নতুন দিন
দূরে... অন্ধকারে, পূর্ব দিগন্ত প্রান্তসীমায় উদিত চাঁদ তার একফালি সরু বক্রতা
নিয়ে আপন পথ পাড়ি দিয়েছে অনেকটা। সেই সাথে শতসহস্র নক্ষত্র দ্যুতি এপাড়ের ভূমিকে
রাত্রির বন্ধনে আরেকটু সামনে প্রসারিত করেছে। জনপদের মানুষগুলো ঘুমিয়ে আছে, অন্যরা
জেগে আছে প্রহরীর মত- সময় সৃষ্ট আতংকে।
রাত্রি নিরব। ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক, প্রকৃতি সৃষ্ট হাজারো গুঞ্জন...
কুকুরের বেসুর গলার কান্না- মাঝে মাঝে শিয়ালের সন্মিলিত হাকঃ সবই রাত্রির বৈশিষ্ঠ।
জনপদের না ঘুমনোর দলের চোখে পরিচিত শব্দ গুঞ্জনের নির্দিষ্ট লয়ের ছন্দের মাদকতায়
স্পষ্টত ঘুমের অভিবার্ব- সেই সাথে সারাদিনের কষ্টকর পরিশ্রমের ক্লান্তি তো আছেই।
কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে তা তুচ্ছ।
হঠাৎ, গ্রামের শেষ মাথায় ছুটন্ত পদশব্দ পাওয়া গেল। জেগে থাকা মানুষগুলোর
ইন্দ্রিয় সতর্ক হয়ে উঠল। ধুপ-ধাপ চলার আওয়াজ ক্রমশ এগিয়ে আসছে। আরও কাছে এসে শব্দ
থেমে গেল। জোরে করাঘাতের শব্দ হল
দরজায়।
প্রহরীর মত জেগে থাকা লোকগুলো বেড়িয়ে এল তাদের গৃহ-আঙিনা ছেড়ে। প্রত্যেক
পরিবারের সদস্যরা পালাক্রমে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে অশনি আশঙ্কায়। অন্ধকারের মাঝে
হ্যারিকেন হাতে দু তিন জন লোক দৌড়ে এল তাদের কাছে। বোমার মত তাদের মুখ দিয়ে বেড়িয়ে
এল- ‘ মিলিটারি আসছে, পালাও’।
পাঁচ মিনিটের মধ্য কোলাহলে পরিণত হল ঘুমন্ত জনপদ। সবাই প্রচণ্ড আতঙ্কিত। গোয়াল
ঘর থেকে গরু ডেকে উঠল কয়েকবার। গ্রামের নেড়ি কুকুরগুলো ডাকছে ক্ষণে ক্ষণে। সবকিছু
ছাপিয়ে উত্তর হতে ভেসে এল যান্ত্রিক শব্দ। ক্ষীণ এবং বহুদুর হতে। শব্দের উৎসমূলে
সতর্ক কর্ণ ইন্দ্রিয় ধাবিত করল কয়েকজন। এক সময় সমস্ত গ্রামবাসী শুনতে পেল- সামরিক
যান চলাচলের শব্দ।
কেউ একজন আঁচড়ে-পাঁচরে অন্ধকারের মাঝেই উঠে পড়লো আম গাছের মগডালে। দু-চারটে
চড়ুই কিচির মিচির সব্দে বিরক্তি প্রকাশ করল পতিক্রিয়ায়। একটি বাদুরও উড়ে গেল আমগাছের
উপর দিয়ে। সামনের চিকন ডালটি একটু ফাঁক করে ধরল সে। ডাল-পাতায় মোড়া অন্ধকার
ফ্যাঁকাসে হল সামান্য।
বহুদূরে অনেকগুলো ক্ষীণ আলোর আভাস পাওয়া গেল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল সে।
আলোগুলো জোড়ায় জোড়ায় অল্প দূরত্বে পর পর এগিয়ে আসছে এবং স্পষ্ট হচ্ছে। যেভাবে গাছে
উঠেছিল সে, সেভাবেই নেমে এল দ্রুত।
অন্ধকারের মাঝে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এল সবাই।
যান্ত্রিক শব্দ আরও কাছে এগিয়ে আসছে। এক সময় থেমে গেল। পরক্ষণেই গ্রামবাসী
শুনতে পেল ভারী বুট পরা ছুটন্ত পদশব্দ। একটি দুটি নয়... অনেক। দু পাশ থেকে গ্রামকে
ঘিরে ধরার জন্য এগুচ্ছে মিলিটারি বাহিনী।
লিয়াকত মিয়া ঘুমিয়ে পড়েছিল। চেয়ারে বসে বসে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে- খেয়ালই নেই।
ঘুম ভাঙল জানালায় করাঘাতের শব্দে। সামান্য পরে দরজায়ও নক হল-
‘লিয়াকত ভাই, আমি শ্যামল’- উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল অগন্তুক।
টেবিল হাতড়ে টর্চ লাইট জ্বালাল। সন্তর্পণে উঠে দরজা খুলল সে।
‘পাইকপাড়া দিয়ে মিলিটারি আসছে- শব্দ শুনেন নাই?’
