একটি ঘুড়ির গল্প
জহিরের বাবার মেজাজ
সাত সকালেই সপ্তমে উঠে আছে। অন্যদিনের চেয়ে আজ জলদি ঘুম থেকে উঠে নিয়মমাফিক প্রথমে
গোয়াল ঘর থেকে গরু বের করে উঠোনের একপাশে শক্ত বাঁশের খুঁটির সাথে বাঁধল ঠিকই,
অল্প সময় পরেই সে দেখতে পেল গরু সিমের মাচার সদ্য বেড়ে উঠা সিমের চারাগুলো গোগ্রাসে
সাবাড় করে চলছে। ভুল কি তার নাকি বজ্জাত গরু দড়ি ছিড়ে ফেলেছে, এ কথা ভাবতে ভাবতে
হাতের কাছে কুড়িয়ে পাওয়া বাঁশের খণ্ড নিয়ে তেড়ে গেল গরুর কাছে। মোটাসোটা
স্বাস্থ্যবান গরুটি তার মত শুকনো চিমসে পাটকাঠিকে পাত্তা না দিয়ে সমানহারে আহার
করতে থাকলে সে আর রাগ সামলাতে পারল না- পটাপট কয়েক ঘা বসিয়ে দিল পিঠের উপর। জহিরের
বাবা যেমন রাগ সামলাতে পারেনি, গরুটিও ক্রোধে পাগল হয়ে ছুট লাগাল। গরুর পিছে পিছে
একটু দৌড়েই সে হাঁপিয়ে ফিরে এল। বেয়াদব গরুর রাগ গিয়ে পড়ল পরিবারের সবার উপর। এত
বেলা হয়ে গেল এখনও সবাই পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে? এদিকে গরু ছুটে যে মানুষের ক্ষেত শেষ
করে ফেলল।
নতুন দিন
দূরে... অন্ধকারে, পূর্ব দিগন্ত প্রান্তসীমায় উদিত চাঁদ তার একফালি সরু বক্রতা
নিয়ে আপন পথ পাড়ি দিয়েছে অনেকটা। সেই সাথে শতসহস্র নক্ষত্র দ্যুতি এপাড়ের ভূমিকে
রাত্রির বন্ধনে আরেকটু সামনে প্রসারিত করেছে। জনপদের মানুষগুলো ঘুমিয়ে আছে, অন্যরা
জেগে আছে প্রহরীর মত- সময় সৃষ্ট আতংকে।
রাত্রি নিরব। ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক, প্রকৃতি সৃষ্ট হাজারো গুঞ্জন...
কুকুরের বেসুর গলার কান্না- মাঝে মাঝে শিয়ালের সন্মিলিত হাকঃ সবই রাত্রির বৈশিষ্ঠ।
জনপদের না ঘুমনোর দলের চোখে পরিচিত শব্দ গুঞ্জনের নির্দিষ্ট লয়ের ছন্দের মাদকতায়
স্পষ্টত ঘুমের অভিবার্ব- সেই সাথে সারাদিনের কষ্টকর পরিশ্রমের ক্লান্তি তো আছেই।
কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে তা তুচ্ছ।
ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। - ৪ ( শেষ অংশ )
ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। -১
ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। -২
ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। - ৩
ইতিমোধ্য চার বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে নতুন মনিবের আশ্রয়ে। সে বাজারের কথা
প্রায় ভুলেই বসেছে ভুলু- সেই সাথে পুরনো মনিবদের বাড়িগুলো। মনিবের অন্যসব পোষা
প্রাণীগুলোর সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে অনেক অনেক আগেই। মনিবও সেই আগের মতই- কোন
পরিবর্তন নেই।
‘মানুষগুলো কত সহজেই বদলে যায় ভুলু। কিন্তু আমি পারি না। কেন পারি না, আমি
নিজেও জানি না। তারা বদলে যায় পূর্ণিমার চাঁদের মত বিশাল এক সুখের প্রত্যাশায়-
তারা কি পায়, তারা জানে না; আমিও জানি না। কিন্তু আমি ‘আমার’ মাঝে, ‘আমাকে’ নিয়েই
বেঁচে থাকতে চাই। যারা বলে, পরিবর্তন হও হে! আমি তাদের দলে নেই। যে সূর্য আজ উঠে,
আগামীকাল উঠবে কিনা- সৃষ্টিকর্তাই ভাল জানেন। এবং একমাত্র তিনিই সত্য। যদি আমি
বলি, আগামীকাল সূর্য উঠবে- তবে আমি মিথ্যা প্রতিপন্ন হব’।
ইদানিং মনিব বেশ মনমরা থাকে। প্রিয় কুকুরটাকেও খুব একটা পাত্তা দেয় না সে।
ভুলু বুঝতে পারে মনিবের মন খারাপ, কিন্তু কি জন্য মন খারাপ সেটুকু বোঝার ক্ষমতা
ইতর প্রাণীটির নেই।
‘পোলট্রি ফার্ম বন্ধ করে দিতে হবে রে ভুলু, কোন উপায় নেই’- একদিন কুকুরটির
উদ্দেশ্যে বলল মনিব।
সত্যিই ফার্ম বন্ধ হয়ে গেল। ফার্মের শূন্য ঘরে একলা বসে থাকে মনিব, চুপচাপ।
ভুলুও তার পাশে বসে থাকে- কিন্তু তার উদ্দেশে মনিব কিছু বলে না। কুকুরটি দেখেছে,
যখন মোটা কাগজের কার্টুনে করে নাদুস নুদুস ব্রয়লার বাচ্চাগুলো এনে রাখা হয় গোলাকার
ব্রুডার হাউসের মধ্য। ব্রুডারের ইলেকট্রিক বাল্বের তাপ নরম শরীরে মেখে ছুটোছুটি
করে ছোট ছোট বাচ্চাগুলি। তারপর সেগুলো বড় হয়, ছড়িয়ে পড়ে পুরো ফার্ম হাউসে। মনিবের
পাশে বসে কতদিন সে বাচ্চাগুলো দেখেছে- মুরগিগুলো দেখেছে।
‘জানিস ভুলু, ফার্ম করেছি অর্থ উপার্জনের জন্য ঠিকই- কিন্তু এ অন্যরকম এক
ভালবাসা। একমাত্র যে এই পেশার সাথে জরিত, সে ই বুঝতে পারে’।– মনিব এ ধরনের কথা এখন
ভুলুকে বলে না।
ফার্ম বন্ধ হওয়ার দু মাসের মাথায় মনিব অর্থ সংকটে পতিত হল তীব্র ভাবে।
বাধ্য হয়ে লেয়ার মুরগিগুলো বিক্রি করে দিতে হল। এই কয় বছরে মোরগ-মুরগি কিংবা
রাজহাঁসের সংখ্যা বেড়ে কয়েকগুন হয়েছে। কবুতরগুলো সব বিক্রি হয়ে গেল। রাজহাঁসগুলোও
চলে গেল- যেদিন মনিব তাদের বিক্রি করে দিল, ভুলু কাঁদতে দেখেছে মনিবকে।
“মৃত্যু শোক ভোলা যায় না বলে একটা ভুল কথা প্রচলিত আছে। সবচেয়ে সহজে যে শোক
ভোলা যায় তার নাম মৃত্যু শোক। সবচেয়ে তীব্র শোক হচ্ছে জীবিত মানুষ হারিয়ে যাবার
শোক। হারিয়ে যাওয়া মানুষ যতদিন জীবিত থাকে ততদিন এই শোক ভোলা যায় না”। ( বুদ্ধদেব
গুহ, একটু উষ্ণতার জন্য)
‘ভুলু, আমি সব হারিয়েছি। পরিবার থেকে আজ আমি নির্বাসিত, নির্বাসিত পাপাচারে
পূর্ণ এ সমাজ থেকে। তবুও আমি নিজের মত করে বাঁচতে চেয়েছিলাম- আমার এই সব বন্ধু
সাথীদের নিয়ে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমার ভাগ্যে তা লিখে রাখেন নি’। একটু থেমে মনিব
বলল, ‘ জানি না এর শেষ কোথায়। ভুলু, তোদের মত অবলা জীবদের আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন,
আমাদের মত মনও দিয়েছেন কিন্তু তার ব্যাপ্তি খুবই ক্ষুদ্র। আমাদের চেতনার গণ্ডী
অনেক বিশাল- আমাদের দুঃখগুলো তাই অনেক। আসলে সময়ের উত্তরণে আমরা এইটুকু পথ অতিক্রম
করেছি। আমাদের প্রাক পুরুষেরা
তাই ভাল ছিল- তারা খিদে লাগলে দল বেঁধে শিকার করত বন জঙ্গলে। তাদের সবটুকু ঐই ওটুকুর
মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল; বস্তুত যেদিন তারা আগুন জ্বালাতে শিখল, সভ্যতার শুরু হয়তবা
সেদিন থেকেই; সেদিন থেকে তারা আরেকটি জিনিস অর্জন করল- এই আগুনের দহন। জানি না এর
শেষ পরিনতি কোথায়’।
‘ভুলু, আমি চলে যাচ্ছি। কোনদিন ফিরব কি ফিরব না – ঠিক জানি না। তুই তোর মত
করে ভাল থাকিস। তবে ভুলু আমি একটি চরম সত্য জানি- সব সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ হয়ে
গেলেও একটি দরজা সবসময় খোলা আছে এবং থাকবে; সে হচ্ছে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্,
তুমি তার দিকে ধাবিত হও’।
সেদিন সকালবেলা মনিব চলে গেল। নিত্যকার মত মনিবের পিছু নিয়েছিল কুকুরটি।
মনিব তার মাথায় হাত বুলিয়ে নিরস্ত করল। ভুলু বাড়িতে ফিরে বসে পরল মনিবের রুমের
দরজার সামনে। দুপুর পর্যন্ত বসে রইল কুকুরটি। তারপর দুপুর গরিয়ে বিকেল- সন্ধ্যা
এবং রাত নেমে এল। শূন্য বাড়িতে কয়েকবার পায়চারি করল কুকুরটি। রাত্রি বেলা থেকে
থেকে ভ-অ-উ... ডাক তুলল অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে।
সকাল হল, আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়াল কুকুরটি। ইতিমধ্যে খিদে তাকে অস্থির করে
তুলেছে; সেই যে গতকাল সকালবেলা মনিব তাকে পেট পুরে খাইয়েছিল- তারপর আর কিছুই
জোটেনি উদরে। তবুও মনিবের জন্য দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করল কুকুরটি এবং অবশেষে সেই
বাজারের উদ্দেশে পা বাড়াল।
অনেক দিন পর কুকুরটি ফিরে এল বাজারে। সবকিছুই তার চেনা, কিন্তু কেমন যেন
