পিচাশপ্রেম ।
8th April.
টাকসন শহরে যখন পৌছালাম তখন সূর্য ঠিক মাথার উপরে। সময়টা গ্রীষ্মকাল। ঘন্টার পর ঘন্টা এসি বিহীন টয়োটা চালিয়ে গ্রীষ্মের দাবদাহে গাড়ির মধ্য যেন ‘ডিম সিদ্ধ’
হয়ে গেছি। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যেতে চাইছে। মন আনচান করছে ঠাণ্ডা পানীয়র জন্য।
সুতরাং বারে ঢুকে প্রথমেই অর্ডার করে বসলাম লেমন সোডার।
সপ্তাহ খানিক পূর্বে সানফ্রান্সিসকোতে গিয়েছিলাম একটা অপরাধ চক্রের পিছু
নিয়ে। মাদকদ্রব্যের বিশাল এক গ্যাং। সানফ্রান্সিসকো পুলিশের সহায়তায় অপরাধ
চক্রটিকে ধরার কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছি, এমন সময় ‘উপরওয়ালার’ জরুরি তলব। অবশ্য তাতে
অসুবিধার কিছু নেই, কেননা হ্যারিসন ওখানেই থাকছে। হ্যারিসনকে আমা থেকে কোন ভাবেই
খাটো করে দেখার উপায় নেই।
ওকলাহোমাতে যখন পৌছালাম, সময় প্রায় বিকেল। রাস্তার ধুলোবালিতে আমার অবস্থা
বেশ শোচনীয়। গোসল সেরে মাত্র সিগারেট ধরিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছি- এমন সময় আমার
সহকারী বাঙ্গালি অফিসার অমিত ভট্টাচার্য এসে বলল, উপরওয়ালা অর্থাৎ চীফ এক্ষুনি
আমাকে তলব করেছেন।
চীফের উপর অসম্ভব মেজাজ বিগড়ে গেল। বুড়ো আমাকে এক মিনিটের জন্যও বিশ্রাম
দিতে নারাজ। খালি কাজ আর কাজ ! কাজ ছাড়া এই বুড়ো কিছুই বোঝে না। বুড়োটাকে যদি
সানফ্রান্সিসকো থেকে এই দাবদাহে গাড়ির হুইল ধরিয়ে দিয়ে ওকলাহোমা পর্যন্ত আনতে
পারতাম, তবে বুড়ো বুঝত- কাজ কাকে বলে, ও কত প্রকার ও কি কি !
অফিসে এসে চীফের রুমে প্রবেশ করলাম। বুড়ো উল্টো দিকে বসে আপন মনে চুরুট টানছে।
সম্ভাষণ জানিয়ে শুরু করব, কিন্তু তার আগে আমার দিকে না ঘুরেই বুড়ো বলল-
‘তোমাকে আজই এলপেসো যেতে হবে’।
অন্য কোন কথা নয়, এমনকি যে দায়িত্ব নিয়ে সানফ্রান্সিসকোতে গিয়েছিলাম- তার
অগ্রগতি নিয়েও নয়। একটু থতমত খেয়ে বললাম-
‘আজকেই যেতে হবে?’
‘হ্যাঁ, এবং এক্ষুনি’।
‘কিন্তু কেন?’
‘এলপেসোর ইন্সপেক্টর তোমাকে সব গুছিয়ে বলবে’।
কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে থাকলাম। কিন্তু বুড়ো নির্বাক। বুঝতে পারলাম, এতদূর
এসেছি শুধুমাত্র বুড়োর হুকুম শুনতে।
রাস্তায় নেমে অসম্ভব রাগ হল। অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে একমিনিটও বিশ্রামের
সুযোগ পাইনি, অথচ এক্ষুনি আবার যাত্রা শুরু করতে হবে। ইচ্ছে হচ্ছে চাকুরি ছেড়ে
দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই- হারামজাদা বুড়োটা পরে থাক। কিন্তু এর আগেও দু দুবার ইস্তফাপত্র
নিয়ে বুড়োর কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু ওই রুমে যাওয়া পর্যন্তই- সাহস আর হয় নি।
9th April.
গতকাল পৌছাতে বেশ
রাত হয়েছিল। পুরো সময় ছিলাম রাস্তার ‘পরে। বিশ্রামের জন্য শরীরের সমস্ত পেশীগুলো
যেন বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছিল। সুতরাং এসেই দিয়েছিলাম লম্বা ঘুম। ঘুম ভাঙ্গল সকাল
নয়টার দিকে। ‘ঘুম ভাঙ্গল’ বললে ভুল হবে, কারন অমিতই জাগিয়ে তুলল আমাকে।
‘ইন্সপেক্টর
ভিক্টর রিও আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন।'
‘কোথায়?’
‘ড্রইং রুমে
আছেন।'
‘ঠিক আছে। ইন্সপেক্টরকে
আরেকটু অপেক্ষায় থাকতে বল ।'
শরীরের উপর ঘুমের
শেষ চিহ্নটুকু দূর করে দশ মিনিটের মোধ্য ড্রইং রুমে প্রবেশ করলাম। ইন্সপেক্টর
দাড়িয়ে বুটের গুরুগম্ভীর শব্দ তুলে সম্ভাষণ জানাল আমাকে।
‘আপনাকে অনেকক্ষণ
বসে থাকতে হল বলে দুঃখিত।'
‘না স্যার, আমি
ক্ষমাপ্রার্থী আপনাকে বিরক্ত করার জন্য।'
একটুপরে ধোঁয়া
উঠা গরম কফির সাথে স্যান্ডউইচ এল। অমিতকে বললাম, আমার ব্রেকফাস্ট এখানেই পাঠিয়ে
দেয়ার- নাস্তা সারতে সারতে ইন্সপেক্টর এর নিকট থেকে জেনে নেয়া যাবে সবকিছু।
আপাত, পুলিশ
ষ্টেশন সংলগ্ন অতিথিশালায় উঠেছি। ইন্সপেক্টর কাছেই পুলিশ ষ্টেশনে থাকেন। গতকাল
রাতে একটা খুনের তদন্তে শহরের বাইরে গিয়েছিলেন, তাই রাতে আমাদের সাথে দেখা করতে
পারেন নি- ইন্সপেক্টর বলছিলেন এ কথা।
পাউরুটির উপর
পিনাট বাটার এবং জেলি মাখাতে মাখাতে ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করলাম-
‘ইন্সপেক্টর, দয়া
করে বলবেন কি কেন এত জরুরী ভিত্তিতে আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে?’
‘অবশ্যই স্যার’।
স্লাইস পাউরুটির
খন্ড মুখে পুরে চিবুতে চিবুতে বললাম- ‘তাহলে শুরু করুন’।
‘গত তিনদিনে
এলপেসো এবং ফিনিক্স শহরে চার চারটি খুনের লাশ পাওয়া গেছে ।'
আমার পাউরুটি
চিবানো বন্ধ হল। বড় বর চোখে তাকালাম তার দিকে। ইন্সপেক্টর এসব বলছে কি !
ইন্সপেক্টর বলতে
লাগলেন-
‘প্রথম লাশটি
পাওয়া যায় এলপেসোতে মিস্টার রজার কুকের খামারের শেষ মাথায়- তারকাটার বেড়ার ওপাশে। ভদ্রলোক
সকাল বেলায় খামারে পায়চারির সময় আবিষ্কার করেন লাশটি। সংবাদ পেয়ে দশ মিনিটের
মোধ্যে পৌঁছে যাই ঘটনাস্থলে। লাশটি রাস্তার পাশে, খামারের বেড়ার প্রান্ত ঘেসে
অনেকটা ঝোপের মাঝে পরে ছিল। মিস্টার রজারের সাথে আলাপচারিতায় জানতে পারি, তার পোষা
কুকুর সঙ্গে নিয়ে এদিকটায় যখন যাচ্ছিলেন; হঠাৎ কুকুর প্রচন্ড ঘেউ ঘেউ করে ছুটে যায়
ওদিকটায় এবং তিনি দেখতে পান লাশটি। কিভাবে লাশটি এখানে এল তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে
ধারনা করা হয়, গাড়ি থেকে এখানে ফেলে দেয়া হয়েছে।'
ইন্সপেক্টর এটুকু
বলে থামলেন। সামান্য বিরতি নিয়ে আবার শুরু করলেন-
‘ লাশটি আট-দশ
বৎসরের এক কৃষ্ণাঙ্গ বালকের। প্রথমে ভেবেছিলাম, বর্ণবাদ কিংবা কোন শত্রুতার জের
হিসাবে এ হত্যাকাণ্ড। কিন্তু উল্টো হয়ে থাকা লাশটা যখন সোজা করা হয়, তখন আমার
ধারনা ভুল বলে প্রমানিত হয়। বর্ণবাদ কিংবা শত্রুতার জের হিসাবে যদি হত্যাকান্ড
খুনি ঘটিয়ে থাকে, তবে সে অবশ্যই তড়িৎ কাজটি সেরে ফেলবে। হয়তবা তাকে নির্যাতনও করতে
পারে, কিন্তু তা এরকম কখনও নয়।'
‘লাশের দেহে কি
রকম হত্যাকাণ্ডের আলামত পাওয়া গিয়েছিল?’
‘সেটা খুবই
অমানবিক স্যার। লাশের বক্ষপিঞ্জরে গভীর কালো গর্ত ছিল। পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্টে
পাওয়া যায়, লাশের বক্ষপিঞ্জর ধারালো ছুরির সাহায্যে চিড়ে ফেলা হয়েছে এবং সবচেয়ে
অমানবিক যেটা- লাশের কোন হৃৎপিণ্ড ছিল না, সমূলে উৎপাটন করা হয়েছে। লাশের
নাভিমূলের চতুপাশে উল্কিদিয়ে সূর্য আকা এবং বৃত্তের ভিতরে ছিল কালো পোড়া দাগ। মনে
হয় হত্যার পূর্বে এখানে কিছু জ্বালানো হয়েছিল এবং পোস্টমর্টেমে এর অস্তিত্ব প্রমান
হয়েছে।'
‘আপনার কি ধারনা
এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে?’
‘আমার যতদূর
ধারনা- সয়তানের কোন উপাসকের কাজ এটি।‘
পুরো ত্রিশ
সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম ইন্সপেক্টরের মুখপানে। তারপর প্রশ্ন করলাম-
‘কি ভাবে
বুঝলেন?’
‘এ বিষয়ে আমার
সামান্য ধারনা আছে’- ইন্সপেক্টর একটু থেমে বললেন-
‘লাশের কোন
হৃৎপিণ্ড ছিল না। উপাসক হৃৎপিণ্ড খুবলে নিয়ে উৎসর্গ করে বেদীতে- সয়তানের প্রভুত্ব
লাভের জন্য। উপাসনাপর্বে নাভিমূলে অজ্ঞাত কোন পদার্থও জ্বালানো হয়। আমরা
নাভিমূলে যে পোড়াদাগ পেয়েছি।'
‘লাশের হাতের
কব্জি কিংবা পায়ে কোন দাগ পেয়েছিলেন?’
‘কিসের দাগ স্যার
?’
‘এই ধরুন, বেঁধে
রাখার।'
‘না স্যার ।'
‘আপনি বলতে
চাচ্ছেন, লাশের জীবন্ত অবস্থাতেই হৃৎপিণ্ড তুলে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু সেটা কিভাবে
সম্ভব?’
‘সম্ভব স্যার।
কারন আগেই সেন্সলেস করে নেয়া হয়েছিল।'
‘পোস্টমর্টেমে সে
ধরনের কোন আলামত পেয়েছেন ?’
‘পাওয়া গেছে।
লাশের টিস্যু বিন্যাসে এবং রক্তে একধরনের রাসয়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে, যার সাথে
পরিচিত কোন রাসয়নিকের মিল নেই। ধারনা করা হয় এহা কোন অজ্ঞাত শক্তিশালী মাদক এবং
প্রবেশ করানো হয়েছে লোমকূপের মধ্য দিয়ে ।'
‘লাশ যেখানে
পাওয়া গেছে, সেখানে কোন সুত্র-টুত্র পেয়েছিলেন?’
‘না স্যার। অন্য
কোন আলামতই পাওয়া যায়নি। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টদের দ্বারা লাশ এবং উক্তস্থান
উভয়ই পরীক্ষা করানো হয়েছিল, কিন্তু কোন ছাপই পাওয়া যায়নি। কোন বিশেষ উপায়ে সব মুছে
ফেলা হয়েছে।'
‘লাশ যখন
পেয়েছিলেন তার কতক্ষণ পূর্বে হত্যা করা হয়েছিল ?’
‘বিশেষজ্ঞদের
ধারনা, বিশ ঘণ্টা পূর্বে। অর্থাৎ আগেরদিন দুপুরবেলা।' একটু থেমে ইন্সপেক্টর আবার
শুরু করলেন-
‘দ্বিতীয় লাশটিও
পাওয়া যায় এলপেসোতে। তবে এবার শহর থেকে একটু দূরে- পাহাড়ের পাদদেশে। তৃতীয় এবং
চতুর্থটি পাওয়া যায় ফিনিক্সে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় লাশটি দুজন নিগ্রো বালিকার।
চতুর্থজন এক কৃষ্ণাঙ্গ বালক। প্রত্যেকটি লাশের হত্যাকাণ্ডের আলামত একই এবং সবকয়টি
লাশের বয়স সাত থেকে বারোর মাঝে। হত্যাকাণ্ডের আরেকটি নির্দেশনা- প্রত্যেকেই
কৃষ্ণাঙ্গ বালক কিংবা বালিকা।'
‘পরবর্তী
খুনগুলোর ক্ষেত্রে কোন দিক নির্দেশনা পাননি?’