‘না তো’- অবাক এবং ভয় মিশ্রিত স্বরে বলল লিয়াকত। ... সামান্য নীরবতা, এর মাঝে
লিয়াকতও শুনতে পেল গ্রামের মেঠো রাস্তা ধরে আসা সামরিক কনভয় চলাচলের শব্দ। এবার সে
সত্যিই বিচলিত হয়ে উঠল। পাইকপাড়ায় রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। ছিল- একারণেই, গত
রাত্রেই এ গ্রামের দশ-বার জনের মুক্তিযোদ্ধার দল গুড়িয়ে দিয়েছে ক্যাম্পটি। তবে
জমির মোল্লাকে ধরতে পারেনি। রাতেই পুরো পাইকপাড়া তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল, কিন্তু
জমির মোল্লাকে পাওয়া যায় নি। তার এক সাঙ্গাতের কাছে খবর মিলল- পাকিস্থানী কাম্পে
আশ্রয় নিয়েছে সে। এবং এর দ্বিতীয় রাতেই মিলিটারির আগমন। জমির মোল্লাকে পেলে পুরো
একটা ম্যাগাজিন খালি করবে পিচাশটার বুকে- ঘৃণায় একদলা থু থু উঠোনে ফেলল লিয়াকত
মিয়া।
একই সাথে অনেকগুলো পদশব্দ শুনতে পেল দুজনেই। হ্যারিকেন-টর্চ লাইটের আলোগুলো
এগিয়ে আসছে তাদের দিকে। উত্তেজিত কথাবার্তা কানে এল- ওরা আসছে।
তারা দুজন এগিয়ে এল দলটির মুখোমুখি। রঞ্জিত, কামাল, ইয়াকুব, হাবিব এবং অন্যরা।
দশ বার জনের দল। মুক্তিযোদ্ধা।
আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে সিগ্ধান্ত হল। ইতিমধ্য গ্রামবাসী সবাই একত্রিত হয়ে
গেছে। সদ্য ঘুম থেকে জেগে উঠা
সবার অবয়য়ে ভয়ের প্রচ্ছন্নতা ফুটে আছে গভীর ভাবে। দলে সবাই আছে, শিশু থেকে শুরু
করে বৃদ্ধ মহিলা- সবাই। লিয়াকত আলী একছুটে তার বাড়িতে চলে গেল। তার দশ মাসের
অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ঘুমাচ্ছে অঘরে। তাকে ডেকে তুলল সে। সেই সাথে বৃদ্ধ বাবা-মা
এবং একমাত্র ছোট বোনকে। সবাই এসে সমবেত হল গ্রামবাসীর সাথে।
মুক্তি যোদ্ধার দল হাতিয়ার নিয়ে প্রস্তুত হয়ে আছে। তারা যানে, তাদের সামান্য
কয়েকটি সেকেলে অস্র আধুনিকা সমরাস্র সমৃদ্ধ বিশাল বাহিনীর কাছে নস্যি মাত্র।
কিন্তু বিচলিত হলে চলবে না। মুক্তিযোদ্ধা সবার মনে একই ভাবনা। নিজেদের জীবন দিয়ে
হলেও রক্ষা করতে হবে মা-ভাই-বোন তথা গ্রামবাসীকে।
গ্রামের সবাই সমবেত হয়েছে গ্রামের শেষ মাথায় অর্থাৎ দক্ষিণ প্রান্তে। এখান হতে
শুরু হয়েছে তাদের বিস্তীর্ণ আবাদি শস্যখেত। কোথাও কোমর সমান, কোথাও মাথাসম কিংবা
তারও বেশি উঁচু ধান, পাট, ইক্ষু ইত্যাদি ফসলের আবাদ। তার মাঝে সরু আইল চলে গেছে