অপরিচিত ঠেকল তার কাছে। আগের মত পিছু নিল খাদ্যদ্রব্যে উদরপূর্তি করা কোন মানুষের।
কেউ তার দিকে ছুঁড়ে দিল পাউরুটি কিংবা অন্য কোন খাদ্যের অংশবিশেষ। কিন্তু এতে তার
ক্ষুধা মিটত না। বাধ্য হয়ে বাজারের ড্রেনগুলো কিংবা মাংসের দোকান অথবা হোটেলের
উচ্ছিষ্টের জন্য মারামারি বাধিয়ে দিল অন্য কুকুরগুলোর সাথে। কিন্তু এতোগুলোর সাথে
পেরে উঠত না সে। বাজারে অনেক নতুন কুকুরের আমদানি হয়েছে, তারা তার অপরিচিত। সেই
সাথে যে কুকুরগুলো অতীতে তার বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, সময়ের ব্যাবধানে সবাই শত্রুতে
পরিনত হয়ে গেছে। নিজেদের রাজত্বে এই নতুন অগুন্তককে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না।
সৃতি হাতড়ে পুরনো মনিবদের দু এক জনের বাড়ি থেকে ঘুরে এল কুকুরটি। কিন্তু পূর্বের
মত ব্যবহার পেল না। আসলে সবাই তাকে ভুলে গেছে, চিনতে পারেনি কেউ- তাই তাড়িয়ে
দিয়েছে বাড়ি থেকে। কুকুরটির এখন এক মাত্র আশ্রয় এই বাজারটি।
বাজারে আসার পরদিনই কুকুরটি সেই মনিবের বাড়িতে গিয়েছিল। একরাত সেখানে
অতিবাহিত করে ফের ফিরে এল। সেই মনিবের বাড়িতে সে দু দিন পর পর হাজির হত এবং এই ধারাবাহিকতা রয়ে
গেল।
সেই মনিবের আশ্রয়ে ভাল ভাল খাবার কিংবা নিয়মিত ফার্মের মুরগি-ডিম ইত্যাদি
খেয়ে কুকুরটি আরও তরতাজা এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখানে এসে ক্রমশ দুর্বল
হয়ে পড়ল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল তার পাঁজরের হাড় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে মোটা
চামড়ার ভিতর দিয়ে। ধীরে ধীরে তার সোনালী উজ্জ্বল লোমগুলো বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়তে
লাগল। এবং বছর দুয়েক পর কুকুরটির অবস্থা এমন হল যে সেই মনিব দেখলেও ঠিক চিনতে
পারবে না। শেষ পর্যন্ত সংকর কুকুরটির সাথে বাজারের অস্থি-চামড়া সর্বস্ব কুকুরগুলির
কোন পার্থক্য রইল না- সম্পূর্ণ বেওয়ারিশ নেড়ি কুকুরে পরিনত হল সে।
তবুও সেই নেড়ি কুকুরটি এখনও ভুলতে পারেনি সেই মনিবকে। এখনও দুর্বল পা গুলো
টেনে টেনে হাজির হয় সেই মনিবের বাড়িতে।
বাড়িটি জঙ্গলে পূর্ণ হয়ে গেছে। পুরো বাড়িটি ঘিরে অন্যরকম এক শূন্যতা-
কুকুরটির মন কেঁদে উঠে। মনিবের সেই রুমের দরজার সামনে বসে করুন সুরে ডেকে উঠে।
মনিবের সেই নির্দেশ গুলো এখনও তার মনে আছে। কাঁক দেখলে ছুটে যায়- তাড়িয়ে দেয় বাড়ি
থেকে। গুইসাপ কিংবা অন্য কোন কোন কুকুর মনিবের বাড়িতে দেখলে সেই পুরনো দিনগুলোর মত
ঘড় ঘড় শব্দ তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মনিবের শত্রুর উপর।
মনিবের সেই পুরনো গন্ধ এখনও খুঁজে ফিরে কুকুরটি। বদ্ধ রুমের দরজার সামনে
দাঁড়িয়ে মনিবের ভালবাসা ভরা শরীরের গন্ধ এখনও বারবার শুঁকতে থাকে। জীর্ণ রাজহাঁস
কিংবা লেয়ার মুরগির ঘরের সামনে ছুটে যায়। ফার্ম হাউসের চারপাশ ঘুরে ফিরে- তারপর
আবার ফিরে যায় বাজারে। যদি খিধে নামক জিনিসটি তার বেলায় না থাকত, তবে মনিবের শূন্য
বাড়ি ছেড়ে কখনও বাজারে চলে যেত না কুকুরটি।
আগের মত এখন আর দু দিন পর পর মনিবের বাড়িতে যাওয়া হয় না কুকুরটির। সময়ের
সাথে সাথে সেখানে যাতায়াতও কমে গেছে। দুর্বল শরীর এতটা ধকল সইতে পারে না। তবুও
কিছুদিন পরপর সে ঠিকই চলে আসে নিঃসঙ্গ বাড়িটিতে।
সেদিন দুপুর বেলা পুকুরপাড়ের জঙ্গল পেড়িয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেই অজান
শিহরনে-আনন্দে নেচে উঠল নেড়ি কুকুরটির মন। খুশির অতিশজয়ে কয়েক বার ডেকে উঠল সে।
লাফাতে লাফাতে চক্কর দিল পুরো বাড়ি, তারপর বসে পরল মনিবের রুমের দরজার সামনে।
মনিবের শরীরের তরতাজা গন্ধ পেয়েছে সে। এ গন্ধ কোনদিনই ভুলতে পারবে না
কুকুরটি।
সন্ধায় মনিব চলে এল। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর মনিবকে দেখে কুকুরটির খুশি আর ধরে
না। দৌড়ে মনিবের কাছে গিয়ে লেজ নাড়তে লাগল। তার সবটুকু খুশি প্রকাশের জন্য এই
একখানা লেজ যথেষ্ট নয়, যদি আরও গোটা দশেক
লেজ থাকত!
কুই কুই ডাক তুলে মনিবের সামনে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল কুকুরটি।
মনিব প্রথমে চিনতে পারল না দুর্বল নেড়ি কুকুরটিকে- তার আচরণে বিস্মিত হল
পুরো এক মিনিট, তারপর সৃতি হাতড়ে মুখ থেকে বেড়িয়ে এল একটি নাম ‘ভুলু’।
বহুদিন পর প্রিয় মনিবের দেয়া পুরনো নাম তার মুখে শুনতে পেয়ে আনন্দে কেঁদে
উঠল কুকুরটি। এ কান্নার ভাষা বোঝা কারও সাধ্য নেই।
মনিব কুকুরটির মাথায় হাত বুলাতে লাগল। যখন কুকুরটির সোনালী উজ্জ্বল লোম ছিল- নাদুস নুদুস
ছিল দেখতে, তখন কতজনই তার শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করেছি। কতজনই কুকুরটিকে নিয়ে গেছে আপন
বাড়িতে। কিন্তু এখন সে ঘৃণিত
নেড়ি- মানুষগুলো তার বর্তমান কদাকার শরীরে হাত বুলানো দূরের কথা, অকারনে কত যে মার খেতে হয়েছে এই অবোধ পশুটি জানে। তার এই মনিব অন্য মানুষগুলির অনেক
উরদ্ধে।
‘ভুলু আমি ফিরে এসেছি, আর কোনদিন চলে যাব না’-
পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে বসতে বসতে বলছে মনিব, তার পাশে বসে আছে ভুলু।
‘তোকে আর কোনদিন কষ্ট করতে হবে না। তুই আমার সাথে আগের মতই থাকবি’।
‘ভুলু, আমি অনেক টাকা নিয়ে এসেছি। আবার আমি ফার্ম করব। রাজহাঁস কিনব, কবুতর কিনব। আবার পুকুরে মাছের চাষ করব, লেয়ার মুরগি
পালব। ভুল, সেই দিনগুলো
আমি আবার ফিরিয়ে আনব’।
‘ভুলু, এখন চল- আমরা দুজন
সেই আগের মত পুরনো জায়গাগুলো ঘুরে আসি। চল ভুলু’।
মনিবের আহবানে নেড়ি কুকুরটি চলল তার পিছু পিছু। গ্রাম্য রাস্তা, ক্ষেতের আইল, বিলের পাড় পেড়িয়ে দু জন পৌঁছে গেল নদী পাড়ে।
নদীতীরে বিস্তৃত বালুচরে লম্বালম্বি শুয়ে পরল মনিব। কি মনে হতেই আবার উঠে বসল সে। কুকুরটিও বসে রইল ঠিক তার পাশে।
‘ভুলু, আমার মনে আজ কি আনন্দ’- উচ্চস্বরে গান ধরল মনিব।
মনিবের আনন্দটুকু ধরতে পেরেছে বুদ্ধিমান কুকুরটি। তার মনেও আজ খুশির জোয়ার বইছে।
মনিব গান থামিয়ে আবার সটান শুয়ে পরল বালির উপর।
পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ- অযুত নিযুত
নখত্রেরা আকাশের সবটুকু অবস্থান জুড়ে বিরাজ করছে। কোনটি দ্যুতিময়তায় প্রখর, আবার কোনটি ম্লান। মনিব এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে
তার গুলোর দিকে। মনিবের মনে চলছে ভাবনার
খেলা- সে ভাবছে তার অতীত সময় গুলোকে নিয়ে। ভাবনার ব্যপ্তিতে সময় চলে যাচ্ছে, কিন্তু তার
সেদিকে কোন খেয়াল নেই। ভুলুও বসে আছে চুপচাপ, তারও কোন তাড়া
নেই। মনিব যদি সারারাত এভাবেই
শুয়ে থাকে নদীপাড়ে,
সেও থাকবে বসে- কোন প্রকার বিরক্ত বা ডাকাডাকি
করবে না মনিবকে।
আকাশে চাঁদ উঠেছে- অর্ধেক চাঁদ। সে চাঁদের আলো নদীর পানিতে প্রতিফলিত হয়ে নদীটিকে পরিনত করেছে
আঁকা বাঁকা কোন সরীসৃপের মত। নদীর ওপাড়ের অন্ধকার
সীমানায় জ্বলে জ্বলে নিভে যাচ্ছে, আবার জ্বলছে- শত সহস্র জোনাকির দল। হালকা বাতাসের গুঞ্জন, ঝি ঝি পোকার একটানা ডেকে চলা-
এ ছাড়া প্রকৃতি পুরোপুরি নিরব। নীরব মনিব। নীরব কুকুরটিও।
অনেক অনেকক্ষণ পর কথা বলল মনিব, ‘ভুলু, অনেকগুলো
বছর আগে কেউ একজন আমার ডাইরিতে একটি কবিতা লিখে দিয়েছিল। কবিতাটিকে আমি খুব ভালবাসি। আজ এতদিন পর আবার সে কবিতাটি মনে
পড়ছে। তুই শুনবি?’
