচ করে
দিলেন! এই ভুঁড়ি নিয়ে মইয়ে চড়ে আকাশ থেকে পৃথিবী দেখার কোন শখ নেই।
অন্য এক জনের প্রস্তাব
ছিল, অনেক উঁচু এক মিনার নির্মাণ করা হোক। রাজা মিনারের চুড়ায় বসে পৃথিবী দেখবেন।
রাজা হাত উচিয়ে এটিও না করে দিলেন।
তাদের এত বিশাল রাজ্যে
কি এক জনও নেই যে রাজাকে একটি উপায় বাতলে দিতে পারে ?
রাখালের বয়স বার কি
তের হবে। রাখালের কাজ সারাদিন মাঠে গরু চরানো। তাদের অনেকগুলো গরু আছে। গরুগুলো
মাঠে ছেড়ে গাছের ছায়ায় বসে থাকে সে। বিকেলে মাঠে যখন রোদ না থাকে তখন ঘুড়ি উড়ায়।
রাখালের কয়েকটি ঘুড়ি আছে। নানা রকমের ঘুড়ি বানাতে উস্তাদ সে। একেক দিন এক একটি
ঘুড়ি নিয়ে মাঠে উড়ায়। ঘুড়ি উড়ানোর সময় চিন্তা করে কিভাবে আরও নতুন নতুন রকমের ঘুড়ি
বানানো যায়।
পাখি আর ঘুড়ি- দুটো
প্রায় একই জিনিস। পাখিও বাতাসে ভর করে উড়ে, ঘুড়িও ঠিক তাই। পাখি ডানা ঝাপটে বাতাসে
ভেসে থাকে, ঘুড়ি ভেসে থাকে নাটাইয়ের সূতার টানে। যদি অনেক অনেক বড় পোষা পাখি থাকত,
তবে তার পিঠে চড়ে আকাশে ঘুরে বেড়ানো যেত। রাজা মহাশয়ের পুরস্কারের কথা শুনেছে
রাখাল। রাজা মহাশয়কে কি একবার বলবে সে এ রকম একটি পাখির সন্ধান করার জন্য? নাহ, এ
রকম বিশাল পাখির কথা কেউ কখনও শুনেনি- পরে পাখি না পাওয়া গেলে পুরষ্কার তো দূরের
কথা, গর্দান যেতে পারে!
তার চেয়ে ঘুড়ির কথা
বললে কেমন হয়? বিশাল একটি ঘুড়ি বানিয়ে তার সাথে রাজা মশাইকে বেঁধে দিলেই তো হয়!!
ঘুড়ির পিঠে চড়ে রাজা মশাই পৃথিবী দেখবেন। তার মিলবে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা!
শুধু বললে তো আর কাজ
হবে না, প্রমান দেখাতে হবে যে ঘুড়ির পিঠে চড়ে আকাশে উঠা সম্ভব। রাজা মশাইকে সে কি প্রমান দেখাবে তা অনেক ভেবে চিনতে ঠিক করল।
পরদিন বেশ বড় এক ঘুড়ি
বানিয়ে রাখাল চলল রাজ প্রসাদের উদ্দেশ্যে।
রাখালের কথা শুনে
পরিষদেরা সবাই হো হো করে হেসে উঠল। আকাশে উঠা, সে কিনা আবার ঘুড়িতে করে! ঘুড়িতে
চড়ে যদি আকাশে যাওয়া যেত, তবে অনেক আগেই মানুষ আকাশে পৌঁছে যেত। তাদের রাজ্য সহ
আশেপাশের অন্য রাজ্য কি পুরো পৃথিবীতেই ঘুড়ি শত বছর ধরে প্রচলিত, অথচ, কেউ কখনও
শুনেনি মানুষ ঘুড়িতে চেপে আকাশ ভ্রমন করছে।
রাজা মহাশয় কিন্তু
চুপচাপ। হাত উঁচু করে সভ্যদের হাসি থামানোর নির্দেশ দিলেন।
রাখাল থলে থেকে নাদুস
নুদুস একটি বিড়ালের বাচ্চা বের করে ঘুড়িটির
ঠিক মাঝখানে শক্ত করে বাঁধল। তারপর উড়িয়ে দিল। মিয়াঁও মিয়াঁও শব্দ সহকারে
ঘুড়িটি আকাশে উড়ে ফের নেমে এল মাটিতে !
