নবারুণ কাহিনী
নদী পাড়ে, ভেজা উন্মুক্ত বালি মাটির ‘পরে
একটুকরো প্লাস্টিকের কাগজের উপর গামছা পেতে বসে আছে নবারুণ- অন্যদিনের মত একই
জায়গায়। মাছ ধরার জন্য জুতসই জায়গাও বটে। শীতে নদীবক্ষের প্রায় সব জায়গা যখন
শুকিয়ে যায়, নদীর সব জলচর প্রাণী আশ্রয় নেয় সে গভীরতম অঞ্চলে, যেখানে পানি কখনও
শুকায় না- স্থানীয় ভাষায় যাকে ‘দহ’ বলে। সে রকম একটি জায়গায় বড়শিতে মৎস্য শিকার ব্যস্ত
নবারুণ।
তার ধৈর্যের কমতি নেই- সেই সকাল থেকে ঠায় বসে
আছে। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল, যদিও একটি মাছও বড়শিতে আটকাতে পারেনি সে। ঘণ্টা-খানিক
পূর্বে সুতোতে ‘টান’ পড়েছিল দু তিন বার, কিন্তু এখন একদম শান্ত।
নদী পাড়ে শান্ত প্রকৃতি। পড়ন্ত বেলার সূর্যের
আলোয় ঝিলমিল করেছে নদীর স্বচ্ছ পানি। তাদের সীমানা পেড়িয়ে- যেখানে ভাঙ্গা গড়ার
মাঝে ঠিক দাড়িয়ে দু চারটি বাড়িঘর, উঁচু তালগাছ... বাঁশ ঝোপ... আরও দূরে- যেখানে
অকৃত্রিম ধরিত্রী আর বিশাল নীলাকাশ একই রেখায় প্রনয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে; তাদের
স্বর্গীয় উপাখ্যান এপাড়ের পাখিগুলোর ডানায়- কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে মিলিয়ে যায় সেই
দিগন্তের মাঝে; তখন নিজেকে, নিজের আবর্তনকে একটা সময়ের জন্য হলেও ভুলে হারিয়ে
যাওয়ার ইচ্ছা জাগে বিশ্ব ধরিত্রীর এ প্রনয়লীলার মাঝে। নবারুণের মনের ভাষাও ঠিক একই
রকম। মাছ পেল না তাতে কি? সময়টুকু তো সে উপভোগ করতে পারে সম্পূর্ণ নিজের সাথে।
নিদেনপক্ষে ভুলে তো থাকা যায় সমাজ- সংসারের ক্লান্তিকর জীবন যাত্রা।
পুরনো ইঞ্জিনের ভট ভট শব্দে নবারুণের চৈতন্য
হল। শব্দটি তার পরিচিত এবং পরিচিত বলেই ফিরে চাইবার ইচ্ছাটাকে দমন করতে পারলো না।
নিজের অজান্তেই একচিলতে হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে।
শুকনো বালিমাটির ছোট বড় টিলার ফাঁকে গজিয়ে
উঠা দু চারটি লতা ঝোপের পাড় মাড়িয়ে সর্পিল রেখা তুলে মোটর সাইকেলটি এসে থামল
নবারুণের পাশে।
‘নবারুণ! আছো ক্যামন ?’
‘জে বাই(ভাই), বালা’।
‘তা মারছনি দুই-চাইরড্যা?’
‘না বাই’- হতাশ চোখে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে
বলল নবারুণ।
‘আইছ কহন?’