মনিব বলতে লাগল-
'বলো আমাকে রহস্যময় মানুষ-
কাকে তুমি সবচেয়ে ভালবাস?
তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নীকে?'
পিতা, মাতা, ভ্রাতা
ভগ্নী- কিছুই নেই আমার।
‘তোমার বন্ধুরা'?
- ঐই শব্দের অর্থ কখনও
জানিনি।
'তোমার দেশ?'
-জানিনা কোন দ্রাঘিমায় তার
অবস্থান।
'সৈন্দর্য?'
পারতাম বটে, তাকে ভালবাসতে- দেবী তিনি
অমরা।
'কাঞ্চন?'- ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন তোমারা ঘৃণা কর ভগবানকে।
'বলো তবে অদ্ভুত অচেনা
মানুষ, কি ভালবাস তুমি?'
আমি ভালবাসি মেঘ ..... চলিষ্ণু মেঘ .....
মেঘ ..... উঁচুতে ..... ঐই উঁচুতে .....
আমি ভালবাসি আশ্চার্য মেঘদল।
(শার্ল বোদলেয়ার)
মনিব চেয়ে আছে নক্ষত্র পানে, কুকুরটি রাত্রির অন্ধকারে। আর বাকি সবটুকু
জুড়েই নিরবতা। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মনিব, বলল ‘আমার কিছুতেই কিছু যায় আসে না’। তারপর
আবার নীরবতা।
(রচনাকালঃ ২০০৬)
ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। - ৩
ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। -২
মিনির দেখা মিলল পরদিন সকালে। মনিবের পাশে বসে সকালের মিঠে রোঁদ পোহাচ্ছিল ভুলু, মিউ মিউ শব্দ শুনে মনিবের সাথে সেও ফিরে চাইল বাদামি ছোপওয়ালা সাদা বিড়ালটির দিকে। এ প্রাণীটিকে পছন্দ করে না সে। বাজারে, বেয়াদব প্রাণীগুলোর একটি থাবা চালিয়েছিল অনেকদিন আগে।
বিড়াল দেখে ঘড় ঘড় শব্দ করে উঠল কুকুরটি। যাবে নাকি- দৌড়ে গিয়ে বিড়ালটির নাকে কামড় বসাতে। উহ, মনিব যে কোন ইঙ্গিত দেয়নি।
‘ভুলু, যা ধর’।
যেন এ হুকুমের অপেক্ষায় ছিল কুকুরটি। নড়েচড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। তারপর সতর্ক পদক্ষেপে এক পা দু পা এগিয়ে এলো মিনির সামনে।
মিনি পালাবার চেষ্টা না করে সতর্ক দৃষ্টিতে কুকুরটিকে নিরিখ করে চলল। কিন্তু কুকুরটি তার নাক খানা মিনির
সামনে-নিচে নামিয় আনলে বিড়ালটির পতি-ক্রিয়া হল দেখার মত। মিনি লম্বা লেজখানা ফুলিয়ে খাড়া
শূন্যে তুলে পিঠটাকে বাঁকিয়ে ফেলল ধনুকের মত, একই সাথে সামনের ডান পা দিয়ে থাবা চালাল
কুকুরটির নাক বরাবর।
সামান্য এক ছিচকে প্রাণী তার মত বিশালাকার কুকুরের নাকে আঘাত করেছে, এত বড় সাহস!
মনিবের হাসির শব্দ শুনে তার মেজাজ আরও সপ্তমে চড়ে গেল- পর মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়ল বেয়াদব প্রাণীটির উপর। ধূর্ত বিড়ালটি এক লাফে সড়ে গেল, ভুলু আবার
আক্রমণ চালাল। এবার রণে ভঙ্গ দিয়ে
দৌড়ে পালাল মিনি,
পিছু পিছু ভুলুও ছুটল। অবশেষে সারা বাড়ি ঘুরে কোন উপায়ন্তর না দেখে মিনি নারকেল
গাছে উঠে পড়ল। গাছের নীচে দাঁড়িয়ে
একটানা ঘেউ ঘেউ করে চলল ভুলু, যে মাত্র সে গাছ থেকে নেমে আসবে- বাছাধনের তুলতুলে নরম ঘাড় কামড়ে দিবে আচ্ছা মতন!
মিনি পড়েছে বেকায়দায়। নখগুলো গাছের শরীরে
ঢুকিয়ে কতক্ষণ আর ঝুলে থাকা যায়। এদিকে রোমশ প্রাণীটিও
প্রস্তুত হয়ে আছে তাকে ধরার জন্য।
‘ভুলু আয়’।
মনিবের ডাক শুনে কুকুরটি শেষ বারের মত ঘেউ ঘেউ ভৎসনা প্রকাশ করল বিড়ালটির প্রতি, তারপর দৌড়ে
চলে এলো মনিবের কাছে।
ভুলুর আগ্রহ ছিল কখন মনিব তাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাবে। মনিব আজ সারাদিন বাড়িতেই ছিল, কোথাও যায়নি।
বিকেলে মনিব বড়শি নিয়ে পুকুরপাড়ের সিঁড়িতে বসে পড়ল। ভুলুর বেড়াতে যাওয়া হল না- মনিবের পাশে রইল বসে। মিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মিউ মিউ
করছে- অন্যদিনের মত মনিবের কাছে আসতে সাহস পাচ্ছে না। ভুলু একবার ছুটে যেতে চাইল- কিন্তু মনিব
ধমক লাগাল তাকে।
রাজহাঁসগুলো দল বেঁধে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে- একটু আগে বাড়ি ফিরেছে সবাই। নিত্যদিনের মত ফিরেই খাবারের জন্য
চিৎকার চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছিল, মনিবের হাতে ধরা বড়শির ছিপের বাড়ি খেয়ে এখন সাহস হারিয়ে
চুপচাপ অপেক্ষায় আছে কখন মনিব গামলা ভর্তি খাদ্য এনে তাদের দিবে। মোরগ মুরগিগুলোও আছে তাদের দলে।
পুকুরের পানিতে আলোড়ন- ভুলু বুঝতে চাইছে ব্যাপারটা কি। মনিবকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখল সে। তার হাতের লম্বা লাঠিখানার মাথা (বড়শির ছিপ)
বেঁকে গেছে নিচের দিকে।
বেশ বড় আকারের মাছ। মাছটি দেখে বিস্ময়ে
ঘেউ ঘেউ করে উঠল ভুলু- বসে ছিল সে, এখন দাঁড়িয়ে সামনে
এগিয়ে নাক নামিয়ে প্রাণীটির শরীরের গন্ধ বুঝতে চাইল। ঠিক তখনই মাছটি লেজের ঝাঁপটা মারল তার মুখে। লাফিয়ে পিছনে সড়ে এলো কুকুরটি।
সন্ধ্যার পর মনিব চলে গেল- ভুলু পিছু নিতে চেয়েছিল, কিন্তু মনিব বারণ করলে সে থেকে গেল বাড়িতে। কবুতর, রাজহাঁস এদের কোন সাড়া-শব্দ নেই। সন্ধ্যা হতেই সবগুলো
প্রাণী আশ্রয় নিয়েছে স্ব স্ব বাসস্থানে। বাইরে থেকে মনিবও ছোট ঘর দুটোর দরজা বন্ধ করে দিয়েছে- ভুলু জানে,
ঠিক সকাল হলে মনিব তাকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে বের হবে এবং ফিরে এসে মুক্ত
করে দিবে প্রাণীগুলোকে। মিনির শরীরের গন্ধও
সে পাচ্ছে মনিবের রুম থেকে।
মনিবকে ছাড়া একা একা শূন্য বাড়িতে থাকতে মোটেও ভাল-লাগছে না কুকুরটির। করুন স্বরে কয়েকবার ডেকে উঠল সে। তারপর বসে পড়ল মনিবের রুমের দরজার
সামনে।
রাতে মনিব ফিরে এলো। ভুলুও খাওয়া-দাওয়ার পাঠ
চুকিয়ে মনিবের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল। খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে মনিবকে সে দেখতে পাচ্ছে- মনিবও খাওয়ার
পর্ব শেষ করে বসে পড়েছে বিছানার উপর। সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বেড়িয়ে এলো মনিব রুম ছেড়ে।
সমস্ত বাড়ি চক্কর দিল একবার কুকুরটি মনিবের সাথে। মনিব সবকিছু দেখে নিচ্ছে- অর্থাৎ রাজহাঁস, কবুতর, মুরগি ইত্যাদি প্রাণীদের ঘরের দরজা ঠিক