আতঙ্কিত ছোট বিড়ালের
বাচ্চাটি ছাড়া পাওয়া মাত্রই রাজার পাশ দিয়ে পালিয়ে চলে গেল। পরিষদের সভ্য সবাই হাঁ
করে অক্ষত বিড়ালটিকে দেখল। তাদের যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না যে মাত্র আগেই বিড়াল
ছানাটি ঢাউস ঘুড়িতে চেপে আকাশে উঠেছিল।
সভাসদেরা যেমন মনে মনে
কল্পনা করছে বিশাল এক ঘুড়ির, রাজাও ঠিক তেমনটিই ভাবছেন। সত্যিই তো, যদি সে রকম
একটি বিশাল ঘুড়ি বানিয়ে ঘুড়ির পিঠে চেপে আকাশে উঠা যেতে পারে । আবার এতবড় বিশাল
ঘুড়ি বানিয়ে কি ভাবেই বা আকাশে উড়ানো সম্ভব? আবার তার পিঠে তিনি চাপবেনই বা
কিভাবে।
রাজা সিগ্ধান্ত নিয়ে
ফেলেছেন- বিশাল এক ঘুড়ি তিনি বানাবেন। তারপর যদি ঠিক ঠিক আকাশে উঠতে পারেন, তবেই
মিলবে রাখালের এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা। রাখালকে বিদায় দিয়ে রাজা মহাশয় জরুরি তলব ডাকলেন রাজ্যের বিজ্ঞ বিজ্ঞ কারিগরদের।
বিজ্ঞ কারিগরেরা দিন
রাত বসে ভেবে ঘুড়ির আকার এবং নক্সা ঠিক করল। রাজা মহাশয়ের অনুমোদন নিয়ে কারিগরেরা
লেগে গেল ঘুড়ি তৈরির কাজে।
পুরো রাজ্য জুড়ে হৈ চৈ
পরে গেল রাজা মহাশয়ের ঘুড়ি তৈরির সংবাদে।
রাজপ্রসাদের পাশে
বিশাল নদী; সে নদীর দক্ষিণের বিস্তৃত খোলা যায়গায় ঘুড়ি তৈরির জন্য তোড়জোড় শুরু হয়ে
গেল। সারি সারি তাঁবু টানিয়ে সেখানে আনাগোনা শুরু হয়ে গেল হাজার মানুষের। রাজ্যের
বিভিন্ন জায়গা থেকে মোটা লম্বা বাঁশ সংগ্রহ করে তা ঘোড়ার গাড়িতে টেনে এখানে এনে
স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। কৃষকদের নিকট থেকে দড়ি পাকাবার শুকনো পাট সংগ্রহ করে এনে
খড়ের গাঁদা আকৃতিতে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। খেলার মাঠের চেয়ে বেশি জায়গা জুড়ে রাজ্যের
তাঁতিরা বসে গেছে কাঠের তৈরি কাপড় বুননের যন্ত্র নিয়ে। শত শত তাঁতের খট খট খট ...
শব্দে কান পাতাই দায়! তাঁতিদের তৈরি এ কাপড জোড়া দিয়ে বিশাল ছামিয়ানার মত তৈরি করা
হবে। তারপর তা জুড়ে দেয়া হবে ঘুড়ির বাঁশের খাঁচার উপর। দেখতে দেখতে এক মাসের মধ্যই
ঘুড়ির কাঠামো মানে খাঁচা তৈরি হয়ে গেল। বাঁশগুলোকে একটির সাথে আরেকটি সাজিয়ে
পাঁটের দড়ি দিয়ে বেঁধে বিজ্ঞ মিস্ত্রীদের ডিজাইন অনুসারেই তৈরি করা হয়েছে ঘুড়ির
খাঁচা। এবার এর সাথে কাপড় জুড়ে দিলেই হয়। রাজ্যের তাঁতিরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে
বানিয়ে ফেলল বিশাল একখণ্ড শক্তপোক্ত কাপড়। ওদিকে অন্যান্য কাজগুলোও প্রায় শেষের
পথে। কাঠমিস্ত্রিরা প্রমান সাইজের একটি কপিকলও তৈরি করে ফেলেছে রাজ্যের সবচেয়ে ভাল
কাঠ দিয়ে। কপিকলের হাতলের সাথে দড়ি দিয়ে বেঁধে জুড়ে দেয়া হয়েছে দশটি ঘোড়া, এত বড়
একটি ঘুড়ি উড়ানো এবং নিয়ন্ত্রন তো সোজা কথা নয়। প্রায় কলা গাছের সমান মোটা, এক
মাইল লম্বা দড়ি পাকানোও হয়ে গেছে। দড়ির এক মাথা কপিকলের রিলের সাথে এবং অন্য মাথা
ঘুড়ির সাথে বেঁধে দেয়া হল।
ঘুড়ি এবার উড়িয়ে পরীক্ষা
করার পালা। রাজা সংবাদ পেয়েই অনুচর নিয়ে হাজির হলেন। বিশাল ঘুড়ি দেখে রাজার তো
চক্ষুস্থির ! হ্যাঁ এ ঘুড়িই পারবে বটে তার মত নাদুস-নুদুস রাজাকে নিয়ে আকাশে উড়তে।
সবকিছু দেখে রাজা বেশ সন্তুষ্ট হলেন। তার প্রজারা বেশ কর্মঠই বটে !