‘হেই সকালে’।
‘সকালে!’- ভদ্রলোকের একরাশ বিস্ময়।
বিস্ময়টুকু কাটতে না কাটতেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়লো মাছ মারার সরঞ্জামাদি নিয়ে।
নবারুণের হাত পাঁচেক দূরেই সে তার আসন পেতেছে। আসন বলতে মোটা এক খানা প্লাস্টিকের
কাপড় বিছিয়ে তার উপর নিজ সমেত মৎস্য শিকারের সরঞ্জামাদি নিয়ে বসে একাগ্রচিত্তে
মনোনিবেশ করা। ভদ্রলোক রেক্সিনের মোটা ব্যাগ থেকে একে একে হুইল বড়শির ছিপ,
চার(পানিতে দেয়া হয়- মাছকে আকর্ষণ করার জন্য), পাউরুটি, পিঁপড়ের ডিম, নেট ইত্যাদি
যেখানে যেমনটি প্রয়োজন সাজিয়ে নিলেন এবং সকল প্রস্তুতি পর্ব শেষ করে টোপ সমেত
বড়শিগুলো ছুড়ে মারলেন মাঝ নদীতে। এবার অপেক্ষার পালা।
নবারুণ এদিকেই তাকিয়ে ছিল। অন্যদিনের মত আজও
ভদ্রলোকের সব প্রস্তুতি নিঃশব্দে দেখে নিলো। তার বেশ লাগে। চারের
প্যাকেট যখন খুলেন তিনি, সুন্দর একটা গন্ধ এসে
নাকে লাগে নবারুণের। এ গন্ধেই আকৃষ্ট হয় মাছ। তারপর রয়েছে পাউরুটি এবং পিঁপড়ের ডিম
মিশিয়ে বড়শির টোপ তৈরি। অনেক সময় এর সাথে অন্যান্য উপাদানও মেশানো হয়, তবে বেশ
দামি।
নবারুণের এত ফুসরৎ নেই। বড়শির জন্য তার
কেঁচোই যথেষ্ট। সেই সাথে ছিপ বড়শি সূতা সবই তার সাদামাটা। ভদ্রলোকের মত দামি
ফাইবার (বড়শির ছিপ) তার নেই। তবে নবারুণ খুশি- মাছ
তো আর জানে না কোনটি ফাইবার, কোনটি সাধারণ। তবে নবারুণের স্বীকার করতেই হবে, দামি
ফাইবার(তার ভাষায়) দিয়ে মাছ শিকার মজাই আলাদা।
ভদ্রলোক এই মাত্র শেষ বড়শিটি তুলে আবার মাঝ
নদীতে নিক্ষেপ করলেন। তিনটি বড়শি তার। নবারুণের মতই বড়শিগুলোর মাঝখানে পনের ডিগ্রি
কোন রেখে পানিতে ফেলা হয়েছে। সূতার দূরত্বানুপাতিক হার এবং কোন- দুটো মিলে
বড়শিগুলো যেন অতন্দ্র প্রহরী জলসীমার তলদেশে। লোভী মাছ এ সীমানায় প্রবেশ মাত্রই
খাবারের গন্ধে সবকিছু ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়বে টোপের উপর। আহা বেচার মাছ! যদি জানত- লোভে
পাপ, পাপে মৃত্যু!!
‘বুঝলা নবারুণ’- ভদ্রলোক হতাশাময় অভিব্যক্তি
নিয়ে নবারুণকে বলল, একটা দীর্ঘশ্বাসের বিরতি দিয়ে- ‘ব্যবসা-বাণিজ্য সব ফালাইয়্যা
দশ মাইল লক্কড়-ঝক্কর রাস্তা মাড়াইয়া এখানে আসি একটা বড় মাছ মারমু বইলা, মাগার বড়
মাছতো দূরের কথা, এক সপ্তা ধইরা আইতাছি আর জাইতাছি, একটা
পুডিও মারা হারলাম না’।
নবারুণ গোঁফের ফাঁকে কিঞ্চিৎ হাসে। ‘আলি বাই,
এইডারেই তো কয় মাছ মারা। তয় ঐই ডিম পাউরুটি দিয়া ফালাইলে কাম অইব না। কেইচ্যা দিয়া
ফালান লাগবো, নয় পচা পুঁটি’।
‘কেইচ্যা ? না মিয়া। তোমারে যে পচা পুঁটি
আনবার কইছিলাম, আনছনি?’
‘হ বাই’- ছোট
পলিব্যাগে আনা পুঁটি মাছ নিয়ে নবারুণ চলে এলো ভদ্রলোকের পাশে। ভদ্রলোক হুইল বড়শির রিলে সুতা গুছিয়ে বড়শি তুলে আনল পানির উপরে। নবারুণ
দক্ষ হাতে ছোট ছুরির সাহায্যে মাছের আঁশ, লেজের অংশ, কাঁটা ইত্যাদি আলাদা করে
পিণ্ডটুকু গেঁথে দিল বড়শির মধ্যে- যদিও পচা পুঁটি মাছের দুর্গন্ধে তার বমির উদ্রেক
হচ্ছিল।
‘খালি যদি একটা বোয়াল ধরতে পারি নবা মিয়া’-
ভদ্রলোক একরাশ আশাবাদীতা নিয়ে বড়শি নিক্ষেপ করলো নদীতে।
নবারুণ ইতিমধ্যে চলে এসেছে তার নিজের জায়গায়।
বড়শিগুলোর সূতা সেই একই- স্থির, শান্ত। সেদিকে চেয়ে রইল নবারুণ।
‘আলী বাই, কাশিলের দহ থাইকা কাইল একজনে বোয়াল
মারছে। শুনছি, বোয়ালডা নাকি তিন
হাতের বেশী লম্বা আছিল’- নবারুণ বলল।
‘কও কি মিয়া। তাইলে-তো যাওয়া লাগে কাশিলের
দহে’।
‘চলেন, কাইলই (আগামীকাল) যাই’।
‘অবশ্যই। হালার মাছ আছে কনে ! ওনেই যামু। আরে