ঠাক মত বন্ধ করা হয়েছে কিনা। ফার্ম হাউসও বাদ পড়ল
না। সেখান থেকে ফিরে এসে
নিজের রুমে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিল মনিব।
ভুলু জানে,
মনিব অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকে। মনিবের ঘরে যতক্ষণ পর্যন্ত ইলেকট্রিক বাল্ব এর আলো থাকে এবং
হালকা গানের শব্দ ভেসে আসে- তার মানে সে জেগেই আছে। মাঝে মাঝে চেয়ার টানাটানির ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ কিংবা মনিবের
কথাবার্তাও শুনতে পায় সে। কিন্তু বুদ্ধিমান কুকুর
জানে মনিব সেখানে একাই থাকে, অবশ্য মিনিও থাকে সেখানে। বিড়ালটির গন্ধ সে ঠিকই পাচ্ছে, কিন্তু মিয়াঁও
মিয়াঁও ডাক শুনতে পায়নি একবারও।
গত দু রাতে ভুলু দেখেছে- অনেক রাতে, ঠিক ঘুমতে যাওয়ার আগে
মনিব একবার বেড়িয়ে আসে রুম ছেড়ে। ফার্ম হাউস, রাজহাঁসের ঘর সবকিছু দেখে তারপর ঘুমিয়ে
পরে। তখন মনিবের রুমে কোন
আলো থাকে না, কিংবা শব্দও ভেসে আসে না।
ঠিক মধ্যরাতের পর মনিবের ঘরের দরজা খুলে গেল। ফার্ম হাউস পাশ কাটিয়ে সদর দরজা খুলে মনিবকে বের হতে দেখে
অবাক হয়ে গেল কুকুরটি।
‘আয় ভুলু, আয়’।
মনিবের ডাক শুনে গেটের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো কুকুরটি। দিনের বেলা হলে লাফাতে লাফাতে তার পিছু নিত, কিন্তু এই
সময়ে তার আপত্তি পুরো মাত্রায়। মনিব আরও দু বার হাঁক ছাড়ল- প্রতিত্তুরে
একবার ডেকে উঠল কুকুরটি, কিন্তু দাঁড়িয়ে রইল সেই একই জায়গায়।
মনিবের পায়ে চলার শব্দ এবং শরীরের গন্ধ দূরে সরে যেতেই সব দ্বিধা ঝেড়ে বাইরে
বেড়িয়ে এলো এবং মনিবের পিছু নেয়ার জন্য ছুটল। মনিব একবার পিছন ফিরে দেখল কুকুরটিকে, তারপর পথ চলতে
লাগল।
সরু খালের পাড় ধরে গ্রাম্য জনপদ, বিস্তীর্ণ বাঁশ ঝোপের সারি, বিশাল বিশাল গাছগুলোর অন্ধকার অববয় পেড়িয়ে এলো দুজন। কোথাও একটা পেঁচা ডেকে উঠল রাতের
নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে দিয়ে। ভুলুর ইন্দ্রিয় সতর্ক
হয়ে উঠল, যদিও অজানা একটা ভয়-অনুভূতি ইতর প্রাণীটিকে ঘিরে
ধরেছে আগেই। এ ভয়ের জন্যই মনিবের
সাথে আসতে দ্বিধা করেছিল সে। ইতর প্রাণীদের এ অনুভূতি
দিনের আলো মুছে গেলেই ফিরে আসে রাতের আঁধারে। নিশাচর প্রাণীগুলোর সাথেই এখানে
পার্থক্য- রাতের আঁধারে-নীরবতায় তাই কোন কুকুর একাকী এমনকি দল বেঁধে হলেও নিজস্ব
গণ্ডির বাইরে বেরুবে না। কেউ কখনও কোন কুকুরকে কিংবা তার দলকে দেখবে না জনপদের
বাইরে গভীর রাতে ঘুরে ফিরে বেড়াতে। যদি দেখে- সেটা অন্য রহস্য।
শস্যখেত গুলোকে যে রাস্তাটি দু ভাগে ভাগ করে দিয়ে বিলের পাশ দিয়ে চলে গেছে
দূরে- তার মাঝামাঝি একপাশে বসে পড়ল মনিব। ভুলু সতর্ক দৃষ্টি চারপাশে বুলিয়ে আনল
একবার। ওদের সামনে, পিছনে, ডানে, বায়ে- চারপাশেই শূন্য শস্যখেত। ফেলে আসা পথের ও প্রান্তে
গ্রামের কাঠামো হালকা ফুটে উঠেছে পূর্ণিমার আলোর নিচে। পূর্ণিমার চাঁদ সামান্য ক্ষয়ে গেছে, কিন্তু তার মায়াবী আলোক-বন্যার
প্রাচুর্যতার কমতি নেই।
মনিব যেখানে বসে আছে তার অল্প দূরত্বে ধানের খড়ের গাদা- ছোট একটি টিবি যেন। মনিব দাঁড়িয়ে সে টিবি থেকে দু
হাত ভর্তি খড় নিয়ে বিছিয়ে দিল শিশির ভেজা ঘাসগুলোর উপর। তারপর সটান শুয়ে পড়ল।
ভুলু বসে পড়ল মনিবের পায়ের কাছে সোনালী খড়ের উপর। সামনে, শূন্য শস্যখেত
গুলোর দিকে তাকিয়ে রইল কুকুরটি। সতর্ক
দু চোখ কি যেন খুঁজে ফিরছে।
মনিবের লাইটার জ্বালানোর শব্দে ভুলু সেদিকে ফিরে চাইল। সিগারেটে অগ্নিসংযোগ
করল মনিব।
মনিব সিগারেট ফুঁকছে- নিভু নিভু লাল অগ্নিগোলক আবার জ্বলে উঠছে দ্বিগুণ
তেজে। ধোঁয়াগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে ক্রমশ, জ্যোৎস্নার আলোয় সে
কুণ্ডলী ছায়া ছায়া হয়ে ধরা পড়ছে কুকুরটির চোখে। হঠাৎ অদ্ভুত চাপা শব্দ করে লাফ মের
দাঁড়িয়ে পড়ল ভুলু। কুকুরটির এ আচরণের কারণ জানার জন্য কৌতূহলী মনিব উঠে বসল এবং
ভুলুর সতর্ক চোখের দিকে একবার চেয়ে সেদিকেই দৃষ্টি ফিরল মনিব।
কতটা প্রখর পূর্ণিমার আলো, তবুও ওগুলোর ছায়া ছায়া কায়াগুলো বুঝতে কষ্ট
হচ্ছে মনিবের। কায়াগুলোর মাঝখানে: জ্যোৎস্নার আলো প্রতিফলিত হয়ে জ্বল জ্বল করছে
সারি সারি জোড়ায় জোড়ায় চক্ষু। দু মিনিট পর চক্ষুগুলো উধাও হয়ে গেল- অদৃশ্য হল
কায়াগুলোও।
‘কিরে বেটা, ভয় পেলি নাকি। ওগুলো শেয়াল’। মনিবের কথার সমর্থনে সামান্য পরে
শেয়ালগুলো ডেকে উঠল। প্রথমে একটি, তারপর দুটি, তিনটি- সবগুলো শেয়াল এবার ডেকে উঠল
একযোগে। বহুদূর থেকে গ্রামের কুকুরগুলোও ডেকে উঠল প্রতিত্তুরে। ভুলু স্বজাতির
আহবানে সূর মেলাল না- সতর্ক দৃষ্টি রেখে সেখানেই রইল চুপচাপ দাঁড়িয়ে।
মনিব আবারও শুয়ে পড়ল সোনালী খড়ের বিছানায়। জ্যোৎস্নার আলো সরাসরি পড়ছে তার
মুখের উপর। সেদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ভুলু দেখল, মনিব এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রুপালী
চাঁদের দিকে। মনিবের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল ভুলু-
“একবার নক্ষত্রের দিকে
চাই- একবার প্রান্তের দিকে
আমি অনিমেষে।
ধানের খেতের গন্ধ মুছে গেছে
কবে
জীবন থেকে যেন: প্রান্তরের
মতন নীরবে
বিচ্ছিন্ন খরের বোঝা বুকে
নিয়ে ঘুম পায় তার;
‘নক্ষত্রেরা বাতি
জ্বেলে-জ্বেলে-জ্বেলে নিভে গেল- নিভে গেলে? বলে তারে
জাগায় আবার’ ।
জাগায় আবার
বিক্ষত খরের বোঝা বুকে
নিয়ে- বুকে নিয়ে ঘুম পায় তার
ঘুম পায় তার .........”।
(জীবনানন্দ দাস)
মনিবের সাড়া-শব্দ নেই অনেকক্ষণ হল। এই সময়ে, এই পরিবেশে এ নীরবতা কুকুরটির
সহ্য হচ্ছে না। তাছাড়া অদ্ভুত কিছু গন্ধ পাচ্ছে সে। এ রকম গন্ধ একবার সে পেয়েছিল
পূর্বোক্ত এক মনিবের আশ্রয়ে। শস্যখেতে ঘাস খাচ্ছিল গরুটি। ভুলুকে সেখানে রেখে মনিব
গিয়েছিল চলে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। ঠিক তখনই সে গন্ধ পায় কুকুরটি। মনিবের পোষা
