একটি সুইসাইড
‘ জ্যোৎস্নায়
সবকিছু আলোকিত, কিন্তু সে বসে আছে ঠিক অন্ধকারের মাঝে।‘
কোন একটা
উপন্যাসে এই লাইনটা আমি পরেছিলাম মনে আছে, কিন্তু কি পরিপ্রেক্ষিতে এ অবতারণা – কিছুই ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে আমার সময়ের সাথে এর
মিল আছে বলে উল্লেখ করলাম এখানে। আজ পূর্ণিমা। তবে পূর্ণিমা একাদশী না দ্বাদশী, এ হিসাব
নিকাশ আমি কিছুই করতে পারব না; চাঁদটা পূর্ণরূপে মধ্যগগনে – এ থেকেই বলছি, আজ পূর্ণিমা।
হয়তবা আমার বলার ভুলও হতে পারে। ‘ কিন্তু সে বসে আছে ঠিক অন্ধকারের মাঝে ‘ – এ নিয়ে
আমার কিছু বলবার আছে এবং আমি আপনাদের বলব।
ধলেশ্বরী
নদীর পারে আমার এ ছোট্ট বাড়ি। আজ বছর খানিক হতে চলল আমি এখানে পাকাপোক্ত ভাবে বসাবস
করছি, যদিও প্রথমে এটা ছিল আমার অবকাশ যাপন কেন্দ্র । বলতে পারেন জগৎ সংসার থেকে স্বেচ্ছায়
নির্বাসন নিয়ে আশ্রয় নিয়েছি এখানে। না না, আমার কোন পিছুটান নেই, নেই খাওয়া-পড়ার ভাবনা।
আসলে শেষ বছরগুলো …।
আজ আমি পূর্ণ
বিশ্রাম নিয়েছি এবং ডুবে আছি ঠিক নিজের মাঝে। জোসনার আলো পরে ধলেশ্বরীর পানি যখন চিকচিক
করে, আমি আমার উঠোনে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিক তাকিয়ে থাকি এবং আপন মনে ভাবি কতকিছুই
না। ভাবি নিজেকে নিয়ে – এই আমি ; আমার অবস্থান, চিন্তা চেতনা, আমাকে ঘিরে সমাজ, সমাজের
মানুষগুলি কিংবা সে ভাবনা ছাড়িয়ে ধলেশ্বরীর এই পাড়ের শত সহস্র জোনাকির মেলার ‘পরে পূর্ণিমার
শেষ সীমানা আমার চোখে- আমার ভাবনার কোন সীমারেখা নেই। কিন্তু আজ সব ভাবনা আমার হারিয়ে
গেছে ; সেখানে কেবল অবস্থান নিয়েছে একজন, একটি নারী – নিশু।
আমার সামনে
একটি টেবিল। টেবিলের এক পাশে জীবনান্দের একটি কবিতার বই – মহাপৃথিবী, আলোর পৃথিবী।
এখানে বসে প্রতিদিন আমি আবেগিত কণ্ঠে কবিতা আবৃতি করি – মহাপৃথিবী আলোর পৃথিবীকে বুঝতে
চেষ্টা করি এবং মহাপৃথিবীর মাঝে হারিয়ে যাই, ফিরে আসি আলোর পৃথিবীর হাত ধরে। আর হারিয়ে
যাওয়ার এই সময়টাকে মনে হয় জীবনের সর্বশ্রেষ্ট সময় আমি পার করছি – বুঝতে পারি জীবনান্দকে।
অথচ আজ কবিতার বইটি ছুয়েও দেখিনি। জীবনান্দ এই মুহূর্তে আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে।
আজ নিজের
সাথে একটা খেলা খেলব। কি নাম দিব এই খেলার ? আচ্ছা, এর নাম দিলাম ‘ভালোবাসার খেলা’।
হ্যাঁ, ভালোবাসার শেষ খেলাই খেলব নিজের সাথে। খেলোয়াড় এখানে আমি একা। একটু ভুল বললাম
কি ? নিশুও কি এর সাথে জড়িত না ? হ্যাঁ, সে জড়িত এবং তার উপলক্ষেই আমার এ আয়োজন। যাই
হোক, খেলার প্রথম অংশে আমি একাই খেলাব । দ্বিতীয় অংশেও আমি একাই যদিও খেলব তবে তা হবে
নিশুর সামনে – এখনের মত একাকী না। অবশ্য প্রথম ভাগের উপর নির্ভর করছে ‘ভালোবাসার খেলার’
শেষটা।
আমার সামনে
একটি রিভলবার। জীবনান্দের কবিতার বইয়ের পাশে ওটা পরে আছে। আগ্নেয়াস্রটির অর্ধেক চেম্বার
বুলেটে ভরা, বাকি অর্ধেক খালি। চেম্বারও আমি ঠিকভাবে সাজিয়েছি অর্থাৎ, ব্যারেলে একটি
চেম্বারে বুলেট তারপরেরটি ফাঁকা, তারপর আবারও বুলেট – আবার খালি। চান্স এখানে ফিফটি
ফিফটি।
নিজের সমন্ধে
আরও কিছু বলার আছে আমার। নিশুর কথাও বলব। বলব আমি আরও অনেক কিছুই। আচ্ছা, রাজবন্দী
এই নামটা কি চিনতে পারছেন ? আমি কিন্তু ‘রাজবন্দীর’ কথা বলছি না। বলছি, এই নামের কোন
এক মানুষের কথা। আপনি যদি সাহিত্যপ্রেমী হন, তাহলে হয়তবা চিনতে পারেন, আর না চিনলেও
আপনাকে কোন দোষ দিতে পারব না। কেননা, বাজারে কত শত লেখক-কবি আছেন, তাদের কয়জনের খবর
কে রাখে। হ্যাঁ, আমি একজন সাহিত্যিক । খুবই সাধারন মানের একজন কবি-সাহিত্যিক। অবশ্য
লেখকদের জাত এক, কে ছোট আর কে বড় এটা কোন বিষয় না – আমরা সবাই সাহিত্যিক, এটাই আমাদের
বড় পরিচয়।
‘রাজবন্দী
? কিন্তু রাজবন্দী তো আপনার নাম না।‘
হ্যাঁ, রাজবন্দী
আমার ছদ্দনাম। এ নামেই বাজারে দু চারটা বই বেরিয়েছে। কেউ জানেনা, হয়তবা কোনদিন জানবে
না, রাজবন্দী নামের আসল মানুষটাকে। আর এই আসল মানুষটার আশে পাশের কেউ ধারনা করতে পারবে
না যে সে ‘রাজবন্দী’ হতে পারে। আমার এক হাতে
রিভলবার, অন্যহাতে কবিতার বই- আমার মানসিকতা এ ধরনেরই। অবশ্য আমার পরিচিতজনেরা শুধু
রিভলবারটাই দেখেছে, কবিতার বই নয়। আসলে আমিও কবিতার বই নিজেই আড়াল করে রেখেছি – এটা
শুধু একান্তই আমার, দশজনকে দেখানোর মত কিছু নেই এতে। একটু মনে হয় ভুল বললাম ? আচ্ছা,
তাহলে বলছি ; আমরা আসলে রিভলবার আর কবিতা এ দুটো এক সাথে দেখে অভ্যস্ত নই।
আমি এক হাতে
সৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠি, অন্যহাতে ধ্বংসের উল্লাস। জীবনান্দের কবিতা পড়তে পড়তে আমি
গুলি চালাই কপালের ঠিক মাঝ বরাবর, সেখানে ফুটো ; গলগল করে বের হওয়া তাজা রক্ত – সে
রক্ত নিয়েই আমি আবার কাব্য রচনা করি …
‘ আমাদের কক্তে ভেজা তোমাদের এই শহরে –
আমরা রঞ্জিত, তবুও সুখী।
আমাদের ফিনকি দিয়ে বের হওয়া তীরস্রোতা ‘ধারা
তোমাদের আকাশ ছোয়া অট্রালিকা থেকে ফের চুইয়ে পড়ে
–
শহরের পিচঢালা কালো রাস্তাটা
রক্তিম হয়ে উঠে কৃষ্ণচূড়ার মত –
তোমরা মেতে উঠ বসন্তের হলি উৎসবে।
তোমাদের শহরে উড়ে লাল সবুজের পতাকা
আমাদের বুকের লাল জমিনের মাঝখানে
সবুজ হয়ে শুধু বেঁচে আছে একচিলতে ভালোবাসা –
আমরা এতেই সুখী … । ‘
আপনাকে
এবার একটা ধাঁধা দিচ্ছি। আচ্ছা বলুন তো, আমার হাতে সর্বপ্রথম কোনটা উথেছিল – কবিতা,
নাকি রিভলবার ? নাকি দুটোই একসাথে ? তবে এটা বলবেন না যে মানুষ জন্মগত ভাবেই কবি, খুনি
নয়। স্বীকার করছি, আপনার কথা ঠিক আছে ; কিন্তু
সবাই তো আর ‘কবি’ না।
মনে
পড়ে, কলেজে বার্ষিক প্রকাশনা উৎসবে একবার একটি কবিতা দিয়েছিলাম, কিন্তু প্রকাশ হয়নি
। আমাদের সিরাজ স্যার বলেছিলেন, উল্টোপালটা ভাবের আবোল তাবোল কিছু লেখার নাম কবিতা হয়। সেদিন স্যারের কথায় অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম,
প্রতিজ্ঞা করেছিলাম – জীবনে আর কোনদিন একটা কবিতাও লিখব না। আমার প্রতিজ্ঞা আমি রাখতে
পারিনি, কিন্তু নিজেকে আড়াল করে জন্ম দিয়েছি ‘ রাজবন্দীর’ ।
বিশ্ববিদ্যালয়
জীবনেই আমার প্রথম বই প্রকাশিত হল। জীবনে প্রথম প্রকাশিত বইকে ঘিরে যে কত আবেগ-আনন্দ
থাকে, এটা একমাত্র সেই কবি সাহিত্যিকরাই বুঝতে পারবেন। অথচ এই আনন্দটাকে আমি কারও সাথে
ভাগাভাগি করিনি। মনে পড়ে, কবিতার বইয়ের একটা কপি শুধু নিশুকে উপহার দিয়েছিলাম। বলেছিলাম
– ‘ আমার পরিচিত একজনের প্রথম প্রকাশিত বই। পড়ে দেখ, ভালো লাগবে’।
এক
সপ্তাহ নিশুর সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিল না। তারপর যেদিন সে বিশ্ব বিদ্যালয়ে এল, বিকেল
বেলা ওকে নিয়ে বসলাম ক্যাম্পাসের সামনের মাঠের এক কোনায় – সবুজ ঘাসের উপর। আমার হাতটা
সে কোলের উপর নিয়ে চুপচাপ বসে রইল। ওর দৃষ্টি ছিল মাঠের পাশের বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছের
উপর। গাছটিতে ফুলে ফুলে পূর্ণ।
‘একটা
কবিতা শুনবি ?’- নিশু আমার দিকে চেয়ে বলল।
‘বল’
– আমি বললাম।
‘ কাঁদলে যদি জল ঝরে চোখে
তবে বৃষ্টির কান্না কত ?