মিয়া, মাছ মারমু বইল্যা পাঁচ-ছয় হাজার টাকা খরচ কইরা আরও দামী দুইটা ফাইবার কিনলাম।
আমার টাকাডাই গচ্চা। তারপর ধর প্রতিদিন বউরে বইল্যা আসি- বউ মসল্লা রেডি কইরা
রাইখ্য। আইজ মারতে না পারলে ইজ্জত পাংচার ! চিন্তা করছি, বাজার থিক্যা বড় একটা
বোয়াল নিয়া যামু’।
নবারুণ দাঁত বের করে হাসে। ভদ্রলোকের কোথায়
বেশ মজা পায়। দিলখোলা মানুষ। নবারুণের সাথে তার পরিচয় সপ্তাহ খানিকের বেশি হবে না। এরই মাঝে নবারুণের চলতি কথোপকথন ভাষও সে আয়ত্ত করে ফেলেছে অবলীলায়। আঞ্চলিক
ভাষার মধ্য একটা মাধুর্য আছে এবং তা যখন ‘আলী ভাইয়ের’ মত শহরে লোকদের বেলায়- তখন শুনতে বেশ লাগে।
পরনের চাদর ভালমতো পেঁচিয়ে নিলো নবারুণ- বেশ
শীত শীত করছে। সূর্যালোকের প্রখরতায় এতক্ষণ অবশ্য অতটা টের পাওয়া যায়নি। সূর্য যতই
পশ্চিমাকাশের প্রান্তসীমায়- শীত ততটাই ধরণীতলে। তারপর কমলা আলোর শেষ আভা মুছে গিয়ে
রাত্রি নামবে এবং যতই গভীর হবে, ভূ-ভাগকে ততই জাপটে ধরবে শীত তার কনকনে চাদর দিয়ে।
আহা ! সকালে বউ বলেছিল ভাপা পিঠার কথা। সাত
সকালের ঘটনাটুকু মনে পড়ে গেল নবারুণের। তার আট বছরের ছেলে মায়ের
কাছে বায়না জুড়েছিল পিঠে তৈরির। ঘরে চাল-ঢেঁকি
সবই আছে- নবারুণের বউ তাকে তাই বলেছিল চাল পিষে দেওয়ার। ঢেঁকিতে ছন্দ তুলে যাবে
নবারুণ, আর বউ সতর্ক হাতে উলট-পালট করে দিবে ভেজা চাউল। তারপর ছাঁকনিতে ছেঁকে
নিলেই হবে পিঠার গুড়ো। বউ চালও ভিজিয়েছিল...
‘হালার মাছ!’- নবারুণের মাঝের বড়শির ছিপ
সংলগ্ন সূতা টানটান হয়ে এক ধাক্কায় আরও হাত খানিক মাছ টান দিয়ে নিয়ে গেল এবং
নবারুণের চৈতন্য হল; তড়িৎ বেগে বড়শির ছিপ সে তুলে ফেললো অর্থাৎ খোট্টা দিল- মাছ
ততক্ষণে পগারপার। তারপরেই নবারুণের স্বীকারোক্তি সহ বিরক্তি।
‘কি নবামিয়া, আটকাইতে পারলা না! তোমার কপাল
!’- প্রতিত্তুরে মিষ্টি হাসি উপহার দিল নবারুণ ‘আলী ভাই’ কে।
হু, কপালই। কি দরকার ছিল সারাদিন বড়শি নিয়ে
বসে থাকার। এরচেয়ে যদি বৌয়ের কথা শুনত। আহারে, সন্ধ্যায় কুপির আলোয় তপ্ত চুলার
পাশে পোলাপান নিয়ে বসে গরম গরম ভাপা পিঠা...।
ভাপা পিঠার মিষ্টি সৌরভের কল্পনায় নিজের
অজান্তেই জিভে পানি এসে গেল নবারুণের। ঠোঁট দুটো চেটে নিলো দু-তিন বার।
পোলাপানগুলো কি খুশিই না হত...।
পঁয়ত্রিশ কি ছত্রিশ পেরুবোর আগেই পাঁচ
সন্তানের বাপ বনে গেছে নবারুণ। সেই সাথে মধ্য বয়স পার হবার পূর্বেই বুড়োটে বনে গেছে সে। চেহারার মাঝে আগের সে সাবললিতা আর নেই। আগে নিয়মিত হাডুডু খেলত।
তখন তার শরীর কিংবা মুভমেন্ট ছিল দেখার মত। অন্য গ্রামের টীম তাকে ‘হায়ারে’ নিয়ে
যেত। সেই ‘হায়ারে’ গিয়েই পরিচয় ঘটে তকলিমা বিবির সাথে। তকলিমা নবারুণের বউ। তারপর
বিয়ের দশ বছরের মধ্যেই তকলিমা বিবি স্ব উৎসাহে পাঁচ পাঁচটি সন্তানের জন্ম দেয়।
নবারুণের ধারণাও ছিল একই রকম- বেশি সন্তান বেশি বল। কিন্তু সে বল অর্জনের
ধাক্কাটাও নবারুণকে সইতে হচ্ছে নিদারুনভাবে।
টানাটানির সংসার সেই বাপ দাদার আমল থেকেই।
তবে তখন টানাটানির প্রাদুর্ভাব থাকলেও অন্ন সংস্থানের কোন সমস্যা ছিল না। যেটুকু
চাষাবাদের জমি-জমা তাদের ছিল, তাতে তিন বেলা পেট পুরে খেয়ে ভালই পার করা যেত দিন।
কিন্তু এ টুকুই- এর বেশি জৌলুসতা প্রকাশ কোনদিনই সম্ভব হয় নি। বাপ দাদার ছনের ঘর
এখন টিনের চাল-পাট খড়ির বেড়া- ব্যস এ পর্যন্তই। তারপরেও মহা হ্যাঙ্গামা। বর্ষাকালে
জীর্ণ টিনের ছিদ্র চুইয়ে পানি পড়ে সাধের কুটিরে। বছর বছর পাল্টাতে হয় খড়ির বেড়া...।
‘নবা মিয়া, তোমাগো এলাকায় এ সিজনে পুকুরে
টিকেট ছাড়ব না?’