গরুটিও সে গন্ধ পেয়েছিল; তারপর কান দুটো খাড়া করে, চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে, চার পা
ছুঁড়ে লেজ উঁচিয়ে দে ছুট! প্রচণ্ড শক্তিতে দড়ির টানে, মাটিতে পুতে রাখা হাতখানিক
লোহার খুঁটি উপচিয়ে একছুটে মনিবের বাড়িতে- পিছন পিছন কুকুরটি।
অজানা সে ভয়-অনুভূতি এবার আতঙ্কে রুপ নিল ভুলুর। বার বার সে ফিরে চাইছে
কুয়াশার শিশির স্নাত সবুজ ঘাসের কার্পেটে মোড়া রাস্তাটির এপারের জনপদের ছায়া ছায়া
অববয়ের দিকে- সেখানে তার মনিবের বাড়ি, এ সময় তার সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় স্থল।
প্রচণ্ড ইচ্ছে হচ্ছে এখান থেকে এক ছুটে বাড়ি যাওয়ার। কিন্তু মনিবকে একা রেখে জেতেও
মন চাইছে না কুকুরটির।
ক্রল করে, যুদ্ধ ক্ষেত্রে সৈনিকরা যেভাবে এগিয়ে যায়- ভুলু সেভাবেই বসে বসে
মনিবের পায়ের কাছ থেকে সামনে চলে এল। ঘুমন্ত মনিবকে শুঁকল কয়েকবার, তারপর মনিবের
গাল চেটে দিল। মনিবের ঘুম তবুও ভাঙল না। অস্থিরতা এবং আতংক, এ দুটোর মিশেল ধ্বনি বেড়িয়ে এল
কুকুরটির মুখ দিয়ে। মানুষের ভয় মিশ্রিত কান্নার মতই শোনাল এ ডাক। আরও একবার ডেকে
উঠল সে। এবার আশা করছে মনিব জেগে উঠবে।
মনিবের ঘুম ভাঙল অবশেষে। উঠে বসল সে। বার দুয়েক হাই তুলে চারপাশে চাইল
একবার, তারপর চাঁদের দিকে।
‘তাহলে অনেক ক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম ভুলু, এবার চল বাড়িতে যাই’- দাঁড়াতে দাঁড়াতে
বলল মনিব।
মধ্য গগন থেকে চাঁদ সরে এসেছে পশ্চিমাকাশে। ভুলু এবং মনিবের প্রশস্ত ছায়া পড়ছে জমিনে। যখন তারা এখানে এসেছিল তখন ভুলু
ছিল মনিবের পিছু পিচু, এখন যাওয়ার সময় ভুলু আগে আগে চলতে লাগল মনিবের। তাদের হালকা ছায়াগুলোও চলছে সাথে
সাথে।
বাড়ির কাছে আসতে পূর্ব পরিচিত অথচ নতুন একটা গন্ধ নাকে এল কুকুরটির। আরও সতর্ক হল সে। খোলা গেটের ভিতর প্রবেশ করতেই
সে গন্ধ আরও জোরালো হল ভুলুর নাকে। অস্থির হয়ে উঠল সে
এবং ভয়ঙ্কর ঘড় ঘড় শব্দ তুলে বাড়ির এ মাথা ও মাথা ছুটোছুটি শুরু করে দিল।
মনিব হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করল ভিতরে। রাজহাঁসগুলোর অস্থির চিৎকার পথেই শুনতে পেয়েছে, অথচ ওগুলোর
অন্যদিনের মত চুপচাপ থাকার কথা। অন্যরকম আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল তার। রাজহাঁসগুলো মনিবের সবচেয়ে প্রিয়। হাটার গতি বাড়িয়ে দিল সে। সদা সতর্ক ভৃত্য ভুলু আগেই ছুট লাগিয়েছে বাড়ির পথে।
প্রথমেই সে গেল রাজহাঁসের ঘরের কাছে। তার আশংকাই সত্য। রাজহাঁসের ঘরের বেড়া লোহার নেট এবং বাঁশ দিয়ে তৈরি। বৃষ্টির পানি এবং বাতাসে লোহার
নেট মরচে ধরে ভঙ্গুর হয়ে গেছে। এবং সেখানে এক জায়গায়
নেট ও পুরনো বাঁশের বেড়া ভেঙ্গে ফোকরের মত সৃষ্টি হয়েছে। এখানেই হামলা চালিয়েছে অজানা প্রাণী।
মনিবের সাড়া পেতেই রাজহাঁসগুলো ডেকে উঠল একসাথে। সবগুলো ঘরের এক কোনায় জড়সড় হয়ে আছে। ভুলু লম্বা জিহ্বা বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে মনিবের পাশে এসে
দাঁড়াল। মনিব টর্চের আলো ঘুরিয়ে
সে স্থানে ফেলল আবার। ভুলু সামনে এগিয়ে নাক
নামিয়ে আনল। মাটি অনেকটাই শুষে
নিয়েছে- তারপরেও ছোপ ছোপ তাজা রক্ত স্পষ্ট ফুটে উঠেছে টর্চের আলোয়। সেখানে বিক্ষিপ্ত পরে আছে রাজহাঁসের
বুকের নরম লোম এবং ডানার বড় পালক।
পরদিন সকালবেলা ঘুম হতে উঠে ভুলুকে নিয়ে প্রাতঃভ্রমনে বের হল না মনিব। প্রথমেই কবুতর, মুরগি,
রাজহাঁসদের মুক্ত করে দিল এবং তাদের আহার পর্ব সমাধা করিয়ে কিছু সময়
চুপচাপ বসে থাকল পুকুরপাড়ের সিঁড়িতে। ঘণ্টাখানিক সেখানে বসে তারপর চলে গেল বাইরে।
মনিবের পিছু নিতে না পেরে ভুলু আবার আগের জায়গায় এসে বসে পড়ল। অন্যদিনের মত খাওয়া-দাওয়া শেষে
বাইরে চলে গেল না, দলবেঁধে একস্থানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। বাদামি মুরগি কিংবা সাদা মোরগগুলো
পুরো বাড়ি ছড়িয়ে পড়েছে। মিনি বসে আছে রাজহাঁসগুলোর
কাছাকাছি- সকালের মিঠে রোঁদ পোহাচ্ছে। ভুলু কোন আগ্রহ দেখাল না বিড়ালটির প্রতি- মনিবের নিষেধ
আছে ঝগড়ার।
ফার্মের কর্মচারী লোকটি এসে তার কার্যাদি শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্য। ভুলু সেখানে গেল, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে
থেকে আবার ফিরে এল পূর্বের জায়গায়। রাজহাঁসগুলো এই ফাঁকে চলে গেছে মাঠে।
মনিব ফিরে এল- তার পিছনে কিছু জিনিসপত্র হাতে অন্য একটি লোক। মনিবের রুমের
সামনে সবকিছু রেখে লোকটি চলে গেলে মনিব ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে গুলো নিয়ে। প্রথমেই লেগে
পড়ল নতুন নেট এবং বাঁশ দিয়ে রাজহাঁস ও মোরগ-মুরগির ঘর মেরামতে। ফার্ম হাউসে সে
ধরনের কোন আশংকা নেই- মজবুত লোহার তার এবং নেট দিয়ে তৈরি তার বেড়া।
দুপুর পর্যন্ত মনিব মেরামতের কাজ চালাল একটানা। তারপর রুমে গিয়ে বিশ্রাম
বিশ্রাম সেরে অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরল সে। দরজার কাছে বসে ভুলু সবকিছু দেখছে।
রুমের মেঝেতে বসে আছে মনিব, তার সামনে অনেক যন্ত্রপাতি- স্প্রিং, কলকব্জা থেকে
শুরু করে সোল্ডারিং আয়রন, ইলেক্ট্রনিক্স পার্টস, তার, সুইচ... ইত্যাদি ইত্যাদি।
বিকেল পর্যন্ত মনিব সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে রইল। কাজ শেষ হলে কোদাল হাতে
বেড়িয়ে এল সে এবং থামল রাজহাঁসের ঘরের সামনে। রাজহাঁস এবং মুরগিগুলোর ঘরের সামনের
ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় ইঞ্চি তিনেক গভীরতায় গোলাকার গর্ত তৈরি করল সে এবং সেখান থেকে
কোদাল দিয়ে সামান্য গভীর দাগ টানল রুম পর্যন্ত।
রুম থেকে যন্ত্রপাতি এনে বসিয়ে দেয়া হল সে গর্তে- তারপর মাটি চাপা দেয়া হল
সবকিছু। সেখান থেকে লম্বা ইলেকট্রিক তার সেই গভীর দাগ বরাবর বসিয়ে মাটিচাপা দেয়া
