ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। - ৪ ( শেষ অংশ )
ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। -১
ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। -২
ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। - ৩
ইতিমোধ্য চার বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে নতুন মনিবের আশ্রয়ে। সে বাজারের কথা
প্রায় ভুলেই বসেছে ভুলু- সেই সাথে পুরনো মনিবদের বাড়িগুলো। মনিবের অন্যসব পোষা
প্রাণীগুলোর সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে অনেক অনেক আগেই। মনিবও সেই আগের মতই- কোন
পরিবর্তন নেই।
‘মানুষগুলো কত সহজেই বদলে যায় ভুলু। কিন্তু আমি পারি না। কেন পারি না, আমি
নিজেও জানি না। তারা বদলে যায় পূর্ণিমার চাঁদের মত বিশাল এক সুখের প্রত্যাশায়-
তারা কি পায়, তারা জানে না; আমিও জানি না। কিন্তু আমি ‘আমার’ মাঝে, ‘আমাকে’ নিয়েই
বেঁচে থাকতে চাই। যারা বলে, পরিবর্তন হও হে! আমি তাদের দলে নেই। যে সূর্য আজ উঠে,
আগামীকাল উঠবে কিনা- সৃষ্টিকর্তাই ভাল জানেন। এবং একমাত্র তিনিই সত্য। যদি আমি
বলি, আগামীকাল সূর্য উঠবে- তবে আমি মিথ্যা প্রতিপন্ন হব’।
ইদানিং মনিব বেশ মনমরা থাকে। প্রিয় কুকুরটাকেও খুব একটা পাত্তা দেয় না সে।
ভুলু বুঝতে পারে মনিবের মন খারাপ, কিন্তু কি জন্য মন খারাপ সেটুকু বোঝার ক্ষমতা
ইতর প্রাণীটির নেই।
‘পোলট্রি ফার্ম বন্ধ করে দিতে হবে রে ভুলু, কোন উপায় নেই’- একদিন কুকুরটির
উদ্দেশ্যে বলল মনিব।
সত্যিই ফার্ম বন্ধ হয়ে গেল। ফার্মের শূন্য ঘরে একলা বসে থাকে মনিব, চুপচাপ।
ভুলুও তার পাশে বসে থাকে- কিন্তু তার উদ্দেশে মনিব কিছু বলে না। কুকুরটি দেখেছে,
যখন মোটা কাগজের কার্টুনে করে নাদুস নুদুস ব্রয়লার বাচ্চাগুলো এনে রাখা হয় গোলাকার
ব্রুডার হাউসের মধ্য। ব্রুডারের ইলেকট্রিক বাল্বের তাপ নরম শরীরে মেখে ছুটোছুটি
করে ছোট ছোট বাচ্চাগুলি। তারপর সেগুলো বড় হয়, ছড়িয়ে পড়ে পুরো ফার্ম হাউসে। মনিবের
পাশে বসে কতদিন সে বাচ্চাগুলো দেখেছে- মুরগিগুলো দেখেছে।
‘জানিস ভুলু, ফার্ম করেছি অর্থ উপার্জনের জন্য ঠিকই- কিন্তু এ অন্যরকম এক
ভালবাসা। একমাত্র যে এই পেশার সাথে জরিত, সে ই বুঝতে পারে’।– মনিব এ ধরনের কথা এখন
ভুলুকে বলে না।
ফার্ম বন্ধ হওয়ার দু মাসের মাথায় মনিব অর্থ সংকটে পতিত হল তীব্র ভাবে।
বাধ্য হয়ে লেয়ার মুরগিগুলো বিক্রি করে দিতে হল। এই কয় বছরে মোরগ-মুরগি কিংবা
রাজহাঁসের সংখ্যা বেড়ে কয়েকগুন হয়েছে। কবুতরগুলো সব বিক্রি হয়ে গেল। রাজহাঁসগুলোও
চলে গেল- যেদিন মনিব তাদের বিক্রি করে দিল, ভুলু কাঁদতে দেখেছে মনিবকে।