‘পাওয়া যায়নি
স্যার। অপরাধী খুবই চালাক প্রকৃতির বলে ধরে নেয়া যায়।'
‘হু, বুঝতে
পেরেছি।'
‘তবে স্যার, ধরা
পরতেই হবে। প্রত্যেকটি স্থানে গোয়েন্দা পুলিশ মোতায়ন করা হয়েছে।‘
ইন্সপেক্টর চলে
যাওয়ার পর রুমে এসে সিগারেট ধরিয়ে তার কথাগুলোই ভাবতে লাগলাম-
প্রতি ক্ষেত্রেই
ব্যার্থ হয়েছে পুলিশ। তদন্তের অগ্রগতি হবে এ ধরনের কোন গুরুত্বপূর্ণ সূত্র
আবিষ্কার হয়নি। এটা অপরাধীর জন্য বড় প্লাস পয়েন্ট। পুলিশ পুরোপুরি তদন্তে নামার
আগেই এই চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তৃতীয় এবং চতুর্থ লাশটি পাওয়া গেছে নির্জন স্থানে।
ইন্সপেক্টরের ভাষ্যমতে দুদিন যাবত লাশ দুটি আলাদা স্থানে পরে ছিল। লাশের অনেক অংশই
ছিল নষ্ট। দু দিন ধরে পরে থাকলে তা জন্তু জানোয়ারের খোরাক হত, বিশেষ করে হায়েনার-
কারন এখানে সর্বত্রই এই প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু তা হয়নি। এটা একটা রহস্য
বটে।
প্রথম লাশটি
পাওয়া গেছে চারই এপ্রিল এবং একই দিনে পাওয়া যায় দ্বিতীয়টি। প্রথম লাশটি হত্যা করা
হয়েছিল ২ই এপ্রিল এবং দ্বিতীয়টি ১লা এপ্রিল। পরবর্তী লাশদুটো পাওয়া যায় ছয় এবং সাত
তারিখে এবং হত্যা করা হয়েছিল মোটামুটি পাঁচ এবং ছয় এপ্রিলে।
এপ্রিলের
প্রথমদিন থেকেই শুরু হয়েছে এই হত্যাকাণ্ড- এর পূর্বে ঘটেনি একটিও। হটাৎ করে
ধারাবাহিকভাবে এত হত্যাকাণ্ডের কারন কি ? যতদূর জানি, গত তিন বছরে এ রকম ঘটনা
একটিও ঘটেনি। আচানক মনে পরে গেল বছর পাঁচেক আগে এলপেসোর পাশের রাজ্য সানএন্টেনিওতে
এ ধরনের একটি লাশ পাওয়া গিয়েছিল। বর্তমান হত্যাগুলির সাথে প্রচুর মিল ছিল লাশটির।
গোয়েন্দা পুলিশ সেই লোকটিকে ধরে ফেলেছিল। বিচারে তার ফাঁসি হয়। সে সময় ঘটনাটি
পত্রিকায় বেশ আলোড়ন তুলেছিল। সবচেয়ে আশ্চর্য, ফাঁসি হবে জেনেও লোকটি বিস্তারিত মুখ
খুলেনি। তবে স্বীকার করেছে, তার সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির জন্য ঘটিয়েছিল হত্যাকাণ্ড
এবং তার সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং সয়তান!
তবে কি ভিক্টর
রিয়োর ধারনা সত্য? আপাত প্রমানাদি তো তাই বলে।
অমিতকে নিয়ে
একবার ফিনিক্সে যেতে হবে।
10th April.
ছবির মত সাজানো
সুন্দর ছোট্ট শহর ফিনিক্স। অবশ্য এমেরিকার কোন শহরই ছোট নয়। শহরের অদূরে প্রচুর
খামারের ছড়াছড়ি। বেশিরভাগই ডেইরী ফার্ম। এলপেসো থেকে ফিনিক্স চল্লিশ কিলোর মত পথ।
রাস্তাটা সানফ্রান্সিসকো থেকে সানডিয়াগো, টাকসান, ফিনিক্স হয়ে সরাসরি সানএন্টেনিওর
দিকে গিয়েছে। অবশ্য এলপাসোতে এসে রাস্তা দুভাগ হয়ে আরেকটি চলে গেছে ওকলাহামার পথে। ফিনিক্স থেকে আরেকটি রাস্তা একেবেকে চলে গেছে ডেনভারের পার্বত্য অঞ্চলের দিকে।
ফিনিক্স পুলিশ
ষ্টেশনে যখন পৌঁছালাম তখন পুরোপুরি বিকেল। সূর্যাস্তের আরও ঘণ্টা দুয়েক বাকি। সাব
ইন্সপেক্টর রিচার্উ রিওমি জানতেন আমার আগমনের খবর। পৌঁছানো মাত্র তাই সাদর
অভ্যর্থনা জানালেন।
ফিনিক্স পুলিশ
ষ্টেশনে কোন ইন্সপেক্টর নেই। পদটি খালি আছে পুরো এক সপ্তাহ যাবৎ। বদলীকৃত
ইন্সপেক্টর অসুস্থ থাকার কারনে তার দায়িত্ব এখন রিওমিকেই পালন করতে হচ্ছে।
সাব ইন্সপেক্টর
মধ্যবয়সী হাসিখুশি টাইপের মানুষ। তার কাছে ফিনিক্স শহরের শেষ দুটো হত্যাকাণ্ড
সমন্ধে জানতে চাইলাম। কিন্তু তার বর্ণনায় নতুন কিছুই পেলাম না। ঘুরে ফিরে
ইন্সপেক্টর ভিক্টর রিয়োর কথারই বহিঃপ্রকাশ।
সন্ধ্যায় চলে যাব
শুনে রিওমি ঘোর আপত্তি জানালেন। ‘একদিনের জন্য হলেও আথিথিয়তা গ্রহন করতে হবে
আমাদের’- রিওমির সরল উক্তি। বেচারার মুখের দিকে চেয়ে ‘না’ করতে পারলাম না। কিন্তু
তাই বলে বিকেলটা এখানে নষ্ট করতে চাই না।
সমস্ত বিকেল ফিনিক্সের অলি গলি সবখানেই ঘুরে বেড়ালাম। শহরটাকে ভালো মত চিনে রাখা দরকার।
ভবিষ্যতে এ থেকে সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া আরও একটি কারন ছিল- ফিনিক্সে খুন
দুটি সমন্ধে যদি নতুন কিছু জানা যায়। অবশ্য তার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
তদন্তের স্বার্থে সন্ধ্যার পরপরই অমিত চলে গেল অন্যত্র।
আমি প্রবেশ করলাম জরাজীর্ণ এক কফি হাউসে।
ভেতরে তেমন একটা
ভীর নেই। এক কোনার চার পাঁচজন লোক কফির পেলালায় ঝড় তুলে গল্প করছে। তাদের গল্পের
বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিশ্চয়। অঙ্গভঙ্গি এবং মুখের চাউনির ভাষা দেখেই
অনুমান করলাম।
ওদের থেকে একটু
দূরত্ব রেখে বসলাম খালি জায়গাটাতে।
একটু পর কফি এল।
পেয়ালায় চুমুক দিয়ে মনোনিবেশ করলাম ভেসে আসা কণ্ঠস্বরগুলোর দিকে। বক্তা একজন
বৃদ্ধ, আর স্রোতা মাঝবয়সী চার জন। কথাবার্তার প্রসঙ্গ সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড নিয়ে।
‘আমি জানি’-
বৃদ্ধ বলতে লাগলেন, ‘এগুলো স্বয়ং সয়তানের কাজ। কোন মানুষের পক্ষে এতটা নির্মম হওয়া সম্ভব না। আর সয়তান যদি কোন মানুষের উপর ভর করে তবে তো কথাই নেই।'
‘সয়তানের কাজ?’ উৎসাহী
একজন স্রোতা প্রস্ন করল।
দেখা যাচ্ছে
হত্যাকাণ্ডগুলো জনমনে বেশ প্রভাব ফেলছে। আর ফেলবেই বা না কেন ? এ তো সাধারন কোন
ঘটনা নয়। সুতরাং এই স্বাভাবিক।
একটু পরে লাশের
প্রসঙ্গ পাল্টে বৃদ্ধ ফিরে গেল সূর্যগ্রহন প্রসঙ্গে। আড্ডা কিংবা আলোচনার ক্ষেত্রে
এক বিষয় বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়না।
মাসখানেক পূর্বে
পত্রিকাতে এই সূর্যগ্রহন সংক্রান্ত সংবাদ যখন ছাপা হল, তার পর থেকেই বেশ মেতে আছে
লোকজন এ নিয়ে। তার সাথে হত্যাগুলো মিলে আড্ডা কিংবা আলোচনার পরিবেশ আরও ভারী
করেছে। সূর্যগ্রহনের দিন যতই এগিয়ে আসছে, এ সংক্রান্ত আলোচনা জমজমাট হচ্ছে তত
বেশি। যে কোন আড্ডাতে এ দাঁড়িয়েছে মূল আলোচনা হিসাবে। তাছাড়া আমেরিকার লোকজন একটু
বেশি হুজুগে প্রকৃতির। মনের মত একটা বিষয় পেলে তা নিয়ে মেতে উঠা চাইই চাই। জনগনের
দোষ দিয়ে লাভ নেই। তাছাড়া এই সূর্যগ্রহন নিয়ে আলোচনা হবেই বা না কেন ? সামনের এই
সূর্যগ্রহন হবে শতাব্দীর দীর্ঘতম পূর্ণ সূর্যগ্রহন। পূর্ণগ্রহন চৌদ্দ মিনিট
তেত্রিশ সেকেন্ড স্থায়ী হবে এবং শেষ হবে দুপুর একটা পঞ্চান্ন মিনিটে। সূর্যগ্রহন
শুরু হবে সকাল দশটায় এবং দুপুর ঠিক বারোটায় শুরু হবে পূর্ণ গ্রহন। পৃথিবীর সব
জায়গা থেকে পূর্ণ সূর্যগ্রহন দেখা যাবে না। কেবল মাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অংশ,
কানাডা, মেক্সিকো, ব্রাজিল এবং গুয়েতেমালা থেকে দেখা যাবে পূর্ণ সূর্য গ্রহন।
আমেরিকা সহ অন্যান্য দেশের বড় বড় বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সাধারন মানুষ- সবাই অধীর
অপেক্ষায় সেই দিনটির জন্য।
ক্যাফে থেকে
রাস্তায় নামলাম। ড্রাইভ বরাবর অমিতই করে থাকে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে এখন আমাকেই
করতে হচ্ছে।
মগজ এখন ‘সূর্য গ্রহন’ নিয়ে খেলছে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন সূর্য গ্রহন প্রকৃতি এবং প্রাণীর উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। অবশ্য মানুষের উপর প্রভাব পরে কিনা তা জানা যায় নি। সূর্য গ্রহনের সময় কিছু কিছু প্রাণী অদ্ভত আচরন করে। তারা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে এক অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম, এক অলস সিংহকে দুই দিন ক্ষুধার্ত রেখে পূর্ণ গ্রহনের সময় আস্ত একটি মোষের রান দেওয়া হয়, কিন্তু সিংহটি মাংসের দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে আশ্চর্য ভাবে পায়চারী করতে থাকে খাঁচার শক্ত লোহার বেড়ার ভিতরে। কিন্তু সূর্য গ্রহন শেষ হওয়ার সাথে সাথে সিংহটির অস্থিরতা একদম থেমে যায় এবং এতক্ষণে ঝাঁপিয়ে পরে মাংসের উপরে। বিজ্ঞানীরা পশুর এ আচরন নিয়ে গবেষণা করেছেন বিস্তর, কিন্তু সঠিক মতৈকে পৌঁছাতে পারেনি।
আমাদের উপর এর
প্রভাব হয়তবা আছে, কিন্তু আমরা সেটা অনুভব কিংবা বুঝতে পারি না। তবে এ নিয়ে অনেক
কুসংস্কার প্রচলিত আছে। অনেক বিবিধ ধর্মালম্বীর অনুসারীরা সূর্যের অর্চনা করে।
প্রাচীন লোক পুরাণেও এ নিয়ে প্রচলিত আছে অনেক কাহিনীর। একদল লোক আছে যারা একে অশুভ
মনে করে। পৃথিবীতে যে কত কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোক আছে, সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
আচ্ছা, সামনে
সূর্য গ্রহন। এর সাথে কি হত্যাযজ্ঞের কোন যোগাযোগ আছে ? হয়তবা থাকতে পারে। এক
হিসাবে একে খুনের মোটিভ কল্পনা করা যায়। সূর্যগ্রহণকে সামনে রেখে খুনগুলো ঘটছে।
পরিষ্কার মনে পড়ে সানএন্টিনিওতে যে খুনটা সংগঠিত হয়েছিল তা রাত্রিবেলা এবং সেদিন
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহন ছিল। ধরে নিই, খুনি খুনগুলো করেছে এই সূর্য গ্রহণকে সামনে রেখে
এবং সানএন্টেনিওতে পূর্ণ চন্দ্র গ্রহনের রাতে সংগঠিত হয়েছিল হত্যাকাণ্ড। একটা
গ্রহনের দিন এবং অন্যগুলো গ্রহণকে সামনে রেখে। অবশ্য দুটোর মাঝে যথেষ্ট তফাৎ
রয়েছে। তফাৎটা ঘোচানো যায় যদি সানএন্টেনিওর খুনি গ্রহনের পূর্বে আরও খুন করে থাকে।
কিন্তু তা করেনি। আবার, হয়তবা করেছিল- কিন্তু কেউ জানতে পারেনি বা প্রকাশ হয়নি।
আপাত, যথেষ্ট
মিলও কিন্তু আছে উভয় হত্যাকাণ্ডে। প্রথমত, দুটোই গ্রহণকে সামনে রেখে। দ্বিতীয়ত,
হত্যাকাণ্ডের নমুনায় উভয়ই যথেষ্ট মিল আছে।
বর্তমান খুনি
(এখানে খুনী ব্যাবহার করছি- প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের নমুনা এক হওয়ায় খুনী সম্ভবত
একজন কিংবা একটি দলের। দ্বিতীয় কোন ব্যাক্তির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।) লাশগুলো
বাইরে ফেলে দিল কেন? সে তো লাশগুলো গুম করতে পারত। এখানেও দুটো ব্যাখ্যা দেয়া যায়।
গুম করার মত অবস্থা বা অবস্থান তার ছিল না। অথবা খুনি অতিমাত্রায় সাহসী কিংবা
আত্মপ্রত্যয়ী- তার নাগাল কেউ পাবে না। ঘটনাচক্রে এই মনে হচ্ছে।
16th April.