হল। গোলাকার জায়গার পরিধি থেকে আরও অনেকটা দূরে আরেকটি পরিধি রচনা করে দাঁড়িয়ে রইল
সরু সরু কয়েকটি কাঠি।
সন্ধ্যা হলে মনিব ফার্ম হাউস থেকে একটি মৃত মুরগি এনে নামিয়ে রাখল সে
বৃত্তের কেন্দ্রে। ভুলু শুঁকতে গেল মুরগি, কিন্তু মনিব ধমক লাগাল।
‘ভুলু, ঐই যে কাঠিগুলো দেখছিস, ওগুলোর একটির মাথায় বসানো ইনফ্রারেড এল ই
ডি(LED) এবং অপরতির মাথায় সেন্সর (sensor), মাঝখানের কাঠিগুলোতে প্রতিফলক খুদে
গ্লাস। এল ই ডি থেকে নির্গত অদৃশ্য আলোক রশ্মি প্রতিফলক গুলোকে পেড়িয়ে বৃত্ত রচনা
করে সেন্সরের উপর পড়েছে। কোন প্রাণী এই বৃত্ত অতিক্রম করলে অদৃশ্য আলো বাধাপ্রাপ্ত
হয়ে মাটির নিচে রাখা সার্কিডটি সচল করে দিবে এবং সামান্য সময় পরে বৈদ্যুতিক রিলে
সক্রিয় করে তুলবে কলকব্জার সাথে বসানো শক্তিশালী দুটো স্প্রিং কে। এবং স্প্রিং এর
সাথে বসানো ফাঁদ আটকে দিবে অনুপ্রবেশকারীকে। আশা করি পুরো প্রক্রিয়াটি কাজ করবে
সুন্দর ভাবে’।
মনিব কুকুরটিকে বেঁধে রাখল রুমের সামনে। এখান থেকে রাজহাঁসের ঘর অনেকটা
দূরে- ফার্ম হাউসের পিছনে, দেখা যায় না।
মনিবের আচরণে ভুলু অবাক হলেও কোনরূপ প্রতিবাদ করল না। বসে পড়ল সেখানে।
সেদিন রাতে কিছুই ঘটল না, ঘটল পরদিন মধ্যরাতের পরে।
আগের দিনের মত ভুলুকে বেঁধে রাখা হল একই স্থানে- সন্ধ্যার পরপরই। মনিব তার
রুমে চলে গেলে ভুলু বসে রইল সেখানে।
ভুলুর চোখে ঘুম চলে এসেছিল- আসলে ঘুম এবং জাগ্রত অবস্থার মাঝামাঝি রয়েছে
কুকুরটি। চোখ দুটো বন্ধ থাকলেও কান কিন্তু সতর্ক। সেই সাথে মনিব এবং পোষা
প্রাণীগুলোর গন্ধও সে বিচার করতে পারছে।
এভাবে ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছিল কুকুরটি জানে না। মনিবের রুমের আলো তখনও
জ্বলছে, কিন্তু
খোলা জরজা দিয়ে কোন শব্দ আসছে না সেখান থেকে। এক সময় চেয়ার টানার শব্দ হল-
তারমানে মনিব জেগেই আছে।
কিন্তু ভুলুর ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার কারন তা নয়, তার চিরশত্রু প্রাণীটির গন্ধ
পাচ্ছে সে। চাপা ঘড় ঘড় করে উঠল কুকুরটি এবং একই সাথে মনিবের নিচু ধমক খেয়ে চুপ
মেরে গেল।
সে রাতেও জ্যোৎস্না ছিল। কিন্তু সতর্ক কুকুরটির চোখে কোন ছায়া ধরা পরল না
অথচ গন্ধ ঠিকই পাচ্ছে প্রাণীটির। যদি মনিবের নিষেধ এবং বাঁধা না থাকত তবে ভয়ঙ্কর
গর্জন তুলে সে ঝাঁপিয়ে পড়ত চিরশত্রু প্রাণীটির উপর।
রাজহাঁসগুলো সতর্ক হয়ে ডেকে উঠল একবার, বাদামি মুরগি গুলোও সতর্কতা প্রকাশ
করল তাদের সাথে। আরও একটু নীরবতা...।
ফার্ম হাউসের পিছন থেকে ধুপ ধাপ শব্দ ভেসে এল। রাজহাঁসগুলো তীক্ষস্বরে ডেকে
উঠল একযোগে। কক কক শব্দে বাদামি মুরগি ডেকে উঠল দু তিনটে। এবং পরপরই আর্তনাদ ভেসে এল কোন প্রাণীর।
মনিব রুম থেকে বেড়িয়ে এল তড়িৎ। ঘড় ঘড় শব্দ তুলে লাফাতে থাকা কুকুরটির বাঁধন
খুলে দিল সাথে সাথেই। ভুলু শব্দের উৎসের দিকে ছুটল ক্ষিপ্রগতিতে। মনিবও ছুট লাগাল,
কিন্ত তার সাথে তাল মিলাতে না পেরে পিছিয়ে পরল।
ভুলু কোন প্রকার দিদ্ধা করল না কিংবা মনিবের জন্য অপেক্ষা অথবা হুকুমের
তোয়াক্কা না করে ঝাঁপিয়ে পরল ফাঁদে আটকা পরা প্রাণীটির উপর। তীক্ষ্ণ দাতগুলো দিয়ে
এক নিমিষেই ছিঁড়ে দু ভাগ করে ফেলল চিরশত্রু প্রাণীটির কণ্ঠনালী।
‘মুরগিগুলো দিম দিতে শুরু করেছে ভুলু’- মুরগিগুলোর
থাকার ছোট ঘরের ভিতর থেকে বলল মনিব, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কুকুরটির উদ্দেশ্যে।
দু হাত ভর্তি বাদামি ডিম নিয়ে ছোট দরজা দিয়ে বেড়িয়ে এল মনিব। ভুলু এক পা
সামনে চলে এল। মনিবের বাড়ানো হাতের ডিমগুলো শুকে দেখল একবার, মসৃণ বাদামি ডিমগুলোর
খোলস চেটে দিতে চাইল- কিন্তু মনিব মৃদু ধমক লাগালে মুখখানা সরিয়ে আনল বুদ্ধিমান
কুকুরটি।
‘ভুলু মিয়া, মুরগিগুলোকে এখন বেশি যত্ন করতে হবে। আহা, আজ থেকে আমার ডিম
কিনে খেতে হবে না’- পরম উচ্ছ্বাসের সাথে কথাগুলো বলতে বলতে মনিব চলল রুমের দিকে।
‘আহ, আমার সোনার মুরগি’- মনিব রুম থেকে দু হাত ভর্তি খাদ্য বসে পড়ল কথাগুলো
বলতে বলতে। পরিচিত হাঁক ছাড়ল মুরগিগুলোর প্রতি। মনিবের চেনা আহবানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
থাকা মুরগিগুলো পাখা ঝাপটে দৌড়ে চলে এল এবং মনিবের হাত থেকে খাদ্য খেতে লাগল ঠুকে
ঠুকে।
‘জানিস ভুলু, মাস ছয়েক পূর্বে ফার্মে একবার ককরেল (লেয়ার মোরগের বাচ্চা)
তুলেছিলাম, সেখানে এই মুরগিগুলো ছিল। দু মাস পরে পাঁচটি মোরগের বাচ্চা এবং এই
চোদ্দটি মুরগি রেখে অন্যগুলো বিক্রি করে দিলাম। এখন মোরগের বাচ্চাগুলো কত বড়
হয়েছে, মুরগিগুলোও ডিম দিতে শুরু করেছে’- বাদামি মুরগিগুলোর দিকে চেয়ে বলল মনিব।
‘একদিন যখন আমার পর্যাপ্ত টাকা হবে, ব্রয়লার মুরগিগুলোর পাশাপাশি লেয়ার
মুরগির চাষও করব। প্রতিদিন হাজার হাজার ডিম সংগ্রহ করব ট্রে থেকে- ভাবতে পারিস?’
ভুলু কিছুই ভাবছে না, কিন্তু মনিবের উচ্ছ্বাসটুকু ধরতে পেরেছে সহজেই।
মনিবের মন আজ খুবই ভাল- এই ‘ভাল’ বুঝতে কোন সমস্যা হয়না কুকুরটির। আবার যখন মনিবের মন খারাপ থাকে সে বুঝতে পারে
তার অভিব্যাক্তিতে-ভাষায়।
‘দাড়া, তোকেও প্রসাদ দিচ্ছি’- বলে মনিব একছুটে রুমে চলে গেল, ফিরে এল দুটো
ডিম হাতে নিয়ে। ভুলুর সামনে নামিয়ে রাখল ডিম দুটো। ভুলু গন্ধ শুঁকল, তারপর মুখ
সরিয়ে নিল- সকালের মনিবের ধমকের কথা মনে পড়েছে তার।
‘ভুলু, যা, খা’- মনিব অনুমতি দিলে কুকুরটি আবার নাক নামিয়ে আনল ডিমের উপর। গন্ধ শুকে চেটে এবার সন্তর্পণে
দাত বসিয়ে দিল দিমের উপরে। ডিম ফেটে গেল। ডিম দুটো চেটেপুটে খেয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশে
লেজ নাড়তে লাগল সে মনিবের উদ্দেশ্যে।
‘ঠিক আছে যা, প্রতিদিন তোকে দুটো করে ডিম খেতে দিব। কিন্তু তুই সবসময়
পাহারা দিবি যেন অন্য কোন প্রাণী ডিমগুলো খেতে বা নষ্ট করতে না পারে। আর খবরদার।
তুই কিন্তু ভুলেও একটা ডিম চুরি করে খাবি না, ঠিক আছে?’