“মৃত্যু শোক ভোলা যায় না বলে একটা ভুল কথা প্রচলিত আছে। সবচেয়ে সহজে যে শোক
ভোলা যায় তার নাম মৃত্যু শোক। সবচেয়ে তীব্র শোক হচ্ছে জীবিত মানুষ হারিয়ে যাবার
শোক। হারিয়ে যাওয়া মানুষ যতদিন জীবিত থাকে ততদিন এই শোক ভোলা যায় না”। ( বুদ্ধদেব
গুহ, একটু উষ্ণতার জন্য)
‘ভুলু, আমি সব হারিয়েছি। পরিবার থেকে আজ আমি নির্বাসিত, নির্বাসিত পাপাচারে
পূর্ণ এ সমাজ থেকে। তবুও আমি নিজের মত করে বাঁচতে চেয়েছিলাম- আমার এই সব বন্ধু
সাথীদের নিয়ে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমার ভাগ্যে তা লিখে রাখেন নি’। একটু থেমে মনিব
বলল, ‘ জানি না এর শেষ কোথায়। ভুলু, তোদের মত অবলা জীবদের আল্লাহ্ সৃষ্টি করেছেন,
আমাদের মত মনও দিয়েছেন কিন্তু তার ব্যাপ্তি খুবই ক্ষুদ্র। আমাদের চেতনার গণ্ডী
অনেক বিশাল- আমাদের দুঃখগুলো তাই অনেক। আসলে সময়ের উত্তরণে আমরা এইটুকু পথ অতিক্রম
করেছি। আমাদের প্রাক পুরুষেরা
তাই ভাল ছিল- তারা খিদে লাগলে দল বেঁধে শিকার করত বন জঙ্গলে। তাদের সবটুকু ঐই ওটুকুর
মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল; বস্তুত যেদিন তারা আগুন জ্বালাতে শিখল, সভ্যতার শুরু হয়তবা
সেদিন থেকেই; সেদিন থেকে তারা আরেকটি জিনিস অর্জন করল- এই আগুনের দহন। জানি না এর
শেষ পরিনতি কোথায়’।
‘ভুলু, আমি চলে যাচ্ছি। কোনদিন ফিরব কি ফিরব না – ঠিক জানি না। তুই তোর মত
করে ভাল থাকিস। তবে ভুলু আমি একটি চরম সত্য জানি- সব সম্ভাবনার দুয়ার বন্ধ হয়ে
গেলেও একটি দরজা সবসময় খোলা আছে এবং থাকবে; সে হচ্ছে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্,
তুমি তার দিকে ধাবিত হও’।
সেদিন সকালবেলা মনিব চলে গেল। নিত্যকার মত মনিবের পিছু নিয়েছিল কুকুরটি।
মনিব তার মাথায় হাত বুলিয়ে নিরস্ত করল। ভুলু বাড়িতে ফিরে বসে পরল মনিবের রুমের
দরজার সামনে। দুপুর পর্যন্ত বসে রইল কুকুরটি। তারপর দুপুর গরিয়ে বিকেল- সন্ধ্যা
এবং রাত নেমে এল। শূন্য বাড়িতে কয়েকবার পায়চারি করল কুকুরটি। রাত্রি বেলা থেকে
থেকে ভ-অ-উ... ডাক তুলল অন্ধকার আকাশের দিকে চেয়ে।
সকাল হল, আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়াল কুকুরটি। ইতিমধ্যে খিদে তাকে অস্থির করে
তুলেছে; সেই যে গতকাল সকালবেলা মনিব তাকে পেট পুরে খাইয়েছিল- তারপর আর কিছুই
জোটেনি উদরে। তবুও মনিবের জন্য দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করল কুকুরটি এবং অবশেষে সেই
বাজারের উদ্দেশে পা বাড়াল।
অনেক দিন পর কুকুরটি ফিরে এল বাজারে। সবকিছুই তার চেনা, কিন্তু কেমন যেন
অপরিচিত ঠেকল তার কাছে। আগের মত পিছু নিল খাদ্যদ্রব্যে উদরপূর্তি করা কোন মানুষের।
