স্বপ্ন ।
‘ বিখ্যাত হবার স্বপ্ন আমার অনেকদিনের এবং তা সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে।’
ছেলেবেলায় যখন স্কুলে পড়তাম, তখন থেকেই সাহিত্যের সাথে আমার পরিচয়য়। স্কুলে
আমার কয়েকজন ভালো বন্ধু ছিল, যে বন্ধুরা নিয়মিত গল্পের বই পড়ত। তাদের হাত ধরে সেই
তখন প্রবেশ করেছিলাম সাহিত্যের আশ্চর্য জগতে। ক্লাসে স্যারের চক্ষু বাঁচিয়ে কিংবা
বিকেলবেলায় সমবয়সী সবাই যখন মাঠে খেলাধুলায় ব্যাস্ত, তখন আমি ছাদের কোনায় বসে
হারিয়ে গেছি কল্পনার অসীম রাজ্যে।
রুদ্ধশ্বাসে টান টান উত্তেজনার সে মুহূর্তগুলি। নিজেকে গল্পের নায়ক বা কোন
চরিত্র কল্পনা করে হারিয়ে যেতাম পাহাড় বন-জঙ্গল কিংবা তাদের সীমানা ছাড়িয়ে অনন্ত
মহাকাশের গ্রহ নক্ষত্রের মাঝে।
পরিবর্তনটা যখন এল ততদিনে ঠোঁটের উপর পুরোদস্তুর গোঁফ উঠতে শুরু করেছে। রুচিও
তার ডালপালা বিস্তার করেছে পুরোমাত্রায়। এখন রহস্য আর রোমাঞ্চে ভরপুর বইগুলোর পাশে
ভাললাগে নর-নারীর সরল প্রেমের উপাখ্যান, সাধারন মানুষের ইতিকথা ইত্যাদি। বয়স বাড়ার
সাথে সাথে পছন্দের ধাপটাও বেড়ে চলল সমান গতিতে। আস্তে আস্তে পরিচিত হলাম অস্কার
ওয়াইল্ড, আন্তন চেখভ, লেভ তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিভূতি, সত্যজিৎ রায়
ইত্যাদি সাহিত্যের দিকপালদের সাথে।
সাহিত্য প্রীতি থেকে সেই ছেলে বেলা থেকেই মনের মধ্য একটা সংকল্প দানা বেধে উঠে
– বড় হয়ে আমিও একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিক হব।
স্কুলে বার্ষিক গল্প, কবিতা ইত্যাদি প্রতিযোগিতায় নিয়মিত ছড়া কবিতা লিখতাম।
বন্ধু মহলে তার প্রশংসাও বেশ শুনেছি। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবনেও নিয়মিত
লেখালেখি করতাম। এ সময় কবিতা লিখতাম প্রচুর।
তবে নিজের লেখাগুলি একসময় সাহিত্যের অরুচিকর মনে হত। তাই বন্ধু মহলের বাইরে
প্রকাশ কিংবা পত্রিকায় লেখালেখি থেকে বিরত থাকতাম। ভাবতাম, যখন আমি অনেকগুলো গল্প
লিখব- তখন তা থেকে সেরাটাই প্রথম পাঠাব পত্রিকায়।
আমার সে ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে পুরোপুরি আত্মমগ্ন হলাম
লেখালেখিতে।
ইদানিং একটা স্বপ্ন খুব বেশি দেখি।
প্রান্তরের সবুজ ঘাস বিছানো গালিচা ক্রমশ উপরে উঠে গেছে। একটা টিলা। এপাড়ে
টিলার খাড়া ঢাল গিয়ে মিশেছে এক বহমান স্রোতের তীরে। টিলার খাড়া ঢাল ঘেঁসে সুন্দর সাজানো গোছানো ছিমছাম বাড়ি। বাড়ির সামনে হাজারো ফুলের সমাবেশ। এর ঠিক
মাঝখান দিয়ে ঘাসের গালিচা বিছানো রাস্তা সোজা চলে গেছে সে বহমান জলধারার
তীরে। সেখানে ছোট্ট একটা নৌকা- দড়ি দিয়ে বাঁধা গাছের সাথে। স্রোতাস্বিনীর অপর