দুপুরের পর মনিব চলে গেলে ভুলু অভ্যাস মত বসে পড়ল মনিবের ঘরের দরজার সামনে।
বসে বসে ঝিমাতে লাগল সে। খুব বেশি সময় পার হয়নি, মুরগি এবং মোরগগুলোর সতর্ক ডাক
শুনতে পেল সে। চোখ মেলে চাইল ভুলু, বাতাসে গন্ধ শুকে বুঝতে চেষ্টা করল সবকিছু।
সামনের পা দুটো প্রসারিত করে দেহ মাটির সমান্তারালে বাঁকিয়ে আড়মোড়া ভাঙল
কুকুরটি,তারপরেই দেখতে পেল প্রাণীটিকে।
পুকুরের পানি থেকে একরাশ কচুরিপানা-শ্যাওলা গায়ে মেখে পাড়ে উঠে এসেছে
প্রাণীটি। চারপায়ে বুকে ভর করে সরু জিহব্বা বার বার বের করে হেলেদুলে এগিয়ে আসছে
কদাকার প্রাণীটি। অল্প দূরত্বে দাঁড়িয়ে মোরগ-মুরগিগুলো সতর্কতা প্রকাশ করছে সে
প্রাণীটির দিকে চোখ রেখে।
ভুলু ছুটে গিয়ে প্রাণীটিকে কামড়ে দিতে চাইল, কিন্তু তার লম্বা লেজখানা
চাবুকের মত ছুটে আসতে দেখে সে পিছিয়ে গেল। কুকুরটির বুঝতে সমস্যা হল না, মোটা
চামড়ার বিদঘুটে লেজের বাড়ি খেলে আর রক্ষা নেই।
প্রাণীটিকে আর কামড়ে দেয়ার চেষ্টা করলনা কুকুরটি। মুখখানা সামনে বাড়িয়ে ঘেউ
ঘেউ করতে লাগল সমানে।
ফার্মের কর্মচারী লোকটি ছুটে এল ফার্ম ঘরের ভিতর থেকে। প্রাণীটিকে দেখেই
একটি ইট তুলে নিল সে এবং সামনে এগিয়ে এসে ইটখানা ছুঁড়ে মারল সেদিকে। অব্যর্থ
লক্ষ্যভেদ।
কিন্তু গুইসাপ টিকে সামান্য আহত হয়েছে বলে মনে হল না, তবে সে উল্টো দিকে
ঘুরে নেমে যেতে চাইল পুকুরের পানিতে।
দিন কয়েক পরে একদিন সকালবেলা মনিব মুখ কালো করে বলল, ‘ ভুলু, ডিমগুলো যেন
কিসে খেয়ে যাচ্ছে। চোদ্দটি মুরগির বারোটিই নিয়মিত ডিম দিতে শুরু করেছে, অথচ পাচ্ছি
মাত্র পাঁচ-ছয়টা। ভুলু, বাপ আমার! একটু লেজ তুলে পাহারা দিস’।
তার হুকুম ছাড়া কুকুরটি যে ডিমগুলো স্পর্শ করবে না, এর প্রমান মনিব
কয়েকবারই পেয়েছে। আবার মুরগিগুলো তো অসুস্থ হয়ে পরেনি? মনিব ভাবতে বসল। নাহ, সে
রকম আলামত তো চোখে পরেনি। সবগুলোই পূর্ণ সুস্থ-সবল।
এর ঠিক দু দিন পরে ব্যাপারটি খোলাসা হয়ে গেল। পরিকল্পনা মাফিক মনিব পাহারায়
বসেছিল লেয়ার মুরগির ঘর থেকে অল্প দূরত্বে লেবু গাছের ঝোপের আরালে বসে। ভুলুও তার
পাশে বসে দৃষ্টি রাখছিল সেদিকে।
প্রাণীটি পুকুর থেকে ডাঙ্গায় উঠে হেলেদুলে চলতে লাগল ডিম পাড়ার ঘর অভিমুখে।
মুরগিগুলো আসে পাশে ছিল এবং বরাবের মত সতর্কতা প্রকাশ করল ঝুটি নাচিয়ে।
লেয়ার মুরগির ঘরের সামনে চলে এলে বিশাল গুইসাপটিকে মনিব এবং ভুলু দুজনেই
দেখে ফেলল। প্রবৃত্ত বসে ভুলু ঘড় ঘড় শব্দ করে ছুটে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু মনিব
নিরস্ত করল তাকে। গুইসাপটি মাথা ঘুরিয়ে, জিহব্বা নাচিয়ে দু পাশে একবার দেখে নিল
মাত্র- তারপর ঢুকে গেল মুরগিগুলোর ঘরের দরজা দিয়ে।
‘ভুলু,
যা ধর’- গুইসাপের পুরো দেহ এবং লম্বা লেজখানা ছোট দরজার ভিতর চলে গেলে মনিব
নির্দেশ দিল কুকুরটিকে। ভুলু মনিবের হুকুম পেয়ে লাফিয়ে ছুটল সেখানে, হকিস্টিক হাতে
নিয়ে মনিবও চলল দৌড়ে। এবার আর বাছাধন গুইসাপের রক্ষা নেই।
সরীসৃপ প্রাণীটি কেবল মাত্র ডিমগুলোর একটি মুখে পুরেছে, এমন সময় কুকুরটির
সাড়া পেয়ে উল্টো ঘুরে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিল। ভুলু ঘরের দরজা দিয়ে ঢুকে
গুইসাপটির মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে, কিন্তু কামড় দিতে সাহস পাচ্ছে না।
ইতিমধ্যে মনিব পৌঁছে গেছে সেখানে। মনিবকে দেখে ভুলুর সাহস বেড়ে গেল
কয়েকগুন। কৌশলে কামড়ে দিতে চাইল প্রাণীটির মাথা, কিন্তু বিদঘুটে প্রাণীটি সাপের
ছোবলের মত লেজ চালাল। সদ্য মেরামতকৃত ঘরের মজবুত নেটের বেড়া বেঁকে সামান্য ছিঁড়ে
গেল লেজের আঘাতে। পরপর কয়েকটি আঘাত হানল সরীসৃপটি। সতর্ক কুকুরটি প্রতিবারই পিছিয়ে
গিয়ে নিজেকে রক্ষা করল, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হল ঘরের বেড়া।
ভুলু নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ঘেউ ঘেউ করে চলেছে, ইতিমধ্য সে বুঝে গেছে
এছাড়া তার কিছু করার নেই।
‘ভুলু, বেড়িয়ে আয়’- মনিবের নির্দেশ প্রথমে বুঝতে পারলনা কুকুরটি। আরও দু
তিনবার বললে সে পিছিয়ে এল দরজার কাছে।
গুইসাপটি পড়েছে মহা বেকায়দায়। সব সম্ভাবনাই চেষ্টা করে দেখেছে- কিন্তু
একমাত্র দরজা ছাড়া বেড়িয়ে যাবার উপায় নেই। কুকুরটিকে পাত্তা দেয়ার কারন নেই,
সমস্যা হচ্ছে মানুষটি। তবুও তাকে পালাতে হবে।
ছোট দরজার একপাশে সামান্য সরে অবস্থান নিয়েছে মনিব। ভুলু দরজার সামনে ঘেউ
ঘেউ করে চলেছে। প্রাণীটি আবার কয়েকবার লেজ চালিয়ে বাধ্য করল কুকুরটিকে আরও পিছনে
সরে যেতে।
গুইসাপটির কদাকার শরীরের অর্ধেকটা দরজার বাইরে বেড়িয়ে এলে হাতের হকিস্টিক প্রচণ্ড
গতিতে নামিয়ে আনল মনিব ঠিক তার মাথার উপর।
অন্য কোন প্রাণী হলে তার দফারফা শেষ হয়ে যেত এক আঘাতেই। কিন্তু গুইসাপটি লেজ চালাল সাথে সাথে। লেজের আঘাতে বাঁশের খুঁটি কেঁপে
উঠল।
মনিবের আরও দুটি আঘাতে গুইসাপটি কাবু হয়ে গেল, তবুও মরিয়া
হয়ে বেড়িয়ে এল দরজার বাইরে। শরীরটাকে টেনে
টেনে শেষবারের মত পালাতে চাইল। আত্মরক্ষার প্রধান হাতিয়ার লেজটি চাবুকের মত
চালানোর অবস্থা এখন আর নেই প্রাণীটির।
মনিবের হাতিয়ার প্রস্তুত ছিল মাথার উপরে, ইচ্ছে করলেই আরও কয়েকটি আঘাত করে
প্রাণীটির ভবলীলা সাঙ্গ করে দিতে পারে, কিন্তু হকিস্টিকটি ধীরে নামিয়ে আনল মাটির
উপর। বেচারার যথেষ্ট শিক্ষা হয়েছে- প্রানে মারার ইচ্ছা নেই মনিবের।
ভুলু প্রাণীটির দুর্বলতা বুঝতে পেরে কামড়ে ধরতে চাইল, মনিবের ধমক শুনে
নিরস্ত হল এবং গুইসাপটির নিকট থেকে মুখ সরিয়ে এনে মনিবের দিকে গলা বাড়িয়ে ভ-অ-উ
ডাক তুলল একবার। অর্থাৎ গুইসাপ বাছা তুমি চলে যাও, মনিবের নির্দেশে তোমায় কিছু বলব
না!
মনিব বসে পড়ল সেখানেই- উত্তেজনায় ক্লান্ত। সরীসৃপটি খুবই ধীর গতিতে এগুচ্ছে
পুকুরের দিকে, ভুলু তার পিছনেই আছে- কিন্তু কোন প্রকার ঘেউ ঘেউ কিংবা বাধাও দিচ্ছে
না। একসময়য় গুইসাপটি পানিতে নেমে গেল, ভুলু ফিরে এল মনিবের কাছে।
‘ব্যাটার উচিত শিক্ষা হয়েছে, আর কোনদিন ডিম চুরি করতে আসবে না- কি বলিস
ভুলু?’