কেউ তার দিকে ছুঁড়ে দিল পাউরুটি কিংবা অন্য কোন খাদ্যের অংশবিশেষ। কিন্তু এতে তার
ক্ষুধা মিটত না। বাধ্য হয়ে বাজারের ড্রেনগুলো কিংবা মাংসের দোকান অথবা হোটেলের
উচ্ছিষ্টের জন্য মারামারি বাধিয়ে দিল অন্য কুকুরগুলোর সাথে। কিন্তু এতোগুলোর সাথে
পেরে উঠত না সে। বাজারে অনেক নতুন কুকুরের আমদানি হয়েছে, তারা তার অপরিচিত। সেই
সাথে যে কুকুরগুলো অতীতে তার বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, সময়ের ব্যাবধানে সবাই শত্রুতে
পরিনত হয়ে গেছে। নিজেদের রাজত্বে এই নতুন অগুন্তককে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না।
সৃতি হাতড়ে পুরনো মনিবদের দু এক জনের বাড়ি থেকে ঘুরে এল কুকুরটি। কিন্তু পূর্বের
মত ব্যবহার পেল না। আসলে সবাই তাকে ভুলে গেছে, চিনতে পারেনি কেউ- তাই তাড়িয়ে
দিয়েছে বাড়ি থেকে। কুকুরটির এখন এক মাত্র আশ্রয় এই বাজারটি।
বাজারে আসার পরদিনই কুকুরটি সেই মনিবের বাড়িতে গিয়েছিল। একরাত সেখানে
অতিবাহিত করে ফের ফিরে এল। সেই মনিবের বাড়িতে সে দু দিন পর পর হাজির হত এবং এই ধারাবাহিকতা রয়ে
গেল।
সেই মনিবের আশ্রয়ে ভাল ভাল খাবার কিংবা নিয়মিত ফার্মের মুরগি-ডিম ইত্যাদি
খেয়ে কুকুরটি আরও তরতাজা এবং শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখানে এসে ক্রমশ দুর্বল
হয়ে পড়ল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল তার পাঁজরের হাড় উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে মোটা
চামড়ার ভিতর দিয়ে। ধীরে ধীরে তার সোনালী উজ্জ্বল লোমগুলো বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়তে
লাগল। এবং বছর দুয়েক পর কুকুরটির অবস্থা এমন হল যে সেই মনিব দেখলেও ঠিক চিনতে
পারবে না। শেষ পর্যন্ত সংকর কুকুরটির সাথে বাজারের অস্থি-চামড়া সর্বস্ব কুকুরগুলির
কোন পার্থক্য রইল না- সম্পূর্ণ বেওয়ারিশ নেড়ি কুকুরে পরিনত হল সে।
তবুও সেই নেড়ি কুকুরটি এখনও ভুলতে পারেনি সেই মনিবকে। এখনও দুর্বল পা গুলো
টেনে টেনে হাজির হয় সেই মনিবের বাড়িতে।
বাড়িটি জঙ্গলে পূর্ণ হয়ে গেছে। পুরো বাড়িটি ঘিরে অন্যরকম এক শূন্যতা-
কুকুরটির মন কেঁদে উঠে। মনিবের সেই রুমের দরজার সামনে বসে করুন সুরে ডেকে উঠে।
মনিবের সেই নির্দেশ গুলো এখনও তার মনে আছে। কাঁক দেখলে ছুটে যায়- তাড়িয়ে দেয় বাড়ি
থেকে। গুইসাপ কিংবা অন্য কোন কোন কুকুর মনিবের বাড়িতে দেখলে সেই পুরনো দিনগুলোর মত
ঘড় ঘড় শব্দ তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে মনিবের শত্রুর উপর।
মনিবের সেই পুরনো গন্ধ এখনও খুঁজে ফিরে কুকুরটি। বদ্ধ রুমের দরজার সামনে
দাঁড়িয়ে মনিবের ভালবাসা ভরা শরীরের গন্ধ এখনও বারবার শুঁকতে থাকে। জীর্ণ রাজহাঁস