সরল রেখায়, কখনও বা সর্পিল বক্রতায়।
অন্ধকারের মাঝে ওদের ছুটে চলা শুরু হল। অন্নসংস্থানের জন্য সযত্নে লালিত
শস্যগুলো মারিয়ে সবাই ছুটছে স্বীয় জীবন রক্ষার্থে। কে নেই ওদের দলে ? মায়ের আঁচলের
নিচে ঘুমন্ত শিশু থেকে বৃদ্ধ- সবাই। হায়েনাদের কাছে কোন ভেদাভেদ নেই- দেখা মাত্র
গুলি করতে দ্বিধা করবেনা এক মুহূর্ত।
লিয়াকত আলীদের দশ বারো জনের মুক্তিযোদ্ধার দল ভাগ হয়ে গেছে যার যার কর্তব্য
পালনে। তাদের মাঝে সিগ্ধান্ত হয়েছিল আলোচনা-পর্যালোচনা শেষে- গ্রামবাসীকে নিরাপদ
দূরত্বে কাভার করে এগুতে হবে তাদের। মিলিটারি বাহিনীর কাছে যদি গ্রামবাসীর অবস্থান
প্রকাশ পেয়ে যায় তবে তাদের রক্ষার্থে স্থির অবস্থান নিয়ে প্রতিরক্ষা গড়তে হবে
স্বীয় অস্র দিয়ে- এই সময়টুকুতে সবাই যেন নিরাপদ জায়গায় সড়ে যেতে পারে। নিজেদের
নিয়ে কোন ভাবনা নেই মুক্তিযোদ্ধাদের। ওরা জানে, যদি যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যু হয় তবে
আর কিছু না হোক, অন্তত দেশপ্রেমিক শহীদের মর্যাদা পাবে। গতকাল পর্যন্ত তাদের
আগ্নেয়াস্র সামান্য ছিল। দুটি দেশি দোনালা বন্দুক, একটি স্টেনগান এবং একটি থ্রি নট
থ্রি রাইফেল। এই কয়টি হাতিয়ার নিয়েই তারা
পাইকপাড়ার রাজাকারদের ক্যাম্প আক্রমন করেছিল অসীম সাহসিকতায়। সেথা হতে আরও নয়টি
আগ্নেয়াস্র যোগ হয়েছে- এই যা ভরসা।
বুক সমান পাটক্ষেতের মাঝ দিয়ে সন্তর্পণে এগুচ্ছে লিয়াকত আলী। অন্ধকারে চলা
দায়, তবুও তাদের চলতে হচ্ছে জীবনের প্রয়োজনে। অবশ্য নিজের জন্য কোন ভাবনা নেই
লিয়াকত আলীর, ভাবনা-উৎকণ্ঠা তার সবার জন্য- স্ত্রী, বৃদ্ধ বাবা মা, বোন এবং
গ্রামবাসী সবাই। তাদের নিয়তিতে কি লেখা আছে, লিয়াকত আলী জানে না। হয়তবা মৃত্যু...
। আপন জনপদের দিকে পিছন ফিরে চাইল সে। দূরে, অনেকটা স্থান জুড়ে আলোকিত। আলোকের
লেলিহান শিখা সহজেই তার দৃষ্টিগোচর হল।
গ্রাম জ্বলছে।
হয়তবা জ্বলছে তার ভিটেমাটি। আহা,
বাপ-দাদার তিলে তিলে গড়ে তোলা তার প্রানের জন্মভূমির শৈশব-কৈশোর কিংবা যৌবনের
স্বপ্নময় দিনগুলির তীর্থস্থান টুকু এক লহমায় পরিণত হয়ে যাবে টর্নেডোয় বিধ্বস্ত
শ্মশান ঘাটের মত। এ যে কতটা কষ্টের- কতটা সীমাহীন বেদনার, লিয়াকত আলী কে কেউ
বোঝাতে পারবে না। কিন্তু কি তাদের অপরাধ?