প্রান্ত ছুয়ে আকাশ ছোঁয়া বিশাল সব বৃক্ষরাজি বেষ্টিত গহীন অরন্য। অরণ্যে হাজার
প্রাণীর মধুর কোলাহল, গুঞ্জন ...।
বিদ্যুতের ঝলকানি, সেই সাথে গগন
বিদারী তীব্র আর্তনাদ। ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছে সমস্ত প্রকৃতি।
বিশাল হলরুম। হলরুমের ডানপাশে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দার শেষপ্রান্তে ছোট্ট
একটি রুম। চমৎকার সে রুমের পরিবেশ। একপাশে তক্তপোষ। দেয়ালের গায়ে একটি পোট্রেট।
ওপাশে বিশাল জানালার নিচে সেগুন কাঠের টেবিল। সেই টেবিলে ছড়ানো ছিটানো বই পুস্তক
ইত্যাদি।
কেরোসিনের একটা ল্যাম্প জ্বলছে মিট্মিট করে টেবিলের উপর। তারই আলোতে একমনে
লিখে চলছেন এক বৃদ্ধ।
বাইরে প্রকৃতির অশান্ত গর্জন ......।
স্বপ্নটা আমার কাছে এতটাই বাস্তব, স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে যখন জেগে উঠি – তখন
বিশ্বাস হতে চায় না যে এহা স্বপ্ন। প্রতিবারে এই একই স্বপ্ন দেখি। কোন একটা দৃশ্যের
একটুকুও হেরফের নেই।
তবে সবচেয়ে বেশি অবাক হই, যখন দেখি স্বপ্নের সে বৃদ্ধলোক কিংবা দেয়ালের
চিত্রকর্মটি স্বয়ং আমি !
পত্রিকায় একটার পর একটা গল্প পাঠানো, তারপর অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষার প্রহরের
নিষ্ঠুর অবসান এবং একসময় আমার আশার জলাঞ্জলি দিয়ে রাতের আকাশে তারাগোনা – এভাবেই
দিনগুলি কাটছিল।
রোদ-বৃষ্টি ঝড়-তুফান মাথায় তুলে প্রকাশকের দুয়ারে দুয়ারে কাপা কাপা হাতে
পাণ্ডুলিপি তুলে দেয়া- প্রকাশকের নাক ছিটকানো, তাই একদিন পূর্ণিমার চাঁদের মতই
বিসর্জন দিলাম কলমকে।
একসময় প্রচন্ড হতাশা গ্রাস করে নিল আমাকে। একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। বিশাল
পরিবর্তন।
পরিবর্তনের স্বাদ নিতে যখন রাস্তায় নামলাম, জীবনের প্রথমবারের মত পেলাম
স্বাধীনতার সুধা। আমার সামনে ধরা দিল নতুন এক জগত।
গ্রাম থেকে গ্রামে, জনপদ থেকে জনপদে – মুক্তচেতার আস্বাদন নিয়ে ছুটে চলছি আমি।
কত শত শত হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়েছি, তার হিসাব নেই। পরিচয় ঘটেছে কত সংস্কৃতির
সাথে। খুব কাছ থেকে দেখেছি সাধারনের জীবনধারা।
প্রকৃতির অপূর্ব নৈসর্গের সাথে পরিচয় হয়েছে। এতদিন যা বই পুস্তকে পড়তাম এবং
বুনে চলতাম কল্পনার জাল, আজ সেই কল্পনার জাল বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে আমার চোখে। আমি
আবিষ্কার করে চলেছি ধরণীকে- নিকেকে।
এভাবে দীর্ঘ একটা সময় অতিবাহিত করে অবশেষে ক্ষ্যান্ত দিলাম। চলে এলাম চেনা
জানা আগের জীবনে।
তারপর ?