কিন্তু কদিন পরেই আবার ডিম চুরি হতে লাগল নিয়মিত।
‘বদটাকে মেরে ফেলাই উচিত ছিল ভুলু। এবার পেলে দেখিস সত্যই খতম করে ফেলব।
বদমাশটাকে এত মার দিলাম অথচ দু দিন পরেই সব ভুলে গেল। একেই বলে গুইসাপের চামড়া!’ একটু থেমে মনিব বলল, ‘ঠিক
আছে আজই পাহারায় বসছি’।
লেবু গাছের ঝোপের আড়ালে পাহারায় বসল দুজন পূর্বেকার মত। ঠিক দু ঘণ্টা পরে
শিকার এসে হাজির হল।
‘অ্যাঁ!’- মনিবের মুখ ফসকে শব্দটি বেড়িয়ে গেল চোর ব্যাটাকে দেখে।
ভুলুর আকারের অর্ধেক সাদা কালো ছোপওয়ালা দেশী মেয়ে কুকুর। লেয়ার মুরগির
ঘরের সামনে চলে এল কুকুরটি চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি রেখে। নেটের ভিতর দিয়ে ডিমগুলো
দেখল একবার, বাতাসে গন্ধ শুঁকল তারপর আরও সতর্ক দৃষ্টি চারপাশে বুলিয়ে গ্রাম্য
মেয়ে কুকুরটি চলল দরজার দিকে।
সেদিন গুইসাপের কারনে ছোট ঘরটির সামান্য ক্ষতি হয়েছিল, অনেকগুলো ডিমও
গিয়েছিল ভেঙ্গে, মনিব তাই কুকুরটিকে দরজার ভিতরে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল না-
আক্রমনের নির্দেশ দিল ভুলুকে।
প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসা ভুলুকে দেখে ফেলল কুকুরটি। সাথে সাথে দু পায়ের
ফাঁকে লেজ নামিয়ে আর্তনাদ করে উল্টো দিকে ঘুরে পালাতে চাইল কুকুরটি, কিন্তু দশ কদম
পাড় হবার পূর্বেই ভুলু ধরে ফেলল এবং মুহূর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়ল চোর বদমাশটির উপর।
মনিব ভুলুকে নিরস্ত না করলে হয়তবা কুকুরটিকে সে মেরেই ফেলত। দুর্বল নেড়ি
কুকুরটির যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে। মনিবের মাথায় হঠাৎই চিন্তাটি উদয় হল- মেয়ে কুকুরটিকে
ভুলুর সঙ্গী বানালে কেমন হয়?
যেই ভাবনা, সেই কাজ। মনিব সে কুকুরটিকে আদরের ডাক তুলে মাথায় হাত বুলাল
কয়েকবার, অবশ্য তার ভয় হচ্ছিল- যদি কামড়ে দেয়।
মেয়ে কুকুরটির গলায় দড়ি পরানো হল। মনিব তাকে টেনে নিয়ে চলল রুমের সামনে।
শিকারি ভুলুর কামড়ের আঘাতে আহত কুকুরটি, কয়েক জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে, যদিও
ক্ষতগুলো গভীর নয়।
মনিব এক হাতে লাঠি এবং অন্যহাতে ওষুধ-তুলা নিয়ে কুকুরটির পরিচর্যায় লেগে
গেল। মেয়ে কুকুরটির চোখে আতঙ্ক থাকলেও সে বুঝে নিয়েছে এ মানুষটির কাছে তার কোন
ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।
ক্ষতস্থান গুলোতে ওষুধ লাগানো শেষে কুকুরটিকে বেঁধে রেখে মনিব রুমের ভিতরে চলে
গেল এবং একটু পর ফিরে এল প্লেট ভর্তি খাদ্য নিয়ে। পুরনো প্লেটটি নামিয়ে রাখল গ্রাম্য
কুকুরটির সামনে।
খাবার দেখে ভুলু এগিয়ে এসেছিল কিন্তু মনিবের ধমক খেয়ে পিছিয়ে গেল।
ক্ষুধার্ত গ্রাম্য কুকুরটি গ্রোগ্রাসে গিলতে লাগল খাবার এবং এই প্রথম বারের মত
মনিবের আনুগত্য প্রকাশ করল লেজ নাড়িয়ে। মনিব সেদিকে চেয়ে হাসি দিল, কুকুরটির মাথায়
হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘তোদের মত ইতর প্রাণীদের ভালবাসা থাকে পেটে, মানুষের মনে।
আবার মানুষের জীবন সংগ্রাম এই পেটকে ঘিরে। তাহলে মানুষের সাথে তোদের পার্থক্য
কোথায়? আবার দ্যাখ, তোরা মানুষের থেকে মহৎ। কিভাবে? মানুষ নিজের পেটের তাগিদে অপর
দশ জনের পেটে লাথি মারতে পিছপা হয় না। কিন্তু তোরা নিজের পেট নিয়েই সন্তুষ্ট
থাকিস। যাকগে, তোর বন্ধন এখনই মুক্ত করে দিলাম। ইচ্ছে হলে থাকিস, না হলে চলে যাস।
আমার কিছুতেই কিছু যায় আসে না’।
মনিব কুকুরটির বাঁধন খুলে দিল। গ্রাম্য মেয়ে কুকুরটি পালিয়ে না গিয়ে ঠিকঠাক
থেকে গেল মনিবের আশ্রয়ে। ভুলুর সাথে তার মিতালি হতে সময় লাগল না।
দিন কয়েক পরে একটি মজার ঘটনা ঘটল।
একটি কাক চুপিসারে ডিম পারা মুরগির ঘরে গিয়ে ঠুকে ঠুকে ডিম খেতে লাগল। বজ্জাত পাখিটাকে মনিব পছন্দ করে
না ভুলু জানে। মনিবের শিক্ষা পেয়েছে কুকুরটি- বাড়িতে কোন কাক দেখলে ছুটে গিয়ে
তাড়িয়ে দিত এবং পাখিটি উড়ে গিয়ে ডালে বসলে সে ঘেউ ঘেউ করত গাছের নিচে দাঁড়িয়ে।
কালো পাখিটিকে হঠাৎই ডিম ভক্ষণরত অবস্থায় দেখে ফেলল ভুলু এবং একছুটে চলে গেল ছোট
ঘরটির ভিতরে, তার পিছনে পিছনে মিসেস ভুলু! মনিব মেয়ে কুকুরটির নাম তাই দিয়েছে। এখন
তাকে মিসেস ভুলু বলে ডাকলে একছুটে চলে আসে মনিবের কাছে।
কাকটিকে হত্যা করতে কোন সমস্যাই হল না ভুলুর। দাতে কামড়ে ধরে মৃত পাখিটিকে
নিয়ে বাইরে এল এবং মনিবের রুমের দরজার সামনে নামিয়ে রেখে সেখানে বসে অপেক্ষা করতে
লাগল মনিবের জন্য।
অদূরে একটি গাছের ডালে কয়েকটি কাঁক বসে ছিল। নিহত কাঁকটিকে দেখেই অগুলো কা
কা চিৎকার শুরু করে দিল- যেন স্বজাতির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছে। ভুলু এবং মিসেস
ভুলু দু জনেই ঘেউ ঘেউ করে উঠল। তিন চারটি কাঁক উড়ে চলে গেল, অন্যগুলো গাছের ডালে
বসে অব্যাহত রাখল তাদের চিৎকার।
পনের মিনিটও পাড় হয়নি, শত শত কাকে ভোরে গেল পুরো বাড়ি। কেউ গাছের ডালে, কেউ
মাটিতে- যে যেখানে পারে অবস্থান নিয়ে চিৎকার করছে। মৃত পাখিটি ঘিরে আকাশে চক্কর
দিচ্ছে আরও অসংখ্য কাঁক।
দু চারটি কাঁক হলে অবশ্য অন্য কথা ছিল, কিন্তু এতগুলো কাঁক দেখে ভুলু সত্যি
ভড়কে গেল। তাদের কা কা রবের সমান তালে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। মেয়ে কুকুরটিও তাল মিলাল
তার সাথে।
আরও অনেকক্ষণ পর মনিব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে মৃত কাঁকটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিল
অনেক দূরে। কাকগুলো সব চলে গেল সেখানে।
ভুলু মনিবের সব নির্দেশ সহজেই বুঝতে পারত এবং একই নির্দেশ তাকে দ্বিতীয়বার
মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হত না। এই যেমন, মনিবের একবারের নির্দেশ মেনে কখনও লেয়ার
মুরগির ঘরের দরজা খোলা পেয়েও ডিম চুরি করত না। কিন্তু মিসেস ভুলুর বেলায় তা হল না।
লোভ সামলাতে না পেরে কয়েকবার ডিম চুরি করে খেয়ে ফেলল। দু বার ভুলুও তাকে ডিম চুরি
করে খেতে দেখল, কিন্তু বুঝতে পারলনা তার করনীয়তা- সে কুকুরটিও যে মনিবের পোষা।
কথায় আছে, চোরের দশ দিন গৃহস্থের একদিন। মিসেস ভুলুর অবস্থা তাই হল। মনিবকে
কুকুরটির পাছায় বেত্রাঘাত করতে দেখে অবাক হল ভুলু, কিন্তু একাত্মতা প্রকাশ করল
মনিবের সাথে- প্রথম দিনের মত মেয়ে কুকুরটির ঠ্যাং কামড়ে ধরতে চাইল। মনিব ভুলুকে
নিরস্ত করল ঠিকই, তবে তাড়িয়ে দিল সে কুকুরটিকে ।
মনিবের বাড়িতে আরও পাঁচটি সদস্য ছিল- এক বেজি পরিবার। এগুলো মনিবের পোষা
ছিল না, বলা চলে আশ্রিত। পুকুরপারে একটি শ্যাওড়া গাছ ছিল, সে গাছের গোঁড়ায়
প্রকৃতিসৃষ্ট গর্তে বাসা বানিয়েছিল বেজি পরিবার। দুটো বেজি বড়, অন্য তিনটে ছোট- বড়
দুটোর ছানা। বেজি গুলো দেখতে খুব সুন্দর। মনিবকে দেখে অভ্যস্ত হলেও কাছাকাছি হতে
সাহস পেত না। প্রায়শই মনিব সে গর্তের কাছে
মৃত মুরগি ফেলে আসত এবং বেজিগুলো ভক্ষণ করত সবাই মিলে। কতদিন মনিবের সাথে
পুকুরপাড়ের সিঁড়িতে বসে অপলক দেখেছে ভুলু এ আহার পর্ব। প্রথমদিকে বেজিগুলো দেখতে
পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইত, কিন্তু মনিবের নির্দেশে অভ্যস্ত বলে সেগুলোকে আর কিছুই
বলত না কুকুরটি, এমনকি তার পাশ দিয়ে চলে গেলেও।
ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। - ৪ ( শেষ অংশ )
Subscribe to:
Posts
(
Atom
)