লিয়াকত আলী জানে, এ অপরাধের প্রশ্ন নয়।
হঠাৎ সার্চ লাইটের তীব্র আলো প্রতিফলিত হল ওদের অভিমুখে।
লিয়াকত আলী বুঝতে পারল, ওরা ধরা পরে গেছে।
মেশিন গানের প্রচন্ড শব্দে কেঁপে উঠল এপাড়ের ধরণী।
সার্চ লাইটের আলো খেলা করছে পুরো শস্যখেত জুড়ে। সেই সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার মত
আগ্নেয়াস্রের একটানা গর্জন। এর পতিক্রিয়ায় সামনে, পলায়নপর গ্রামবাসীদের অবস্থান
থেকে চিৎকার-কান্নার শব্দ ভেসে এল। লিয়াকত আলীরা শুনে থাকবে, মিলিটারি হায়েনারাও।
লিয়াকত আলী তার কর্তব্য স্থির করে ফেলেছে। ওপুড় হয়ে বুকে ভর করে দু হাতে স্বীয়
আগ্নেয়াস্র নিয়ে পজিশন নিয়েছে মিলিটারির বিপরীতে। প্রতিরোধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ
বেড়িয়ে এল তার শক্ত মুঠোয় ধরা রাইফেল থেকে।
আরও দশ-বারোটি আগ্নেয়াস্র গর্জে উঠল হায়েনাদের সহস্র আধুনিক সমরাস্রের
বিপরীতে।
‘আর পারছিনা, মা’ – রাহেলা বেগম ধপ করে বসে পড়ল।
‘আর একটু কষ্ট কর মা’ – লিয়াকত আলীর মা, রাহেলার শাশুড়ি তাকে সাহস যোগানোর
চেষ্টা করে কিন্তু নিজেই ভরসা পায় না। আগ্নেয়াস্রের গর্জনে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত।
তাদের আশপাশ দিয়ে বি...ই...ই...ঙ্গ শব্দ তুলে কত বুলেটই না ছুটে যাচ্ছে। এদের কোন
একটি যদি তাদের ঘায়েল করে।
রাহেলার ডান পাশে তার শাশুড়ি অন্যপাশ থেকে একমাত্র ননদী তাকে শক্ত করে ধরে
আছে। অন্তিম সময়ের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কারনে স্বাভাবিক চলনের শক্তি তার নেই। এবং
এই মুহূর্তে তার ভাবনা নিজ স্বামী কিংবা অন্য কাউকে নিয়ে নয়- সেই অনাগত ভবিষ্যৎ
বংশধর নিয়ে। যেভাবেই হোক, তাকে বাঁচতে হবে।
মাথাসম পাটক্ষেত পিছনে ফেলে ইখুখেতে প্রবেশ করল তারা। ইক্ষুগুলো ঝোপের মত বিক্ষিপ্ত ভাবে দারিয়ে আছে এবং এবং
সবগুলো তাদের মাথা ছাড়িয়ে। আঁখ খেতের ভিতর দিয়ে তাদের সামনে চলা বেশ সমস্যাই
হচ্ছিল। কিন্তু জীবনের মায়া সবচেয়ে বড় মায়া, এর কাছে যেকোনো বাঁধাই তুচ্ছ।
ইক্ষুগুলো তো নগণ্য।
হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেল রাহেলা শাশুড়ি এবং ননদির
কল্যাণে। থেমে, বসে, অন্ধকার হাতড়ে বুঝতে চেষ্টা করল সে দলামতন থলথলে জিনিসটি কি।
একজন মানুষ মরে পরে আছে। পালাতে গিয়ে পিছন দিক থেকে গুলি খেয়েছে। রাহেলা শিউরে
উঠল, সেই সাথে তার শাশুড়ি এবং ননদীও। লাশটি
তার শ্বশুরেরও তো হতে পারে। অন্য দুজনেরও ভাবনা একই। রাহেলা কেঁদে উঠল, সেই সাথে
তার শাশুড়িও। কিন্তু তাদের কান্না চাঁপা পরে রইল শত সহস্র বুলেটের গর্জনের নিচে।
আরও দুটি লাশ তাদের যাত্রাপথে এভাবেই পরে রইল। সকাল হলে দেখা যেত আরও কত শত
লাশ পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
স্বামীর কথাগুলো মনে পড়লো রাহেলার।
‘আমারা জানিনা, আমরা কি জন্য যুদ্ধ করছি। একটি দেশের জন্য? আগে তো আমার দেশে
ছিল ভারতীয় উপমহাদেশ, তারপর পাকিস্থান; জানিনা, এখন কোন গন্তব্যে যাব। যুদ্ধটা
আসলে আমাদের উপর একতরফা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরাও বুঝে গেছি- আমাদের টিকে থাকতে
হলে এভাবেই অস্র ধারন করতে হবে। ব্রিটিশ শোষকদের বিরুধে অস্র ধরেছিলাম, এখন লড়ছি