সকালবেলা
মর্নিংওয়াকে একটা কথাই চিন্তা করছিলাম, খুনি তাহলে ক্ষান্ত দিয়েছে। গত পাঁচ দিনে
একটি লাশও পাওয়া যায় নি। খুনি নিশ্চয়ই পুরোপুরি সতর্ক হয়ে গেছে। পুলিশ
ডিপার্টমেন্টে সবাই এতে বেজায় খুশি। কে চায় খুনোখুনি হোক। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম।
সত্যিকথা বলতে কি, যে কাজের জন্য এখানে আগমন; তার বিন্দুমাত্র অগ্রসর হয়নি। তাই
মনেপ্রানে চেয়েছিলাম- আরেকটি খুন হোক। আরেকটি লাশ পাওয়া যাক। তাতে নিশ্চয়ই কোন
সূত্র মিলবে। যেখান থেকে নতুন করে তদন্ত করা যেত। এর আগের লাশগুলোর অবস্থানে তেমন
কোন সূত্র পাওয়া যায় নি। হয়তবা কোন সুক্ষ সূত্র ছিল, কিন্তু তা সবার চোখ এড়িয়ে
গেছে।
ফিনিক্স থেকে
ফিরে এসেছি তার পরদিনই। নতুন কোন খুন কিংবা লাশ পেলে সাব ইন্সপেক্টর রিওমি অবশ্যই
জানাবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে ধরনের কোন বার্তা আসেনি।
রুমে ফিরতে
দৃষ্টি চলে গেল ড্রইংরুমে। ইন্সপেক্টর ভিক্টর রিয়ো এই সাত সকালে বসে আছেন। তার
উদ্ভ্রান্তের মত অববয় দেখে বুঝতে পারলাম নতুন কোন সংবাদ আছে।
ইন্সপেক্টর
দাঁড়িয়ে মুখ কালো করে যে কথাটি বললেন, তার জন্যই আমি প্রতীক্ষায় ছিলাম।
‘স্যার, আরও একটি
লাশ পাওয়া গেছে’।
‘কোথায়?’
‘হেরিং নদীর
তীরে’।
তৎক্ষণাৎ রওনা
দিলাম। পনের মিনিটের মাথায় যখন নদীতীরে পৌঁছালাম, ততক্ষণে লাশ বেলাভূমিতে তোলা
হয়েছে।
হাটুমুড়ে বসলাম
লাশের পাশে। বায়ুপ্রবাহের বিপরীত দিকে থাকা সত্ত্বেও ভক করে পচা দুর্গন্ধ নাকে
ধাক্কা খেল।
একজন কিশোরী নিগ্রো বালিকার লাশ। আগের লাশগুলোর মত সম্পূর্ণ নগ্ন। পেটটা ফুলে একদম ঢোল হয়ে গেছে। লাশ প্রায় নষ্ট হওয়ার পথে এবং নাভীমূলে পৈচাশিকতার নিদর্শন এখনও স্পষ্ট। খুনির পঞ্চম শিকার এটি।
তেরপেল দিয়ে
ঢেকে লাশ গাড়িতে তোলা হল। ইন্সপেক্টর চলে গেলেন লাশের সাথে।
‘অমিত, এখানকার
আবহাওয়া অফিসের ফোন নাম্বার বের কর’- আমি বললাম ।
পকেটে রাখা
ছোট্ট নোটবুকের পৃষ্ঠা ঘেঁটে বের করা হল ফোন নাম্বার। আবহাওয়া অফিসে ফোন করে জেনে নিলাম
এলপেসো শহরের গত চারদিনের বাতাসের গড় গতিবেগ। যন্ত্রপাতির সাহায্যে নদীর স্রোতের গড়
গতিবেগও বের করা হল। স্রোতের গতিবেগ এবং স্রোতের বিপরীতে বাতাসের গতিবেগের সাহায্য
নিয়ে বের করে ফেললাম কাঙ্ক্ষিত অনুমানিক দূরত্ব। লাশটি দুদিন যাবৎ পানিতে পরে আছে।–
পর্যবেক্ষণ থেকে বুঝতে পেরেছি। এবং তা যদি হয়ে থাকে তবে হিসাবমতে ফিনিক্সের উপশহর রংহাই
থেকে ফেলা হয়েছে লাশটি।
এলপেসো ফিরে
ইন্সপেক্টরকে জানিয়ে রাখলাম- ঘুর্নাক্ষরেও যেন লাশের কথা প্রকাশিত না হয়। যদিও অতি
সতর্কতার কারনে হত্যাকাণ্ডগুলোর খবর প্রেস কে দেয়া হয়নি, কিন্তু গত চারটি হত্যার ঘটনা
প্রকাশ হয়ে পরে এবং জনমনে বেশ আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া এবার খুনিকে এবার একটি সুযোগ
দিতে হবে। খুনি জানবে, তার প্রথম চারটি প্রকাশ পেলেও পঞ্চমটি পায়নি। এ থেকে সে সামান্য
হলেও স্বস্তি বোধ করবে, ভুল করবে এবং সে ভুলের সুযোগ নিতে হবে পুরোমাত্রায়।
এলপেসো থেকে
রংহাই আসতে হলে ফিনিক্স হয়ে আসতে হয়। ফিনিক্স থেকে দশ কিমি দূরে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত
এ শহর। লোকসংখ্যাও এখানে ফিনিক্স অপেক্ষা অনেক কম।
রংহাইতে প্রথম
শ্রেণির দুটো হোটেল থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় শ্রেণির একটা হোটেলে অবস্থান নিলাম। এখান
থেকেই তদন্তের কাজে সুবিধা হবে। বাড়তি প্লাসপয়েন্ট হল হোটেলটি মূল রাস্তার পাশে। রুমে
বসেই পূর্ণ নজরদারি করা সম্ভব রাস্তার উপর।
হোটেল থেকে
রওনা দিলাম হেরিং নদীর উদ্দেশ্যে। শহরের শেষ মাথায় নদী- এখান থেকেই ফেলে আসা হয়েছিল
লাশ।
নদীতীরে এসে
তদন্তে সুবিধা হবে এমন কিছুই পাওয়া গেল না। এখান থেকে না ফেলে একটু অদুর থেকে লাশ ফেলতে
পারে খুনি। তীর ধরে সোজা হাঁটতে লাগলাম।
পনের মিনিট
পরে পৌঁছে গেলাম সেই স্থানে যেখানে লাশ ফেলা হয়েছে।
খুনি খুবই
সতর্ক। তাই একটু ঘুরপথে এখানে এসে ফেলেছে লাশটি। ঝোপের পাশে যেখানে সে গাড়িটি রেখেছিল,
সেখানে হালকা কাদার উপরে স্পষ্ট গাড়ির টায়ারের ছাপ- কাঁদা শুকিয়ে সযত্নে ধরে রেখেছে
খুনির চিহ্ন।
প্রতিক্ষেত্রেই
খুনি একই গাড়ি ব্যাবহার করে নিশ্চিত হলাম ছাপ দেখে। এলপেসোতে প্রথম লাশের পাশে যে টায়ারের
দাগ পেয়েছিলাম- তার সাথে এখানে হুবুহু মিল। অবশ্য আরেকটি মিল আছে।
দুটো টায়ারের
দাগই মাটির বেশ গভীরে। সুতরাং ভারী কোন যান ব্যাবহার করে খুনি। প্রথমবার নিশ্চিত হয়নি,
কিন্তু এবার হলাম।
বিরতি পথে
ফিনিক্সের সাব ইন্সপেক্টরের সাথে দেখা হল। আজ ছুটির দিন। স্বপরিবারে তাই কেনাকাটা করতে
বেড়িয়েছেন শহরে।
ভদ্রলোকের
স্ত্রীর নাম মারিয়া রিওমি। একমাত্র ষোড়শী কন্যা লুমেন রিওমি। রিওমি মা মেয়ে কেনাকাটায়
ব্যাস্ত। আমার দিকে দৃষ্টি পরতেই ভদ্রলোক দ্রুত এগিয়ে এলেন।
‘স্যার, আপনি
এখানে ?’
‘আপনার সাথে
সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছিলাম। ভাগ্য ভালো, এখানেই পেয়ে গেলাম।'
সাব ইন্সপেক্টর
একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘স্ত্রী ধরেছিলেন, তাই একটু… । '
‘এলপেসোতে
আরও একটি খুনের লাশ পাওয়া গেছে, জানেন নিশ্চয় ?’
‘বলেন কি
স্যার! আমি মাত্রই জানলাম ।'
লাশের বর্ণনা
দিয়ে সাব ইন্সপেক্টরকে যখন বললাম, লাশটি রংহাই থেকে ফেলা হয়েছে নদীতে- সে আরও অবাক
হলেন।
‘রংহাই থেকে
ফেলা হয়েছে !’
‘হ্যাঁ, দুদিন
পূর্বে নদীতে ফেলা হয়েছিল।'
‘তাহলে স্যার,
খুনি কি রংহাইয়ের বাসিন্দা?’
‘তা কিভাবে
বলব?’
‘মানে রংহাই
থেকে ফেলা হয়েছে তো…।’
‘হতে পারে।
তবে এতদিন ধারনা ছিল মাত্র- খুনি কোথাকার বাসিন্দা । তবে আজ মোটামুটি নিশ্চিত হলাম।
খুনি ফিনিক্স অথবা রংহাইয়ের বাসিন্দা। এলপেসো নয়; কারন এলপেসো থেকে রংহাই আসতে হলে
ফিনিক্স হয়ে আসতে হবে তাকে। কিন্তু তা সে করবে না, এতে পুলিশের নজরে পরার সম্ভাবনা
নব্বুই পার্সেন্ট।
তবে খুনি
রংহাইয়ের বাসিন্দা হবার সম্ভাবনাই বেশী। এলপেসো এবং ফিনিক্সে চব্বিশ ঘণ্টা অতন্দ্র
পাহারার ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে, যেটা রাংহাইয়ে নেই।
‘কিন্তু স্যার।
খুনি যদি রংহাইয়ের বাসিন্দা হয়ে থাকে তবে প্রথম চারটি লাশতো ফিনিক্স এবং এলপেসোতেই পাওয়া গিয়েছিল- রংহাইতে
হয়।‘
‘ফিনিক্স
এবং এলপেসোতে ইতিপূর্বে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটেনি, তাই পুলিশের চোখ ফাকি দিতে পেরিছিল
খুনি- কিন্তু এখন আর সম্ভব নয়। এ কারনে সে আর ওপথে যায়নি।‘
‘আমরা কি
তবে স্যার চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশ প্রহরারা ব্যাবস্থা করব রংহাইতে?’
‘ভুলেও এ
কাজ করবেন না। কারন খুনি টের পেয়ে গেলে তাকে আর ধরা সম্ভব হবে না। তবে হ্যাঁ, তদন্ত
চালাতে পারেন, কিন্তু ঘূর্ণাক্ষরেও খুনি যেন টের না পায় আমাদের সন্দেহের কথা। ‘
হোটেলে ফিরে
বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে আয়েশ করে একটা সিগারেট
ধরালাম। এখান থেকে পুরো রাস্তাটাই দেখা যায়। সিগ্ধান্ত নিয়েছি, সারারাত জেগে নজর রাখব
রাস্তায়। খুনির গাড়ির দেখা পেলেও পেতে পারি। সর্বক্ষেত্রেই খুনি লাশ সরিয়ে ফেলেছে রাতের
বেলায়। দিনে কোন ভাবেই নয়।
চিন্তা করছি
খুনের বিষয়-বস্তু নিয়ে। আমার বদ্ধমূল ধারনা, সূর্য গ্রহনের সাথে খুনের অবশ্যই একটা
সম্পর্ক রয়েছে। এ মাসের বাইশ তারিখেই সূর্যগ্রহন। আর মাত্র পাঁচ দিন বাকী। আমার ধারনা
সত্যি হলে এই সময়ের মধ্যই খুনিকে পাকড়াও করতে হবে। বাইশ তারিখের পরে আর সম্ভব হবে না।
কিন্তু সমস্যা
হল, এমন কোন সুত্র হাতে নেই যা দিয়ে পাকড়াও করা যাবে খুনিকে। খুনির অবস্থান কিংবা ব্যাবহৃত
গাড়ি সমন্ধে ধারনা পাওয়া গেলেও এটুকু সুত্র দিয়ে তা সম্ভব নয়। ফিনিক্স এবং রংহাই শহরে
এক লক্ষ লোকের বাস এবং গাড়িও আছে হাজারের উপরে। এত লোকের মাঝে মূল আসামীকে বের করা
মুশকিল।
আপাত তাই
এটুকু সুত্র নিয়েই এগুতে হবে।
18th
April.
আমেরিকানদের
কাছে পৃথিবীর অন্যান্যদের মত সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত কোন নতুন ঘটনা নয়- তাই এর কোন
গুরুত্ব নেই। আমি জাতে আমেরিকান হলেও প্রতিদিনের সূর্যদয়কে উপভোগ করি নিজের মত করে।
কিন্তু, আজকে যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন সময় নির্দেশ করছে সকাল দশটা! সূর্য অনেক আগেই
উদিত হয়েছে এবং তা চলছে আপন যাত্রাপথে। সুতরাং আজকের দিনটা আমার শুরু হল ব্যাতিক্রম
ভাবে।
সকালবেলা
নাস্তা সেরে জানালার পাশে বসলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে দৃষ্টি রাখলাম রাস্তার উপর।
গত কয়দিন
ধরে রংহাইয়ের এই হোটেলটাতেই আছি। এবং দু তিন ধরে সেই একই কাজ- সর্বদা রাস্তায় নজর রাখা।
তবে এখন পর্যন্ত কোন সাফল্য পাইনি । অবশ্য এই দু তিন দিনে কোন খুনের ঘটনা ঘটেনি কিংবা
ঘটলেও লাশ পাওয়া যায় নি।
সাদা একটি
গাড়ি হোটেলের কার পার্কিং এ অবস্থান নিল। কালো স্যুট পরিহিত অমিত ভট্টাচার্য নামল গাড়ি
থেকে।
কলিংবেলের
সব্দ হতেই দরজা খুলে দিলাম।
‘ফিনিক্স
শহর থেকে এইমাত্র একটি ছেলে নিখোঁজ হয়েছে স্যার’।
‘বল কি ?
বয়স কত? দেখতে কেমন?’- একসাথে প্রশ্নোগুলো করলাম কেননা একটি সম্ভাবনা আমার মনে ধাক্কা
দিয়েছে এবং অমিতের উত্তরে নিশ্চিত হলাম।
‘দশ বছরের
নিগ্রো ছেলে। এই শহরের মিলিওয়ম্যান জেমস কুকারের একমাত্র ছেলে। সকাল বেলা গাড়িতে স্কুলে
যাচ্ছিল পরিচারিকার সাথে । একটি নির্জনস্থানে বড় একটি ভ্যান তাদের গতিরোধ করে এবং ছেলেটিকে
তুলে নিয়ে যায়। পরে অজ্ঞান অবস্থায় পরিচারিকাকে উদ্ধার করা হয় গাড়ি থেকে। সে লোকটিকে
চিনতে পারেনি কারন তার মুখ মুখোশে ঢাকা ছিল।
তবে তার বর্ণনামতে, শক্ত সামর্থ গড়নের প্রায় ছয় ফিট উচ্চতা লোকটির। তবে বয়স অনুমান
করতে পারেনি দস্তানা এবং মুখোশের কারনে। ' একটু থেমে আবার শুরু করল-
‘ এই পথ দিয়ে
যাচ্ছিলেন স্কুল শিক্ষক পিটার বেন। তিনিই প্রথম লক্ষ্য করেন নির্জনস্থানে দাঁড়িয়ে থাকা
গাড়িটি এবং ভিতরের অজ্ঞান মহিলাকে। তার সহায়তায় পরিচারিকার জ্ঞান ফিরে আসে এবং দ্রুত
পুলিশকে জানায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। অতিদ্রুত শহরের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে
দেয় পুলিশ। কিন্তু আসামী ততক্ষনে পগারপার!