‘হুরমুজ মিয়ার পুকুরে তো ছাড়নের কথা। কিন্তু
ঐই পুকুরে মাছের সাইজ বালা না। তয় ওমর আলির বড় পুকুরে ছাড়ব বইলা শুনতাছি’। আফনেরে
জানাইবনি আলী বাই’।
‘নদীতে মাছ না মারতে পারলেও নবা মিয়া, পুকুরে
কিংবা লেকে মাছ ধরনের উস্তাদ আমি। তুমিতো জানই, আমাগো শহরে সৌখিন মৎস্য শিকার
সমিতির একজন সদস্য আমি। খালি সদস্য না, একটা পদও আছে আমার মিয়া। গত বছর আমাগো
সমিতি থিকা টিকেট ছাড়ছিল পৌরসভার লেকে। আমি যে সাইজের চিতল মারছিলাম- মাগার
রেকর্ড! আমাগো ক্লাব অফিসে গ্যালে মাছের সাথে আমার ফটোডাও দেখতে পাইবা। আহারে, যদি
সেই রকম একটা মাছ মারতে পারতাম নদী থিক্যা। সামনে আমাগো মৎস্য সমিতির নির্বাচন।
বুঝলা নবা, যদি সত্য সত্যই বড় একটা বোয়াল ধরতে পারি তয় সভাপতি পদটাও আমার হইয়্যা
যাইব। আমার মার্কা হইব বোয়াল মার্কা! আরে আমারে ভোট দিবার না চাইলে কি হইব, ঐই
বোয়াল দেইখ্যাই সকলে ভোট দিব! কি
কও?’
‘হ মিয়া বাই’- নবারুণও চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা
নাড়ে।
‘পানির মাছ তো তাই কওয়া যায় না, কার কপালে
কখন লাইগা পরে। দ্যাহোনা, এক সপ্তা ধইরা খালি আইতাছি আর জাইতাছি- কিন্তু ধৈর্য
হারা হইনাই। মাছ একটা মাইরাই ছাড়মু নবা...’। ভদ্রলোক কথা এ পর্যন্তই থামিয়ে দিলেন,
কেননা তার মাঝের বড়শির সূতাতে থেকে থেকে একটু একটু টান পড়ছে আবার ঢিল হয়ে যাচ্ছে।
সুতার সাথে কোন ফাৎনাও দেননি নবামিয়ার পরামর্শে। এখন আফসোস হচ্ছে। ফাৎনা থাকলে মাছ
মারতে সুবিধা। মাছ যে মাত্র টোপ গলাধঃকরণ করে ছুটে পালাবে, ফাৎনা যাবে ডুবে। এখন
সূতাতে টানের উপর নির্ভর করে মাছ আটকাতে হবে অর্থাৎ খোট্টা দিতে হবে।
খোট্টা তিনি দিলেনই, যখন রিল থেকে আরও হাত
খানেক সূতা একটানে চলে গেল পানিতে।
‘পাইছি নবা!’- ভদ্রলোক উত্তেজনায় বড়শির ছিপ
নিয়ে দাড়িয়ে গেলেন এবং একই সাথে পিছিয়ে গেলেন দু তিন হাত। হুইলে সূতা চালান করে
দিচ্ছেন দ্রুত। কিছু একটা যে বড়শিতে আটকেছে এ সত্য, কারণ ধাতুর তৈরি ছিপের মাথা
অনেকটা বেঁকে গেছে পানির সমান্তরালে।
নবারুণও উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু
শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ময়লা পানি ভর্তি পলিব্যাগ আটকে আছে বড়শিতে। দু জনেই প্রচণ্ড
হতাশ।
‘শেষ পর্যন্ত এই আছিল কপালে! নবামিয়া কিছু
কও’।
নবারুণের কিইবা বলার আছে। ‘হায়রে কপাল
মন্দ... চোখ থাকিতে অন্ধ... এত সুন্দর আধার দেইখ্যাও মাছ তো খাইল না...’ তার আট
বছরের ছেলের মুখে শুনা গানটি মনে মনে গাইছে নবারুণ। অবশ্য আলী ভাইয়ের ট্রাজেডিটুকু
সে উপভোগ করেছে গান থামিয়ে। ‘আহা, আন্ধারে একটা কুপি ধপ কইরা জইলা আবার ধপ কইরা
নিভ্যা গ্যালো!’