পাক হায়েনাদের সাথে। আমরাও বুঝিয়ে দিব, আমরা বীরের জাত এবং স্পষ্ট ভাষায় কথা বলি।
কথার জবাবে কথা, বুলেটের জবাবে বুলেট।
আমরা হয়তবা একটি দেশ পাব কেননা আমরা বুকে মাইন বেঁধে শত্রু নিধনে দিদ্ধা করি
না- দুর্নিবার আমাদের সাহস, একই সাথে মাতৃভূমির প্রতি প্রেম; যে প্রেম উপমহাদেশীয়
ধারায় বইছে। আপাতত আমাদের একটি স্বাধীন দেশ খুবই প্রয়োজন, তারপর কি- জানিনা।’
স্বামীর কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারে না রাহেলা। এতটা জ্ঞান গ্রামের এক অশিক্ষিত
বধূর নেই। তবে এটুকু বুঝতে পারে, তারা সবাই একটা কঠিন সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে।
দেশের হালচাল, যুদ্ধের সবটুকু সংবাদ পায় স্বামীর কাছ থেকে। বাড়িতে একটি রেডিও সেট
আছে, বলা চলে গ্রামের মধ্য একমাত্র রেডিও। সন্ধ্যা হলেই ভিড় লেগে যায় উঠোনে।
রেডিওটি অন করে সবাই মনযোগী স্রোতা হয়ে যায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সবটুকু
জ্বালাময়ী অনুষ্ঠান শুনে অজানা আনন্দে শিহরনে অন্য সবার মত নেচে উঠে রাহেলার মন।
যুগের পর যুগ ওরা বঞ্চিত থেকেছে, এবার সে বঞ্চনার অবসান হবে। সময় এখানে মুখ্য নয়,
শত্রুর বিরুদ্দে যুদ্ধ দশ মাসও চলতে পারে আবার দশ বছরও লাগতে পারে। কিন্তু যুদ্ধ
চলবেই। অনাগত সন্তাদের কথা চিন্তা করে তার স্বামী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে
পার্শ্ববর্তী দেশেও চলে যায়নি কিংবা মুক্তিযুদ্ধের কোন সেক্টরেও যোগ দেয় নি। বিচ্ছিন্ন
ভাবে, গ্রামের যুবকদের নিয়ে দল গঠন করে অস্র সংগ্রহ করে, নিজেই সবার অস্রচালনা
শিখিয়ে আপন অবস্থান থেকে লড়ে যাচ্ছে। ইপিআর এর একজন সদস্য ছিল তার স্বামী। যুদ্ধ
শুরু হওয়ার পূর্বমুহূর্তে পালিয়ে গ্রামে চলে আসে সে। একটি আগ্নেয়াস্রও লুট করে
সাথে নিয়ে এসেছে। তারপর শুরু হয় যুদ্ধ।
পাক সেনাদের শত সহস্র বুলেটের জবাবে মুক্তিযোদ্ধাদের স্থির অবস্থান থেকে
আগ্নেয়াস্রও পাল্টা গর্জে উঠছে। রাহেলাও শুনতে পাচ্ছে। নিজেদের কথা আরও একবার ভাবল
সে, তারপর স্বামীর কথা। তারা জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছে, আর তার স্বামী-মুক্তিযোদ্ধারা
তাদের বাঁচাতেই মরন কামড় দিয়েছে শত্রুর বিপরীতে।
কিন্তু সেই অল্প কয়েকটি হাতিয়ার- কতক্ষণ টিকে থাকবে মিলিটারির সহস্র
আগ্নেয়াস্রের কাছে?
রাহেলার স্বামী লিয়াকত আলীর একমাত্র ছোটবোন হঠাৎ আর্ত-চিৎকার করে মাটিতে পড়ে
গেল। রাহেলার শাশুড়ি ডুকরে কেঁদে উঠল। পর মুহূর্তেই দুজনে বসে পড়লো গুলিবিদ্ধ
দেহটির পাশে। শেষ বারের মত কিছু বলতে চাইল বারো-তের বছরের কিশোরী মেয়েটি। কথাগুলো
গোঙানির মত বেড়িয়ে এল কণ্ঠ দিয়ে এবং সামান্য পরে থেমে গেল সে গোঙ্গানি।
মেয়ের লাশ বুকে নিয়ে রাহেলার শাশুড়ি উচ্চস্বরে বিলাপ করে কাঁদতে লাগল। সে
কান্না তার চাঁপা পরে রইল আগ্নেয়াস্রের গগনভেদী আর্তনাদের নিচে।
কিন্তু রাহেলাকে বাঁচতে হবে।
শাশুড়িকে টেনে দাড় করাল সে। নিজের কান্নার মাঝখানে- শাশুড়িকে দু একটা
সান্ত্বনা সুচক কথা বলে তাগিদ লাগাল সে পলায়নের। মেয়ের লাশ ফেলে কিছুতেই যেতে চাইল
না বৃদ্ধ মহিলা।