কিংবা লেয়ার মুরগির ঘরের সামনে ছুটে যায়। ফার্ম হাউসের চারপাশ ঘুরে ফিরে- তারপর
আবার ফিরে যায় বাজারে। যদি খিধে নামক জিনিসটি তার বেলায় না থাকত, তবে মনিবের শূন্য
বাড়ি ছেড়ে কখনও বাজারে চলে যেত না কুকুরটি।
আগের মত এখন আর দু দিন পর পর মনিবের বাড়িতে যাওয়া হয় না কুকুরটির। সময়ের
সাথে সাথে সেখানে যাতায়াতও কমে গেছে। দুর্বল শরীর এতটা ধকল সইতে পারে না। তবুও
কিছুদিন পরপর সে ঠিকই চলে আসে নিঃসঙ্গ বাড়িটিতে।
সেদিন দুপুর বেলা পুকুরপাড়ের জঙ্গল পেড়িয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেই অজান
শিহরনে-আনন্দে নেচে উঠল নেড়ি কুকুরটির মন। খুশির অতিশজয়ে কয়েক বার ডেকে উঠল সে।
লাফাতে লাফাতে চক্কর দিল পুরো বাড়ি, তারপর বসে পরল মনিবের রুমের দরজার সামনে।
মনিবের শরীরের তরতাজা গন্ধ পেয়েছে সে। এ গন্ধ কোনদিনই ভুলতে পারবে না
কুকুরটি।
সন্ধায় মনিব চলে এল। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর মনিবকে দেখে কুকুরটির খুশি আর ধরে
না। দৌড়ে মনিবের কাছে গিয়ে লেজ নাড়তে লাগল। তার সবটুকু খুশি প্রকাশের জন্য এই
একখানা লেজ যথেষ্ট নয়, যদি আরও গোটা দশেক
লেজ থাকত!
কুই কুই ডাক তুলে মনিবের সামনে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল কুকুরটি।
মনিব প্রথমে চিনতে পারল না দুর্বল নেড়ি কুকুরটিকে- তার আচরণে বিস্মিত হল
পুরো এক মিনিট, তারপর সৃতি হাতড়ে মুখ থেকে বেড়িয়ে এল একটি নাম ‘ভুলু’।
বহুদিন পর প্রিয় মনিবের দেয়া পুরনো নাম তার মুখে শুনতে পেয়ে আনন্দে কেঁদে
উঠল কুকুরটি। এ কান্নার ভাষা বোঝা কারও সাধ্য নেই।
মনিব কুকুরটির মাথায় হাত বুলাতে লাগল। যখন কুকুরটির সোনালী উজ্জ্বল লোম ছিল- নাদুস নুদুস
ছিল দেখতে, তখন কতজনই তার শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করেছি। কতজনই কুকুরটিকে নিয়ে গেছে আপন
বাড়িতে। কিন্তু এখন সে ঘৃণিত
নেড়ি- মানুষগুলো তার বর্তমান কদাকার শরীরে হাত বুলানো দূরের কথা, অকারনে কত যে মার খেতে হয়েছে এই অবোধ পশুটি জানে। তার এই মনিব অন্য মানুষগুলির অনেক
উরদ্ধে।
‘ভুলু আমি ফিরে এসেছি, আর কোনদিন চলে যাব না’-
পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে বসতে বসতে বলছে মনিব, তার পাশে বসে আছে ভুলু।
‘তোকে আর কোনদিন কষ্ট করতে হবে না। তুই আমার সাথে আগের মতই থাকবি’।
‘ভুলু, আমি অনেক টাকা নিয়ে এসেছি। আবার আমি ফার্ম করব। রাজহাঁস কিনব, কবুতর কিনব। আবার পুকুরে মাছের চাষ করব, লেয়ার মুরগি
পালব। ভুল, সেই দিনগুলো
আমি আবার ফিরিয়ে আনব’।
‘ভুলু, এখন চল- আমরা দুজন
সেই আগের মত পুরনো জায়গাগুলো ঘুরে আসি। চল ভুলু’।