নদীতে বড়শি ফেলার পর অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।
বড়শিগুলো তুলে দেখা দরকার ঠিকঠাক মত আছে কিনা টোপ। একে একে তিনটি বড়শি তুলে পুরনো
কেঁচোর টোপ ফেলে দিয়ে নতুন কেঁচো গেঁথে আবার নদীতে ফেলল নবারুণ। বড়শিতে মৎস্য
শিকারের ক্ষেত্রে রুটিন মাফিক কাজ।
আবারও প্রতীক্ষা। একই আশায় ভদ্রলোকও বসে আছেন
চুপচাপ। তবে পারিপার্শ্বিকতা কিন্তু নিশ্চুপ নয়। সেখানে দিনের আলোটুকু বিদায় নেয়ার
প্রস্তুতি চলছে। ছন্নছাড়া পাখিগুলোর বুকেও সময় ঘণ্টা বেজে উঠেছে ছোট্ট সুন্দর
নীড়ে ফেরার। এপাড়ের মানুষগুলি চলছে লাঙ্গল কাঁধে, পরিশ্রান্ত পশুগুলোর সাথে ভাবনার
তাল মিলিয়ে।
‘নবা মিয়া, আছো কতক্ষণ?’- ভদ্রলোক প্রশ্নবোধক
দৃষ্টিতে চাইলেন নবারুণ পানে।
‘যে তক সূতা দেখা যায় বাই’- নবারুণ বলল।
‘আমিও’- ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।
তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, ‘নবা মিয়া, একটা কথা কি জান’- নবারুণের মুখের দিকে
চাইলেন একবার, ‘দুনিয়াতে যত প্রকার শৌখিন নেশা আছে তার মধ্য পয়লা নম্বরই এই মাছ
মারা। আমারে দ্যাখ মিয়া, বয়স ত কম হয়নাই- দুই পোলার বাপ । তারপরেও বরশি নিয়া
আহি(আসি) অথচ মারতে পারি না একটাও। প্রতিদিনই মনটা আনচান করে, আজ মারমুই মারমু-
বরশি লইয়া আইয়া পরি। শেষতক হেই ফক্কা। আর কতদিন যে ফক্কা খামু ...।‘
নবারুণ হাসছে। তার হাসিটা হো হো পর্যায়ের না
হলেও কাছাকাছি হবে। ভদ্রলোকও হেসে দিলেন। বড়শিতে তার শিকে ছিঁড়বেনা ভেবে বিদায়ের
কথা ভাবছেন মনে মনে। সেই একই পুনরাবৃত্তি। তবে আজ সরাসরি বাসায় ফিরবেন না।
সন্ধ্যাবেলায় মেজাজ খারাপ করে, রাতে বন্ধুদের আড্ডায় বোকা সাজবার প্রয়োজন নেই। তার
সাত বছরের বাঁদর ছেলেটা বলে কিনা ‘একবার না পাড়িলে দ্যাখ শতবার!’ সেদিন বদটাকে চর
মেরেছিলেন। ছেলের কান্না সুনে খুন্তি হাতে ছেলের মা দৌরে এসেছিল রান্নাঘর হতে।
ভড়কে জান তিনি- শহরে মেয়ে বলে কথা! সদর দরজা খোলাই ছিল ...। তারচে বন্ধুদের
আড্ডাটাই বেশ। বেশ জমে উঠে তাদের পৌর জেলা সদর শৌখিন
মৎস্য শিকার সমিতির অফিসে। সভাপতি তার ছেলেবেলার বন্ধু। আরও অনেককে মিলবে এখানে
জাদের সাথে বাইরে সচারচার দেখা-সাক্ষাত হয়না। সেখানে প্রাত্যহিক জীবনের নানা বিষয়
সহ আলাপ আলোচনা চলে ক্লাব কিংবা মাছ শিকার সম্বন্ধে- কে কবে কোথায় কতবড় কাল বাউস
কতল করেছিল...। মাঝে মাঝে এমন সব কাহিনী উঠে আসে গল্পের তোড়ে, রীতিমত ভয় ধরে জায়
এই মধ্যবয়সে। নাহ, তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।
ভদ্রলোক
শেষ বারের মত সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করলেন। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন-
সিগারেট শেষ করেই বরশি গুঁটিয়ে উঠে পড়বেন। হাহ, হতাশ কপাল।
নবারুণও হতাশ। তাদের- যেখানে, সৌখিনতার
বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই; দু বেলা দু মুঠো অন্ন সংস্থানের জন্য দিনপাত করতে হয় নিদারুণ
ভাবে, সেখানে সারাদিন বরশি নিয়ে কাঙ্গালের মত বসে থাকা একটু বাড়াবাড়িই। কিন্তু কি
আর করা, মানে না একই ছকে বাঁধা প্রতিনিয়ত চলা। সেই একঘেয়েমি
জীবন সংসার। আহা, জীবনটা একলা হলে কত সুন্দর হত। একটা ভাবনার
তালে প্রায়শই হারিয়ে যায় নবারুণ। বেদেদের জীবন যাত্রা খুব কাছ থেক সে দেখেছে। নদী
মাতৃকাকে কেন্দ্র করে তাদের ছুটে চলা। যদি বেদেদের মত তার একটা নৌকা থাকত, না থাকত
সংসারের ঝামেলা পূর্ণ দায়িত্ব- তবে নৌকা নিয়ে একলা আজ এখানে, কাল সেখানে... জীবনটা
কত সুন্দর ভাবে উপভোগ করতে পারত সে। সারাদিন নৌকায় বসে মাছ ধরত, নিজেই কেটে কুটে
ধুয়ে মাছ রান্না করত নৌকার মধ্য। সন্ধ্যায় পাখিরা যখন ডানার ঐকতান তুলে হারিয়ে যেত
দূর দূর দিগন্তের মাঝে... জ্যোৎস্না রাতে জোনাকির দল যখন হাট বসাত নদী পাড়ের
কাশবন, হেলেঞ্চা কিংবা কমলি লতার ঝোপের মধ্য- সে নিজেও একাত্ম হয়ে যেত তাদের সাথে,
নিশাচর রাত্রির সাথে। কখনও নৌকার ছইয়ের উপর বসে আপন হাতে তুলে নিত রুদ্র বাঁশের
বাঁশি। দু ঠোঁটের ফাকে তুলে যেত অবিরাম সুর-বন্যা। জ্যোৎস্না রাতের রুপালি ডানায়
ভর করে সে সুর পৌঁছে যেত তেপান্তরের মাঠ পেড়িয়ে ঐই অন্ধকার গ্রাম গুলোতে- সেখানে
মানুষ জনের মনে আবেগের ঝড় তুলে হারিয়ে যেত দূর অজানায়... ।
হঠাৎ নবারুণের দৃষ্টি নিবদ্ধ হল নদীর কালো
পানিতে। তার প্রথম বড়শির সুতো একটু একটু কাঁপছে এবং সেই সাথে লক্ষ্য করল শান্ত
জলরাশিতে মৃদু কম্পন। পানির নিচ থেকে বাতাসের ভুস ভুস উপরে উঠার ফলে সৃষ্ট ঢেউ নবারুণের
পূর্ণ মনোযোগ কেড়ে নিলো সেখানে। অর্থাৎ বড়শির জলসীমায় বড় কোন মাছ এসে পড়ছে। এদিকে
ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যার অন্ধকারও। দেখা যাক, এই শেষ সময়ে তার কপালে মাছ জোটে কিনা।
প্রথম সে বড়শির সুতা টানটান হয়ে আছে। যে কোন
মুহূর্তে রিলের সুতা মাছ এক ঝটকায় টান দিয়ে নিয়ে যেতে তিন-চার হাত। উত্তেজনায় টান
টান হয়ে আছে নবারুণ। দু হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে সে বড়শির ছিপ। ভদ্রলোকও নবারুণের উত্তেজনাময় অভিব্যক্তিতে বুঝে ফেলেছেন, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে।
দুই... চার... দশ... বিশ সেকেন্ড
বাঁশের রিলে গোছানো সুতার তিন-চার হাত তীর
বেগে বড়শির ছিপের আঙটাগুলোর ছিদ্র গলে চলে গেল পানিতে। নবারুণও প্রস্তুত ছিল-
সজোরে বড়শির ছিপ তুলে আনল ভূমির সমান্তরাল থেকে অর্থাৎ খোট্টা দিল প্রচণ্ড গতিতে।
বড়শির চিকন ছিপ বেঁকে অর্ধ বৃত্ত রচনা করে কাঁপছে তীর তীর করে। সুতা এতটাই টানটান
হয়ে আছে যেন ছিঁড়ে যাবে যেকোনো মুহূর্তে।
‘আলী বাই, মাছ আটকাইছি’- চিৎকার করে বলল
নবারুণ। ‘আলী বাই’ দ্রুত চলে এলো নবারুণের পাশে ।
বেশ বড় আকারের মাছই হবে। বড়শির শক্ত নাইলনের