দুঃখ পেলে হৃদয় ভাঙ্গে যদি
তবে নদীর দুঃখ কত ?
বিরহে যদি নীল নীল ছবি বুকে
তবে আকাশের বিরহ কত ?
তুমি কাঁদছ তোমার দুঃখ বিরহ নিয়ে –
বৃষ্টির জন্য, আকাশ-নদীর জন্য কেউ কাঁদে না।
তুমি
ভাবছ বসে আনমনে
কতটা
পথ পেড়িয়ে তবুও পথের ঠিকানা তুমি পেলে না।
রূপালী
চাঁদের আলোয় আলোকিত পৃথিবী
কতদুরে
চাঁদ – তুমি জাননা।
তুমি
ভাবছ তোমার ক্ষুদ্রতা নিয়ে
অনুতে অনুনে বিশাল ধরণী … ‘।
‘নিশু,
তোর কি মন খারাপ ?’
‘
কই না তো ।‘ সামান্য একটু হাসল সে, তারপর বলল, ‘ কবিতাটি কেমন লাগল বললি না তো?’
আমার
নিজের লেখা কবিতা আর আমাকেই বলছে কেমন লাগছে !
‘তোর
কাছে কেমন লাগছে ?’ আমি বললাম।
‘ভালো।‘
‘শুধুই
ভালো?’
‘হ্যাঁ,
তবে নতুন হিসাবে অনেক ভালো। সবচেয়ে বড় কথা কবিতাগুলোর ভাব সহজ আর ভাষাও সাবলীল।‘
‘তুই
বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী, তাই তুই ভালো বললেই ভালো। আমি রসায়নের ছাত্র, আমার মাঝে অতটা
রস নেই যে বলতে পারব ভালো না খারাপ।‘
‘এই
কবিতা বুঝতে রস এর দরকার হয়না গাধা!’
‘তাহলে
কি দরকার হয় ?
‘একটা
নিরেট উর্বর মস্তিষ্ক, যা তোর মত গাধাদের আছে !’
‘বলিস
কি রে ! তাহলে কাল থেকেই কবিতা রচনা শুরু করা যাক। কারন আমি জানি, নিরেট উর্বর মস্তিষ্ক
ছাড়া কবি হওয়া যায় না !’
কথাগুলো
বলার পড়েই কিল এসে পড়ল আমার পিঠে ! কবিতা প্রীতি ওর প্রবল। একই সাথে নিজেও যে দু চারটা
কবিতা লিখে না, তা না। ওর নিজের লেখা কবিতাগুলোও খুব সুন্দর, হয়তবা আমার থেকেও ভালো।
ও যখন ওর কবিতা পড়ে শোনায়, আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। কিন্তু ভাবটা গোপন রেখে ফাজলামি করি
কবিতা নিয়ে। আর ওর কিল এসে পড়ে আমার পিঠে ! একদিন মজা করে বললাম,-
‘আমাকে
কিলাতে কিলাতে তো তোর হাত শক্ত হয়ে গেছে। এই শক্ত হাত দিয়ে আর কবিতা লিখে কি হবে !
এক কাজ কর, জুডোর কোর্সে ভর্তি হয়ে যা – ভালোই নাম করতে পারবি।‘
‘তুই
ভেবে বলছিস এ কথা ?’
‘ক্যান
?’
‘তখন
যদি আমি একটা পাঞ্চ মারি, তোকে যে আর কিছুই দেখতে হবে না !’
‘অ্যাঁ
?’
আমার
নাকটা টিপে দিয়ে ও বলল ‘ হ্যাঁ ‘।
সেদিন
নিশুর মন সত্যই অনেক খারাপ ছিল; আমি তা জানতে পারলাম ওর বন্ধু পারুলের কাছে। আমার মাথায়
খুন চেপে গেল।
হলে
ফিরে এলাম। রিভলবারটা গুজে নিলাম কোমরে। একাই চলে গেলাম সি এস হলের ১০৭ নাম্বার রুমে।
অরা চারজন বসে তাস খেলছিল –
‘
তুই নিশুকে কি বলেছিস ?’ একটু থেমে বললাম, এর আগেও আমি তোকে দুইবার সাবধান করে দিয়েছিলাম।
আমার কথায় তোর কিছু আসে যায় না, না ?’