ঘুড়িটিকে বিশাল একটি
প্লাটফর্মের উপর দুপাশে বাঁশের সাহায্যে খাড়া ভাবে দাঁর করিয়ে রাখা হয়েছে, ঠিক
যেভাবে গায়ের ছেলেরা ঘুড়ি উড়ানো জন্য টান টান করে ধরে রাখে। প্রায় আধা মাইল দূরে নাটাই মানে কপিকলটির কাছে
লোকজন সহ ঘোড়াগুলো প্রস্তুত হয়ে আছে ইশারার। সংকেতের সাথে সাথেই ঘোড়াগুলোকে চাবুক
মারা হবে, ঘোড়াগুলো দৌড় দেয়ার সাথে সাথে কপিকলের চাকা ঘুরবে, টান পড়বে ঘুড়ির সুতোয়
– উড়তে শুরু করবে ঘুড়ি।
দখিণা হাওয়া বেশ ভালই
বইছিল, বাতাস ছাড়া তো আর ঘুড়ি আকাশে উড়বে না। রাজামশাই তাই হাত উঁচিয়ে অনুমতি
দিলেন ঘুড়ি উড়ানোর। ঘোড়ার পিঠে চাবুক পড়লো দ্রুত।
উড়ানোর সুবিধার কথা
চিন্তা করে ঘুড়িটির নিচে দুটি কাঠের চাকা জুড়ে দেয়া হয়েছে। মোটা পাটের সূতার টানে
প্লাটফর্ম ছেড়ে চাকার উপর গর-গড়িয়ে ঘুড়িটি সামনে এগুলো বেশ কয়েকগজ, তারপর একটু
একটু করে উপরে উঠতে লাগলো এবং একসময় অনেক অনেক উঁচুতে উঠে গিয়ে বিশাল ঘুড়িটির আকার
ছোট হয়ে এল।
রাজা মশাইয়ের খুশি আর
ধরে না। প্রায় সিকি মাইল লম্বা লেজসমেত কি সুন্দরই না উড়ছে ঘুড়িটি। নিচে থেকে দেখে
মনে হচ্ছে বিশাল এক সাপ আকাশের বুকে লেজ নাড়িয়ে নাচছে। স্বীকার করতেই হবে, তার
রাজ্যের বিজ্ঞ কারিগরদের মত কারিগর পৃথিবীর আর কোথাও নেই। এ রকম বিশাল একটি ঘুড়ি
সত্যি সত্যি আকাশে উড়ানো তো চট্টিখানি কথা নয়।
সারা দিনভর ঘুড়িটি
আকাশেই ভেসে রইল। মাঝ খানে অবশ্য কয়েকবার বাতাসের বেগ একদম কমে গিয়েছিল, সবার
আশংকা ছিল বাতাস না পেয়ে ঘুড়িটি না মাটিতে নেমে আসে। নিচে বাতাসের বেগের তারতম্য
হলেও, দেখা যাচ্ছে অতি উঁচুতে বাতাসের প্রবাহ সবসময়ই থাকে যে কারনে ঘুড়ির উড়তে কোন
সমস্যা হয় না।
সমস্ত দিন সবকিছু দেখে
শুনে বুঝে বিজ্ঞ কারিগররা মত দিলেন, এবার রাজা মশাই ঘুড়ির পিঠে সওয়ারী হতে পারেন।
সন্ধ্যার সময় ঘুড়িটি নামিয়ে ফেলা হল। রাজা ঘোষণা দিলেন, আগামীকাল প্রত্যুষেই তিনি
ঘুড়ির পিঠে চেপে আকাশ ভ্রমন করবেন। ইতিহাসের প্রথম এই ঘটনা দেখার জন্য সকল প্রজা
যেন উপস্থিত থাকে ময়দানে।
পরদিন সূর্য উঠার আগেই
পিল পিল করে মানুষজন এসে জমায়েত হতে লাগলো ময়দানে। সবশেষে এলেন রাজা মশাই। রাজা
হেঁটে হেঁটে চললেন ঘুড়ির কাছে, পিছনে সভাসদগণ। প্লাটফর্মের উপর বাঁশের সাহায্যে
দাড়া করে রাখা ঘুড়িটির ঠিক মাঝখানে ফ্রেমের সাথে শক্তপোক্ত বাঁধা একটি আসন। রাজকীয়
চেয়ারের আদলে মজবুত অথচ হালকা আসনটি বিজ্ঞ কাঠমিস্ত্রিরা তৈরি করেছেন। আসনটি মাটি
থেকে বেশ উঁচুতে, রাজা মহাশয়কে তাই একটি মইয়ের সাহায্য নিতে হল। রাজার পিছু পিছু
প্রধান কারিগর উপরে এসে সাহায্য করলেন রাজাকে আসনে বসতে। তারপর বুঝিয়ে দিলেন
সবকিছু। এই যেমন, আকাশে যদি বাতাস বেশি থাকে তবে এই কাঠিটি ধরে টানতে হবে- তাহলে
ঘুড়ির মাঝে অবস্থিত দু পাশের জানালা দুটি খুলে অতিরিক্ত বাতাস বের হয়ে ঘুড়িটিকে
‘গোত্তা’ খাওয়ার হাত থেকে বাঁচাবে। আবার, এ কাঠিটি ধরে টানলে জানালাদুটো বন্ধ হয়ে
যাবে। এ কাঠিটি টানলে ঘুড়ি ডানে যাবে, এটি টানলে বায়ে ... ... ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রধান কারিগর নিচে
নেমে এলে মইটি সরিয়ে দেয়া হল। রাজা মশাইও জানালেন, তিনি প্রস্তুত। চাবুক পড়লো
ঘোড়ার পিঠে এবং গতকালের মতোই ঘুড়িটি উঠে গেল আকাশে। প্রজার সব হৈ হৈ চিৎকার করে
হাত নাড়তে লাগল ঘুড়িটির দিকে চেয়ে।
উড়ানোর জন্য ঘুড়িটির সুতোয় যখন প্রথম টান পড়লো,
রাজা মহাশয়ের মনে হল তিনি আসনশুদ্ধ উল্টো পড়ে যাবেন। ভয় এবং শিহরণে তিনি চোখ বন্ধ
করে ফেললেন। তারপর তার মনে হল, নিচ থেকে কেমন যেন একটা ধাক্কা মত খেলেন, মাথার
মধ্য ঝি ঝি করে উঠল। চোখ মেললেন। ইয়া মাবূদ, তিনি এখন আসমানের উপরে !