অস্তিত্বের চরম সঙ্কটে পৌঁছে রাহেলা স্থবির-স্থানুর মত দারিয়ে রইল দু মিনিট।
যদি অন্তঃসত্ত্বা সে না হত তবে হায়েনার বুলেটকে আলিঙ্গন জানাত বুক উঁচিয়ে। আবারও
নিজেকে সাজেশন দিল মনে মনে- তাকে বাঁচতে হবে।
শাশুড়িকে শেষ বারের মত অনুযোগ জানাল রাহেলা। শাশুড়ি তার ডুকরে কেঁদে উঠল শুধু,
তারপর বেহুঁশ হয়ে পরে রইল মেয়ের লাশ আঁকড়ে ধরে
উঠে দাঁড়াল রাহেলা, তারপর চলতে লাগল। পদক্ষেপ গুলো তার এলোমেলো- দুঃখ
যন্ত্রণায় ভরাক্রান্ত। আঁখগুলোর কড়াতের মত খাঁজ কাটা ধারালো সরু লম্বা পাতা রাহেলার শরীরের উন্মুক্ত স্থানে
হুলের মত দাগ বসিয়ে যাচ্ছে- কিন্তু সে যন্ত্রণার ভূমিকাও নেই এ সময়ে। কয়েক বার
পড়েও যাচ্ছিলো সে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছে সৃষ্টিকর্তার কৃপায়। জানে না,
শেষ রক্ষা হবে কিনা।
আঁখ খেত পেছনে ফেলে খোলা জায়গায় চলে এসেছে রাহেলা। এখানে অন্ধকার ফ্যাঁকাসে
হয়ে গেছে নক্ষত্র এবং নতুন চাঁদের মৃদু আলোয়। সামনে ধান খেত। খাল থেকে পানি সেচে
বিস্তীর্ণ জায়গায় ধানের চাষ করা হয়েছে। ক্ষেতগুলো কর্দমাক্ত, পা ফেললেই দেবে যায়;
তারপর কষ্ট হয় সেই পা টেনে তুলতে। কিন্তু এরপরেও ক্ষেতগুলো পাড়ি দিতে হবে রাহেলার।
ধানক্ষেতগুলো পেরুবার পরেই সরু খাল, সে খাল সাঁতরে পাড়ি দিয়ে ওপাড় যেতে পারলে তবেই
নিরাপদ। গ্রামের মেয়ে হিসাবে ভাল সাঁতার জানে রাহেলা। কিন্তু এই সময়ে, তার এই
শারীরিক অবস্থায় সে পারবে কিনা নিজেও জানে না। তাকে যে পারতেই হবে।
হায়েনাদের আগ্নেয়াস্রের গর্জন চলছে সমানে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের
কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে গেছে। খুব ভাল করে কান পাতলে শোনা যাবে তাদের অবশিষ্ট দু তিনটি
আগ্নেয়াস্রের গর্জন- বাকিরা শহীদ বীরের সন্মানে পরপারে চলে গেছেন। তবুও নিজের
অবস্থান থেকে একচুল পিছায়নি তারা- এ বলা চলে, সবার স্বার্থে নিজেদের আত্মাহুতি।
বাকি দু-তিন জনও একই পরিনাম মাথায় রেখে সমানে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। যতক্ষণ দেহে
প্রান আছে, শেষ বুলেটটিও শত্রুর বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধের জবাবে পাঠাতে ভুলবে
না।
ইতিমধ্য পেটের চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে বুঝতে পেরে আতঙ্কিত হল রাহেলা। বা
হাত আপনা আপনি চলে এল নিচে- উঁচু পেটের উপর। সে হাতখানা দিয়ে শক্ত করে পেট চেপে
ধরে আবার চলতে লাগল।
মুক্তিযোদ্ধাদের আর একটিও প্রতিরোধ নেই দেখে হায়েনারা গোলাগুলি থামিয়ে দিল,
তারপর ফেটে পড়লো উল্লাসে- সমস্বরে। বহুদূর থেকে রাহেলাও শুনতে পেল পিচাশদের
উল্লাস। একই সাথে বাকরুদ্ধ হয়ে এল তার কণ্ঠ; স্বামীর পরিণতির কথা ভেবে। সব
হারিয়েছে সে। সর্বহারা-সর্বস্বান্ত।
পাক বাহিনীর আগ্নেয়াস্রগুলো দু চারটে বিক্ষিপ্ত গুলি ছুড়ে উল্লাস প্রকাশ করছে।
উল্লাসিত সবাই এবার সামনে এগুতে লাগল সার্চ লাইটের আলোয় পথ দেখে দেখে- যে দিকে
পালিয়েছে গ্রামবাসী।
সরু খালের পাড়ে এসে ধপ করে বসে পড়লো রাহেলা। শরীরের সবগুলো পেশী যেন অসাড় হয়ে
গেছে। হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে, সেই সাথে তলপেটের চিনচিনে ব্যাথাটা কেমন যেন ঝিম ঝিম হয়ে