ওই
খা*কি মা*র পোলা, তুই ক্যাডারে ?’ উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় চলল সামান্য সময়। একসময় রানা বলল, ‘ ধর শালারে। শালারে আইজক্যা বানামু ।‘
আমি
দাঁড়িয়ে ছিলাম ঠিক দরজা বরাবর। আর অরা বসে ছিল রুমের মাঝখানে। রানার কথা শেষ হওয়া মাত্র
চারজন বিদ্যুৎ বেগে উঠে দাঁড়াল। তোষকের নিচে রাখা চাপাতি চলে এল রানার হাতে। একজন লকার খুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল; অন্য
তিনজন দৌড় দিল আমার দিকে।
আমার
ডান হাতে কখন যে রিভলবার চলে এসেছে আমি নিজেও জানি না। এটাও মনে নেই ঠিক কখন আমি গুলি
চালালাম। শুধুমাত্র দেখতে পেলাম বা হাটুতে গুলি খেয়ে রানা হুমড়ি খেয়ে পড়ল আমার একহাত
সামনে। অন্য দুজন দুপাশে সরে পড়েছে। চতুর্থজন যে লকার খুলতে ব্যাস্ত ছিল তার হাতে উঠে
এসেছে পিস্তল।
দ্বিতীয়
বারের মত আগ্নেয়াস্ত্রের কান ফাটানো শব্দ এল এবং একই সাথে আমার বা হাতের পেশিতে তীক্ষ
ব্যাথা অনুভব করলাম। নিজেকে রক্ষার জন্য এক পা পিছে এসে বা পাশে ড্রাইভ দিলাম এবং সেকেন্ড
বিলম্বে দ্বিতীয় বারের মত গুলি ছুড়লাম।
আমার
তখন হিতাহিত জ্ঞান নেই। রিভলবার সমেত ডানহাত দিয়ে বা হাতের পেশী শক্ত করে চেপে ধরে দৌড়াচ্ছি
দিকভ্রান্তের মত। এক সময় এসে উপস্থিত হলাম আপন হলে।
উত্তরা
– ৪ অর্থাৎ আমার হলের সামনে উৎসুক ছাত্ররা জমা হয়ে গেছে। আমাকে এভাবে দৌড়ে আসতে দেখে
সবাই পথ ছেড়ে দিল। একটু পরে সবাই যখন ঘটনা জানলো- স্থির হয়ে গেল আতঙ্কে।
মাসুদ,
তাহের, শিপন, বেলাল ওরা আমার সাথে রুমে চলে এল। দরজা বন্ধ করে শিপন ব্যাস্ত হয়ে পড়ল
আমার হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধতে। গুলিটি এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে চলে গেছে।
যদিও
ঘটনা পুরোটাই ঘটেছে নিশুকে কেন্দ্র করে, আর
বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির মাঠে ওরা আমাদের বিরোধী পার্টি। ওদের দল এখন ক্ষমতায়
তাই ধরাকে সরাজ্ঞান করছে এবং প্রতিশোধ নিতে ওরা আমাদের হল আক্রমন করতে পারে। সাধারন
ছাত্র যারা, তারা গোলমালের আশঙ্কায় তড়িৎ হল ত্যাগ করতে শুরু করল কিংবা দরজা জানালা
বন্ধ করে চুপ মেরে রইল রুমের ভিতর। আমাদের দলের ক্যাডারাও প্রস্তুতি নিল আক্রমন প্রতিহতের।
একটু পরে ইমতিয়াজ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল রুমের মাঝে।
কয়েকবার দম নেয়ার পর ইমতিয়াজ যে কথাটি বলল, ‘ পিন্টু মারা গেছে।‘
রুমের মাঝখানে পিনপতন নিরবতা। কেউ কোন কথা বলছে না। সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
‘
খালিদ, তুই পালা।‘
‘
হ্যাঁ, তারাতারি, এক্ষুনি।‘
‘
জলদি, হাতে সময় নেই। এদিকের সবকিছু আমরা সামলাবো। তুই চলে যা দ্রুত।‘
হলের
পিছনের বাউন্ডারি টপকে পালালাম আমি। দুশো গজের মত দৌড়ে পার হয়েছি মাত্র, এমন সময় গুলির
শব্দ কানে এল। দু গ্রুপের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।
গুলির
শব্দে আমার হাতে আপনা আপনি রিভলবারে চলে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের পাশে একটি খাল,
খালের ওপাশেই মফস্বল শহর। করটিয়ার মানুষ কোনদিন ভুলবে না যে রক্তে রঞ্জিত সার্ট পরিহিত
একজন যুবক আগ্নেয়াস্র হাতে ব্যাস্ত রাস্তায় হাজার মানুষের সামনে উদ্ভ্রান্তের মত দৌড়াচ্ছে
যার অন্যহাতের ব্যান্ডেজ চুইয়ে চুইয়ে ফোটায় ফোটায় রক্ত পরছে পিচঢালা রাস্তায়।
ইন্ডিয়াতে
বসে আমি সংবাদটি পড়লাম।
ছাত্রনেতা
পিন্টু হত্যাকে কেন্দ্র করে দু দলের মাঝে ব্যাপক সংঘর্ষ, নিহত দুই, আহত অর্ধ শতাধিক।
বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা। ছাত্রদের অবিলম্বে হল ত্যাগের নির্দেশ।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কারফিউ জারি। পুলিশ ও আর্মি মোতায়েন। পিন্টু হত্যাকারী ঘাতক খালিদ
পলাতক।
আমার
মাঝে কোন ভাবান্তর হল না খবরটি পড়ে। শুধুমাত্র তাহেরের জন্য কষ্ট লাগল। ওর শরীরে কয়েকটা
গুলি লেগেছে, মৃত সে। অন্য একজন যে মারা গেছে সে প্রতিপক্ষের ইমতিয়াজ। তাহের ছিল ইতিহাসের
ছাত্র। সেই সাথে আমাদের প্যানেলের একনিষ্ঠ কর্মী। খুব ভাল বন্ধু ছিল আমার।
গতবারের
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা। আমাদের দল তখন ক্ষমতার আসনে। আমরা তাই
আশাবাদী ছিলাম। ভিপি হিসাবে স্বাধীন ভাই মনোনয়ন পেলেন। এ জি এস আখতারুজ্জামান। যদিও
এ প্রার্থিতা নিয়ে আরও দুজনের সাথে মনোনয়নের যুদ্ধে সামিল হতে হল তাকে। জি এস এই পদটা
আমার। ক্রীড়া সম্পাদকের জন্য আহমেদ রাসেল। কিন্তু সমস্যা হল দপ্তর সম্পাদক নিয়ে। স্বাধীন
ভাইকে বললাম। সে বলল, ওটার জন্য মনোনয়ন দেওয়া হবে পারভেজকে। আমি বললাম, ‘সে ক্ষেত্রে
আমি প্যানেল থেকে সরে দাঁড়াব।‘
স্বাধীন
ভাই সেই সাথে দলের সাথে আমার মনোমালিন্য শুরু হল। তবে ওরা বুঝতে পারল, আমাকে ছাড়া প্যানেল
পঙ্গু হয়ে যাবে। অবশেষে মনোনয়ন পেল তাহের। সেবার নির্বাচনে আমাদের প্যানেল জয় লাভ করল
বিপুল ব্যাবধানে।
সেদিনের
কথা ঘুরেফিরে বারবার মনে পড়ছে। রিভলবার হাতে উদ্ভ্রান্তের মত মফস্বল শহরের রাস্তা ধরে
দৌড়াচ্ছি আমি। লিচু বাগান রোডের সিনেমা হলটি পার হয়েছি মাত্র, একটি ট্যাম্পু আমার পাশে
এসে থামল। আমি ট্যাম্পুতে উঠে বসলাম। চালক শিবা কোন কথা না বলে আমাকে নিয়ে হাজির হল
তার বাড়িতে। সে আমার পূর্ব পরিচিত।
আমি
গোসল, পরনের কাপড় পরিবর্তন করে শিবাকে বললাম, ‘ আমাকে বাড়ি নিয়ে চল।‘
ঘণ্টা
দুয়েক পরে আমি আমার গ্রামের বাড়িতে পৌছালাম। আমার মা মারা গেছেন আমার জন্মের সময়ই।
বাবা মারা গেছেন আজ প্রায় চার বছর হল। আমার কোন ভাই বোন নেই, অর্থাৎ সংসারে আমি পুরোপুরি
একলা।
বাবা
মারা যাওয়ার সময় এই বসতবাড়ি আর সামান্য চাষাবাদের জমি রেখে গিয়েছিলেন। চাষাবাদের সেই
জমিটা বিক্রি করে দিয়েছি কয়েক বছর পূর্বে – কোন উপায় ছিল না বলে। আমার বড় চাচার কাছেই
জমিটা বিক্রি করে দিয়েছি বাজার দরের চেয়ে কম মুল্যে, কেননা চাচাকে শর্ত দেওয়া হয়েছে
ভবিষ্যতে যখন আমার অর্থকরি হবে তখন চাচা জমিটা ফের বাজার মুল্যে আমার কাছেই হস্তান্তর
করবেন।
বসতবাড়িটা
গাছ-গাছালিতে পুর্ন। মা’র নাকি খুব সখ ছিল গাছ লাগানোর। বাড়ির উত্তরপাশের বিশাল কাঠাল
গাছ থেকে শুরু করে নারিকেল, জাম, জলপাই, চালতা ইত্যাদি আরও হরেক রকমের গাছ- সবই আমার
মায়ের অবদান। বসতবাড়ির উত্তরে চৌচালা কাঁচা একটি পুরনো টিনের ঘর- যার সবটুকুই নষ্ট
হয়ে গেছে মরিচা পরে। বর্ষাকালে শতছিদ্র চাল থেকে পানি পরে মেঝেতে বন্যা বয়ে যায়- তারপরেও
এই ঘরটিই আমার বাবার শেষ স্মৃতিচিহ্ন ।
একদিন
নিশুকে নিয়ে এসেছিলাম বাড়িতে। তাকে আমার অবস্থা সম্পর্কে আগেই বলেছিলাম। কিন্তু বাড়ি
দেখে নিশু মহাখুশি। পুরো বাড়ি সে ঘুরে ফিরে দেখল। আমাকে বলল, ‘ তুই আমাকে বিয়ে করলে
বিয়ের পর আমি কিন্তু এখানেই থাকব। ‘
‘তোকে
বিয়ে করতে আমার বইয়ে গেছে ! আমি কি তোকে কখনও বলেছি যে আমি তোকে বিয়ে করব ?’
‘তাহলে
আমার সাথে প্রেম করলি ক্যান ?’
‘আমি
প্রেম করেছি নাকি তুই?’
‘আচ্ছা,
আমিই প্রথম বলেছি যে আমি তোকে ভালবাসি। কিন্তু এটা তো মিথ্যা না যে তুই আমাকে ভালবাসিস না ?’