আহা, রাজার খুশি যেন
আর ধরে না ! ঘুড়ির আসনের সাথে শক্তপোক্ত বাঁধা না থাকলে এতক্ষণে আনন্দে লাফিয়ে
উঠতেন ! এত উঁচু থেকে মানুষজন তো দেখাই যাচ্ছে না, বাড়ি ঘরগুলোকে মনে হচ্ছে
পিঁপড়ের সাড়ি। ওই তো, আঁকাবাঁকা সাদা একটি রেখা ... আরে, এটা তো রাজ্যের সীমান্তের
বিশাল গঙ্গা নদী- এখন এত টুকুন মনে হচ্ছে। নদীর ওপারেই প্রতিবেশী রাজ্য। প্রতিবেশী
হীরক রাজ্যের বাড়িঘর ,গাছপালা্, রাস্তাঘাট , শস্যখেত সবই দেখা যাচ্ছে- হুবুহু তার
দেশের মতোই; একটুও পার্থক্য নেই। অথচ ওরা অনেক বড়, অনেক শক্তিশালী। ওদের রাজধানী
অনেক দূরে, না হলে অট্রালিকাগুলো দেখা যেত। রাজা মহাশয়ের দৃষ্টিসীমা বহুদূর
পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে কিছু সময় পর্যন্ত; তারপর চোখ আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে আসে। আবার
অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন তিনি।
দিনভর ঘুড়িতে উড়ে
বিকেলের দিকে নিচে নামার জন্য ঘুড়ির একটি কাঠি টানলেন রাজা মহাশয়। কাঁঠির সাথে
বাঁধা চিকন সুতা ঘুড়ির মোটা দড়ির সাথে নিচে নেমে এসেছে। ঘুড়ি উড়ানোর কারিগররা চিকন
সুতোয় টানের ইঙ্গিত পেয়ে আবার চাবুক হাঁকলেন ঘোড়ার পিঠে। কপিকলের রিল আবার ঘুরতে
লাগলো, ধীরে ধীরে ঘুড়ি নেমে এল মাটিতে।
ঘুড়ির আসন ছেড়ে মাটিতে
পা রাখতেই সভাসদ এবং প্রজাকুলের অভিনন্দনের জোয়ারে ভেসে যেতে লাগলেন রাজা । হবেই
বা না কেন। তাদের রাজা এমন একটি কর্ম করে দেখিয়েছন, যা কেউ কোনোদিন করতে পারেনি।
রাজা কিন্তু তার
প্রতিশ্রুতির কথা ভোলেন নি, এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা পুরষ্কার রাখালকে দিয়েছিলেন
পরদিনই।
(২)
রাখালও রাজার
পুরষ্কারের টাকায় অনেক যায়গা জমি কিনে, সুন্দর বাড়ি করে, হাজার হাজার গরুর খামার
করে, রাজ্যে বেশ অবস্থাসম্পন্ন হয়ে নাম
কুড়িয়েছে এবং সময়ও চলে গেছে বেশ কিছু দিন। ঘুড়িতে চড়ে আকাশে বেড়ানো রাজা মশাইয়ের
কাছে অনেকটা নেশার মত হয়ে গেছে। আবহাওয়া ভাল থাকলেই হলো, চেপে বসেন ঘুড়ির আসনে।
ইদানিং আবার সাথে করে বই নিয়ে যান, ঘুড়ির পিঠে চেপে আসমানের উপর বসে ফুরফুরে
বাতাসে বই পড়ার মজাই আলাদা!
অনেকদিন পর আবার
রাজপ্রসাদে ডাক পড়লো রাখালের। একই ঘুড়িতে বারবার আকাশ ভ্রমনে রাজা মহাশয় ক্লান্ত
হয়ে গেছেন। এবং অন্য রকম একটি ঘুড়ি তার চাই। এই ঘুড়িটির যেমন লম্বা লেজ আছে, সে
রকম ল্যাজ থাকলে চলবে না। এটি দেখতে সাপের মত, পাখির মত দেখতে বানাতে হবে।
রাখাল তো বিভিন্ন
রকমের ঘুড়ি বানাতে উস্তাদ। রাজা যেমনটি বলছেন, সে রকম ঘুড়ি তার আছে। একে সে ‘চিলা
গুড্ডি’ বলে। এবারও সে বড় একটি ঘুড়ি তৈরি করে তার পিঠে বিড়ালছানা বেঁধে আকাশে
উড়িয়ে, পরীক্ষায় সন্তুষ্ট হয়ে রাজার কাছে বড় ঘুড়িটি নিয়ে গেল। রাজাও খুশী হয়ে ইনাম
দিলেন রাখাল কে, কারিগরেরাও লেগে গেল এবং তৈরি হয়ে গেল আরেকটি ঘুড়ি। এভাবে রাজা
কিছুদিন পরপর রাখালকে ডাকেন, এবং তৈরি হতে থাকে নিত্য নতুন ঘুড়ি। শেষমেষ এ এক আজব
সখ হয়ে দাঁড়াল রাজার কাছে।
আগের দিনের রাজাদের
ঘোড়া রাখার জন্য ঘোড়াশাল, হাতি রাখার জন্য হাতিশাল থাকত। পালামা রাজ্যের রাজার
ঘুড়ি রাখার জন্য তৈরি করা হলো ‘ঘুড়ি শাল’। সেখানে বিশাল বিশাল সব ঘুড়ি রাখা এবং
সংখ্যায় শতাধিকেরও বেশী। কোনটি দেখতে সাপের মত, কোনটি ডানাওয়ালা মাছের মত, বিভিন্ন
প্রকারের পাখির মত, পশুর মত, আরও যে কত আজব আজব রকমের ঘুড়ি। রাজার যখন যে ঘুড়ির
ইচ্ছে হয়, সেটাতে চেপেই উঠে পড়েন আকাশে।
মাঝে মাঝে মেঘ যখন