ছড়িয়ে পড়ছে পুরো দেহে। এ অনুভূতির সাথে তার পরিচয় কখনও ঘটেনি- এই প্রথম বারের মত
মা হবে সে, এ জন্য ভয়টা অনেক বেশি। তারপর, যেখানে সব হারিয়েছে সে সামান্য সময়ের
মধ্য; যে সামান্য সময় উলট-পালট করে দিয়েছে তার সবকিছু, সেই অন্ধকার- ভয়ঙ্কর সময়ের
আবর্ত থেকে বেড়িয়ে আসতে একটি প্রানের জীবন-মরন সংগ্রাম আরেকটি প্রান রক্ষার্থে; যে
প্রান এখনও নতুন দিনের সূর্যোদয় দেখেনি- যে প্রানের মাঝে লুকিয়ে আছে রাহেলার
সবটুকু অস্তিত্বের সংগ্রাম। তাকে বাঁচতে হবে।
পাক হায়েনাদের উল্লাস- সার্চ লাইটের আলো, আগ্নেয়াস্রের ফাকা গর্জন আরও সামনে
চলে এসেছে। রাহেলা বুঝতে পারল তারা অনেক কাছাকাছি চলে এসেছে। উঠে দাঁড়াল সে। পর
মুহূর্তেই মাথা চক্কর দিয়ে উঠল তার এবং দু হাতে মাথা চেপে ধরে আবার বসে পড়লো মাটির
উপরে।
রাহেলা সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানাল জ্ঞান হারায়নি বলে এবং প্রার্থনা করল-
শেষ বারের মত তাকে সাহায্য করার জন্য।
দু হাতে মাটিতে ভর দিয়ে ফের উঠে দাঁড়াল সে। মিনিট খানিক এভাবেই দারিয়ে রইল
রাহেলা- আগের মত পতিক্রিয়াকে পাত্তা দিতে চাইল না। হেঁটে চলে এল সে পানির নিকটে।
আঁচল ভরে পানি পান করল রাহেলা- উত্তেজনায় তৃষ্ণার্ত। দু আঁচল পানি মাঠাতেও
ঢালল। এখন সামান্য সুস্থ বোধ করছে সে।
সার্চ লাইটের আলো রাহেলার কাছাকাছি চলে এসেছে। একবার উঠে দাঁড়িয়ে, সেদিকে চেয়ে
দূরত্বটুকু মাপার চেষ্টা করল সে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। ভারী পা দুটো টেনে টেনে
নেমে পড়ল খালের ঠাণ্ডা পানিতে, তারপর ভাসিয়ে দিল পুরো দেহ।
হঠাৎ সার্চ লাইটের তীব্র আলো এসে পড়ল ঠিক খালের পানির উপর। রাহেলা সাথে সাথে
ডুব দিল, কেউ কিছুই বুঝতে পারল না। আলোটি ত্রিশ-চল্লিশ সেকেন্ড একই স্থানে স্থির
রইল, তারপর ঘুরে গেল অন্য দিকে।
ভুস করে ভেসে উঠল রাহেলার মাথা। হৃৎপিণ্ড ফেটে যেতে চাইছে তার বাতাসের অভাবে।
লম্বা একটা দম নিল, এবার ভাসতে ভাসতে চলল তীরের দিকে।
খালের অপর পাশে পৌঁছে গেল অবশেষে রাহেলা, কিন্তু উঠে দাঁড়ানর মত শক্তি অবশিষ্ট
নেই শরীরে। হাত-পা দিয়ে মাটি খামচে পানির উপরে চলে এল সে এবং আরেকটু অমানুষিক
প্রচেষ্টায় খালের ঢালু পার পেড়িয়ে সমতল জায়গায় পৌঁছে গেল।
চার হাত-পা ছেড়ে চিৎ হয়ে পরে রইল রাহেলা। শরীরের যন্ত্রণার সাথে টের পাচ্ছে,
পেটের যন্ত্রণা তার বেড়েই চলছে। এক সময় সে যন্ত্রণা তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে
আর্তনাদ করে উঠল রাহেলা এবং তার পরেই জ্ঞান হারাল সে।
রাতের নক্ষত্রগুলো বিদায় নিয়েছে একে একে- আজকের মত। বিস্তৃত অন্ধকার জুড়ে
ছড়িয়ে থাকা জোনাকির দল দিনের সূচনার ঠিক পূর্বক্ষণে কোথায় চলে গেছে, কেউ জানে না।
আগামী রাত্রিতে আবার ঠিক ঠিক হাজির হয়ে যাবে রাতের নক্ষত্রদের মত। সবকিছুই চলছে-
চলছে সময়ের সাথে, চিরাচরিত নিত্য সত্যগুলো উপস্থাপনে, নতুন দিনের সূর্যোদয়ের মত।
পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। দিগন্ত রেখাও স্পষ্ট ফুটে উঠছে। পাখিরা বের হয়েছে
তাদের ছোট্ট বাসা ছেড়ে। দিনের সব প্রাণীকুলই জেগে উঠছে- প্রতিদিনের মত। মৌমাছি বের