‘আচ্ছা
বাপ, তোকে আমি ভালবাসি, ভালবাসি, ভালোবাসি। কিন্তু ভালোবাসলেই যে বিয়ে করতে হবে এ রকম
কি কোন চুক্তি হয়েছে তোর সাথে আমার ?’
‘তাহলে
তুই আমাকে বিয়ে করবি না ?’
‘না
।‘
‘ভেবে
বলছিস তো ?’
আমি
হাসি মুখে বললাম, ‘হ্যাঁ’।
‘তাহলে
শুনে রাখ নরাধম পাপিষ্ঠ, তোর সাথে আমার বিয়ে কোনদিন হবে না।‘
‘আচ্ছা,
শুনে রাখলাম।‘
আমি
মজা করছিলাম বরাবরের মত নিশুর সাথে। কিন্তু এতে যে ও মন খারাপ করে ফেলবে – আমি বুঝতে
পারিরি। নিশুর হাত ধরে ওকে টেনে ঘরের ভিতরে নিয়ে এলাম। ঠিক ওর সামনে দাঁড়িয়ে তার চোখে
চোখ রাখলাম। বললাম,
‘আমাকে
তুই বিয়ে করতে চাষ ? ভেবে উত্তর দিবি।‘
নিশু
আমার চোখে চোখ রেখেই বলল, ‘হ্যাঁ ।‘
‘যদি
বলি আজ এখানেই তোর সাথে আমার বিয়ে হবে, তুই রাজি ?’
নিশু
সেকেন্ডও সময় নিল না, বলল, ‘হ্যাঁ ।‘
আমি
নিশুর ঠোটে চুমু খেলাম। তারপর ওকে ছেড়ে দিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম চেয়ারে।
আনোয়ার
হোসেন, জেলা শহরের একজন গনমান্য ব্যাক্তি, ব্যাবসায়ী – নিশুর বাবা। নিশুর কোন ভাইবোন নেই, আনোয়ার সাহেবের একমাত্র আদরের
মেয়ে সে। অঢেল অর্থ সম্পত্তির মালিক সে, সেই সাথে একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সক্রিয়ভাবে
জড়িত। আর খালিদ ! আনোয়ার সাহেবের জামাই হিসাবে কল্পনা করতেও আমার হাসি পেল। অথচ এই
বাড়িতে বসেই আমি কতশত কল্পনা করেছি নিশুকে নিয়ে। পুরনো বাড়িটা ভেঙ্গেচূড়ে নতুন করে
সাজাব। এখানে থাকবে শুধু দুটো প্রাণী – আমি আর নিশু। আমাদের ঘিরে থাকবে বিশাল আকাশসম
অফুরন্ত ভালোবাসা।
বড়
চাচার সাথে দেখা করলাম, বললাম, ‘আমার অনেক টাকা লাগবে।‘
চাচা
বললেন, ‘ টাকা লাগবে ভালো কথা, কিন্তু কত টাকা ?’
আমি
বললাম, ‘এক লাখ।‘
‘এক
লাখ !’ চাচা যেন আকাশ থেকে পড়লেন। ‘ আমি তোমাকে তুই চার পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্য
করতে পারি, কিন্তু তাই বলে এক লাখ ।‘
‘শোনেন
চাচা’ – আমি বললাম, ‘ পুরো এক লাখ টাকাই আজ এক্ষুনি চাই আমার। আপনাকে আমার বাড়ির দলিলপত্র সব দিচ্ছি, ওগুলো বন্ধক রেখে আপনি আমাকে টাকা দিবেন।
আপনার সাথে আমার চুক্তিপত্র হবে – যদি দু বছরের মোধ্য আমি এই টাকা আপনাকে ফেরত দিতে
না পারি তবে আমার বাড়িটা আপনার হয়ে যাবে।‘
আসলে
আমার এ ছাড়া কোন উপায়ও ছিল না, কেননা বন্ধুদের কাছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন, দোকান
– সব যায়গায় সব মিলিয়ে পঁচিশ-ত্রিশ হাজার টাকার মত ঋন হয়ে গেছে। আর এখন আমি ফেরারী
আসামী। কতদিন যে আমাকে পালিয়ে থাকতে হবে আমি জানি না।
শিবার
হাতে ঋনের টাকা ও তালিকা তুলে দিয়ে সেদিন রাতেই আমি রওনা হলাম সাতক্ষীরার উদ্দেশ্যে।
এখানে আমার এক দুঃসম্পর্কের খালু সীমান্তুরক্ষী বাহিনীতে চাকুরি করেন। তিনিই সব ব্যাবস্থা
করে দিলেন আমার জন্য। পরদিন দুপুরবেলা ভোমরা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করলাম ইন্ডিয়ার চব্বিশ
পরগণাতে, সেখান থেকে কোলকাতা।
কত
বড় বড় সন্ত্রাসী পুলিশের নাকের ডগায় তেল লাগিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ আমি সন্ত্রাসী
নই – একজন রাজনৈতিক ক্যাডার মাত্র, আমাকে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হল ইন্ডিয়াতে। অবশ্য আমি
এখন একজন খুনি। এমন একজন আমার হাতে খুন হয়েছে যে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিপির
আপন খালাতো ভাই। এখন সবাই আমার পিছনে ছুটবে – পুলিশ, রাজনৈতিক দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসী,
বিরোধী ছাত্রদলের নেতা কর্মী সবাই। অবশ্য ইন্ডিয়া আসার আমার আরেকটি উদ্দেশ্য আছে –
বেশ কিছু দিনের জন্য আমি মুক্ত স্বাধীন জীবন যাপন করব।
আমি
পথে নামলাম। সেই পথ কলিকাতা থেকে কাশ্মীর কিংবা ব্যাঙ্গালোর থেকে উত্তর প্রদেশ পর্যন্ত
প্রসারিত। এই পথে পাড়ি দিতে আমার পুরো একটা বছর সময় কেটে গেল। এরই মাঝে নিজের জন্য
আরও একটা কাজ করলাম – আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত হল আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।
একটা সময় ভাবলাম, আমার তো কোন পিছুটান নেই, থেকে যাব নাকি ইন্ডিয়াতে। নাহ, সেটা সম্ভব
নয়, বাবার শেষ স্মৃতিচিহ্ন গ্রামের বাড়িটা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নিশু, সে বসে
আছে আমার পথপানে চেয়ে।
ইন্ডিয়াতে
বসে সবার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা না করলেও নিশুর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি অনেকবার।
কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। আচ্ছা, যদি দেশে ফিরে
আসি তবে নিশু কি আমাকে আগের মতই গ্রহন করবে,
নাকি প্রত্যাখান করবে একজন খুনি-ফেরারি বলে ? না, না, কি আবোল তাবোল ভাবছি আমি। আমাকে
প্রত্যাখান করা ওর পক্ষে সম্ভব নয় ; অনেক বেশি ভালোবাসে আমাকে।
ঠিক
দেড় বছর পর ফিরে এলাম দেশে, আমার গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু এটা কি আমার বাড়ি ? সত্যিই
আমার অবাক হওয়ার পালা । দিগম্বর বাড়িটা এখন টিনের বাউন্ডারী দিয়ে ঘেরা। আমি খোলা গেট
দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। আমার বাড়ি সংলগ্ন উত্তর পাশেই চাচার বাড়ি। দু বাড়িকে চাচাই
পৃথক করে রেখেছিলেন টিনের বেড়া দিয়ে। সে বেড়াও এখন আর নেই। দুটো বাড়ি এখন পরিনত হয়েছে
বিশাল এক বাড়িতে।
বাবার
জীবিত অবস্থায় চাচার সাথে তার সম্পর্ক কোনদিনও
ভালো ছিল না। কিন্তু আমার সাথে তেমন খারাপ সম্পর্ক ছিল না। বাবার মৃত্যুর পরে চাচাই
আমার অভিভাবক, আমিও মনে প্রানে সেটাই স্বীকার করতাম। বড়চাচীকে দেখতাম আমার মায়ের যায়গায়,
চাচাতো বোন গুলোও আমার আপন বোন ; কিন্তু চাচার ছেলে গুলোকে আমি দুই চোখে দেখতে পারতাম
না। চার মেয়ে আর পাঁচ ছেলে নিয়ে চাচার বিশাল সংসার। বড় তিনটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে,
সবার ছোটটি পড়ালেখা করছে স্থানীয় গার্লস স্কুলে। বড় ছেলে দুটো বিয়ে করেছে দুই তিন বছর
পূর্বে। একটি যায়গায় ভাইগুলোর মাঝে বেশ মিল – তারা কেউ লেখাপড়ায় স্কুলের গণ্ডী পার
হতে পারে নি এবং তারা সবাই গ্রামের মানুষের অনিষ্ট কর্মে মত্ত। বখাটেপানা থেকে শুরু
করে ঝগড়া বিবাদ – অন্যের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়া এবং চড়া সুদের কারবার। আমার বড়
চাচাও মনে হয় গর্বিত তার গুণধর ছেলেদের নিয়ে, কেননা তাদের কল্যানেই গ্রামে তার প্রতিপত্তি
আগের চেয়ে বেশি।
দেড়
বছরে একজন মানুষ কতটা পরিবর্তন হতে পারে যে তাকে কেউ চিনতে পারে না ? অবশ্য আমার দাড়ি-গোফ
কিংবা বাবরি লম্বা চুল দেখতেও কেউ অভ্যস্ত নয়। তাছাড়া এই অল্প সময়টা আমার ভিতরে বাহিরে
– সবক্ষেত্রেই বিশাল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তারপরেও আমি তো সেই আমিই আছি – অন্য কেউ
হয়ে যাইনি। চাচী তাই আমাকে ঠিকই চিনতে পারলেন, যদিও তাকে সামান্য সময় নিতে হল।
‘
তুই খালিদ না ?’