নিচু দিয়ে উড়ে চলে, রাজা হাত বাড়িয়েই স্পর্শ করতে পারেন সাদা তুলার মত নরম পেজা
পেজা মেঘকে। মেঘগুলো যখন হাতের আঙ্গুলগলে বেড়িয়ে যায় অথবা ঠাণ্ডা মেঘ তার মুখাবয়ে
ঝাঁপটা মারে, শিহরিত হয়ে রাজা নিজের অজান্তেই অস্ফুট চিৎকার করে উঠেন। চিলগুলো
আকাশের সবচেয়ে উঁচুতে উড়ে , বাতাসের উপর
ডানা মেলে চিলগুলো যখন ভেসে বেড়ায়, রাজার মনে হয় পাখিগুলোর পিছু নিতে পারলে মন্দ
হত না। পাখিরা যেমন এক যায়গা থেকে আরেক যায়গা, এক দেশ থেকে আরেক দেশে ডাঙ্গার
মানুষের মত ভ্রমন করে ; আকাশপথে সে রকম ছুটতে পারলে সবচেয়ে ভাল হত। কিন্তু ঘুড়ির
পিঠে চেপেও পাখীদের মত এরকম ইচ্ছা স্বাধীন চলা সম্ভব নয়; যদি হত তবে রাজা রাজ্য
ফেলে বেড়িয়ে পড়তেন বিশ্ব ভ্রমনে। মানুষ একদিন হয়তোবা এমন কিছু বানাতে পারবে, যা তে সাওয়ারি হয়ে আকাশপথে ঘুড়ে বেড়ানো যাবে
দুনিয়া – মনে মনে ভাবেন রাজা।
এদিকে, রাজার এ রকম
খামখেয়ালীপনায় রাজ্যের রাজকার্য সব মাথায় উঠল। উঠবেই বা না কেন, রাজামহাশয়
সারাক্ষণ যদি ঘুড়িতে চেপে আকাশে বসে থাকেন তবে জমিনের খবরই বা রাখবেন কি করে! রাজ্য
জুড়ে শুরু হয়ে গেল বিশৃঙ্খলা। রাজকোষের অবস্থাও প্রায় শূন্য। ঘুড়ির পিছনে রাজ
ভাণ্ডারের সব অর্থই খরচ হয়ে গেছে জলের মত। সাধারণ সৈনিকের পর্যন্ত ঠিকমত বেতন
পাচ্ছে না। প্রজাদের কাছে জীবনধারণের পর্যাপ্ত অর্থ নেই, খাদ্য নেই।
প্রতিবেশী হীরক
রাজ্যেও পৌঁছে গেল মালামা নগর রাজ্যের এ দুরাবস্থার সংবাদ। এটাই সুযোগ! কোনভাবে
গঙ্গানদী পার হয়ে একবার যদি মালামা নগর আক্রমন করা যায়, তবে একদিনের মধ্যেই রাজ্য
দখল করা কোন ব্যাপারই হবে না। ওদের রাজ্যে কোন প্রাচীর নেই, তাই কোন বাঁধাও পেরুতে
হবে না। আর সেনাবাহিনী ? হীরক রাজ্যের বিশাল সেনাবাহিনীর কাছে ওদের অতি ক্ষুদ্র
সেনাদল স্রেফ খড়কুটোর মত উড়ে যাবে ! এক মাত্র সমস্যা বিশাল গঙ্গা নদী। অবশ্য
সেনাবাহিনীকে যদি পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে দেয়া যায়, তবে কয়েক মাসের মধ্যেই সৈন্য-
সামন্ত পারাপারের জন্য শত শত নৌকা বানিয়ে ফেলা সম্ভব। তাদের হস্তী বাহিনীতে তিন হাজারের বেশি মর্দ
হাতি আছে। তাদের সাহায্যে জঙ্গল থেকে গাছ এনে বড় বড় নৌকা বানিয়ে ফেলা যাবে। একবার
গঙ্গার ওপাড়ে যেতে পারলেই হল। হীরক রাজা বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আর দেরি না করে
রওনা হয়ে গেলেন গঙ্গার পথে।
পালামা নগরের রাজা
গুপ্তচর মারফত খবরই পেলেন না; একদিন তিনি ঘুড়ির পিঠে বসে গঙ্গার অনেক দূরে ধুলোর
ঝড় উঠিয়ে আসতে থাকা সেনাবাহিনীকে আবছা মতন দেখতেও পেলেন। সেদিন আর ঘুড়ির পিঠে বসে থাকলেন না, দ্রুত নিচে
নেমে এলেন।
রাজ্যের সবাই জেনে
গেছে, তাদের রাজ্য আক্রমনের জন্য হীরক রাজা সেনাবাহিনী নিয়ে গঙ্গার ওপাড়ে সমবেত
হচ্ছে। খেয়ালী রাজার জন্য এবার বুঝি আর রক্ষাও নেই। রাজ্য দখল মানে, তাদের সবকিছু
লুটপাট করে নেবে, ভিখিরির বেশে পালিয়ে বেড়াতে হবে। আর যদি সৈন্যদের হাতে পাকড়াও
হয়, তবে বাকি জীবন ক্রীতদাস হয়ে কাটাতে হবে।
রাজা সবচেয়ে বেশী
মুষড়ে পড়লেন তার ঘুড়িগুলোর জন্য। রাজ্য চলে যাওয়ার সাথে সাথেই ঘুড়িগুলোও শত্রুদের
দখলে যাবে। এক একটি ঘুড়ি তৈরির জন্য তাকে কত লোকবল, কত টাকা পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
সবচেয়ে বড় কথা, এগুলো নিয়ে গেলে তিনি আর কখনও আকাশে উড়তে পারবেন না। রাজ্য হারালে
বিজ্ঞ কারিগরদেরই বা কোথায় পাবেন, কে দেবে তাকে টাকা পয়সা ঘুড়ি বানাতে।
দুশ্চিন্তায় বসে বসে রাজা মাথার চুল ছিঁড়তে লাগলেন!