মনিবের আহবানে নেড়ি কুকুরটি চলল তার পিছু পিছু। গ্রাম্য রাস্তা, ক্ষেতের আইল, বিলের পাড় পেড়িয়ে দু জন পৌঁছে গেল নদী পাড়ে।
নদীতীরে বিস্তৃত বালুচরে লম্বালম্বি শুয়ে পরল মনিব। কি মনে হতেই আবার উঠে বসল সে। কুকুরটিও বসে রইল ঠিক তার পাশে।
‘ভুলু, আমার মনে আজ কি আনন্দ’- উচ্চস্বরে গান ধরল মনিব।
মনিবের আনন্দটুকু ধরতে পেরেছে বুদ্ধিমান কুকুরটি। তার মনেও আজ খুশির জোয়ার বইছে।
মনিব গান থামিয়ে আবার সটান শুয়ে পরল বালির উপর।
পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ- অযুত নিযুত
নখত্রেরা আকাশের সবটুকু অবস্থান জুড়ে বিরাজ করছে। কোনটি দ্যুতিময়তায় প্রখর, আবার কোনটি ম্লান। মনিব এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে
তার গুলোর দিকে। মনিবের মনে চলছে ভাবনার
খেলা- সে ভাবছে তার অতীত সময় গুলোকে নিয়ে। ভাবনার ব্যপ্তিতে সময় চলে যাচ্ছে, কিন্তু তার
সেদিকে কোন খেয়াল নেই। ভুলুও বসে আছে চুপচাপ, তারও কোন তাড়া
নেই। মনিব যদি সারারাত এভাবেই
শুয়ে থাকে নদীপাড়ে,
সেও থাকবে বসে- কোন প্রকার বিরক্ত বা ডাকাডাকি
করবে না মনিবকে।
আকাশে চাঁদ উঠেছে- অর্ধেক চাঁদ। সে চাঁদের আলো নদীর পানিতে প্রতিফলিত হয়ে নদীটিকে পরিনত করেছে
আঁকা বাঁকা কোন সরীসৃপের মত। নদীর ওপাড়ের অন্ধকার
সীমানায় জ্বলে জ্বলে নিভে যাচ্ছে, আবার জ্বলছে- শত সহস্র জোনাকির দল। হালকা বাতাসের গুঞ্জন, ঝি ঝি পোকার একটানা ডেকে চলা-
এ ছাড়া প্রকৃতি পুরোপুরি নিরব। নীরব মনিব। নীরব কুকুরটিও।
অনেক অনেকক্ষণ পর কথা বলল মনিব, ‘ভুলু, অনেকগুলো
বছর আগে কেউ একজন আমার ডাইরিতে একটি কবিতা লিখে দিয়েছিল। কবিতাটিকে আমি খুব ভালবাসি। আজ এতদিন পর আবার সে কবিতাটি মনে
পড়ছে। তুই শুনবি?’
মনিব বলতে লাগল-
'বলো আমাকে রহস্যময় মানুষ-
কাকে তুমি সবচেয়ে ভালবাস?
তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা, ভগ্নীকে?'
পিতা, মাতা, ভ্রাতা
ভগ্নী- কিছুই নেই আমার।
‘তোমার বন্ধুরা'?
- ঐই শব্দের অর্থ কখনও
জানিনি।
'তোমার দেশ?'
-জানিনা কোন দ্রাঘিমায় তার
অবস্থান।
'সৈন্দর্য?'
পারতাম বটে, তাকে ভালবাসতে- দেবী তিনি
অমরা।
'কাঞ্চন?'- ঘৃণা করি কাঞ্চন, যেমন তোমারা ঘৃণা কর ভগবানকে।
'বলো তবে অদ্ভুত অচেনা
মানুষ, কি ভালবাস তুমি?'
আমি ভালবাসি মেঘ ..... চলিষ্ণু মেঘ .....
মেঘ ..... উঁচুতে ..... ঐই উঁচুতে .....
আমি ভালবাসি আশ্চার্য মেঘদল।
(শার্ল বোদলেয়ার)
মনিব চেয়ে আছে নক্ষত্র পানে, কুকুরটি রাত্রির অন্ধকারে। আর বাকি সবটুকু
জুড়েই নিরবতা। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল মনিব, বলল ‘আমার কিছুতেই কিছু যায় আসে না’। তারপর
আবার নীরবতা।
(রচনাকালঃ ২০০৬)