‘
জী চাচী । আপনি ভালো আছেন তো? চাচা কই, চাচাকে দেখছি না ? চাচার শরীর ভালো তো ?’
‘হ্যাঁ
বাবা ভালো। তোর চাচা একটু আগে ক্ষেতে গেছে, দাড়া আমি খবর পাঠাচ্ছি। তুই ভিতরে এসে বস।‘
‘ইয়ে
চাচী, বাড়ির এতসব পরিবর্তন, আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না … ।‘
আমার
বলা মাত্রই চাচীর মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। বললেন, ‘তোর চাচা আসুক, তার সাথেই কথা বল।
আমি কিছুই বলতে পারব না।‘ চাচী একছুটে ঘরের ভিতর চলে গেলেন, যেন পালিয়ে বাঁচলেন আমা
থেকে।
আমি
ঘুরে ফিরে বাড়ি দেখছি। লক্ষ্য করলাম, মায়ের হাতে লাগানো গাছগুলোর মাঝে দুটো আমগাছ আর
বহু পুরনো একটা কাঁঠাল গাছ নেই। পৈত্রিক ঘরটা অবশ্য ঠিকই আছে। কিন্তু কাঁচা ঘরটা পাকা
করা হয়েছে ; যতটুকু প্রয়োজন মেরামত করা হয়েছে। এবং ঘরটিতে সংসার পেতেছে চাচার বড়ছেলে আনোয়ার।
এই
দিনটা আমার জীবনের স্মরণীয় একটা দিন হয়ে থাকবে।
চাচা
এলেন তার ছেলেরাও এল। এল গ্রামের আরও দু চারজন মুরুব্বী। না, ভিটে বাড়িটা আর আমার নেই,
ওটা চাচার কাছে দেড় বছর পূর্বে পাঁচ লক্ষ টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছি। চাচা এই
কাজটা কিভাবে কেন করলেন এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে চুপচাপ চলে এলাম বাড়ি ছেড়ে।
দেশে
তখন নির্বাচনী হাওয়া বইছে জোরেশোরে। পোস্টার প্লাকার্ডে ছেয়ে গেছে রাস্তা ঘাট, যায়গায়
যায়গায় বসেছে প্রচারনী ক্যাম্প। মিছিল মিটিং সমাবেশ – স্লোগান এসবের মাঝেই আমি প্রবেশ
করলাম আমার সেই বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন পুরনো শহর করটিয়াতে।
বন্ধুদের
অনেকের সাথেই দেখা হল। দেখা হল আরও অনেকের সাথে যাদের প্রত্যাশায় আমি মোটেই ছিলাম না।
নিশুর খবর পেলাম, যদিও সে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন অনেক কম আসে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্তরে গিয়ে
নিশুর সাথে দেখা করা সম্ভব না কিংবা তাদের বাড়িতে গিয়েও। অবশেষে বন্ধু বেলালের সাহায্য
নিতে হল আমাকে।
আমার
হাতে একটি কবিতার বই – আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের একটি কপি যা আমি নিশুর জন্য নিয়ে
এসেছি। প্রথম বারের মত ওকে বলব, ‘ আমার সেই বন্ধু রাজবন্দীর দ্বিতীয় বই এটা। পড়ে দ্যাখ,
ভালো লাগবে।‘ আমি বসে আছি করটিয়া শহরের অদুরে
ঝিনাই নদীর পাড়ে। এখানেই নিশু আসবে। আহা, কতদিন পরে আজ নিশুকে দেখব।
বেলালের
বাইকে চেপে নিশু এল ঘণ্টা খানিক পরে। ওকে রেখেই বেলাল চলে গেল। আমি দাঁড়ালাম নিশুর
সামনাসামনি।
‘
কেমন আছিস নিশু ?’
‘
ভালো। আপনি ভালো আছেন তো ?’
সামান্য
একটা ধাক্কা খেলাম আমি। নিশু আমাকে আপনি করে বলছে। মজা করে যে বলছে তা নয়। আসলে কোথাও
একটা পরিবর্তন হয়েছে এই সময়ের মাঝে, কিন্তু পরিবর্তনটা যে কি আমি বুঝতে পারলাম না।
এতক্ষন
বসে বসে ভাবছিলাম নিশু এলে প্রথমে ওকে জড়িয়ে
ধরে চুমু খাব ওর কপালে, তারপর তার হাত ধরে বসব পাশাপাশি। এখন এসবে বাধা দিল আমার মন।
তাই শুধুমাত্র বললাম, ‘ বসবে না ?’
আমরা
দুজন বসলাম – পাশাপাশি, কিন্তু মাঝখানে কিছুটা দূরত্ব। এই দূরত্বটা আমি তৈরি করিনি,
নিশুই করেছে। নাকি আমার কারনেই সে করেছে ?
‘তোর
পড়াশোনা কেমন চলছে ?’
‘ভালো।‘
‘আমার
তো আর মাস্টার্স করা হল না … জাকগে, কপালে নেই তাই কি আর করা যাবে। ও আচ্ছা শোন, তোর
জন্য একটা কবিতার বই এনেছি, পড়ে বলবি কেমন লাগল।‘
আমার
বাড়ানো কবিতার বই নিতে হাত বাড়াল নিশু, আমি ওর হাত খপ করে ধরে টেনে আনলাম নিজের দিকে।
আলতো করে চুমু খেলাম হাতে। বললাম, ‘নিশু, কি হয়েছে তোর ?’