রাজা আবার রাজ্য জুড়ে
ঘোষণা দিলেন, ‘ কেউ যদি রাজাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে তবে তাকে প্রধান
মন্ত্রী বানিয়ে রাজ ক্ষমতা তার হাতে তুলে দিয়ে, বাকি জীবন তিনি ঘুড়ির পিঠে চেপেই
কাটিয়ে দিবেন !’
কৈশোর পেড়িয়ে রাখাল
এখন দুর্দান্ত যুবক। সেই সাথে রাজার ‘ঘুড়ি মন্ত্রণালয়ের’ প্রধানও তিনি। রাজা তাকে পুরষ্কারের
পাশাপাশি নতুন এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও
দিয়েছেন। রাখালের কাজই হচ্ছে রাজার জন্য নিত্য নতুন ঘুড়ি তৈরি করা এবং ঘুড়ি নিয়ে
গবেষণা করা। সভাসদদের মাঝে রাখালের অবস্থানও অনেক উঁচুতে। রাজার পুরষ্কারের ঘোষণা
সে সবার আগেই শুনেছে। রাজা রাজাই থাকবেন, কিন্তু দেশের ভার প্রধান মন্ত্রীর হাতে
তুলে দিয়ে বাকি জীবন ঘুড়ির পিঠেই কাটাবেন। একি কম কথা !
কিন্তু, এ যে অসম্ভব
একটি কাজ। হীরক রাজার সৈন্য সংখ্যা এক লাখের উপরে। হস্তী বাহিনীর তিন হাজার হাতি, দশ
হাজার ঘোড়ার অশ্বারোহী বাহিনী, পাঁচ শতাধিক রথ, পদাতিক বাহিনী, তীরন্দাজ বাহিনী...
সব মিলিয়ে বিশাল অবস্থা! এদিকে, তাদের সৈন্য টেনেটুনে দশ হাজার হবে কিনা সন্দেহ! হস্তী
বাহিনী তাদের নেই, অশ্বারোহী বাহিনী মাত্র শ পাঁচেক। আগের দিনের যুদ্ধ ঢাল
তরোয়ালেই সীমাবদ্ধ ছিল। ঢাল-তরোয়াল, বর্শা, তীর-ধনুক, কুড়াল এগুলোর পাশাপাশি আর
একটি যন্ত্র প্রচলিত ছিল। একটি লিভারের সাহায্যে আগুনের গোলা শত্রুপক্ষের দিকে
ছুঁড়ে মারা হত। এ রকম যন্ত্র তাদের বেশ কিছু আছে, কিন্তু এগুলো দিয়ে তাদের
মোকাবেলা করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
খবর এসে গেছে, নদীতে
বড় বড় নৌকা বানানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে ওদের সৈন্যরা । দু এক মাসের মধ্যে নৌকা
তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাবে। নৌকায় করে সৈন্যদের এপাড়ে আসতে বড়জোর কয়েক ঘণ্টা লাগবে।
রাখাল দিন রাত বসে বসে নানা মতলব খোঁজে শত্রুপক্ষকে ঘায়েলের। একদিন সে বাগানের
সামনের রাস্তায় চিন্তা ভাবনায় বিভোর হয়ে পায়চারী করছিল, আচমকা মাথায় শক্ত কিছুর
আঘাত পেয়ে ব্যথায় চেঁচিয়ে উপরে চাইল। একটি কাঁক উড়ে যাচ্ছে। মাটিতে থেকে যে
জিনিসটি তার মাথায় পড়েছিল, তা তুলে নিয়ে ভাল করে দেখে ব্যাপারটি বুঝতে পারলো।
কাঁকটি একখণ্ড সাদা হাড় পায়ে আঁকড়ে উড়ে যাচ্ছিল, মাঝপথে তা ফসকে পড়ে রাখালের মাথার
উপরে। হঠাৎ, একটি আইডিয়া খেলে গেল তার মাথায়।
রাখাল তার পোশাক ঠিক ঠাক আছে কিনা একবার দেখে ইউরেকা, ইউরেকা বলে চিৎকার করতে করতে
প্রবেশ করলো রাজদরবারে !
দু মাস পরের কথা। হীরক
রাজা ঘোড়ায় চড়ে গঙ্গার তীরে প্রায় সিকি মাইল বিস্তৃত নৌকার বহর পরিদর্শন করছেন।
সবগুলো নৌকাই তাদের তৈরি হয়ে গেছে। হস্তী বাহিনীকে অবশ্য বাদ দিতে হয়েছে, ঘোড়ার
সংখ্যাও কমিয়ে আনা হয়েছে তিন ভাগের একভাগে । এক কিছুর দরকারই ছিল না, অর্ধেক পদাতিক সৈন্য দিয়েই দখল করা যেত মালামা
নগর। এ রাজ্যটি দখলে নেয়ার পর কিছুদিন সেখানেই বিশ্রাম করবেন। তারপর গঙ্গার ওপার
থেকে হস্তী বাহিনী এবং ঘোড়াগুলো এসে গেলেই আক্রমন করবেন মালামা নগরের পাশের রাজ্য
গৌরি রাজ্যে। এভাবে একের পর এক রাজ্য দখল করে হীরক রাজ্যের সীমানা বিস্তৃত করবেন আরাকান পর্যন্ত। অনেক
উচ্চাবিলাসী পরিকল্পনা হীরক রাজার ! পরিদর্শন শেষে সন্তুষ্ট হলেন রাজা, ঘোষণা
দিলেন, আগামীকাল সূর্যোদয়ের সাথে সাথে নৌকার বহর যাত্রা শুরু করবে।
পরদিন সকাল হতেই
নোঙ্গর তুলে গঙ্গায় ভেসে চলল হীরক রাজার সৈন্যবাহিনী বোঝাই শত শত নৌকা। বাতাস বেশ
জোড়েই বইছে, কিন্তু অনুকূলে নয়- হলে, পাল টাঙ্গিয়ে নৌকাগুলো বেশ দ্রুতই ছুটতে
পারত। তাই বৈঠার সাহায্য নিতে হচ্ছে। লম্বা লম্বা বৈঠায় পানিকে কাটিয়ে সুশৃঙ্খল
ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধের সাঁজে সজ্জিত হীরক রাজার রণতরী। মাঝি- মাল্লাদের হেইয়ো
হেইয়ো, বৈঠার আঘাতে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, সৈন্যদের কোলাহল, ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি ...