হয়েছে নিত্যকার মত ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহ করতে। কীট পতঙ্গ, প্রজাপতিরা উড়ে চলছে-
সবকিছুই পুরনো দিনের অনুকরণে, কিন্তু নতুন দিনের মত নতুন করে।
নতুন দিনের এ প্রকৃতির হাজারো সারথির গুঞ্জনের মাঝে আরেকটি তীক্ষ্ণ শব্দ ভেসে
আসছে দূর হতে। সেই সাথে ব্যতিক্রমী কাক-কুকুরের কোলাহল শুরু হয়েছে দূরে।
সেই কোলাহলকে ঘিরে মাথার উপর চক্কর দিচ্ছে একদল শকুন। এই সাত সকালে ঠিকই হাজির
হয়ে গেছে গন্ধ শুকে- পুরো প্রাঙ্গন জুড়ে। এখানে, খালের পানিতে-কিনারায় ছড়িয়ে
ছিটিয়ে আছে অনেকগুলো মৃতদেহ। কাঁকগুলোও সে দেহ ঘিরে কা কা রব জুড়ে দিয়েছে, গ্রামের
ছন্নছাড়া নেড়ি কুকুরগুলোও এখানে এসে ঘেউ ঘেউ জুড়ে দিয়েছে কাঁকগুলোর সাথে। নতুন
দিনের প্রকৃতির গতানুগতিক আয়োজনে এ সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
রাহেলার জ্ঞান ফিরল। তীক্ষ্ণ সেই সব্দ সে শুনতে পেল, এবং শব্দের ভাষা বুঝতে
পেরে আনন্দে নেচে উঠল তার মন। সাথে সাথে তার দৃষ্টি চলে গেল দেহের নিম্নাংশের
দিকে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সেখানে।
মাটিতে ভর দিয়ে বহুকষ্টে উঠে বসল রাহেলা। পেঁচিয়ে থাকা রক্তে ভেজা কাপড় সরিয়ে
ফেলল হাঁটুর উপড়ে। সদ্য ভুমিস্ট হওয়া নবজাতক শিশুটিকে আলতো দু হাতে তুলে নিল,
তারপর জড়িয়ে ধরল বুকের সাথে।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে রাহেলার শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। ঠিকমত বসে থাকতে পারছেনা
সে। সন্তানটিকে একহাতে বুকের উপর চেপে ধরে অন্যহাত মাটিতে রেখে আলতো ভাবে শুয়ে পড়ল
সে।
নবজাতক শিশুটি পরে আছে চুপচাপ- কাঁদছে না সে, দুর্বল ভঙ্গিতে শুধু নড়ছে তার
পাটকাঠির মত হাত পা।
রাহেলার মনে কতশত সৃতি এসে ভিড় করছে। অনেকগুলো সৃতির দৃশ্যপট ভেসে উঠছে
এলোমেলো ভাবে- সেই তার শৈশব থেকে আজ এই ক্ষণ পর্যন্ত। পুরো জীবনটা কেটে গেল কত
সহজেই। কত সুন্দর সাজানো-গোছানো ছিল তার পরিবার...।
আর পারছেনা সে। রাহেলার চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আসলে, সে কি ভাবছে সে
নিজেও জানে না। শরীরটাও ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে। মৃত্যু তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
শেষ বারের মত নবজাতকের দিকে চাইল রাহেলা- তার বুকে মুখ লুকিয়ে আছে শিশুটি। এক
চিলতে হাসি ফুটে উঠল রাহেলার ঠোঁটে। সৃষ্টিকর্তাও পৃথিবীর মুখ দেখাতে শেষ পর্যন্ত
নিরাপদেই পাঠিয়েছেন, তিনিই তাকে রক্ষা করবেন তার নতুন দিনগুলিতে।
রক্তমাখা নোংরা ভেজা কাপড়ের আঁচল দিয়ে ঢেকে দিল রাহেলা নবজাতকের ক্ষুদ্র
দেহখানি। অসুন্দর, অপবিত্র, মিথ্যা- কোনকিছুই যেন তাকে স্পর্শ করতে না পারে।
তারপর, পরপারের ঠিকানায় চলে গেল রাহেলা- ভবিষ্যৎ বংশধরকে বুকের উপর আগলে রেখে।
শকুনগুলোও একই ভাবে চক্কর দিয়ে যাচ্ছে মাথার উপর...।
পূর্ব দিগন্তরেখার ঠিক উপরে লাল টকটকে উদীয়মান নতুন দিনের সূর্য। তার সোনার
আলোর পরশ শরীরে রেখে জেগেছে নতুন দিন। সবকিছুই ভরপুর সে দিনের আমন্ত্রনে।
শকুনগুলোর সীমানা ছাড়িয়ে শিশুটিও চেয়ে আছে সে নতুন দিনের দিকে।
(রচনাকালঃ ২০০৬)