ছেলেটির পরিনতি
ভেবে প্রচণ্ড কষ্ট হল। বিলম্ব না করে বেড়িয়ে পরলাম রাস্তায়।
জেমস কুপারের
বাড়িতে পৌঁছালাম। শোকের রাহুগ্রাস যেন স্তব্ধ করে দিয়েছে বাড়ির পরিবেশকে। ভদ্রলোক আমাদের
দেখে মিনতিতে ফেটে পরলেন তার ছেলের জন্য। একফাকে পরিচারিকার কাছ থেকে নতুন করে জেনে
নিলাম সম্পূর্ণ ঘটনা। নতুনত্বের মধ্য একটা জিনিসই পাওয়া গেল, যেটা অমিতের বর্ণনায় পাওয়া
যায় নি- লোকটা বা হাতি। অবশ্য সেটা তার ‘ভানও’ হতে পারে। কিন্তু এ তবুও একটা সুত্র বটে।
সমস্ত ফিনিক্স
এবং রংহাই চষে বেড়ালাম। সন্ধ্যায় চলে এলাম হোটেলে। রাত্রিবেলায় বুড়ো হোটেল ম্যানেজারের
সাথে অনেক কথা হল। আলাপচারিতায় প্রসঙ্গ তুললাম হত্যাকাণ্ড সমন্ধে। গত কয়েকদিনের ব্যাবহারে
আমার মনে হয়েছে, বৃদ্ধ কিছু বলতে চায়। হয়তবা আমার কর্মকান্ড সমন্ধে ধারনা পেয়েছে সে।
সুযোগ পেয়েই তাই বৃদ্ধ শুরু করল-
‘কিছু কিছু
লোক আছে যাদের বদ্ধমূল ধারনা, পৃথিবীতে ঈশ্বরের পাশাপাশি সয়তানের ক্ষমতাও অনেক বেশী।
তাই সয়তানের উপাসনা করলে সে তাকে প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী করে দেয়। এই সব লোক সেই ক্ষমতা
অর্জনের তরে শুরু করে সয়তানের উপাসনা। এই উপাসনা অনেক রকম হতে পারে। এরকম এক রকম উপাসনার
প্রথম ধাপে এরা ডাকিনী বিদ্যার সাহায্যে সয়তানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। এতে
সফল হলে সয়তান এদের সামনাসামনি দেখা দেয়। তারা তখন সয়তানের সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ
হয়, এবং তার কাছে বিক্রি করে দেয় স্বীয় আত্মা। সয়তান খুশি হয়ে তার পিচাশতা এদের অন্তরে
গেথে দেয়। তৃতীয় ধাপে সয়তানকে খুশি করার জন্য উৎসর্গ করে জীবিত প্রান। এইসব জীবিত প্রান
হচ্ছে কালো বেড়াল অথবা পেঁচা। উৎসর্গের পরের ধাপে সয়তান তাকে কথা দেয় যে, সে তাকে অমরত্ব
প্রদান করবে যেহেতু সয়তান নিজেই সে ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু এ অমরত্বের কিছু নিয়ম এবং
সময় রয়েছে। পূর্ণ চন্দ্রগ্রহন কিংবা বিশেষ করে পূর্ণ সূর্যগ্রহন এর সময়ক্ষনে জীবিত
প্রান উৎসর্গ করতে হয়। এই সময় উৎসর্গকৃত প্রান হতে হবে একজোড়া বালক। অবশ্যই নিগ্রো
বালক, কারন সয়তানের রাজত্ব অন্ধকারের মাঝে- অন্ধকারের মধ্যই তার ক্ষমতা। অবশ্য এর পূর্বে
আরও অনেকগুলো প্রান উৎসর্গ করতে হয়। যে যতবেশি প্রান উৎসর্গ করবে, সে তত দ্রুত অমরত্ব
প্রাপ্ত হবে।‘
প্রচন্ড একটা
ঘোরের মধ্য যেন বৃদ্ধের কথাগুলো শুনলাম। বৃদ্ধের প্রতিটি কথাই এখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছা
করছে – যখন প্রমাণাদি হাতেই। একটা সময় পর যেন বাস্তবে ফিরলাম। কিন্তু… জিজ্ঞাসা করলাম
বৃদ্ধকে-
‘আপনি এসব
কথা কিভাবে জানলেন?’
বৃদ্ধ কিছুক্ষন
চুপ থেকে বললেন, ‘ আমিও সয়তানের উপাসক ছিলাম, কিন্তু সয়তান আমাকে গ্রহন করেনি।'
20th
April.
সময়টা সন্ধ্যারাত্রি।
রাস্তায় প্রচুর লোকের আনাগোনা। জনসমুদ্রের এই ঢেউ আস্তে আস্তে শূন্য হয়ে একসময় নির্জনতায়
গ্রাস করে নিবে সমস্ত শহরকে। তারপরে হয়তবা সে আসবে এই রাস্তা দিয়ে, যার প্রতীক্ষায়
অনেকগুলো রাত বিনিদ্র কাটিয়েছি।
শত চেষ্টা
পর্যবসিত হয়েছে এই একটি লোকের কাছে। যে কিনা পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার চক্ষু এড়িয়ে এখনও
টিকে আছে হয়তবা এই শহরে।
কোন সন্ধান
পাওয়া যায়নি সেই ছেলেটির, যে কয়েকদিন পূর্বে নিখোঁজ হয়েছিল।
সময়ও দ্রুত
ফুরিয়ে আসছে। মাঝখানে মাত্র আরেকটি দিন। এর মাঝে কোন সমাধা না হলে কোনদিনও ধরা যাবে
না মানুষরুপী সেই পিচাশকে। হতাশা গ্রাস করে নিয়েছে আমায়। তবে কি একটা খুনির কাছে পরাজিত
হতে হবে সবাইকে?
জানালার পাশে
বসে আছি। রাত্রি এখন নয়টা হবে। রাস্তায় এই মুহূর্তে লোকজনের আনাগোনা অনেকটা কমে গেছে।
অবশ্য রাস্তায় গাড়ি চলছে একটু পরপরই। সব ধরনের যানই আছে। কিন্তু দেখা নেই সেই গাড়িটির।
তবুও একরাশ আশা-প্রত্যাশা, খুনি আসবে, অবশ্যই আসবে।
একটা সিগারেট
ধরালাম। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দৃষ্টি চলে গেল রাস্তার উপর থেকে। অগ্নি সংযোগ করে আবার
দৃষ্টি ফিরল চেনা রাস্তায়।
দূরে কোন
গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা যাচ্ছে। অপেক্ষায় রইলাম নিকটে আসার।
গাড়িটা আসছে-
স্বাভাবিক গতিতেই। চালকের কোন তাড়া নেই। একটা সময় পরে দূরত্ব এসে দাঁড়াল বিশ-ত্রিশ
গজের মত। গাড়ির ভেতরের ড্রাইভারকে এখন দেখা যাচ্ছে … ।
মধ্যবয়সী
চমৎকার স্বাস্থ্যের অধিকারী নিগ্রো লোকটা একজোড়া কুতকুতে চক্ষু দিয়ে তাকিয়ে আছে রাস্তা
পানে। ডান হাতটা কোলের উপর ভাজ করে রাখা, বা
হাতে ধরে আছে স্টিয়ারিং … ।
ভারী একটা
মালগাড়ী। সচারচার যা এই রাস্তায় দেখা যায় না… ।
হ্যাঁ। মিলে
যাচ্ছে !
এক মিনিটেরও
কম সময়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গাড়ির স্টিয়ারিং এ হাত রাখলাম । সামনের গাড়িটা বড়জোর দুশো
গজ দূরে হবে।
সেলফোনে দ্রুতগতিতে
নাম্বার টিপে ওপাশের অপারেটারকে কতগুলো কথা বললাম এক নিঃশ্বাসে।
এখন কাজ একটাই
– নিঃশব্দে ফলো করা। গাড়ির হেডলাইট বন্ধ।
দশ মিনিট
পরে অনেকদূরে কতগুলো সাইরেনের শব্দ ভেসে এল। শব্দের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে,
অর্থাৎ আসছে ফিনিক্স পুলিশ।
লাফ দিয়ে
গাড়ির গতি বেড়ে গেল। মিটারের কাঁটা এখন একশ দশ ছুঁই ছুঁই করছে। এ গতিতে হেডলাইট না
জ্বালিয়ে উপায় নেই।
খুনি বুঝতে
পেরেছে তাকে ধাওয়া করা হয়েছে। তাই সেও ছুটছে
সমান গতিতে। সামনেই একটা মোড়, তার কিছুদূর পরেই নদী। সুতরাং পালাবার পথ নেই।
টায়ারের কর্কশ
শব্দ তুলে এল আকৃতির বাকের ওপাশে পৌঁছে হারিয়ে ফেললাম গাড়িটিকে।
দশ সেকেন্ড
পরে নদীতীরে যখন পৌছালাম- ধু ধু শুন্য চারপাশ। কোথাও খুনির চিহ্ন নেই, এমনকি গাড়িও।
যেন শুন্যে মিলিয়ে গেছে।
অনেকগুলো
গাড়ি হেডলাইটের আলোর বন্যা তুলে পৌঁছে গেল আমার পাশে। সাব ইন্সপেক্টর রিউমি, অমিত এবং
বিশ-পঁচিশ জন সশস্ত্র পুলিশ নামল গাড়ি থেকে।
নির্দেশ পাওয়া
মাত্র পুলিশের দল ছোট ছোট গ্রুপে সার্চ পার্টি গঠন করে ছড়িয়ে পরল চারপাশে।
অমিত এবং
ইন্সপেক্টর নিয়ে ততক্ষণে নদীর একদম তীরে পৌঁছে গেছি। বেশিক্ষণ খুঁজতে হল না, পেয়ে গেলাম
নরম মাটির উপরে টায়ারের ছাপ । একদম নতুন ছাপ। শেষ হয়েছে নদীর ঢালুর প্রান্ত সীমায়।
তড়িৎ বুঝতে
পারলাম । খুনি অন্য কোন উপায় না পেয়ে চলন্ত গাড়ি সহ লাফিয়ে পরেছে খরস্রোতা হেরিং নদীতে।
পুলিশের আরেকটি
দল দু গ্রুপে ভাগ হয়ে ছড়িয়ে পরেছে তীরের দিকে।
খুনি গাড়ি সহ পানিতে নামলেও তাকে অবশ্যই তীরে আসতে হবে কিংবা পানির উপর ভাসমান
অবস্থায় তাকে পাওয়া যাবে।
নির্দেশ চলে
গেল ফিনিক্স শহরের ফায়ার ব্রিগেডে। বড়জোর পনের মিনিটের মধ্য পৌঁছে যাবে ডুবুরীর দল।
ভারী ক্রেনও আসছে গাড়িটি তীরে তোলার জন্য।
বিশ মিনিট
পর ডুবুরীর দল নেমে গেল নদীতে। তীব্র স্রোত, তারই মধ্য ডুবুরীর দল প্রানান্ত প্রচেষ্টা
চালাচ্ছে গাড়ির অবস্থান বের করার।
সকালের খুব
একটা দেরি নেই। সার্চ টিম এবং অন্যান্যরা ফিরে
এল, কিন্তু কোন হদিসই পাওয়া গেল না খুনির। ডুবুরীর দলও অবশেষ হাল ছেড়ে দিল। তবে ভোরের
দিকে এলপেসো থেকে আরেকটি দল আসবে এবং দিনের বেলায় আশা করি সবাই মিলে উদ্ধার করতে পারবে
গাড়িটি।
সকাল বেলা
আবার উদ্ধার কাজ শুরু হল। এবার প্রচুর সরঞ্জামাদি নিয়ে ছয়টি বোটের সহায়তায় চিরুনি তল্লাশি
শুরু হল নদীর তলদেশে।
তিন ঘণ্টা
পরে বের করা সম্ভব হল গাড়িটির অবস্থান। বিশাল ক্রেনের সাহায্যে টেনে তোলা হল গাড়িটি।
ড্রাইভিং
সিটের পাশের দরজাটি খোলা। ভেতরে কেউ নেই। অবশ্য থাকবে সেটাও আশা করিনি। তবে গাড়ির পেছনের
অংশে…।
বিশাল মালগাড়ি।
পেছনের দরজার পাট দুটো খুলে দিতে খানিকটা পানি গড়িয়ে পরল শুকনো বালির উপর।
হ্যাঁ। আমার
আশংকাই সত্য। পানি ছাড়াও আরও একটি জিনিস রয়েছে গাড়ির খালি অংশে। একটি মৃতদেহ। সম্পূর্ণ
উলঙ্গ দশ বারো বছরের কিশোর ছেলে। দুই তিনদিন পূর্বে যে নিখোঁজ হয়েছিল।
গাড়িটি নিয়ে
আসা হল ফিনিক্স পুলিশ স্টেশনে। পিছনের নেইমপ্লেটে লাইসেন্স ইস্যুর স্থান এবং নাম্বার
দেয়া আছে। সানফ্রানসিসকো থেকে ইস্যু করা হয়েছে গাড়িটি।
তড়িৎ যোগাযোগ
করা হল সানফ্রানসিসকোতে। আধঘণ্টা পরে তারা যে সংবাদ দিল, তা শুনে আমাদের মাথায় যেন
বাজ পড়ল।
গাড়িটির আসল
মালিক পাঁচ বছর পূর্বে রোড এক্সিডেন্টে নিহত হয়েছেন এবং পরপরই নিখোঁজ হয় গাড়িটি। এখন
পর্যন্ত তা নিখোঁজের তালিকায়ই আছে।
সানফ্রানসিসকোতে
নিহত সে ভদ্রলোকের পরিবারের সাথেও যোগাযোগ করা হয়েছে, কিন্তু তার স্ত্রী তেমন কিছু
জানাতে পারেনি গাড়িটি সমন্ধে। পুরো ব্যাপারটিই যেন রহস্যময়।
রংহাই, ফিনিক্স
কিংবা এলপেসোর কেহই কোন তথ্য দিতে পারল না গাড়িটি সমন্ধে। কেউ কেউ অবশ্য বলল, অমুক
দিন অমুক রাস্তায় গাড়িটি দেখেছে- এ পর্যন্তই। তাছাড়া এ রকম গাড়ি রংহাই, ফিনিক্স কিংবা
এলপেসোতে অনেকগুলো রয়েছে, তাই আলাদা ভাবে কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি গাড়ি বা তার ব্যাবহারকারীকে।
গাড়ির ভিতরের
প্রতিটি ইঞ্চি তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে , কিন্তু কোন সূত্রই মেলেনি।
জীবনে প্রথমবারের
মত অনুভব করলাম, এমন একজনের পিছে আমরা ছুটছি, যে মনে হয় সাক্ষাৎ সয়তান এবং সয়তানের
মতই তার গতিবিধি। সয়তানকে দেখা যায় না, কিন্তু তার অস্তিত্বের প্রমাণ সর্বত্রই। এ লোকটিও একের পর এক অপকর্ম করেই চলছে- আমরা তার
নিদর্শন পাচ্ছি, কিন্তু পাচ্ছি না তার ছায়ার দেখাও।
প্রচণ্ড উত্তেজনা
এবং নির্ঘুম কেটেছে গত ছত্রিশ ঘণ্টা। এভাবে আর কয়েকদিন চললে হয়তবা বদ্ধ উন্মাদ হয়ে
যাব। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। কয়েক সেকেন্ডের মোধ্যই পৌঁছে গেলাম ঘুমের গভীর রাজ্যে।
22th
April.