সুতা এবং পানির আচরণে দু জনেই বুঝে ফেলেছে। গায়ের জোরে এ মাছ পানির উপরে তোলা
সম্ভব না। তুলতে হবে কৌশলে।
সে কৌশলই অবলম্বন করল নবারুণ।
মাছ বরশি নিয়ে এলোপাথাড়ি দৌড় দেয়- সুতোতে টান
পরে, নবারুণ ছিপ-সুতা ধরা হাতের পেশী ঢিল করে দেয়, একতানে সুতা চলে যায় দশ-পনের
হাত। আবার সুতাতে ঢিল পড়ে, নবারুণ ঢিল পড়া সুতা টুকু টেনে উপরে তোলে। এভাবে চলল
কিছুক্ষণ। কিন্তু সমস্যা হল- মাছের টানে সুতো পানিতে চলে যাচ্ছে দশ-পনের হাত, আবার
ঢিল পরলে এর বিপরীতে সুতা তুলতে পারছে বড়জোর পাঁচ-ছয় হাত। তাই একসময় রিলের সুতা
শেষ হয়ে এলো অথচ মাছের শক্তিমত্তা বিন্দুমাত্র কমেনি।
কি করা যায় ? ‘আলী ভাই’ পরামর্শ দিল নবারুণ
কে। দুটো ছিপ একসাথে বেধে দ্বিতীয় বড়শির সুতা হাতে রেখে ছিপ দুটোকে পানিতে ফেলতে।
রিল দুটো তো আটকেই আছে ছিপের মজবুত আঙটাগুলোর সাথে। ‘খারাও মিয়া’- বলে সে নিজেই
নেমে পড়ল কাজে।
ছিপ দুটো একটি হয়ে পাঁচ-সাত হাত দূরে পানিতে
ভাসছে আবার ডুবে যাচ্ছে- যেন বড় একটি ফাৎনা। এবং ফাৎনাটি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে।
অসুবিধা নেই, রিল তো নবারুণের হাতে। এ রিলে অন্তত একশ হাত সুতা আছে। এরই মাঝে আশা
করা যায় মাছ ক্লান্ত হয়ে পড়বে।
কিন্তু না। শেষ পর্যন্ত নবারুণের তৃতীয়
ছিপ-সুতার রিল ব্যবহার করতে হল। এ রিলেও ধারনা করা যায় একই পরিমাণে সুতা আছে। সব
মিলিয়ে শ তিনেক হাত সুতা হবে । এভাবেই চলল আধাঘণ্টা কি তারও বেশি। অবশেষে মাছের
টানাটানি কমে এলো অর্থাৎ বেচারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
ইতিমধ্যে রাত্রি নেমে এসেছে। নক্ষত্রের আলো
সামান্য, চাঁদ এখনও উঠে নি- তাই চারপাশে শুধুই অন্ধকার। আন্দাজের উপর সুতা গুছিয়ে
চলছে নবারুণ। তিনতে ছিপই এখন উপরে। পানিতে সুতা আছে বড়জোর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হাত।
ভদ্রলোক উঠে গিয়ে মোটর সাইকেলের হেডলাইট জ্বেলে দিলেন। ইঞ্জিনের গম্ভীর শব্দের
সাথে লাইটের আলো সরাসরি গিয়ে পড়ল সুতা সংলগ্ন পানিতে।
তীরের কাছাকাছি চলে এসেছে মাছ। পানিতে
দাপাদাপি করছে- পানির চ্ছটা এসে পড়ছে নবারুণের চোখে মুখে। গামছা দিয়ে মুখ
মুছে নিলো সে। ‘আলী ভাইয়ের’ হাতে সুতা ধরিয়ে দিয়ে
নবারুণ নেমে পড়ল বরফ শীতল পানিতে। খুবই সন্তর্পণে মাছের মাথার নিচের পিচ্ছিল অংশ
সর্বশক্তিতে দু হাতে চেপে ধরল সে। পানিতে, মাছের লেজের প্রচণ্ড ঝাপটায় অর্ধেক ভিজে
গেল নবারুণ। সেদিকে তার খেয়ালই নেই। অবশেষে মাছ তুলে আনল তীরে।
বিশাল সাইজের বোয়াল মাছ। অন্তত পক্ষে দশ-বার
কেজি হবে কিংবা তারও বেশি হতে পারে। নদীতে, বড়শিতে এত বড় মাছ শিকার নবারুণের জীবনে
এই প্রথম। খুবই উৎফুল্ল সে। সেই সাথে বেশ ক্লান্ত।
ভেজা পরিধেয় কাপড় নিয়েই সে বসে পড়ল বালির
উপর। ভদ্রলোকও বসে পড়ল নবারুণের পাশে। সেও ক্লান্ত সমান উত্তেজনায়। প্যাকেট থেকে