সব মিলিয়ে আকাশে বাতাসে জানান হয়ে গেছে যে হীরক রাজা আসছেন। এবার আর রক্ষা নেই
পালামা নগর রাজ্যের!
নদী পাড়ি দেয়ার পথের
অর্ধেক পর্যন্ত আসতেই তিন –চার ঘণ্টা লেগে গেল । মাঝি- মাল্লারা বেশ ক্লান্ত, বাতাস
এবং স্রোতের বিপরীতে নৌকা এগিয়ে নেয়া বেশ কঠিন কাজ। অবশ্য রাজার হুকুমে এখন
পালাক্রমে বৈঠা ঠেলছে সৈন্যরা। নৌকা এখন আগের চেয়ে দ্রুত চলছে। এভাবে চললে দুপুরের
পর পরই তীরে পৌছা যাবে। মালামা নগরের রাজা হয়ত সামান্য সৈন্যদল নিয়ে গঙ্গার পাড়েই
অপেক্ষা করছে যুদ্ধের জন্য। সে রকম হলে ভালই হয়। নদী থেকে তিন – চার মাইল দূরে
ওদের রাজধানী। রাজধানী দখল সময়ের ব্যাপার মাত্র- আসন্ন রাজ্য জয়ের আনন্দে সৈন্যরা
সবাই আগে থেকেই উৎফুল্ল ! থেমে থেমে স্লোগানও দিচ্ছে, ‘হীরক রাজা কি জয় !’
আচমকা সব কোলাহল থেমে
গেল। সৈন্যদের কয়েকজন প্রথমে দেখেছিল, উঁচুতে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে দেয়ায় অন্যরা
সবাই দেখতে পেল। বেশ উপরে আকাশে উড়ছে কয়েকটি ঘুড়ি। দেখতে দেখতে ঘুড়ির সংখ্যা বেড়ে
গেল এবং আরও বাড়ছে। অনেক উঁচুতে থাকায় নৌকা থেকে ঘুড়িগুলোকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র
দেখাচ্ছে, তাই কেউ কিছু বুঝতে পারছে না। তবে কি মালামা নগরের সবাই পরাজিত হবে যেনে
ঘুড়ি নিয়ে খেলায় মেতেছে ? ওদের রাজাও পাগল বটে, রাজকর্ম বাদ দিয়ে সারাদিন নাকি
ঘুড়ির পিঠেই বসে থাকে!
সৈন্য বোঝাই নৌকা যেমন
বৈঠা ঠেলে গঙ্গার ওপাড়ের পথে যাচ্ছে, তেমনি ঘুড়িগুলোও কিন্তু আকাশপথে আরও সামনে
আসছে। এক সময় ঘুড়িগুলো ঠিক নৌকা বহরের সোজাসুজি এসে স্থির হয়ে ভাসতে লাগল। এবং
হঠাৎ করেই সবগুলো ঘুড়িই জোট বেঁধে নিচে নেমে আসতে লাগলো দ্রুত। ঘুড়িগুলো যতই নিচে
নেমে আসছে ততই আকারে বড় হচ্ছে। সৈন্যরা সবাই চোখ বড় বড় করে দেখছে... আরে, ঘুড়ির
পিঠে কালো মতন ওগুলো কি ? দেখে তো মানুষই মনে হচ্ছে, প্রতিটি ঘুড়িতে দুজন করে
মানুষ বসে আছে। আবার মানুষের পাশে গোল গোল বড় বড় কি জিনিস আছে কয়েকটি করে !