সকাল বেলায়
ঘুম থেকে উঠে একটা চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে- আজ বাইশে এপ্রিল। আজ সেই দিন। আজই
হয়তবা দুটো প্রান চিরতরে ঝরে যাবে- সেই পিচাশের হাতে।
অথচ, সবাই
নিরুপায়।
সকাল আটটা
নাগাদ পৌঁছে গেলাম ফিনিক্স পুলিশ স্টেশনে। আজ ডিউটি রুমেই বসে আছেন সাব ইন্সপেক্টর।
বড় বিমর্ষ আর ক্লান্ত মনে হল তাকে।
‘সেন্ট্রাল
ব্যুরো থেকে নির্দেশ এসেছে চব্বিশ ঘণ্টার মোধ্য আসামীকে পাকড়াওয়ের । অথচ এখন পর্যন্ত
কোন হদিসই মেলেনি হত্যাকারীর। ' একটু থেকে বললেন, ‘ ভাবছি, ব্যার্থতার দায়ভার নিয়ে
পদত্যাগ করব স্যার।'
ভারি মায়া
হল সাব ইন্সপেক্টর রিচার্ড রিউমির জন্য। ব্যার্থতার দায়ভার তার একার নয়, আমারও। পদত্যাগ
করতে হলে প্রথমে আমিই করব, যেহেতু পুরো দায়িত্বটাই আমার- রিওমিকে বললাম।
খুনির শেষ
প্রমানচিহ্ন হিসাবে আছে গাড়িটি। গতকাল রাতেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি, কিন্তু
কিছুই পাই নি। হয়তবা ক্লান্তি এবং উত্তেজনার কারনে সূক্ষ্ম কোন প্রমানচিহ্ন এড়িয়ে গেছে
নজর থেকে- আপন মনে বললাম।
আরও একবার
পর্যবেক্ষণে আনতে হবে গাড়িটিকে। প্রথম দর্শনে এড়িয়ে গেলেও দ্বিতীয়বার হয়তবা পাওয়া যাবে
এমন কোন সূক্ষ্ম প্রমান, যার সাহায্যে সম্ভব হবে হত্যাকারীকে পাকড়াওয়ের।
আবার আশার
আলো মনে মনে দেখতে পেলাম অন্ধকারের মাঝে।
ড্রাইভিং
সীটের নিচে, ড্যাসবোর্ড, বিবর্ণ স্টিয়ারিং হুইল, গাড়ির সামনে কিংবা পিছনের প্রতিটি
ইঞ্চিতে শকুনের দৃষ্টিদিয়ে খুজে ফিরলাম। কিন্তু ফের কিছুই পেলাম না।
গাড়ির বডি
সাদা রঙয়ের। অতি ব্যাবহারের কারনে সাদা রঙ পুরোটাই বিবর্ণ হয়ে গেছে। রঙ উঠেও গেছে কয়েক
যায়গায়। হঠাৎ দৃষ্টি আটকে গেল সেই বিবর্ণ সাদা জমিনের উপর। নিজের অজান্তেই কণ্ঠনালী
দিয়ে শব্দ বের হল- ইউরেকা !
বিশ্বাস করুন,
আর্কেমেডিস তার চৌবাচ্চার পানি উপচে পরা রহস্যের সমাধা করতে পেরে যেমন উদ্ভ্রান্তের
মত চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, আমিও ততটা শিহরিত হলাম সাদা জমিনের উপর ধুলিকনার মত সূক্ষ্ম অতি
সূক্ষ্ম রঙ কনার রহস্য আবিষ্কার করতে পেরে।
রঙের ছোপগুলো
আর কিছু নয়, স্প্রে মেশিনের সাহায্যে রঙ করা র সময় রঙের কণাগুলো বাতাসে ভর করে উড়ে এসে
বিদ্ধ হয়েছে গাড়ির বডিতে। সুতরাং গাড়িটি যেখানে রাখা হয়, সেটি কোন ওয়ার্কশপ হবে- যেখানে
স্প্রে মেশিনের সাহায্যে রঙ স্প্রে করা হয়। রঙের কনাগুলো বিভিন্ন বর্ণের- তাই ধারনাটা
মোটেই অযৌতিক নয়।
‘ ইউরেকা’
চিৎকারে রিওমি ছুটে এলেন। এক নিঃশ্বাসে তাকে বুঝিয়ে বললাম সবকিছু। এবং ডজন দুয়েক সশস্র
পুলিশ নিয়ে বেড়িয়ে পরলাম বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে।
বেশি সময়
খুঁজতে হল না। রংহাই শহরের শেষ প্রান্তে পাওয়া গেল একমাত্র ওয়ার্কশপ। সেখানে গাড়ির
বডিতে স্প্রে মেশিনের সাহায্যে রঙ করা হয়। গাড়ির বর্ণনা দিয়ে সেখানের প্রতিটি শ্রমিককে
জিজ্ঞাসাবাদ করা হল। আশানুরূপ উত্তর কেউ দিতে পারল না। কারন বর্বণাক্ত গাড়ি তাড়া কস্মিনকালেও
দেখেনি। অবশ্য নতুন এক তথ্য পাওয়া গেল। ওয়ার্কশপের উত্তরপাশে অবস্থিত একমাত্র বাড়িটির
বাসিন্দা ভদ্রলোক প্রায়শই আসেন এখানে সরঞ্জামাদির প্রয়োজনে এবং তার নিজ বাড়ির ছোট্ট
ওয়ার্কশপে প্রায় সময়েই স্প্রে মেশিনের সাহায্যে রঙের কাজ করে থাকেন।
রিওমির সাথে
এক মুহূর্তের চোখাচোখিতে সিগ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। কিন্তু পুরোপুরি আশাবাদী তখনও হতে
পারিনি। ওয়ার্কশপ পুলিশের দায়িত্বে রেখে আমরা চললাম সে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
ওয়ার্কশপের
উতরে ঢালু যায়গা ক্রমশ নেমে গেছে নিচের দিকে। ঢালুর শেষ প্রান্তে কিছুটা সমতল ভূমি।
ভূমির শেষে গাছপালায় বেষ্টিত টিলার মত সামান্য উঁচু যায়গা। আসেপাশে কোন বাড়িঘর নেই।
নির্জন স্থানে একাকী দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি- দূর
থেকে মনেই হবে না এর অবস্থান। বেছে বেছে ভালো যায়গায়ই বাড়ি বানিয়েছে আসামী।
ঘড়িতে সময়
নির্দেশ করছে সকাল সাড়ে দশটা। সূর্য গ্রহন শুরু হয়েছে আধা ঘন্টা পূর্বেই। এই মুহূর্তে
সূর্যের একপাশ সামান্য ঢেকে গিয়েছে চাঁদের ছায়ায়। আর মাত্র দেড় ঘণ্টা পরেই শুরু হবে
পূর্ণ গ্রহন।
সমস্ত বাড়ি
ঘিরে ফেলল অস্র সজ্জিত পুলিশ। রিওমি এবং আট দশজন পুলিশ নিয়ে আমরা এগুতে শুরু করলাম
সতর্ক পদক্ষেপে।
প্রথমেই খোলা
উঠোন। উঠোনের দক্ষিণপাশে দু তিনটি গাড়ি রাখার মত গ্যারেজ। গ্যারেজটিই ছোটখাট ওয়ার্কশপ।
একপাশে ছোট-বড় যন্ত্রপাতির স্তুপে স্প্রে মেশিন পাওয়া গেল। তার বিপরীতে রাখা গাড়ি দুটিতেও
পাওয়া গেল রঙের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিন্দুর ছোপ। এবার নিশ্চিত।
সমগ্র বারিটাই
কেমন যেন ভৌতিক এবং নির্জন। আশংকা হল, বাড়িতে কেউ আছে কিনা। তবে আমি নিশ্চিত খুনি বাড়ির
ভিতরেই আছে- কারন তার শেষ কাজটি এখনও বাকী। এতদূর এসে সে অবশ্যই হাল ছেড়ে দিবে না।
তাছাড়া হেরিং নদী কিংবা নদীতীর থেকে কোন প্রমাণাদি রাখা ছাড়াই সে পালাতে পেরেছে। তবে
এতটুকু প্রমান নিয়ে আমরা পৌঁছে যাব এখানে- এটাও সে ধারনা করতে পারেনি হয়তবা।
টানটান উত্তেজনায়
ডানহাতে রিভলবার নিয়ে বা হাত দিয়ে দরজা ধাক্কা দিলাম। খুলল না কাঠের তৈরি পুরনো দরজা।
ভিতর থেকে বন্ধ।
রিওমির সাথে
চোখাচোখি হল। সে দরজার কলিংবেলের সুইচ চাপল। একবার, দুইবার, তিনবার…।
অনেকটা সময়
পরে ক্যাচ ক্যাচ করে খুলে গেল প্রাচীন দরজা। একই সাথে সবগুলো রাইফেল এবং রিভলবারের
নল ঘুরে গেল অগুন্তকের দিকে।
একটা মুহূর্ত।
আমরা সবিস্ময়ে দেখলাম, অগুন্তক একজন মহিলা। পঁয়ত্রিশ ঊর্ধ্ব নিগ্রো মহিলা। তার হতবিহব্বল
ভীত দৃষ্টির মধ্য দিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম ভিতরে।
প্রতিটা রুম
তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। হত্যাকাণ্ডের কোন আলামত পাওয়া গেল না। দেয়ালে টাঙ্গানো একটি
ছবি। একজন নিগ্রো মহিলা- যাকে এই মুহূর্তে রুমে পুলিশ পাহারায় রাখা হয়েছে। নিগ্রো মহিলার
পাশে হাসিখুশি চেহারার একজন পুরুষ। হ্যাঁ, একেই সেদিন রাত্রিবেলায় দেখেছিলাম রাস্তায়
সামান্য সময়ের জন্য গাড়িতে- বা হাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরা অবস্থায়। যে ঘুম হারাম করে
দিয়েছে ফিনিক্স, এলপেসো কিংবা রংহাইয়ের প্রতিটি বাসিন্দার। এই সেই নরাধম পিচাশ খুনী।
ছবির নিচের
অংশে নয় দশ বছরের দুটো বালক। ধারনা করলাম, তাদের সন্তান। নিষ্পাপ চেহারার শিশু দুইটি
কি জানে, তাদের পিতা একজন নিষ্ঠুর হত্যাকারী।
রিওমির চিৎকারে
চলে গেলাম পাশের রুমে। ওয়ার্ড্রোবটা সরানো হয়েছে কোনাকুনি। মাঝখানের সৃষ্ট ফাঁকের দিকে
ইঙ্গিত দিলেন রিওমি। দ্রুত চলে গেলাম সেখানে।
ওয়ার্ড্রোবের
পিছনে তিন ফিট বাই দুই ফিটের একটা ফোঁকর। সেখান দিয়ে লোহার একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচের
দিকে। হ্যাঁ,এটা তাহলে বাড়ির গোপন বেসমেন্ট।
ওয়ার্ড্রোব
একপাশ সরিয়ে টর্চের আলোয় নিচে নামলাম রিওমি এবং দুজন পুলিশ সহ। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার।
টর্চের আলোয় পাওয়া গেল সুইচবোর্ড। নব চাপতেই একশ ওয়াটের বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় আলোকিত
হল সমস্ত রুম।
পনের ফিট
বাই পনের ফিটের বর্গাকৃতি রুম। উচ্চতাও প্রায় একই সমান হবে। দেয়াল ঘেসে একপাশে একটা
র্যাক। রুমের মধ্য অজানা বেশ কিছু জিনিসপত্র, স্টাফ করা একটি পেঁচা, দুটো কালো বেড়াল,
বেশ কিছু মানব হাড় ইত্যাদি। একপাশে দুটো মানব করোটি। একটা পাত্রে আঠালো কালো পদার্থ-
ভক করে দুর্গন্ধ এল সেখান থেকে। রুমের ঠিক মাঝখানে ছ ফিট বাই আড়াই ফিটের একটি সিমেন্টের
বেদী। বেদীর বর্ণ কালচে- জমাট রক্ত শুকিয়ে এই রঙ ধারন করেছে। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের প্রবাহে
কালচে রেখার সৃষ্টি হয়েছে বেদীর দেয়ালে। বেদীর সন্মুখ ভাগে একটি চর্বির প্রদীপ এবং
মাঝখনে প্রায় নষ্ট হওয়া একটি মানব হৃৎপিণ্ড।
শিহরিত হয়ে
উঠলাম। মনে হচ্ছে যেন মৃত্যুর মঞ্চে প্রবেশ করেছি। আসলে মৃত্যুর মঞ্চই। এখানেই কত নিষ্পাপ
প্রান হত্যা করা হয়েছে পিচাশপ্রেমের নিদর্শনে। কত আত্মা হয়তবা গুমড়ে কেঁদে উঠছে চার
দেয়ালের এই বদ্ধ প্রকোস্টে।
বেদীর সন্মুখের
দেয়ালের একপাশে ছোট্ট একটি দরজা। এপাশ থেকেই বন্ধ করা। ওপাশের কৌতূহল ঘোচানোর নিমিত্তে
এক ঝটকায় খুলে ফেললাম কাঠের দরজা। রুমের আলোয় সামান্য আলোকিত হল ওপাশ। তার পরেই যেন
রহস্যময় অন্ধকার।
টর্চের আলোর
বন্যায় উন্মোচিত হল অন্ধকার। পাশাপাশি দুজন যাবার মত একটা সুরঙ্গ। তীব্র আলোর রেখাও
নাগাল পেল না সে সুরঙ্গের শেষ প্রান্তের।
দরজাটা যেহেতু
ভিতর থেকে বন্ধ করা, সুতরাং খুনীর এ পথ দিয়ে পালাবার কারন নেই। তবুও দেখতে হবে এ পথের
শেষের।
রাইফেল বাগিয়ে
টর্চ হাতে দুজন পুলিশ চলল সুরঙ্গ সন্মুখে। অধীর অপেক্ষায় রইলাম সবাই। পাঁচ-সাত মিনিট
পরে ফিরে এল তারা। সুরঙ্গ শেষ হয়েছে বাড়ির পিছনের ঝোপের মধ্য। সুড়ঙ্গের নরম বালিতে
অনেকগুলো পায়ের ছাপ এবং সব একই আকৃতির। এ পথ দিয়েই তাহলে চলাচল করত খুনী।
মৃত্যুর সেই
মঞ্চ থেকে ফিরে এলাম রুমে, যেখানে প্রহরায় রাখা হয়েছে মহিলাটিকে।