‘না
কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।‘
‘না,
তুই ঠিক নেই। আসলে সবকিছু কেমন যেন উল্টাপাল্টা হয়ে গেল …।‘
নিশু
তাকিয়ে আছে নদীর শান্ত জলরাশির দিকে, আর আমি চেয়ে আছি তার মুখপানে। বললাম, ‘নিশু, তুই
আমাকে ভালোবাসিস না ? ‘ নিশু আমার দিকে ফিরে চাইল, চোখে চোখ রাখল একটা মুহূর্ত, কিন্তু
কিছুই বলল না।
আরও
ঘন্টা খানিক রইল সে । তারপর চলে গেল বেলালের সাথে।
আমার
সামনে শান্ত ঝিনাই নদী, তার শুকিয়ে যাওয়া সরু জলধারার পরেই বিস্তৃত বালুচর। সেখানে
অনেকগুলো শিশু কিশোরেরা খেলা করছে। তাদের মাথার উপরে উড়ে চলেছে নাম না জানা কোন পাখির
দল – দিবাসনের সমাপ্তিকল্পে তাদের এ যাত্রা। দিগন্তের শেষ প্রান্তে অর্ধাকৃতি অস্তমিত
লাল সূর্য। তার আভায় রক্তিম ঊর্ধ্বাকাশ। একটু পরে তার শেষ চিহ্নটুকুও মুছে যাবে, ধরিত্রীর
এ প্রান্তে নেমে আসবে আধার। প্রকৃতির এ পরিবর্তিত ধারায় সবকিছুই চলবে ঠিক আগের দিনের
মত ; কিন্তু কেউ একজন নিজেকে সে ধারায় সপে না দিয়ে এখানে, এই ঝিনাই নদীর পাড়ে এভাবেই
একলা বসে রইবে চুপচাপ। আজ সে হিসাব নিকাশ করবে নিজের সাথে। আগামীকাল যখন নতুন সূর্যোদয়
হবে সে সূর্যোদয়ের সাথে শুরু হবে তার নতুন দিন – নতুন ভাবে।
আমার
জীবনের অন্ধকার অধ্যায়ের বীজ আমি রোপণ করলাম সেদিন রাত্রে ; সেই সাথে নিশুর সাথে পরবর্তীতে
দু তিন বার সাক্ষাতের পর সেটি অংকুরোদ্গমিত হল। আমার এ ফেরারি জীবন নিশুর জন্য নয়
; নয় অন্য কারও জন্য। সহায় সম্বলহীন পথের ভিখারীর মত শুধুমাত্র নিশুর ভালোবাসা বুকে
নিয়ে বেঁচে থাকা আমার জন্য নয়। সবার উপরে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব আমি – নিজেকে ধ্বংস
করে দিব, কিন্তু তারপরেও সেটা আমার চাই।
খুব একটা বেশি সময় লাগল না নিজেকে এই মফস্বল শহরটির
একছত্র অধিপতি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে। বারেক আমার হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে পরে রইল হাসপাতালে - যে কিনা পুরো মফস্বল শহরটির ত্রাস ছিল। সেই সাথে আরও কয়েকটি গ্রুপকে নিয়ন্ত্রন করতে
হল বুলেটের মাধ্যমে। নির্বাচনের আগেই আমার নাম মফস্বল শহরটির সীমানা ছাড়িয়ে পৌঁছে গেল
জেলা শহর পর্যন্ত। নির্বাচনের ঠিক দিন কয়েক আগে আমার ডাক পড়ল জেলা শহরের এক প্রভাবশালী
নেতার । তার নিজ দলের একজন এবং বিরোধী দলের দুজনকে খুন করলাম টাকার বিনিময়ে, এবং নির্বাচনের
ঠিক আগের দিন তার শো ডাউনে গুলি চালিয়ে হত্যা করলাম একজন এবং আহত হল গোটা দশেক , আর
সেটা সেই নেতার হুকুমে।
সেই
নেতা যখন বন ও পরিবেশ মন্ত্রালয়ের মন্ত্রিত্ব নিয়ে ক্ষমতায় এল তখন পুরো জেলার আন্ডারওয়ার্ল্ডের
আমিই একছত্র ডন। আমার নামে তখন অনেকগুলো হত্যা মামলা সহ গোটা বিশেক পরোয়ানা জারী হয়েছে
পুলিশের এখতিয়ারে ; যদিও পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের হামেশাই আসা যাওয়া হয় আমার
দুয়ারে নিমন্ত্রিত অতিথি হয়ে।
এর
অনেক আগেই একদিন আমি গিয়েছিলাম আমার গ্রামের বাড়িতে। বড় চাচাকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে
সরাসরি বললাম, ‘ আমি আপনাকে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি, আমার সেই বিক্রি করা জমি এবং
বাড়ির দলিলপত্র হস্তান্তর করতে। সেই সাথে আমার বাড়ির অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদেরও। চাচা
টাকাগুলো রাখলেন ঠিকই, কিন্তু মনে হয় আমার
কথার অতটা গুরুত্ব দিলেন না যা আমি বুঝতে পারলাম চব্বিশ ঘণ্টা পরেই।
সেদিন
বাইকে চেপে একাই গিয়েছিলাম। বাড়িতে প্রবেশ করেই বুঝতে পারলাম, ওরা তৈরি হয়েই আছে। চাচার
ষন্ডামার্কা ছেলেগুলোর সাথে তাদের সাগরেদ সহ সবাই যেন অপেক্ষায় রয়েছে আমার আগমনের।
উঠোনে একটা খালি চেয়ার ছিল, সেটা টেনে বসলাম।
চাচাকে
বললাম, ‘ কই আমার দলিলপত্র নিয়ে আসুন। আর আপনাকে বলেছিলাম আমার বাড়ির সব অবৈধ স্থাপনা
সরিয়ে ফেলতে, মনে হয় সময় পাননি। সমস্যা নেই, আমি সব ব্যাবস্থা করছি।‘
চাচা
কিছু বলার আগেই তার বড় ছেলে বলল, ‘ ভালোয় ভালোয় চলে যা খালিদ, না হলে কিন্তু জান নিয়ে
ফিরতে পারবি না ।‘
‘
ও আচ্ছা আচ্ছা আচ্ছা। জান নিয়ে ফিরতে পারব না ? ভাল, খুবই ভাল কথা ! কি আর করা যাবে,
দেখি পিতৃদত্ত প্রানটা কতক্ষন পরে আমাকে ছেড়ে চলে যায়।‘
একটা
সিগারেট ধরালাম। চাচার সামনে কোনদিন সিগারেট খাইনি, আজ একবুক ধোঁয়া ছাড়লাম চাচার চোখে
চোখ রেখে। চাচা চোখ নামিয়ে নিলেন, কিছু না বলে বড় ছেলেকে টেনে নিয়ে চলে গেলেন ঘরের
ভিতরে।
আমার
সমন্ধে মনে হয় এরা কিছুই জানে না তাই এতটা আস্ফালন দেখানোর সাহস পাচ্ছে। বুঝতে পারছি
না কখন এরা খেলাটা শুরু করবে। আমারও তাহলে একটু প্রস্তুতি নিতে হয়।
‘
একটু ঝামেলায় পরেছি বাপ। চলে আয় আমার গ্রামের বাড়িতে। ‘ মোবাইলে বললাম সঞ্জয়কে।
বড়
চাচা আসে পাশে নেই, কিন্তু তার দুই ছেলে সহ আর দু তিনজন এগিয়ে এল আমার দিকে।
আমার
ঠিক চার পাঁচ হাত সামনে ওরা দাঁড়িয়ে পড়ল। বড়
রাম দা, গরু জবাই করার বড় ছুরি, লাঠি – এ সব শোভা পাচ্ছে ওদের হাতে হাতে। বড় চাচাও
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়লেন বড় ঘরের দরজার ঠিক সামনে।
‘
জীবনে কোনদিন আর এ বাড়ির ত্রি সীমানায় আসবি না। আর এখন যদি না যাস … ।‘ চাচার বড় ছেলে এক পা সামনে এগিয়ে রাম দা উঁচু করে
ধরল মাথার উপর।
আমার
মাঝে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর হল না। যে রকম বসে ছিলাম, সে রকমই রইলাম। শুধু কোমরে গোজা রিভলবারটি আপনা আপনি চলে এল হাতে।
আগ্নেয়াস্র
দেখে চাচার ছেলে একলাফে তিন হাত পিছিয়ে গেল ! দৌড়ে এলেন চাচা।
‘
আমি আধ ঘণ্টা না, ঠিক পনের মিনিট সময় দিচ্ছি …।‘ বললাম চাচার উদ্দেশ্য।
পনের
মিনিট পার হয়ে গেল । দলিলপত্র নিয়ে চাচা এল না, কিন্তু হাজির হল পুলিশ দলবল নিয়ে।
ওসি
আকরাম মোল্লা চাচার সব কথা শুনলেন, চা খেলেন, তারপর চলে গেলেন। আমি বসেই রইলাম রিভলবার হাতে। আমার সাথে ওসি সাহেবের খুবই সুসম্পর্ক এবং লেনদেনও নিয়মিত।
আট-দশটা মোটর সাইকেল চেপে সঞ্জয়রা এল। খেলা চাচাই শুরু করেছিলেন, এখন আমি এর শেষ টানব। এরপর আর কোন কথা চলে না, চাঁচা আমার জমি এবং বাড়ির দলিলপত্র বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার যে আরও একটু বাকী আছে। চাচাকে বললাম, ‘ আপনি কৌশলে আমার বাড়ি দখল করেছিলেন, ভেবেছিলেন প্রতিবাদ করার মত সাহস বা প্রতিপত্তি কোনটাই খালিদের নেই। আজ এখন এই মুহূর্তে আমি আপনার বাড়ি দখল করলাম এবং আপনাকে একঘণ্টা সময় দিচ্ছি, আপনার সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে বিদেয় হন তারাতারি। আচ্ছা যান, আমার ছেলেরা আপনাকে সাহায্য করবে।‘
আমার
বলার পরে চাঁচা পাথরের মত স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইবেন
কিনা সেটাই হয়ত ভাবছেন মনে মনে। আমি তাকে সে সুযোগ না দিয়ে সঞ্জয়কে বললাম, ‘ কাজে লেগে
পর বাপ !’