তীরন্দাজ সৈন্যদের যেন
হুঁশ ফিরে এল। ঝাঁকে ঝাঁকে তীর বর্ষিত হতে লাগলো ঘুড়ি লক্ষ্য করে। ঘুড়িগুলো তীরের
আয়ত্তের কাছাকাছি হতেই নিচে নেমে আসা বন্ধ করল। কিন্তু একটু পরে একটি ঘটনা ঘটল যার
জন্য সৈন্যদের কেউ প্রস্তুত ছিল না। ঘুড়ির পিঠে বড় বড় গোল যে বলগুলো ছিল, সেগুলো
ঘুড়ি থেকে আগলা হয়ে টপাটপ পড়তে লাগল নিচে।
নৌকার সবাই আতংকে
চিৎকার করছে, কেননা বলগুলোতে আগুন ধরে গেছে এবং যতই নিচে নেমে আসছে বলে আগুন ততই বাড়ছে।
বলগুলো পুরোপুরি অগ্নিগোলকে পরিনত হয়ে আছড়ে পড়লো নৌকার উপরে, কিছু গিয়ে পড়লো
পানিতে।
সিকি মাইল বিস্তৃত নৌ
বহরের বেশ কিছু নৌকায় সাথে সাথে আগুন ধরে গেল। আগুনের হাত থেকে বাঁচতে সবাই
ঝাঁপিয়ে পড়লো নদীতে। জ্বলতে থাকা নৌকা দিক-দিশাহীন ঘুরতে ঘুরতে আরেকটি নৌকার সাথে
ঠোক্কর খেল, আগুন ধরে গেল অন্য নৌকায়। বাতাস বেশ জোড়েই বইছিল, তাই দেখতে দেখতে
আগুন ছড়িয়ে পড়লো বেশীরভাগ নৌকায়।
মালামা নগর রাজ্যে্র
রাজা, রাখাল, সেনাপতি, সভাসদ, সৈন্যরা সবাই গঙ্গার পাড়ে দাড়িয়ে বহুদূরে পানির উপর যখন
আগুনের লেলিহান দেখল, সবাই লাফিয়ে উঠল আনন্দে! রাজ নিয়ম ভেঙ্গে রাজা বিশাল বপু
নিয়ে কোলাকুলি করলেন রাখালের সাথে! রাখালের বুদ্ধিতেই তো সব হয়েছে। ‘যোদ্ধা
ঘুড়িগুলো’ যখন নিচে নেমে এল, ঘুড়ির পিঠে থাকা মানুষেরা বলল যে, হীরক রাজার নৌ
বহরের প্রায় সব নৌকাই আগুনে ধ্বংস হয়ে গেছে। সামান্য কিছু অক্ষত ছিল, সে নৌকাগুলো
প্রাণভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে!
মালামা নগর রাজ্যে
আবার সুখ শান্তি ফিরে এল। রাখাল এখন প্রধানমন্ত্রী এবং রাজ্যের শাসন কর্তা। তাদের
রাজার জন্য অনেক ভেবে চিনতে নতুন একটি ঘুড়ি তৈরি করা হয়েছে। ঘুড়ির পিঠে জুড়ে দেয়া
হয়েছে ছোট্ট একটা বাড়ি। রাজা মশাই সেখানেই থাকেন, খান, ঘুমান! একটি ছোকরা চাকরও
আছে ঘুড়িতে। রাজার সব কাজকর্ম সেই করে দেয়। ফুরফুরে বাতাসে বসে রাজা সারাদিন বই
পরেন ! ইদানিং আবার কবিতা লিখতেও শুরু করেছেন !
(শামীম আল মামুন, রচনাকালঃ ২০১৭)
গ্রাম ও প্রকৃতি - ২
প্রথম পর্বে বেশ কিছু ছবি দেয়ার পরও আরও অনেক ছবি বাকি রয়ে গেছে, তাই দ্বিতীয় পর্ব শুরু করলাম। প্রাম ও গ্রামীণ পরিবেশের ফটো বেশী বেশী দেয়ার কারন হচ্ছে আমার ভালোলাগা। যতগুলো বছর চলে গেছে এ জীবন থেকে, তার বেশীর ভাগই কেটেছে গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। হয়তবা, আবার কিছুদিন পরেই কর্মক্ষেত্রে যোগ দেয়ার জন্য হতে হবে 'প্রবাসী', তখন মোবাইলে তোলা এই ছবিগুলো দেখে গ্রামের স্মৃতি রোমান্থন করব ...
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস - মহাদেব সাহা
কেউ জানেনা একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস
নিয়ে বেড়ায়-
কোনো বিষন্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,
এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি অন্তহীন
প্রগাঢ় এপিক !
পাতায় পাতায় চোখের জল সেখানে লিপিবদ্ধ
আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো !
দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল আর
কোথাও নেই,
এমন হলুদ, ধূসর আর তুষারবৃত !
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়,
কেউ জানে না।
হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ্য দুঃখ যদি কখনো কেঁদে ওঠে কিংবা যদি
প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান সশব্দে বেজে যায়,
তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে
গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ,
তার চেয়েও বিষন্নতা নেমে আসবে
মানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।
তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই
মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখে
তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু দেখা যায় না;
মানুষের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস জমাট বেঁধে আছে
কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ
মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস আর আহত সভ্যতা
মেঘের মতো ঘনীভূত হতে হতে একেকটি মর্মান্তিক
দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে
মানুষ তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে।
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ায়,
কেউ জানে না।
একেকটি মানুষ নিজের মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়,
হায়, কেউ জানে না!
নিয়ে বেড়ায়-
কোনো বিষন্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,
এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি অন্তহীন
প্রগাঢ় এপিক !
পাতায় পাতায় চোখের জল সেখানে লিপিবদ্ধ
আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো !
দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল আর
কোথাও নেই,
এমন হলুদ, ধূসর আর তুষারবৃত !
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেড়ায়,
কেউ জানে না।
হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ্য দুঃখ যদি কখনো কেঁদে ওঠে কিংবা যদি
প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান সশব্দে বেজে যায়,
তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে
গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ,
তার চেয়েও বিষন্নতা নেমে আসবে
মানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।
তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই
মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস চেপে রাখে
তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু দেখা যায় না;
মানুষের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস জমাট বেঁধে আছে
কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ
মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস আর আহত সভ্যতা
মেঘের মতো ঘনীভূত হতে হতে একেকটি মর্মান্তিক
দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে
মানুষ তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে।
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়ায়,
কেউ জানে না।
একেকটি মানুষ নিজের মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়,
হায়, কেউ জানে না!
Subscribe to:
Posts
(
Atom
)