মহিলাকে জিজ্ঞাসাবাদ
করে জানা গেল, লোকটি তার স্বামী এবং পাঁচ বৎসর পূর্বে তোলা ছবির শিশু দুটি তার ছেলে। বেসমেন্টের রুম এবং তার স্বামীর হত্যাকাণ্ডগুলোর
বর্ণনা দিতে মহিলা বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলেন। তার দৃষ্টি দেখে অভিজ্ঞ চোখ বুঝতে পারল,
তিনি ঘূর্ণাক্ষরেও জানতেন না স্বামীর পৈচাশিকতার কথা। অবশ্য তার নাকি মনে হয়েছিল, কোন
অপকর্মের সাথে সে জড়িত। কিন্তু সেই অপকর্ম যে এতটা ভয়ংকর লোমহর্ষক- দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে
পরা অশ্রুধারা বলে দিল তিনি কতটা আঘাত পেয়েছেন।
জানতে চাইলাম,
তার ছেলেদুটো কোথায়। উত্তরে জানালেন, ছেলেদের নিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় সূর্য গ্রহন দেখবে
বলে গাড়িতে চেপে বেড়িয়ে গেছে ঘণ্টাখানিক পূর্বে।
রিওমির সাথে
আবার চোখাচোখি হল। আমি বুঝতে পারলাম , সেও বুঝতে পেরেছে চোখের ভাষা। মহিলা বুঝতে পারেনি,
যদি পারত… ।
হাইওয়ে ধরে
প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলছে গাড়ি। পেছনে সমান দূরত্ব বজায় রেখে আসছে আরও তিনটি। রাস্তার
পাশে ব্যাস্ত লোকজন অবাক চোখে তাকাচ্ছে গাড়ির হুইসেল শুনে। ভাবছে- ইদানীং পুলিশের ব্যাস্ততা
দেখে।
ঘড়িতে সময়
এগারোটা আটাশ। আর মাত্র বত্রিশ মিনিট। সূর্য এই মুহূর্তে প্রায় অর্ধাকৃতি চাঁদের মত।
বত্রিশ মিনিট পরে বিলীন হয়ে যাবে সে অংশটুকুও।
ফিনিক্স পুলিশের
আরেকটি দল রওনা দিয়েছে ইতিমধ্য। তাদের সাথে আছেন অমিত। সবার গন্ত্যব্য একটাই- ডেনভারের
পার্বত্য অঞ্চল।
নির্জন রাস্তা
সোজা একেবেকে চলে গেছে পার্বত্য অঞ্চলের দিকে। ক্রমশ নিচু আবার ক্রমশ উঁচু হয়ে গেছে
রাস্তা। সামনে, মূল রাস্তা থেকে বা দিকে চলে গেছে লাল মাটির কাঁচা রাস্তা। এই রাস্তা
সোজা চলে গেছে পর্বতশ্রেণীর পাদদেশে।
কাঁচা রাস্তায়
তরতাজা টায়ারের ছাপ। সেই চিহ্ন ধরে দ্রুত ছুটে চলছে গাড়ি। সামনে একটা বাক। বাকের একশত
গজ দূরে দেখা গেল খুনির গাড়িটিকে।
একরাশ ধুলোর
ঝড় তুলে থামল আমাদের গাড়ি। আর একটা সেকেন্ডও বিলম্ব নয়। গন্তব্য এখনও অনেকটা দূরে।
সময় এগারোটা
পঁয়তাল্লিশ। আর মাত্র পনের মিনিট। একফালি সরু চাঁদের মতই ক্ষীণ সূর্য আকাশ পানে। সন্ধ্যার
অন্ধকারের মত নামতে খুব একটা সময় বাকী নেই।
পৌঁছে গেলাম
পাহাড়ের পাদদেশে। অতি পরিশ্রমের কারনে হৃৎপিণ্ড বের হতে চাইছে বুক চিড়ে। কিন্তু থামলে
চলবে না… আরও দ্রুত এগুতে হবে। বা দিকে পাহাড়ের উপর সোজা উঠে গেছে পায়ে চলাচলের রাস্তা।
উন্মাদের মত আমরা সেই পথ ধরে দৌড়াতে লাগলাম। অনেকটা পিছনে পড়েছে রিওমি এবং পুলিশের
দল।। প্রায় ত্রিশ গজের মতন। যতই এগুচ্ছি, রিওমিদের সাথে ব্যাবধান আরও বেড়ে যাচ্ছে।
দশ মিনিটের মত আরও দৌড়ে পৌঁছে গেলাম পাছাড়ের চুড়ার সমভূমিতে।
সামনে দিগন্ত
প্রসারিত সমতল ভূমি। ভূমির শেষ প্রান্ত সোজা তিন হাজার ফিট নিচে নেমে গেছে। ঘড়ির কাঁটায়
সময় দেখছি বারবার। বারোটার আর সামান্য বাকী মাত্র। এমন সময় দেখতে পেলাম আমি … ।
আমার মোটামুটি
চারশ গজ সামনে, পাহাড়ের একেবারে কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে খুনী- ভদ্রমহিলা যাকে ডেমিয়েন
মার্টিন উল্লেখ করেছিলেন। তার দুপাশে তারই দু পুত্র রোহেন মার্টিন এবং রোভার মার্টিন।
একপানে তাকিয়ে আছে পূর্ব আকাশের দিকে।
বদ্ধ উন্মাদের
মত ছুটছি। রিওমিরা কত পিছনে আছে- দেখার অবকাশ নেই। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকলাম ছেলে
দুটোর নাম ধরে। বাতাসে ভেসে সে শব্দ ছড়িয়ে পড়ল প্রান্তর হতে প্রান্তরে। কিন্তু কোন
ভ্রুক্ষেপ হল না ছেলে দুটোর। হয়তবা, গভীর সন্মোহনে সন্মোহিত তারা।
ঘড়ির কাঁটা
চলছে সমান গতিতে। সূর্য এগুচ্ছে নব্বই ডিগ্রী সমীরণের উদ্দেশ্যে। পাগলের মত দৌড়াচ্ছি।
এ চলার যেন কোন শেষ নেই – শেষ নেই।
সন্ধার অন্ধকারের
মত নেমে এসেছে। পাখিগুলোও অবাক হয়ে গেছে প্রকৃতির এই পরিবর্তন দেখে । উড়ে চলেছে তারা
আপন গন্তব্যে- ঠিক সন্ধ্যার মত।
আমার প্রায়
পঞ্চাশ গজ সামনে মার্টিনরা। ঈশ্বরের কাছে প্রানপন কৃপা ভিক্ষা চাইছি- আর কয়েকটা সেকেন্ড
সময় দাও। দুপুর বারোটা যেন না বাজে।
আমাকেই করতে
হবে এখন। যে করেই হোক, থামাতে হবে এই পৈচাশিক হত্যাকাণ্ড। মুহূর্তেই বের করে ফেললাম
রিভলবার।
ডেমিয়েন মার্টিন
হঠাৎ ঘুরে তাকাল আমার দিকে। লাল টকটকে অগ্নি-দীপ্তিময় সে চক্ষু দুটোকে মনে হল স্বয়ং
সয়তানের । এখন ডেমিয়েনের সাথে সয়তানের কোন পার্থক্য নেই।
অন্ধকার নেমে
এল ধরণীতলে।
এখন ত্রিশ
গজ সামনে মার্টিনিরা। রিভলবারের রেঞ্জের মধ্যই আছে। সূর্য এখন ঠিক মাথার উপর। শুরু
হয়েছে পূর্ণ গ্রহন। ডেমিয়েনের দু হাতে সন্ধ্যার অস্পষ্টতার মাঝেও চিকচিক করে উঠল ধারালো
ফলা।
দু হাত উপরে
তুলল ডেমিয়েন। হঠাৎ নেমে এল হাত দুটো …
প্রকৃতির
নিস্তব্ধতাকে খান খান করে গর্জে উঠল হাতিয়ার…
আহত পাখির
ন্যায় তিনটে প্রাণী একই সাথে শুন্যে ভেসে চলল তিন হাজার ফুট নিচের সমীরণের উদ্দেশ্যে।
( রচনাকাল ঃ ১৯৯৮ । টিনেজ বয়সে বা একাদশ শ্রেণীতে থাকতে লিখেছিলাম এ গল্পটি- হুবুহু তা তুলে দিলাম সাইটে। এ জন্য গল্পটি হাস্যকর লাগলে কিছু করার নেই- ক্ষমাপ্রার্থী !! গল্পটি এখানে দেয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আমার অনেক গল্পই সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে গেছে। তাই এখানে সংরক্ষণ করে রাখলাম। )
স্বপ্ন ।
‘ বিখ্যাত হবার স্বপ্ন আমার অনেকদিনের এবং তা সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে।’
ছেলেবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম, তখন থেকেই সাহিত্যের সাথে আমার পরিচয়য়। স্কুলে
আমার কয়েকজন ভালো বন্ধু ছিল, যে বন্ধুরা নিয়মিত গল্পের বই পড়ত। তাদের হাত ধরে সেই
তখন প্রবেশ করেছিলাম সাহিত্যের আশ্চর্য জগতে। ক্লাসে স্যারের চক্ষু বাঁচিয়ে কিংবা
বিকেলবেলায় সমবয়সী সবাই যখন মাঠে খেলাধুলায় ব্যাস্ত, তখন আমি ছাদের কোনায় বসে
হারিয়ে গেছি কল্পনার অসীম রাজ্যে।
রুদ্ধশ্বাসে টান টান উত্তেজনার সে মুহূর্তগুলি। নিজেকে গল্পের নায়ক বা কোন
চরিত্র কল্পনা করে হারিয়ে যেতাম পাহাড় বন-জঙ্গল কিংবা তাদের সীমানা ছাড়িয়ে অনন্ত
মহাকাশের গ্রহ নক্ষত্রের মাঝে।
পরিবর্তনটা যখন এল ততদিনে ঠোঁটের উপর পুরোদস্তুর গোঁফ উঠতে শুরু করেছে। রুচিও
তার ডালপালা বিস্তার করেছে পুরোমাত্রায়। এখন রহস্য আর রোমাঞ্চে ভরপুর বইগুলোর পাশে
ভাললাগে নর-নারীর সরল প্রেমের উপাখ্যান, সাধারন মানুষের ইতিকথা ইত্যাদি। বয়স বাড়ার
সাথে সাথে পছন্দের ধাপটাও বেড়ে চলল সমান গতিতে। আস্তে আস্তে পরিচিত হলাম অস্কার
ওয়াইল্ড, আন্তন চেখভ, লেভ তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিভূতি, সত্যজিৎ রায়
ইত্যাদি সাহিত্যের দিকপালদের সাথে।
সাহিত্য প্রীতি থেকে সেই ছেলে বেলা থেকেই মনের মধ্য একটা সংকল্প দানা বেধে উঠে
– বড় হয়ে আমিও একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিক হব।
স্কুলে বার্ষিক গল্প, কবিতা ইত্যাদি প্রতিযোগিতায় নিয়মিত ছড়া কবিতা লিখতাম।
বন্ধু মহলে তার প্রশংসাও বেশ শুনেছি। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবনেও নিয়মিত
লেখালেখি করতাম। এ সময় কবিতা লিখতাম প্রচুর।
তবে নিজের লেখাগুলি একসময় সাহিত্যের অরুচিকর মনে হত। তাই বন্ধু মহলের বাইরে
প্রকাশ কিংবা পত্রিকায় লেখালেখি থেকে বিরত থাকতাম। ভাবতাম, যখন আমি অনেকগুলো গল্প
লিখব- তখন তা থেকে সেরাটাই প্রথম পাঠাব পত্রিকায়।
আমার সে ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে পুরোপুরি আত্মমগ্ন হলাম
লেখালেখিতে।
ইদানিং একটা স্বপ্ন খুব বেশি দেখি।
প্রান্তরের সবুজ ঘাস বিছানো গালিচা ক্রমশ উপরে উঠে গেছে। একটা টিলা। এপাড়ে
টিলার খাড়া ঢাল গিয়ে মিশেছে এক বহমান স্রোতের তীরে। টিলার খাড়া ঢাল ঘেঁসে সুন্দর সাজানো গোছানো ছিমছাম বাড়ি। বাড়ির সামনে হাজারো ফুলের সমাবেশ। এর ঠিক
মাঝখান দিয়ে ঘাসের গালিচা বিছানো রাস্তা সোজা চলে গেছে সে বহমান জলধারার
তীরে। সেখানে ছোট্ট একটা নৌকা- দড়ি দিয়ে বাঁধা গাছের সাথে। স্রোতাস্বিনীর অপর
প্রান্ত ছুয়ে আকাশ ছোঁয়া বিশাল সব বৃক্ষরাজি বেষ্টিত গহীন অরন্য। অরণ্যে হাজার
প্রাণীর মধুর কোলাহল, গুঞ্জন ...।
বিদ্যুতের ঝলকানি, সেই সাথে গগন
বিদারী তীব্র আর্তনাদ। ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছে সমস্ত প্রকৃতি।
বিশাল হলরুম। হলরুমের ডানপাশে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দার শেষপ্রান্তে ছোট্ট
একটি রুম। চমৎকার সে রুমের পরিবেশ। একপাশে তক্তপোষ। দেয়ালের গায়ে একটি পোট্রেট।
ওপাশে বিশাল জানালার নিচে সেগুন কাঠের টেবিল। সেই টেবিলে ছড়ানো ছিটানো বই পুস্তক
ইত্যাদি।
কেরোসিনের একটা ল্যাম্প জ্বলছে মিট্মিট করে টেবিলের উপর। তারই আলোতে একমনে
লিখে চলছেন এক বৃদ্ধ।
বাইরে প্রকৃতির অশান্ত গর্জন ......।
স্বপ্নটা আমার কাছে এতটাই বাস্তব, স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে যখন জেগে উঠি – তখন
বিশ্বাস হতে চায় না যে এহা স্বপ্ন। প্রতিবারে এই একই স্বপ্ন দেখি। কোন একটা দৃশ্যের
একটুকুও হেরফের নেই।
তবে সবচেয়ে বেশি অবাক হই, যখন দেখি স্বপ্নের সে বৃদ্ধলোক কিংবা দেয়ালের
চিত্রকর্মটি স্বয়ং আমি !