হ্যাঁ। তারপরের ইতিহাস শুধু সামনে চলার ইতিহাস।
সে ইতিহাসই আমি পাঠকদের বলব।
রঘুবাড়ি গ্রামে যখন পৌছালাম তখন আকাশে সন্ধ্যা বিদায় নিয়ে শুল্কপক্ষের
প্রথম চাঁদ উঠেছে। বাতাসে একটা মিষ্টি গন্ধ। সেই গন্ধে ক্ষিধেটা আবার মাথাচাড়া
দিয়ে উঠল। গন্ধ শুকতে শুকতে হাজির হলাম গ্রামের একমাত্র সরাইখানায়।
এদিকটায় সচারচর কোন বিদেশী পর্যটক আসে না, তাই আমাকে দেখে একসাথে সাত জোড়া
চক্ষু ঘুরে গেল। তাদের সে দৃষ্টির সামনে সরাইখানার বৃদ্ধ মালিক দ্রুত চলে এলেন
অতিথি আপ্যায়নে।
সরাইখানার দোতালার পূর্ব প্রান্তের শেষ রুমটি আমাকে দেয়া হল। মোমবাতির কাপা
আলোয় বৃদ্ধের সাথে ঘরে প্রবেশ করলাম। আস্তরন খসা চার দেয়ালের নীচে, একপাশে একজন
থাকার মত ছোট একটা তক্তপোষ; অপর পাশে জানালার সাথে একটা টেবিল। টেবিলের সংলগ্ন
চেয়ারের উপর ট্রাভেল ব্যাগ নামিয়ে রাখলাম।
সরাইখানার মালিক বৃদ্ধ ভদ্রলোক চলে গেলেন। রুমের মোধ্য ভ্যাপসা গন্ধ। জানালা
খুলে দিতেই এক ঝলক দখিনা বাতাস সজিবতা নিয়ে এল দেহে।
আকাশে হাজার তারার মেলা। চাঁদ তার মায়াবী দ্যুতিতে স্বর্গের আস্বাদন এনে
দিয়েছে ধরণীতলে। জানালার পরে দিগন্ত প্রসারিত শুন্য ভুমি। ঈষৎ আলোয় উদ্ভাসিত অতল
অন্ধকার – সে অন্ধকারের মাঝেই লুকিয়ে আছে কত সহস্র রহস্য ...।
দরজাটা বন্ধ করে নীচতলায় চলে এলাম। খাদ্য চলে এল। বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে
গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম। দুপুরের পর একটা দানাপানিও পরেনি উদরে।
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম। যদিও চাঁদের আলোয় টেবিল আলোকিত- সেখানে নিভু
নিভু করে জ্বলছে প্রদীপ। ভাবছি, সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কতটাই সুন্দর। পূর্ব-পশ্চিম,
উত্তর-দক্ষিণ সবখানেই তার সাক্ষ্য। আজ এততা দিন ধরে যে ছুটে চলেছি – শরীর ক্লান্ত
হয়, কিন্তু একফোঁটা ক্লান্তি জমেনি মনের আঙিনায়। উপরন্তু আরও পাচ্ছি ছুটে চলার
প্রেরনা। সমস্ত জীবনটা যদি ইবনে বতুতাদের মত হত। ভাবনাগুলো একসময় জট পাকিয়ে গেল।
ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।
সকাল বেলা নাস্তা সেরে ভাবছি আজকের দিনটাকে নিয়ে। বাইরে বের হবার উপায় নেই।
জানালার কাছে আঘাত হেনে চলছে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা। চেয়ার টেনে নিয়ে জানালার পাশে
বসলাম।
ঘড়ির কাঁটায় সকাল দশটার ইঙ্গিত দিচ্ছে, অথচ বাইরের অবস্থা দেখে মনে হবে ভোরের
পূর্ব প্রহর।তুমুল বর্ষণের ফাকে চিলতে আবছা ধরা দিচ্ছে প্রকৃতি জানালার মধ্য দিয়ে।
ভুমি এখানে সমতল নয়। ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত উঁচু নিচু টিলায় বিন্যস্ত।
সরাইখানায় বৃদ্ধ মালিক, তার দু কর্মচারী ও একজন রাঁধুনি ছাড়া আর কেউ নেই।
বৃদ্ধের কোন ব্যাস্ততা ছিল না, উঠে এসে বসলেন আমার পাশে।
বৃদ্ধের সাথে অনেক বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হল। তবে স্থানীয় ইতিহাসের উপর আমার
আগ্রহ বুঝতে পেরে তিনি শোনালেন অপূর্ব এক কাহিনী।
দুশো বছর পূর্বে ইংল্যান্ড থেকে বিতাড়িত হয়ে এক ইংরেজ ভদ্রলোক এসেছিলেন এ
অঞ্চলে। এ জায়গা তখন আরাকানের অধীনে ছিল। আরাকান ছিল বাংলার শাসনাধীন। বাংলা সহ
সমগ্র উপমহাদেশ ছিল ইংরেজদের অধীনে।
এ অঞ্চলে সে সময় লোকজনের বাস খুব নগন্য ছিল। ইংরেজ ভদ্রলোক এখানের নৈসর্গিকতা
দেখে এতটাই মুগ্ধ হন, থেকে যান এখানে স্থায়ী ভাবে।
ধীরে ধীরে আরাকানের পাহাড়ি মানুষগুলোর সাথে পরিচয় ঘটে তার। অল্প দিনের মাঝে
তাদের মন জয় করে ফেলেন। শিক্ষার আলো, ধর্মের আলো ছড়াতে ব্রতী হন সবার মাঝে। তারপর
কোন এক অজ্ঞাত কারনে চলে যান এখান থেকে। পরে আর কেহই খুজে পায়নি তাকে। অবশ্য মাঝে
মাঝে জনপদে দেখাও গেছে তাকে। কিন্তু সেটাও সবার কাছে রহস্য।
সমস্ত দিন সরাইখানার ভিতরেই কাটল। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে সন্ধ্যা পর্যন্ত। সময়
কেটেছে একটাই ভাবনা নিয়ে – কে সেই রহস্যময় ইংরেজ ভদ্রলোক ?