ঘণ্টা
দুয়েক লাগল চাচার বাড়ি খালি করতে। কেউ কোন প্রতিবাদ করার সাহস পেল না। সবাই জানে প্রতিবাদ
করলে রক্তের বন্যা বইয়ে দিব। আমার সামান্য খারাপ লাগল চাচীর কান্নাকাটি দেখে ; কিন্তু
ওসব আমি প্রশ্রয় দেয়া বাদ দিয়েছি অনেক আগে থেকেই।
শিবা
ও তার পরিবারকে পাকাপোক্ত ভাবে বাড়িতে বসিয়ে আমি চলে এলাম।
নিশুকে
প্রায় ভুলেই গেছিলাম, অথচ আমি কোনদিন ভাবতে পারিনি তাকে ভুলে আমি থাকতে পারব। আসলে
আমি আমার ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি নিয়ে এতটা ব্যাস্ত হয়ে পরেছিলাম যে নিশুর কথা মনেই পড়ত
না। প্রথমদিকে অবশ্য আমি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে যেতাম নিশুকে একপলক দেখার জন্য – ওকে
দূর থেকে শুধুমাত্র দেখতাম আমি, কিন্তু কখনও মুখোমুখি হতাম না। নিশুকে দেখতাম ও আমাকে
দেখলেই পালিয়ে যেত, কিন্তু আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে তাকিয়ে থাকত অপলক আমারি দিকে।
আমি মনে মনে হাসতাম। আমি জানি, নিশু আজও আমাকে ভালোবাসে এবং বাসবে। ওর পরিবার – পারিপার্শিকতা
হয়তবা তাকে বাধ্য করেছে আমা থেকে দূরে থাকতে। কোন বাবা তার মেয়েকে তুলে দিবে একজন টপ
টেরোরিস্টের হাতে ? আমার সময় শুধুমাত্র এর জন্য দায়ী নয়, নিশুও – কিন্তু নিশুকে আমি
আমার জীবন অধ্যায় থেকে বাদ দিয়ে দিলাম শুধুমাত্র তার ভালোর জন্যই।
আমার
লেখালেখি কিন্তু থেমে নেই। এই তিন বছরের মাঝে আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ, নিজের জীবনের
আলোকে লেখা উপন্যাস শঙ্খচিলের সীমানা এবং আরও একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হল সেই ছদ্দনামেই।
দেশে
আমার প্রকাশিত সর্বমোট বইয়ের সংখ্যা চার, অথচ
কোলকাতা থেকে একটি মাত্র যে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, সেটিই আমাকে খ্যাতি এনে দিল।
আমার দেশের বিদগ্ধ পাঠকের কেউ কেউ জানতে পারেন সে কথা। একটি পুরস্কার পেলাম আমি সেখান
থেকে। আর তার পরেই আমি ভাবতে বসলাম নিজেকে নিয়ে নতুন করে।
নিশু
পড়ে রইল, সেই সাথে পড়ে রইল আমার বিগত পাঁচ বছরের কলঙ্কিত ইতিহাস। আমি জানি, এখন পর্যন্ত
আমি আইনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু যেদিন এই ক্ষমতার চেয়ারেবিষ্ট মানুষটির পরিবর্তন
হবে , সেদিনই আমার স্থান হবে ক্রসফায়ারে অথবা ফাসির বেদীতে।
আমি
সব ছেড়ে আত্মগোপন করার সর্বোৎকৃষ্ট স্থান হিসাবে বেছে নিলাম ধলেশ্বরীর পাড়ের এই বাড়িটি
যা আমি দুই বছর পূর্বে নির্মাণ করেছিলাম। যতদিন বেঁচে থাকব, আমার শুধুই একটাই ধ্যান-জ্ঞান
– আমার লেখালেখি।
আমার
সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল না কেননা আমার একটি উপন্যাসের জন্য বাংলা একাডেমীর পুরস্কার
ঘোষণা করা হয়েছে। আর সেটি আমার চতুর্থ প্রকাশিত উপন্যাস নয়, আমার প্রথম উপন্যাস যা
আমি নিশুকে কেন্দ্র করে লিখেছিলাম।
ইদানীং
নিশুর কথা বেশ মনে পড়ছে।
নিশুর
বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আমেরিকা প্রবাসী এক উচ্চবিত্ত যুবকের সাথে। সপ্তহা খানিক পূর্বে
ওর গায়ে হলুদ হয়ে গেছে এবং আজ রাতে নিশুর বিয়ে।
আমি
বসে আছি ধলেশ্বরীর তীরে আমার বাড়ির একচিলতে উঠোনে। নিশুর সাথে পরিচয়ের প্রথমদিন থেকে
শেষ দিন পর্যন্ত সবই আমার ঘুরে ফিরে মনে পড়ছে, সেই সাথে আমার বিগত বছরগুলির অন্ধকার
সময়।
আজ
এতদিন পরে আমি নতুন করে বুঝতে পারছি, নিশু যদি অন্য কারও বউ হয়ে যায় তবে আমি খালিদ
সইতে পারব না। কি করব তাহলে ? নিশুকে জোর করে তুলে আনব বিয়ের আসর থেকে ? তারপর বিয়ে
করব ?
না,
না, নিশুকে চুল পরিমান কষ্ট বা যন্ত্রণা কোনটাই দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না কারন ওকে
আমি সত্যিকারেই ভালোবাসি, অনেক বেশী ভালোবাসি।
বিধাতা
আমার ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন আমি জানি না, কিন্তু আমি সেই ভাগ্য নিয়েই আজ একটি খেলা
খেলব – ভালোবাসার খেলা অথবা একটি সুইসাইড।
টেবিলের
উপরে রাখা রিভলবারটি তুলে নিলাম আমি। ডান কানের ঠিক ইঞ্চি খানিকে উপরে আগ্নেয়াস্রের
নল ঠেকালাম, হ্যামার টানলাম - ।
এখন
ট্রিগার চাপার পরেই যদি বুলেট আমার মস্তিষ্ক বিদীর্ণ করে তবে ভালোবাসার এই খেলার এখানেই
সমাপ্তি হবে। পরদিন পত্রিকার শিরোনাম হবে – ‘ শহরের আন্ডার অয়ার্ল্ডএর শীর্ষ সন্ত্রাসী
আবু খালিদ এর আত্মহত্যা। কিন্তু কেউ কোনদিন জানবে না যে বাংলা একাডেমীর পুরস্কার প্রাপ্ত
বিশিষ্ট লেখক-কবি আবু খালিদ – ছদ্দনামে রাজবন্দীর আত্মহত্যা।
পৃথিবীর
সাথে সব লেন্দেন চুকিয়ে ট্রিগার টানলাম আমি।
আলোকসজ্জায়
পরিপূর্ণ বিয়ে বাড়ি। ভিতর থেকে হাজারো মানুষের কোলাহল ভেসে আসছে। নিশুদের বাড়ির সামনের
রাস্তাটার দু পাশ ভরে আছে হরেক রকম প্রাইভেট কার, মোটর সাইকেল সমেত নানা যানবাহনে।
মাইক্রটাকে সেখানে রেখে আমি একা এসে দাঁড়ালাম গেটের সামনে। নাহ, নিশুদের বাড়ির দাড়োয়ান
আমাকে বাধা দেওয়ার সাহস দেখাল না, ভীত বিহব্বল দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে রইল খোলা গেটের একপাশে
দাঁড়িয়ে। আমি ভিতরে প্রবেশ করলাম।
বিয়ে
বাড়ির অতিথিদের বেশীরভাগই আমাকে চেনেন, আচমকা
আমাকে দেখে তাদের কলরব থেমে গেল। বাড়ির উঠোনের একপাশে বিয়ের প্যানেল সাজানো
হয়েছে, সেখানে আসনে উপবিষ্ট হয়ে বসে আছে নিশু বধু সাজে। বরটিও সেখানে আছে, আছে কাজী
সাহেব, নিশুর বাবা সহ সবাই। বিয়ে পরানোর কাজ এখনও শুরু হয়নি, হয়তবা একটু পরেই শুরু
হবে। যাক, আমি ঠিক সময়মতই এসেছি।
চেয়ারে
অসীন অতিথি সারির মাঝখান দিয়ে আমি সোজা চলে এলাম প্যানেলের নিচের উঁচু জায়গাটিতে, ঠিক
নিশুর সামনে এসে দাঁড়ালাম।
‘এই
রিভলবারটা গুলিতে পূর্ণ। যদি তুই প্রতিবাদ করিস তাহলে এর একটা বুলেট তোর জন্য, একটা
তোর বাবার , আর একটা রইল আমার জন্য। আমাকে তো তুই ভাল করেই চিনিস ।‘ বাম হাত দিয়ে বসা
অবস্থায় থাকা নিশুকে টেনে দাড় করিয়ে ডান হাত দিয়ে কোমরে গোজা রিভলবার বের করে সোজা
নিশুর কপালে ঠেকিয়ে কথাগুলো বললাম আমি।
নিশু
এতটাই বিহব্বল হয়ে পড়েছে যে আমাকে কিছু বলতেও পারল না। তবে কোন প্রতিবাদও সে করল না।
আমি ওকে টানতে টানতে নিয়ে এলাম মাইক্রোবাসের সামনে, ঠেলে বসিয়ে দিলাম সিটে। আমাদের
গাড়ি চলল, পিছনে পরে রইল হাজারো মানুষের হাজারো কৌতূহল পূর্ণ অবাক দৃষ্টি।
নিশু
আর আমি এখন বসে আছি সামনাসামনি – ধলেশ্বরীর বাড়ির সেই উঠোনের সেই যায়গায়, যেখানে বসে ছিলাম আমি ঘন্টা দুয়েক পূর্বেও। এখন পর্যন্ত নিশু
একটি কথাও বলেনি – আমিও কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। একটি সিগারেট ধরালাম।
‘
কেমন আছিস নিশু ?’