পত্রিকায় একটার পর একটা গল্প পাঠানো, তারপর অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহরের
নিষ্ঠুর অবসান এবং একসময় আমার আশার জলাঞ্জলি দিয়ে রাতের আকাশে তারাগোনা – এভাবেই
দিনগুলি কাটছিল।
রোদ-বৃষ্টি ঝড়-তুফান মাথায় তুলে প্রকাশকের দুয়ারে দুয়ারে কাপা কাপা হাতে
পাণ্ডুলিপি তুলে দেয়া- প্রকাশকের নাক ছিটকানো, তাই একদিন পূর্ণিমার চাঁদের মতই
বিসর্জন দিলাম কলমকে।
একসময় প্রচন্ড হতাশা গ্রাস করে নিল আমাকে। একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশাল
পরিবর্তন।
পরিবর্তনের স্বাদ নিতে যখন রাস্তায় নামলাম, জীবনের প্রথমবারের মত পেলাম
স্বাধীনতার সুধা। আমার সামনে ধরা দিল নতুন এক জগত।
গ্রাম থেকে গ্রামে, জনপদ থেকে জনপদে – মুক্তচেতার আস্বাদন নিয়ে ছুটে চলছি আমি।
কত শত শত হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়েছি, তার হিসাব নেই। পরিচয় ঘটেছে কত সংস্কৃতির
সাথে। খুব কাছ থেকে দেখেছি সাধারনের জীবনধারা।
প্রকৃতির অপূর্ব নৈসর্গের সাথে পরিচয় হয়েছে। এতদিন যা বই পুস্তকে পড়তাম এবং
বুনে চলতাম কল্পনার জাল, আজ সেই কল্পনার জাল বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে আমার চোখে। আমি
আবিষ্কার করে চলেছি ধরণীকে- নিকেকে।
এভাবে দীর্ঘ একটা সময় অতিবাহিত করে অবশেষে ক্ষ্যান্ত দিলাম। চলে এলাম চেনা
জানা আগের জীবনে।
তারপর ?
হ্যাঁ। তারপরের ইতিহাস শুধু সামনে চলার ইতিহাস।
সে ইতিহাসই আমি পাঠকদের বলব।
রঘুবাড়ি গ্রামে যখন পৌছালাম তখন আকাশে সন্ধ্যা বিদায় নিয়ে শুল্কপক্ষের
প্রথম চাঁদ উঠেছে। বাতাসে একটা মিষ্টি গন্ধ। সেই গন্ধে ক্ষিধেটা আবার মাথাচাড়া
দিয়ে উঠল। গন্ধ শুকতে শুকতে হাজির হলাম গ্রামের একমাত্র সরাইখানায়।
এদিকটায় সচারচর কোন বিদেশী পর্যটক আসে না, তাই আমাকে দেখে একসাথে সাত জোড়া
চক্ষু ঘুরে গেল। তাদের সে দৃষ্টির সামনে সরাইখানার বৃদ্ধ মালিক দ্রুত চলে এলেন
অতিথি আপ্যায়নে।
সরাইখানার দোতালার পূর্ব প্রান্তের শেষ রুমটি আমাকে দেয়া হল। মোমবাতির কাপা
আলোয় বৃদ্ধের সাথে ঘরে প্রবেশ করলাম। আস্তরন খসা চার দেয়ালের নীচে, একপাশে একজন
থাকার মত ছোট একটা তক্তপোষ; অপর পাশে জানালার সাথে একটা টেবিল। টেবিলের সংলগ্ন
চেয়ারের উপর ট্রাভেল ব্যাগ নামিয়ে রাখলাম।
সরাইখানার মালিক বৃদ্ধ ভদ্রলোক চলে গেলেন। রুমের মোধ্য ভ্যাপসা গন্ধ। জানালা
খুলে দিতেই এক ঝলক দখিনা বাতাস সজিবতা নিয়ে এল দেহে।
আকাশে হাজার তারার মেলা। চাঁদ তার মায়াবী দ্যুতিতে স্বর্গের আস্বাদন এনে
দিয়েছে ধরণীতলে। জানালার পরে দিগন্ত প্রসারিত শুন্য ভুমি। ঈষৎ আলোয় উদ্ভাসিত অতল
অন্ধকার – সে অন্ধকারের মাঝেই লুকিয়ে আছে কত সহস্র রহস্য ...।
দরজাটা বন্ধ করে নীচতলায় চলে এলাম। খাদ্য চলে এল। বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে
গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। দুপুরের পর একটা দানাপানিও পরেনি উদরে।
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম। যদিও চাঁদের আলোয় টেবিল আলোকিত- সেখানে নিভু
নিভু করে জ্বলছে প্রদীপ। ভাবছি, সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কতটাই সুন্দর। পূর্ব-পশ্চিম,
উত্তর-দক্ষিণ সবখানেই তার সাক্ষ্য। আজ এততা দিন ধরে যে ছুটে চলেছি – শরীর ক্লান্ত
হয়, কিন্তু একফোঁটা ক্লান্তি জমেনি মনের আঙিনায়। উপরন্তু আরও পাচ্ছি ছুটে চলার
প্রেরনা। সমস্ত জীবনটা যদি ইবনে বতুতাদের মত হত। ভাবনাগুলো একসময় জট পাকিয়ে গেল।
ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।
সকাল বেলা নাস্তা সেরে ভাবছি আজকের দিনটাকে নিয়ে। বাইরে বের হবার উপায় নেই।
জানালার কাছে আঘাত হেনে চলছে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। চেয়ার টেনে নিয়ে জানালার পাশে
বসলাম।
ঘড়ির কাঁটায় সকাল দশটার ইঙ্গিত দিচ্ছে, অথচ বাইরের অবস্থা দেখে মনে হবে ভোরের
পূর্ব প্রহর।তুমুল বর্ষণের ফাকে চিলতে আবছা ধরা দিচ্ছে প্রকৃতি জানালার মধ্য দিয়ে।
ভুমি এখানে সমতল নয়। ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত উঁচু নিচু টিলায় বিন্যস্ত।
সরাইখানায় বৃদ্ধ মালিক, তার দু কর্মচারী ও একজন রাঁধুনি ছাড়া আর কেউ নেই।
বৃদ্ধের কোন ব্যাস্ততা ছিল না, উঠে এসে বসলেন আমার পাশে।
বৃদ্ধের সাথে অনেক বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হল। তবে স্থানীয় ইতিহাসের উপর আমার
আগ্রহ বুঝতে পেরে তিনি শোনালেন অপূর্ব এক কাহিনী।
দুশো বছর পূর্বে ইংল্যান্ড থেকে বিতাড়িত হয়ে এক ইংরেজ ভদ্রলোক এসেছিলেন এ
অঞ্চলে। এ জায়গা তখন আরাকানের অধীনে ছিল। আরাকান ছিল বাংলার শাসনাধীন। বাংলা সহ
সমগ্র উপমহাদেশ ছিল ইংরেজদের অধীনে।
এ অঞ্চলে সে সময় লোকজনের বাস খুব নগন্য ছিল। ইংরেজ ভদ্রলোক এখানের নৈসর্গিকতা
দেখে এতটাই মুগ্ধ হন, থেকে যান এখানে স্থায়ী ভাবে।
ধীরে ধীরে আরাকানের পাহাড়ি মানুষগুলোর সাথে পরিচয় ঘটে তার। অল্প দিনের মাঝে
তাদের মন জয় করে ফেলেন। শিক্ষার আলো, ধর্মের আলো ছড়াতে ব্রতী হন সবার মাঝে। তারপর
কোন এক অজ্ঞাত কারনে চলে যান এখান থেকে। পরে আর কেহই খুজে পায়নি তাকে। অবশ্য মাঝে
মাঝে জনপদে দেখাও গেছে তাকে। কিন্তু সেটাও সবার কাছে রহস্য।
সমস্ত দিন সরাইখানার ভিতরেই কাটল। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সময়
কেটেছে একটাই ভাবনা নিয়ে – কে সেই রহস্যময় ইংরেজ ভদ্রলোক ?
সরাইখানার বৃদ্ধ লোকটির থেকে বিদায় নিয়ে যখন রাস্তায় নামলাম, সূর্য তখন একফালি
রক্তিম বর্ণে পূর্বাকাশে। ঘুম থেকে উঠেই সিগ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমি যাব পশ্চিমে
পাহাড়ের ওপাশটাতে।
গত রাত্রেও সেই একই স্বপ্ন ধরা দিয়েছে আমার অবচেতন ইন্দ্রিয়ে। স্বপ্নটা যেন
বাস্তব- জীবন্ত। সৃষ্টিকর্তাই জানেন কবে এ রহস্যের সমাধা হবে।
দুপুরের পরেই পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের ওপাশটাতে।
এখানে দিগন্ত বিস্তৃত সমভুমি। সবুজের ঢেউ খেলে গেছে যেন প্রকৃতিতে। ঈষৎ ছড়ানো
ছিটানো উঁচু বৃক্ষ। সবুজের প্রান্তর জুড়ে খেলা করছে প্রজাপতি আর ঘাসফড়িং এর দল।
কাঠবিড়ালি, খরগোশ এবং অগুনিত পাখির সমারোহ।
সূর্য উঁকিঝুকি দিচ্ছে মেঘের আড়াল থেকে। সেই মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি খেলায়
অদ্ভুত এক অপার্থিবতা এনে দিয়েছে প্রকৃতি জুড়ে। প্রচন্ড একটা ভালো লাগার শিহরণ বয়ে
গেল সমস্ত শরীরে।
বিকেলের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেলাম সমভূমির শেষ প্রান্তে। এখান থেকে ভুমি ক্রমশ
উঁচু হয়ে সামনে চলে গেছে। সন্মুখে, দূরে – আরও দূরে, যেখানে ভুমি তার সর্বচ্চো
উচ্চতায়; ঠিক তার উপরে ঊর্ধ্বাকাশে শেষ বিকেলের অস্তমিত সূর্য।
সবুজ ঘাসের গালিচা মাড়িয়ে ক্রমশ উপরে উঠছি। একসময়.... হঠাৎ মনে হল, এই ভুমি
আমার চিরচেনা- বহুকাল পূর্ব থেকেই একে আমি চিনি-জানি। এর সাথে সম্পর্ক আমার সমস্ত
স্বত্বার।
মনে পড়ল স্বপ্নের কথা ... টিলার খাড়া ঢাল গিয়ে মিশেছে নদীর স্রোতে ...।
সন্ধ্যার বেশ খানিকটা আগেই পা রাখলাম ভুমির সর্বচ্চো উচ্চতায়। একটা সময়ের জন্য
স্তব্ধ হয়ে গেলাম প্রকৃতির এই বিশাল রূপ-মাধুর্য দেখে।
... এবং হ্যাঁ। একটি নদী। নদীর ওপাড় ঘেসে আকাশ ছোঁয়া অরণ্যরাজির সমাহার। যে
দৃশ্য আমি স্বপ্নে বহুবার দেখেছি।
এখন একে একে উন্মোচিত হবে সব রহস্যের মায়াজাল।
টিলার খাড়া ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলাম। সামনে নদী। দূরে নদীর কুল ঘেসে ঢালের
খাড়া নীচে অসংখ্য গাছপালা পরিবেষ্টিত অন্ধকারাছন্ন অববয়। তারই অভ্যন্তরে সামান্য
উঁকি দিচ্ছে শতাব্দী পুরনো এক বিবর্ণ গৃহ কাঠামো।
স্বপ্নের সেই দৃশ্যপটের সাথে এখানে অমিল। স্বপ্নটা হয়তবা শতাব্দী পুরনো। স্বপ্নে
দেখা সেই দৃশ্যপটের সাথে বাস্তবের বাড়ির সম্পূর্ণ অমিল। বাস্তবে, সেই পুস্প
উদ্যানে অসংখ্য পুষ্পের পরিবর্তে অসংখ্য কণ্টক বৃক্ষ। এখানে টিলার ভূমিধ্বস প্রায়
পুরোটাই ঢেকে দিয়েছে এককালের সেই সুন্দর সাজানো বাড়িটিকে।
প্রায় মাটি চাপা পড়া বাড়িটির সন্মুখে দু পাশের কাঁটাঝোপের মোধ্য দিয়ে আগাছায়
পরিপূর্ণ সরু রাস্তা গিয়ে মিশেছে নদীর পাড়ে। সেখানে একটি নৌকার প্রায় ধ্বংসাবশেষ
এখনও সাক্ষী দিচ্ছে কালের রাহুগ্রাহের।
হঠাৎ করে যেন রাত্রি নেমে এল। সমস্ত আকাশ জুড়ে কালো মেঘের অশুভ আনাগোনা।
প্রমত্ত ধারার ওপাশে অরণ্য ভেসে এল প্রচন্ড গর্জন। এক মুহূর্ত পরে বিশ্বচরাচরকে
গ্রাস করে নিল বাতাসের কাঁধে ভর করা পৈচাশিক উল্লাস।
ঝুপ করে নেমে আসা বৃষ্টির তীক্ষ্ হুলে জর্জরিত হয়ে প্রায় ভিজেই মূল দরজা
পেরিয়ে চলে এলাম শতাব্দী পুরনো আবদ্ধ বাতাসের রাজ্যে।
মোমবাতি সাথেই ছিল। অগ্নিসংযোগ করতেই বিশাল এক হলরুমের অববয় ধরা পড়ল চোখে।
এখানকার সবকিছুই সাক্ষ্য দিচ্ছে শতাব্দী পুরনো ইতিহাসের।
হলরুমের ডানপাশে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দার শেষ প্রান্তে পৌঁছে একদম স্থির
হয়ে গেলাম।
উঁইপোকায় খাওয়া, কালের অবক্ষয়ে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটা দরজা। ভেতর থেকে বন্ধ
করা। একটু চাপ দিতেই খুলে গেল। রহস্যের শেষ নাট্যদৃশ্যে এবার উন্মোচিত হবে।
নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি অনেক আগেই। মোহাবিষ্টের মত শুধু সময়ের স্রোতে গা
ভাসিয়ে দিয়েছি। নিয়ন্ত্রক আমি নই – ঘটনাই এখন আমার নিয়ন্ত্রক, তাই অবাক হলাম না