সরাইখানার বৃদ্ধ লোকটির থেকে বিদায় নিয়ে যখন রাস্তায় নামলাম, সূর্য তখন একফালি
রক্তিম বর্ণে পূর্বাকাশে। ঘুম থেকে উঠেই সিগ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমি যাব পশ্চিমে
পাহাড়ের ওপাশটাতে।
গত রাত্রেও সেই একই স্বপ্ন ধরা দিয়েছে আমার অবচেতন ইন্দ্রিয়ে। স্বপ্নটা যেন
বাস্তব- জীবন্ত। সৃষ্টিকর্তাই জানেন কবে এ রহস্যের সমাধা হবে।
দুপুরের পরেই পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের ওপাশটাতে।
এখানে দিগন্ত বিস্তৃত সমভুমি। সবুজের ঢেউ খেলে গেছে যেন প্রকৃতিতে। ঈষৎ ছড়ানো
ছিটানো উঁচু বৃক্ষ। সবুজের প্রান্তর জুড়ে খেলা করছে প্রজাপতি আর ঘাসফড়িং এর দল।
কাঠবিড়ালি, খরগোশ এবং অগুনিত পাখির সমারোহ।
সূর্য উঁকিঝুকি দিচ্ছে মেঘের আড়াল থেকে। সেই মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি খেলায়
অদ্ভুত এক অপার্থিবতা এনে দিয়েছে প্রকৃতি জুড়ে। প্রচন্ড একটা ভালো লাগার শিহরণ বয়ে
গেল সমস্ত শরীরে।
বিকেলের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেলাম সমভূমির শেষ প্রান্তে। এখান থেকে ভুমি ক্রমশ
উঁচু হয়ে সামনে চলে গেছে। সন্মুখে, দূরে – আরও দূরে, যেখানে ভুমি তার সর্বচ্চো
উচ্চতায়; ঠিক তার উপরে ঊর্ধ্বাকাশে শেষ বিকেলের অস্তমিত সূর্য।
সবুজ ঘাসের গালিচা মাড়িয়ে ক্রমশ উপরে উঠছি। একসময়.... হঠাৎ মনে হল, এই ভুমি
আমার চিরচেনা- বহুকাল পূর্ব থেকেই একে আমি চিনি-জানি। এর সাথে সম্পর্ক আমার সমস্ত
স্বত্বার।
মনে পড়ল স্বপ্নের কথা ... টিলার খাড়া ঢাল গিয়ে মিশেছে নদীর স্রোতে ...।
সন্ধ্যার বেশ খানিকটা আগেই পা রাখলাম ভুমির সর্বচ্চো উচ্চতায়। একটা সময়ের জন্য
স্তব্ধ হয়ে গেলাম প্রকৃতির এই বিশাল রূপ-মাধুর্য দেখে।
... এবং হ্যাঁ। একটি নদী। নদীর ওপাড় ঘেসে আকাশ ছোঁয়া অরণ্যরাজির সমাহার। যে
দৃশ্য আমি স্বপ্নে বহুবার দেখেছি।
এখন একে একে উন্মোচিত হবে সব রহস্যের মায়াজাল।
টিলার খাড়া ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলাম। সামনে নদী। দূরে নদীর কুল ঘেসে ঢালের
খাড়া নীচে অসংখ্য গাছপালা পরিবেষ্টিত অন্ধকারাছন্ন অববয়। তারই অভ্যন্তরে সামান্য
উঁকি দিচ্ছে শতাব্দী পুরনো এক বিবর্ণ গৃহ কাঠামো।
স্বপ্নের সেই দৃশ্যপটের সাথে এখানে অমিল। স্বপ্নটা হয়তবা শতাব্দী পুরনো। স্বপ্নে
দেখা সেই দৃশ্যপটের সাথে বাস্তবের বাড়ির সম্পূর্ণ অমিল। বাস্তবে, সেই পুস্প
উদ্যানে অসংখ্য পুষ্পের পরিবর্তে অসংখ্য কণ্টক বৃক্ষ। এখানে টিলার ভূমিধ্বস প্রায়
পুরোটাই ঢেকে দিয়েছে এককালের সেই সুন্দর সাজানো বাড়িটিকে।
প্রায় মাটি চাপা পড়া বাড়িটির সন্মুখে দু পাশের কাঁটাঝোপের মোধ্য দিয়ে আগাছায়
পরিপূর্ণ সরু রাস্তা গিয়ে মিশেছে নদীর পাড়ে। সেখানে একটি নৌকার প্রায় ধ্বংসাবশেষ
এখনও সাক্ষী দিচ্ছে কালের রাহুগ্রাহের।