শেষ
কয়েকবারের ব্যাতিক্রমতা ছাড়া অতীতে যখন আমি ওর মুখোমুখি হয়েছি আমার সন্মোধন
শুরু হত এই বাক্য দ্বারা। আর ও সরাসরি উত্তর না দিয়ে শুরু করত পাল্টা প্রশ্ন দিয়ে,
- ‘তুই কেমন আছিস রে ?’ এর শেষে কখনও যোগ করত ‘গাধা’, কখনও ‘ভ্যাবলা’ ইত্যাদি। আমি
তখনি বলে উঠতাম, ‘তোর জামাইকে এসব কথা বলতে লজ্জা করে না ?’ অতপর ধুপধাপ কিল। সে সময় নিশু ছিল খুবই ছেলে মানুষ।
আর আজ - ।
আমার
প্রশ্নের কোন উত্তর নিশু দিল না। জ্যোৎস্নার মৃদু আলোয় আমি তার অশ্রুসজল চোখদুটো দেখতে
পেলাম না, কিন্তু ওর কান্নার সব্দ শুনতে পেলাম পরপরই।
‘প্লিজ,
কাঁদবি না।‘
‘আমার
জীবনটা তুই নষ্ট করে দিলি ক্যান ?’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল সে।
আমি
হাসলাম। বললাম, ‘না, আমি তোর জীবন নষ্ট করিনি কিংবা করবও না।‘
‘একটা
মেয়েকে বিয়ের আসর থেকে একটা কুখ্যাত সন্ত্রাসী তুলে আনলে তার জীবনের আর কিইই বা বাকী
থাকে ?’
‘বাহ,
খুব ভাল বলেছিস। কুখ্যাত সন্ত্রাসী ! হ্যাঁ, আজ আমাকে কুখ্যাত সন্ত্রাসী হিসাবেই সবাই
চিনে, একজন খুনি আমি। আর জীবনের প্রথম খুনটা আমার দ্বারা হয়েছিল শুধুমাত্র তোর জন্যই।
নাহ, আমি তোকে দোষারোপ করছি না। আসলে আমার নিয়তিতে এইই লেখা ছিল।‘
একটু
থেমে আমি বললাম, ‘ আসলে সেটা ছিল একটা দুর্ঘটনা। আর সেই দুর্ঘটনা আমার জীবনটা ধ্বংস
করে দিল। ফেরারি হলাম আমি। যখন ফিরে এলাম, পথের ভিখারির সাথে পার্থক্য ছিল না আমার।
তোর প্রতি আমার ভালোবাসা কিন্তু ঠিকই আছে তখন। কিন্তু কৌশলে তুই আমাকে প্রত্যাখ্যান
করলি। না, আমি তোর দোষ কখনও দিব না। একদিকে ভিটেমাটি হীন পথের ভিখারি আমি ; একদিকে
আইন- অন্যদিকে তোর প্রত্যাখ্যান। জীবনটাকে একটা কন্টকিত যন্ত্রণা মনে হল আমার। সেই ঝিনুক নদীর পাড়ে বসেই ভাবলাম আমি,
নাহ – আমার এই জীবনের কোন আশা নেই, নেই কোন অবলম্বন কিংবা ঠিকানা। ব্যাস, আজকের এই
আমির রুপান্তর হল সেদিন থেকেই।‘
নিশু
এখন কাঁদছে না, কিন্তু কিছুও বলছে না। থাকুক
ও চুপ করে, আজ আমি একলাই বলব, বলব আমার যত কথা সব তাকে।
‘আচ্ছা,
যখন আমি ফিরে এলাম ইন্ডিয়া থেকে, মুখোমুখি হলাম তোর – আমাকে তখন তুই ভালোবাসতি না
? আজকের কথা বাদ দে। আমাকে শুধু এইটুকু বল – আমাকে কি ভা্লোবাসতি ?’
‘বাসতাম।‘
‘তাহলে
আমার সাথে এমন আচরণ করলি কেন তুই – যেন আমাকে তুই চিনিসই না ?’
একটা
দীর্ঘশ্বাস ফেলল নিশু। আমি বললাম, ‘ প্লিজ বল। কিন্তু তার আগে বলে নিচ্ছি তোকে এখানে নিয়ে আসার পিছনে আমার কোন খারাপ উদ্দেশ্য
নেই। যাকে সত্যিকারে ভালোবাসা যায়, তার ক্ষতি করা কখনও সম্ভব না। আসলে আজ আমি নিজের সাথে ফয়সালায় বসেছি – আর সেখানে তুই
জড়িত। বড়জোর ঘণ্টাখানিক এখানে থাকতে হবে তোকে, তারপর … , আচ্ছা, সেটা পরে বলছি। এখন
তুই তোর কথা বল আমাকে। ‘
‘কি
শুনতে চাস তুই ? তোর আর আমার ব্যাপারটা তো পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে ওপেন সিক্রেট ছিল, তাই
না ? আমার জন্য তুই খুন করলি, তারপর পালালি ; বিশ্ববিদ্যালয়ে গোটা ব্যাপারটা আমার জন্য
কতটা কাল হয়ে দাঁড়াল তা কি তুই ভেবে দেখেছিস ? তারপর ধর আমার পরিবারের কথা। এতদিন তোর
আর আমার সম্পর্কের কেউ জানত না, কিন্তু এরপরে তারা জেনে গেলেন। বাবা আমার পড়ালেখা পর্যন্ত
বন্ধ করে দিলেন, মাস দুয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হল না আমার। তারপর অবশ্য অনুমতি মিলল
সর্ত সাপেক্ষে – তোকে বাদ দিতে হবে আমার জীবন থেকে। আর তাদের অবাধ্য হবার সাধ্য আমার
নেই।‘
একটু
বিরতি নিল নিশু, ‘অথচ আমাদের পরিকল্পনা ছিল, ,তুই পড়ালেখা শেষ করবি – আমিও, ভালো একটা
চাকরি হবে তোর, আমি তোকে নিয়ে দাড় করাব বাবার সামনে। আশা ছিল, বাবা তখন তা মেনে নিতেন।‘
‘যাক,
ও প্রসঙ্গ বাদ দে। সময় আমাদের দুজনকে ঠেলে দিয়েছি দু প্রান্তে। তবে তুই যা করেছিস
– ঠিক আছে নিশু ; ভুল সবটুকু আমারই। আর সব ভুলের অবসান হবে আজ। আচ্ছা, তুই একটু বস,
আমি আসছি।‘
আমার
প্রকাশিত সবগুলো বই নিয়ে এলাম। কোন বইয়েই উৎসর্গ পত্র নেই, যদি থাকত তবে বেশীরভাগই
নাম থাকত নিশুর। বইগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় একটি কথাই লিখেছি আমি – ‘আমার ভালোবাসার নিশুকে।‘
নীচে আমার নাম লেখা – রাজবন্দী।
বইগুলো
নিশুর সামনে টেবিলে রাখলাম। বললাম, ‘এগুলো তোর জন্য। আজ তোকে আমি একটু চমকে দিব। বইগুলো
দ্যাখ।‘
নিশু
একটা বই হাতে নিল – পড়ল সে লেখাটা, চমকে মুখ তুলে চাইলো আমার পানে।
‘রাজবন্দী
?’
‘অন্য
বইগুলোও দ্যাখ।‘
নিশু
অবাক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। আমি বললাম, ‘কিছু বলবি না ?’
‘তুইই
রাজবন্দী ?’
‘রাজবন্দীর
জন্ম খালিদ থেকে। সেই খালিদকেই তুই এতদিন প্রত্যাখ্যান করেছিস। এখন যদি তুই ফিরে আসিস
তো তোর ফিরে আসা মানে রাজবন্দীর জন্যই ।‘ রাজবন্দী
অমর, খালিদের মৃত্যু হলে তাই কি বা এসে যায় । ‘
সামান্য
হাসলাম আমি।
‘নিশু
তোকে ভালোবাসি এবং সময়ের শেষ পর্যন্ত বাসব ।‘
নিশু
কাঁদছে, কিন্তু ওর কান্না আমি শুনতে পাচ্ছি না। ধলেশ্বরী নদীর এপাড়ে আমার বাড়ির ঠিক
সামনেই ওযুৎ নিযুৎ জোনাকির মেলা। ওরা নিজেদের মোধ্য গুঞ্জন করছে – আমি শুনতে পাচ্ছি,
যা কোনদিনই পাইনি। জ্যোৎস্নার অপার্থিব আলোয় আমি যেন ভেসে চলছি সেই জোনাকিদের সাথে।
পরমুহুর্তেই রিভলবারের ট্রিগারে আঙ্গুল চেপে বসল আমার ।
শামীম
আল মামুন
রিয়াদ,
সৌদি আরব
২৪.০২.২০১০