যখন দেখলাম সবকিছু সেই আগের সপ্নের মতই। কোন পরিবর্তন নেই। শুধু বৃদ্ধ লোকটির
জায়গায় বসে আছে শতছিদ্র জীর্ণ পোশাক পরিহিত এক কঙ্কাল। হাতে এখনও কলম, মাথাটা পরে
আছে হাতের পাশে টেবিলের উপর খোলা বইয়ের মাঝখানে।
পাশে দেয়ালে টাঙ্গানো একটি পোট্রেট। উপর থেকে ধুলোর আস্তরন সরিয়ে ফেলতেই
মোমবাতির আলোয় পরিষ্কার ধরা পড়ল একটা শৈল্পিক অবয়য় – হুবুহু আমার পতিকৃতি।
বিছানায় বসে অপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছি স্বাভাবিক থাকার। কাঁপা কাঁপা হাতে একটা
সিগারেট ধরালাম। বাইরে প্রচন্ড তান্ডব। বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের আলোকে এক মুহূর্তের
জন্য আলোকিত হচ্ছে পৃথিবী। পর মুহূর্তে সীমাহীন অন্ধকার।
দীর্ঘ সময় পরে অনেকটা ধাতস্থ হলাম। এখন চিন্তা ভাবনার প্রয়াস পাচ্ছি শেষ সময়
পর্যন্ত। মোমবাতির কাঁপা আলোর রেশ ধরে দৃষ্টি চলে গেল চেয়ারে বসা কঙ্কালের দিকে।
যুগের পর যুগ ধরে একই স্থানে বসে আসে সে।
এই সেই ইংরেজ ভদ্রলোক যিনি ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে বিতাড়িত হয়ে জীবনের শেষ
দিনগুলি কাটিয়েছেন কতটা যাতনার মধ্য দিয়ে।
স্বপ্নের সেই বৃদ্ধ আনমনে লিখে চলেছেন। যার পোট্রেট এখনও দেয়ালে দাড়িয়ে আছে।
চিন্তার ধারাগুলো আস্তে আস্তে জট পাকিয়ে যাচ্ছে আমার মাঝে। তবুও সেখানে একটি
জিজ্ঞাসা- ভাবছি, আমার কোন পূর্ব পুরুষ নাকি অন্য কেউ, যার সাথে চেহারার পুরো
সামজস্যতা আমারই।
টেবিলের ‘পরে বিক্ষিপ্ত দু চারটে বই, ইতঃস্তত ছড়ানো মলিন কাগজ, একটি প্রদীপ
এবং সবকিছুর উপরে শতাব্দী পুরনো ধুলোর আস্তরন।
কঙ্কালের মাথার নিচ থেকে চামড়ায় মোড়ানো লাল মলাটের বইটি তুলে নিলাম। শেষ কিছু
পৃষ্ঠা বাদ পর্যন্ত হাতে লেখা। মুহূর্তেই একটা আদম্য কৌতূহল গ্রাস করল আমাকে।
তিনশত বাহাত্তুর পৃষ্ঠা পর্যন্ত পরে উত্তেজনায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এ পর্যন্তই
লেখাটা শেষ। পরবর্তী শূন্য পৃষ্ঠাগুলি হয়তবা প্রতীক্ষায় ছিল তাদেরও সাদা জমিনের
উপর কালো কালির আঁচড় পড়বে, কিন্তু তা পুরন হয়নি।
অসাধারণ এক উপন্যাস। অনেক শক্তিশালী সাহিত্যিকের সাহিত্য কর্মের সাথে পরিচয়ের
সোভাগ্য আমার হয়েছে, কিন্তু কখনও এতটা শিহরণ অনুভব করিনি- যেমনটি অর্জিত হয়েছে এই
সাহিত্যকর্মের বেলায়।
সে উপন্যাসে আছে ভাগ্য বিবর্জিত এক ইংরেজের জীবনগাথা। প্রায় তিনশত বছর পূর্বে
আপন দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এই বাংলায় এসেছিলেন তিনি। অপরাধ- বৃটিশ রাজতন্ত্রের
বিশ্বকে পদানত করার নীল নকশার প্রতিবাদ করছিলেন তিনি। বাংলায় এসে স্থায়ীভাবে বসাবস
শুরু করেন তিনি। ইংরেজ বনিকদের এ দেশে আগমনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে সাধারনের মাঝে
দেশপ্রেমের বীজ ছড়াতে উদ্যোগ নেন। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধে উপমহাদেশের স্বাধীনতার
সূর্য স্তিমিত হলে, ইংরেজ শাসক তারই স্বজাতির বিরুদ্ধে মৃত্যুর পরওয়ানা জারি করলে
তিনি পালিয়ে আসেন আরাকানে। কিন্তু ভাগ্য এখানেও তার সাথে প্রতারনা করে। জীবনের
প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে বেছে নেন একাকীত্ব।
এসব নিয়েই বাস্তব সত্যের আলোকে লেখা তার আত্মকথামূলক উপন্যাস – এক কথায় অসাধারন।
সেখানে আরও আছে দুশো বৎসর পূর্বের ইংরেজ সমাজ ব্যাবস্থার ভাগ্যাহত সাধারন মানুষের
ইতিকথা, আছে এই উপমহাদেশ শোষণের ইতিহাস।
প্রথম পৃষ্ঠায় চমৎকার একটি নাম দিয়েছেন উপন্যাসের ‘ The Argus ‘ । যেখানে ইংরেজ রাজতন্ত্রকে তিনি শত চক্ষু
বিশিষ্ট দৈত্যরুপে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু শেষের দিকে লেখাটি অসম্পূর্ণ। হয়তবা
তার প্রয়াস ছিল, কিন্তু নিষ্ঠুর সময় তার সে অভিপ্রায় পূর্ণ হতে দেয়নি।
কিন্তু এখন আমি জানি, অসমাপ্ত কাহিনীর সমাপ্ত অংশটুকু। প্রতিটি শব্দের অতলে
হারিয়ে যেতে যেতে একসময় উপলদ্ধি করেছি- এ ইতিহাস আমার পরিচিত, আমার অথবা আমার
অচেনা কোন পূর্ব পুরুষের। যেখানে ভাগ্যের নিষ্ঠুর প্রহসনে চেনা জানা লোকদের
হটকারিতায় চিরদিনের মত হারিয়ে গেছে সে।
সাড়ে আটমাস পরে প্রকাশিত হল উপন্যাস ‘ The Argus’ । বইয়ের ভূমিকাতে আমি বিস্তারিত তুলে ধরেছি ঘটনার সব কিছুই, যেখানে পাঠক
মাত্রই বুঝতে পারে এখানে আমার অবদান সামান্যই। দীর্ঘ পাঁচ মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম,
যেখানে দিন-রাত্রি একটাই চাওয়া- নতুন ভাবে বিন্যস্ত উপন্যাসটির সমাপ্তি। সেই
স্বপ্নটিই নতুন করে দেখি যা দেখতাম বহু বছর পূর্বে – তা যেভাবেই হোক না কেন।
আমার সে স্বপ্ন সার্থক হয়েছে।
‘কেমন হয়েছে’?
পত্রিকাটি নামিয়ে ভাজ করে রাখতে রাখতে
উত্তর দিল আমার সদ্য বিবাহিত সাহিত্যপ্রেমিক স্ত্রী ‘অসাধারন’। এই একটি শব্দের
মোধ্য খুজে পেলাম সেই প্রশান্তি,- যে প্রশান্তি সন্ধ্যায় রাখাল বালক
সারাদিনের কর্মক্লান্তি শেষে মেষপালের পিছু পিছু শত বছরের পুরনো সেই একই সুর
বাঁশির রুদ্র প্রকোস্টে তুলতে তুলতে ঘরে ফিরে।
‘তবে শুরুটা হয়েছে একদম সাদামাটা’ – মন্ত্যব্য করলেন আমার স্ত্রী।
‘সূচনা যেভাবেই হোক, কাহিনীর সাবলীল গতি কিংবা বিশ্বাস যোগ্যতাই মূল বিষয়’।
‘এখানে বিশ্বাসযোগ্যতা পেলে কোথায়? পুরোটাই তো কাল্পনিক’।
স্ত্রীকে বোঝাতে হল, বিশ্বাসযোগ্যতা সেই অর্থে, যখন বিষয়বস্তু কাল্পনিক হলেও
কাহিনীর প্রানচঞ্চল গতিতে পাঠক হারিয়ে যায় কাহিনীর অতলে- যেখানে গল্পের চরিত্র
কিংবা দৃশ্যপটের মাঝে আবিষ্কার করার প্রয়াস পায় নিজেকে। সাহিত্যের বিচারে সেটাই
বিশ্বাসযোগ্যতা।
‘তবে’- একটু থেমে মুচকি হেসে স্ত্রীকে বললাম, ‘গল্পটাতো কাল্পনিক নাও হতে পারে’।
‘ধুর! এমন গল্প কখনও বাস্তব হয়’- দুষ্টুমি ভরা দৃষ্টিতে আমাকে বিদ্ধ করে সে
চলে গেল রান্নাঘরে।
আপাতঃ বেশ ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছে দিনগুলি।
শহরের অদুরে মূল রাস্তা থেকে গলির একটু ভিতরে বহুদিনের পুরনো প্রাচীরের ভিতরে
জীর্ণ দোতলা বাড়ি- এহাই আমার বাসভবন। পৈত্রিক সুত্রে প্রাপ্ত এক কালের বংশের
ঐতিহ্য বাড়িটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে। নীচতলার কয়েকটি রুম সামান্য
মেরামত করে চালিয়ে নিচ্ছি মাথা গোজার আশ্রয় হিসাবে।
দু জনের ছোট্ট সংসার। দিনের বেলায় যে সময় অফিসপাড়ায় জোয়াল কাঁধে অফিসের ‘ঘানি’
টানতে ব্যাস্ত, সে সময় শুন্য বাড়িতে স্ত্রী একলা থাকে। প্রায়শই আবদার তার একটা
কাজের লোকের, কিন্তু সে সামর্থ্য আমার নেই। দু পয়সার চাকরিটা যে ছেড়ে দিব, সে সময়
এখনও তৈরি হয়নি।
তবে লেখালেখি সম্প্রতি বেশ এগুচ্ছে স্ত্রীর উৎসাহে। পত্রিকাও আগ্রহভরে প্রকাশ
করছে দু চারটা। যখন অর্থকষ্ট একটু কাটবে, চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করব
লেখালেখিতে।
কর্মক্লান্ত দিনের শেষে রাত্রিবেলা ডিমলাইটের মৃদু আলোয় স্ত্রী আর আমি যখন
বিছানায় পাশাপাশি; দু জনে মিলে কল্পনার জাল বুনে চলি অনাগত ভবিষ্যতের।
সুন্দর পরিপাটি বাড়িটিতে সাজানো গোছানো ছোট্ট সংসার। বারান্দার প্রসারিত
জালানার ওপাশে-সামনে, সুন্দর বিশাল লন। লনের দুপাশে লাল, নীল, হলুদ – বাহারী ফুলের
সমাবেশ। সেখানে খেলা করছে শিশুর দল ...।
স্ত্রীর কল্পনাগুলো একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে তার সাথে। আমি জেগে থাকি।
আমার কল্পনাগুলো কখনও ক্লান্ত হয় না- সেই দিন খুব একটা দূরে হয়, যেদিন কল্পনাগুলো
বাস্তবতা পাবে। আমি জানি।
ভাবি, টেবিল ল্যাম্পের উজ্জ্বল আলোয় সাদা পৃষ্ঠার উপর কালির আঁচড়ে একের পর এক
প্রান সৃষ্টি করে চলেছি, সেই হাজারো প্রানের মুখরিত কলেরবে মুখরিত সাহিত্য
প্রাঙ্গণ। সে প্রান সবার মাঝে গুণকীর্তন গেয়ে চলছে তার সৃষ্টিকর্তার। বহন করে
চলেছে যুগ যুগ ধরে অনাদিকাল পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার সত্ত্বা সাধারন মানুষের মাঝে।
খোলা জানালা দিয়ে একচিলতে জ্যোৎস্না প্রবেশ করছে ভিতরে। সেই আলোকচ্ছটা
বিন্যস্ত হয়ে পড়েছে সরাসরি স্ত্রীর মুখে। ঠিক যেন শুন্য থেকে নেমে আসা কোন অল্পসী
তার রুপের আলোয় মাতিয়ে তুলেছে নিঃশব্দের অন্ধকার রাত্রি।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত যেন অতিবাহিত সে অল্পসীর রুপের নেশায়- বিহব্বল দৃষ্টিতে
আমার। হৃদয়ের কষ্টের নীল প্রবাহ বেড়িয়ে এল দীর্ঘশ্বাস হয়ে – এক সময়।
আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা আমার স্ত্রী যখন বিলাসিতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে
শুন্য হস্তে আমারই ভগ্নদুয়ারে এসে দাঁড়ালো শুধুমাত্র আমারি জন্য, সেদিনও- কষ্টের
দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়েছিল বুক চিড়ে- আজকের মত এভাবেই।
স্থির, আত্ম প্রত্যয়ের কণ্ঠস্বরের ঢেউ নাড়া দিয়ে উঠল আমার সমস্ত সত্ত্বায়।
আমাদের স্বপ্নগুলিকে পরিনত করতে হবে বাস্তবতার ভীতে।
সে দিন খুব একটা দূরে নয়।
লাল চামড়ার মলাটে আবদ্ধ পাণ্ডুলিপির বইটা চেপে ধরলাম বুকের উপর। আর মাত্র
কয়েকটা দিন, তার পরেই শেষ হবে অসমাপ্ত অংশটুকু। তারপর চলে যাবে প্রেসে, সেখান থেকে
লাল প্রচ্ছদের বই হয়ে বেড়িয়ে আসবে সাহিত্যকর্ম ‘The Argus’, জায়গা করে নিবে শত শত পাঠকের অন্তরে। আমার অবদানেই বেঁচে থাকবে সেই হারিয়ে
যাওয়া মানুষটি- তার অসমাপ্ত সাহিত্যকর্মটি। তার প্রতিদানের কিছুটা অবশ্যই আমার
প্রাপ্য।
বিখ্যাত হবার স্বপ্ন আমার অনেক দিনের।
(রচনাকালঃ ১৯৯৯)