হঠাৎ করে যেন রাত্রি নেমে এল। সমস্ত আকাশ জুড়ে কালো মেঘের অশুভ আনাগোনা।
প্রমত্ত ধারার ওপাশে অরণ্য ভেসে এল প্রচন্ড গর্জন। এক মুহূর্ত পরে বিশ্বচরাচরকে
গ্রাস করে নিল বাতাসের কাঁধে ভর করা পৈচাশিক উল্লাস।
ঝুপ করে নেমে আসা বৃষ্টির তীক্ষ্ হুলে জর্জরিত হয়ে প্রায় ভিজেই মূল দরজা
পেরিয়ে চলে এলাম শতাব্দী পুরনো আবদ্ধ বাতাসের রাজ্যে।
মোমবাতি সাথেই ছিল। অগ্নিসংযোগ করতেই বিশাল এক হলরুমের অববয় ধরা পড়ল চোখে।
এখানকার সবকিছুই সাক্ষ্য দিচ্ছে শতাব্দী পুরনো ইতিহাসের।
হলরুমের ডানপাশে প্রশস্ত বারান্দা। বারান্দার শেষ প্রান্তে পৌঁছে একদম স্থির
হয়ে গেলাম।
উঁইপোকায় খাওয়া, কালের অবক্ষয়ে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটা দরজা। ভেতর থেকে বন্ধ
করা। একটু চাপ দিতেই খুলে গেল। রহস্যের শেষ নাট্যদৃশ্যে এবার উন্মোচিত হবে।
নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি অনেক আগেই। মোহাবিষ্টের মত শুধু সময়ের স্রোতে গা
ভাসিয়ে দিয়েছি। নিয়ন্ত্রক আমি নই – ঘটনাই এখন আমার নিয়ন্ত্রক, তাই অবাক হলাম না
যখন দেখলাম সবকিছু সেই আগের সপ্নের মতই। কোন পরিবর্তন নেই। শুধু বৃদ্ধ লোকটির
জায়গায় বসে আছে শতছিদ্র জীর্ণ পোশাক পরিহিত এক কঙ্কাল। হাতে এখনও কলম, মাথাটা পরে
আছে হাতের পাশে টেবিলের উপর খোলা বইয়ের মাঝখানে।
পাশে দেয়ালে টাঙ্গানো একটি পোট্রেট। উপর থেকে ধুলোর আস্তরন সরিয়ে ফেলতেই
মোমবাতির আলোয় পরিষ্কার ধরা পড়ল একটা শৈল্পিক অবয়য় – হুবুহু আমার পতিকৃতি।
বিছানায় বসে অপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছি স্বাভাবিক থাকার। কাঁপা কাঁপা হাতে একটা
সিগারেট ধরালাম। বাইরে প্রচন্ড তান্ডব। বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের আলোকে এক মুহূর্তের
জন্য আলোকিত হচ্ছে পৃথিবী। পর মুহূর্তে সীমাহীন অন্ধকার।
দীর্ঘ সময় পরে অনেকটা ধাতস্থ হলাম। এখন চিন্তা ভাবনার প্রয়াস পাচ্ছি শেষ সময়
পর্যন্ত। মোমবাতির কাঁপা আলোর রেশ ধরে দৃষ্টি চলে গেল চেয়ারে বসা কঙ্কালের দিকে।
যুগের পর যুগ ধরে একই স্থানে বসে আসে সে।
এই সেই ইংরেজ ভদ্রলোক যিনি ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে বিতাড়িত হয়ে জীবনের শেষ
দিনগুলি কাটিয়েছেন কতটা যাতনার মধ্য দিয়ে।
স্বপ্নের সেই বৃদ্ধ আনমনে লিখে চলেছেন। যার পোট্রেট এখনও দেয়ালে দাড়িয়ে আছে।
চিন্তার ধারাগুলো আস্তে আস্তে জট পাকিয়ে যাচ্ছে আমার মাঝে। তবুও সেখানে একটি
জিজ্ঞাসা- ভাবছি, আমার কোন পূর্ব পুরুষ নাকি অন্য কেউ, যার সাথে চেহারার পুরো
সামজস্যতা আমারই।
টেবিলের ‘পরে বিক্ষিপ্ত দু চারটে বই, ইতঃস্তত ছড়ানো মলিন কাগজ, একটি প্রদীপ
এবং সবকিছুর উপরে শতাব্দী পুরনো ধুলোর আস্তরন।
কঙ্কালের মাথার নিচ থেকে চামড়ায় মোড়ানো লাল মলাটের বইটি তুলে নিলাম। শেষ কিছু
পৃষ্ঠা বাদ পর্যন্ত হাতে লেখা। মুহূর্তেই একটা আদম্য কৌতূহল গ্রাস করল আমাকে।
তিনশত বাহাত্তুর পৃষ্ঠা পর্যন্ত পরে উত্তেজনায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এ পর্যন্তই
লেখাটা শেষ। পরবর্তী শূন্য পৃষ্ঠাগুলি হয়তবা প্রতীক্ষায় ছিল তাদেরও সাদা জমিনের
উপর কালো কালির আঁচড় পড়বে, কিন্তু তা পুরন হয়নি।
অসাধারণ এক উপন্যাস। অনেক শক্তিশালী সাহিত্যিকের সাহিত্য কর্মের সাথে পরিচয়ের
সোভাগ্য আমার হয়েছে, কিন্তু কখনও এতটা শিহরণ অনুভব করিনি- যেমনটি অর্জিত হয়েছে এই
সাহিত্যকর্মের বেলায়।
সে উপন্যাসে আছে ভাগ্য বিবর্জিত এক ইংরেজের জীবনগাথা। প্রায় তিনশত বছর পূর্বে
আপন দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে এই বাংলায় এসেছিলেন তিনি। অপরাধ- বৃটিশ রাজতন্ত্রের
বিশ্বকে পদানত করার নীল নকশার প্রতিবাদ করছিলেন তিনি। বাংলায় এসে স্থায়ীভাবে বসাবস
শুরু করেন তিনি। ইংরেজ বনিকদের এ দেশে আগমনের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে সাধারনের মাঝে
দেশপ্রেমের বীজ ছড়াতে উদ্যোগ নেন। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধে উপমহাদেশের স্বাধীনতার
সূর্য স্তিমিত হলে, ইংরেজ শাসক তারই স্বজাতির বিরুদ্ধে মৃত্যুর পরওয়ানা জারি করলে
তিনি পালিয়ে আসেন আরাকানে। কিন্তু ভাগ্য এখানেও তার সাথে প্রতারনা করে। জীবনের
প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে বেছে নেন একাকীত্ব।
এসব নিয়েই বাস্তব সত্যের আলোকে লেখা তার আত্মকথামূলক উপন্যাস – এক কথায় অসাধারন।
সেখানে আরও আছে দুশো বৎসর পূর্বের ইংরেজ সমাজ ব্যাবস্থার ভাগ্যাহত সাধারন মানুষের
ইতিকথা, আছে এই উপমহাদেশ শোষণের ইতিহাস।
প্রথম পৃষ্ঠায় চমৎকার একটি নাম দিয়েছেন উপন্যাসের ‘ The Argus ‘ । যেখানে ইংরেজ রাজতন্ত্রকে তিনি শত চক্ষু
বিশিষ্ট দৈত্যরুপে আখ্যায়িত করেছেন। কিন্তু শেষের দিকে লেখাটি অসম্পূর্ণ। হয়তবা
তার প্রয়াস ছিল, কিন্তু নিষ্ঠুর সময় তার সে অভিপ্রায় পূর্ণ হতে দেয়নি।
কিন্তু এখন আমি জানি, অসমাপ্ত কাহিনীর সমাপ্ত অংশটুকু। প্রতিটি শব্দের অতলে
হারিয়ে যেতে যেতে একসময় উপলদ্ধি করেছি- এ ইতিহাস আমার পরিচিত, আমার অথবা আমার
অচেনা কোন পূর্ব পুরুষের। যেখানে ভাগ্যের নিষ্ঠুর প্রহসনে চেনা জানা লোকদের
হটকারিতায় চিরদিনের মত হারিয়ে গেছে সে।
সাড়ে আটমাস পরে প্রকাশিত হল উপন্যাস ‘ The Argus’ । বইয়ের ভূমিকাতে আমি বিস্তারিত তুলে ধরেছি ঘটনার সব কিছুই, যেখানে পাঠক
মাত্রই বুঝতে পারে এখানে আমার অবদান সামান্যই। দীর্ঘ পাঁচ মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম,
যেখানে দিন-রাত্রি একটাই চাওয়া- নতুন ভাবে বিন্যস্ত উপন্যাসটির সমাপ্তি। সেই
স্বপ্নটিই নতুন করে দেখি যা দেখতাম বহু বছর পূর্বে – তা যেভাবেই হোক না কেন।
আমার সে স্বপ্ন সার্থক হয়েছে।
‘কেমন হয়েছে’?
পত্রিকাটি নামিয়ে ভাজ করে রাখতে রাখতে
উত্তর দিল আমার সদ্য বিবাহিত সাহিত্যপ্রেমিক স্ত্রী ‘অসাধারন’। এই একটি শব্দের
মোধ্য খুজে পেলাম সেই প্রশান্তি,- যে প্রশান্তি সন্ধ্যায় রাখাল বালক
সারাদিনের কর্মক্লান্তি শেষে মেষপালের পিছু পিছু শত বছরের পুরনো সেই একই সুর
বাঁশির রুদ্র প্রকোস্টে তুলতে তুলতে ঘরে ফিরে।
‘তবে শুরুটা হয়েছে একদম সাদামাটা’ – মন্ত্যব্য করলেন আমার স্ত্রী।
‘সূচনা যেভাবেই হোক, কাহিনীর সাবলীল গতি কিংবা বিশ্বাস যোগ্যতাই মূল বিষয়’।
‘এখানে বিশ্বাসযোগ্যতা পেলে কোথায়? পুরোটাই তো কাল্পনিক’।
স্ত্রীকে বোঝাতে হল, বিশ্বাসযোগ্যতা সেই অর্থে, যখন বিষয়বস্তু কাল্পনিক হলেও
কাহিনীর প্রানচঞ্চল গতিতে পাঠক হারিয়ে যায় কাহিনীর অতলে- যেখানে গল্পের চরিত্র
কিংবা দৃশ্যপটের মাঝে আবিষ্কার করার প্রয়াস পায় নিজেকে। সাহিত্যের বিচারে সেটাই
বিশ্বাসযোগ্যতা।
‘তবে’- একটু থেমে মুচকি হেসে স্ত্রীকে বললাম, ‘গল্পটাতো কাল্পনিক নাও হতে পারে’।
‘ধুর! এমন গল্প কখনও বাস্তব হয়’- দুষ্টুমি ভরা দৃষ্টিতে আমাকে বিদ্ধ করে সে
চলে গেল রান্নাঘরে।
আপাতঃ বেশ ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছে দিনগুলি।
শহরের অদুরে মূল রাস্তা থেকে গলির একটু ভিতরে বহুদিনের পুরনো প্রাচীরের ভিতরে
জীর্ণ দোতলা বাড়ি- এহাই আমার বাসভবন। পৈত্রিক সুত্রে প্রাপ্ত এক কালের বংশের
ঐতিহ্য বাড়িটি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে। নীচতলার কয়েকটি রুম সামান্য
মেরামত করে চালিয়ে নিচ্ছি মাথা গোজার আশ্রয় হিসাবে।
দু জনের ছোট্ট সংসার। দিনের বেলায় যে সময় অফিসপাড়ায় জোয়াল কাঁধে অফিসের ‘ঘানি’
টানতে ব্যাস্ত, সে সময় শুন্য বাড়িতে স্ত্রী একলা থাকে। প্রায়শই আবদার তার একটা
কাজের লোকের, কিন্তু সে সামর্থ্য আমার নেই। দু পয়সার চাকরিটা যে ছেড়ে দিব, সে সময়
এখনও তৈরি হয়নি।
তবে লেখালেখি সম্প্রতি বেশ এগুচ্ছে স্ত্রীর উৎসাহে। পত্রিকাও আগ্রহভরে প্রকাশ
করছে দু চারটা। যখন অর্থকষ্ট একটু কাটবে, চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করব
লেখালেখিতে।
কর্মক্লান্ত দিনের শেষে রাত্রিবেলা ডিমলাইটের মৃদু আলোয় স্ত্রী আর আমি যখন
বিছানায় পাশাপাশি; দু জনে মিলে কল্পনার জাল বুনে চলি অনাগত ভবিষ্যতের।
সুন্দর পরিপাটি বাড়িটিতে সাজানো গোছানো ছোট্ট সংসার। বারান্দার প্রসারিত
জালানার ওপাশে-সামনে, সুন্দর বিশাল লন। লনের দুপাশে লাল, নীল, হলুদ – বাহারী ফুলের
সমাবেশ। সেখানে খেলা করছে শিশুর দল ...।
স্ত্রীর কল্পনাগুলো একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে তার সাথে। আমি জেগে থাকি।
আমার কল্পনাগুলো কখনও ক্লান্ত হয় না- সেই দিন খুব একটা দূরে হয়, যেদিন কল্পনাগুলো
বাস্তবতা পাবে। আমি জানি।
ভাবি, টেবিল ল্যাম্পের উজ্জ্বল আলোয় সাদা পৃষ্ঠার উপর কালির আঁচড়ে একের পর এক
প্রান সৃষ্টি করে চলেছি, সেই হাজারো প্রানের মুখরিত কলেরবে মুখরিত সাহিত্য
প্রাঙ্গণ। সে প্রান সবার মাঝে গুণকীর্তন গেয়ে চলছে তার সৃষ্টিকর্তার। বহন করে
চলেছে যুগ যুগ ধরে অনাদিকাল পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার সত্ত্বা সাধারন মানুষের মাঝে।
খোলা জানালা দিয়ে একচিলতে জ্যোৎস্না প্রবেশ করছে ভিতরে। সেই আলোকচ্ছটা
বিন্যস্ত হয়ে পড়েছে সরাসরি স্ত্রীর মুখে। ঠিক যেন শুন্য থেকে নেমে আসা কোন অল্পসী
তার রুপের আলোয় মাতিয়ে তুলেছে নিঃশব্দের অন্ধকার রাত্রি।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত যেন অতিবাহিত সে অল্পসীর রুপের নেশায়- বিহব্বল দৃষ্টিতে
আমার। হৃদয়ের কষ্টের নীল প্রবাহ বেড়িয়ে এল দীর্ঘশ্বাস হয়ে – এক সময়।
আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা আমার স্ত্রী যখন বিলাসিতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে
শুন্য হস্তে আমারই ভগ্নদুয়ারে এসে দাঁড়ালো শুধুমাত্র আমারি জন্য, সেদিনও- কষ্টের
দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়েছিল বুক চিড়ে- আজকের মত এভাবেই।
স্থির, আত্ম প্রত্যয়ের কণ্ঠস্বরের ঢেউ নাড়া দিয়ে উঠল আমার সমস্ত সত্ত্বায়।
আমাদের স্বপ্নগুলিকে পরিনত করতে হবে বাস্তবতার ভীতে।
সে দিন খুব একটা দূরে নয়।
লাল চামড়ার মলাটে আবদ্ধ পাণ্ডুলিপির বইটা চেপে ধরলাম বুকের উপর। আর মাত্র
কয়েকটা দিন, তার পরেই শেষ হবে অসমাপ্ত অংশটুকু। তারপর চলে যাবে প্রেসে, সেখান থেকে
লাল প্রচ্ছদের বই হয়ে বেড়িয়ে আসবে সাহিত্যকর্ম ‘The Argus’, জায়গা করে নিবে শত শত পাঠকের অন্তরে। আমার অবদানেই বেঁচে থাকবে সেই হারিয়ে
যাওয়া মানুষটি- তার অসমাপ্ত সাহিত্যকর্মটি। তার প্রতিদানের কিছুটা অবশ্যই আমার
প্রাপ্য।
বিখ্যাত হবার স্বপ্ন আমার অনেক দিনের।
(রচনাকালঃ ১৯৯৯)
স্যার দারুন লিখেছেন। চালিয়ে যান।আশা করি সামনে আরো নতুন নতুন কিছু জানতে পারবো আপনার কাছ থেকে। শুভকামনা অবিরাম।
ReplyDelete