সিগারেট বের করে ধরাল সে। নবারুণকেও দিল সিগারেট। অগ্নি সংযোগ করে এক মুখ ধোঁয়া
ছাড়ল নবারুণ।
ভদ্রলোক সিগারেট টানছে একমনে। সামনে রাখা বিশাল মাছটি থেকে থেক
লম্ফ-ঝম্ফ দিচ্ছে। সেদিকে চেয়ে মনে মনে ভাবল, ইস, মাছটি যদি তার বড়শিতে আটকাত। মনে
মনে কল্পনা করছে... মাছটি নিয়ে সোজা চলে যেত মৎস্য শিকার সমিতির অফিসে- তাদের
সন্ধ্যা আড্ডা স্থলে। সবাইকে সে কতটা অবাক করে দিতে পারত! সেখানে ছোটখাটো একটা ভীর জমে যেত। সবাই তাকে বাহবা দিত- প্রশংসায় পঞ্চমুখ
হয়ে যেত তার। দু একজনের চোখে চোখ রেখে
কুটিল অবজ্ঞা সূচক হাসি দিতেও দিদ্ধাবোধ করত না সে। এই ফাঁকে মজনু ক্যামেরা নিয়ে
ছুটে আসতো তার সাথে মাছের দু একটা ‘শট’ নিবে বলে। সেও পোজ দিত হাসিমুখে। তারপর
বন্ধুরা তার সাফল্যে তাৎক্ষনিক পার্টির আয়োজন করত অফিস রুমে। সেখানে খানার
সাথে একটু ‘পিনা’ও চলত। ‘পিনা’র ঘোর কাটার আগেই সে চলে
আসত বাসায়। বাসায় কাজের ছেলে-মেয়ে নেই, তাই গিন্নি কিংবা ছেলেটা সদর দরজা খুলত।
প্রথম চোটেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত। তারপর... তারপর, সোফায় আরামে বসে একহাত দেখে
নিত গিন্নি কিংবা বাঁদরটার। তাকে যে কম অপদস্থ হতে হয়নি! অবশ্য সকাল বেলায়ই তাদের
মারফত এলাকায় চাউর হয়ে যেত তার মৎস্য শিকারের কাহিনী। সেও রসিয়ে রসিয়ে বলত তার মাছ
মারার কেচ্ছা...।
হায়রে কপাল !
চকিতে একটা চিন্তা ভদ্রলোকের মনে উদয় হল।
আচ্ছা, নবারুণের কাছে থেকে মাছটা কিনে নিলে কেমন হয় ? নবারুণ গরিব মানুষ, মাছের
চেয়ে টাকার প্রয়োজনটাই তার বেশি। সেও অনেকগুলো টাকা পাবে একসাথে। নবারুণকে জিজ্ঞাসা করে দেখা
যাক।
নবারুণ সিগারেট টানছে এবং শিতের রাতে ভেজা
কাপড়েও গান গাইছে গুন গুনিয়ে। সেদিকে চেয়ে মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিল ভদ্রলোক।
বললেন,
‘নবামিয়া, মাছডা কি করবা? বাড়ি নিয়া যাবা
নাকি বাজারে?’
‘দেহি বাই, চিন্তা কইরা’।
নবারুণও ভাবছে- ভদ্রলোকের মত। মাছটি মফস্বলের
বাজারে নিয়ে গেলে ভালই দাম পাওয়া যাবে। অন্তত পক্ষে পাঁচ হাজার। এই পরিমাণে টাকা
নবারুণের মত লোকদের কাছে অনেক। সংসারের দিকে আনমনে চাইল সে। পাটখড়ির বেড়া পাল্টানো
দরকার। গোয়ালঘরের চালের টিন জায়গায় জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। বর্ষাকালে চুইয়ে চুয়ে
পানি পড়ে। অবলা জানোয়ার গুলো কষ্ট পায়। ছেলেটাও বায়না ধরেছে সাইকেলের। নতুন সাইকেল
কেনার সাধ্য তার নেই। দু-টিন হাজারে পুরনো সাইকেলের ব্যবস্থা করা যাবে। বেচারাকে
পাক্কা তিন মাইল হেঁটে স্কুলে আসতে হয়। আবার নতুন বছরের বইয়ের কথা বলছে। বৌয়ের ভাল
একটা শাড়ীও নেই। আরও কত শত প্রয়োজনের কথা মনে এলো নবারুণের।
‘হ বাই, মাছডা বেইচ্যাই দিমু’।
‘তাইলে এক কাম কর, মাছটা আমারেই দিয়া দাও’।
একটু থেমে বলল, ‘তোমারে নগদ সাত হাজার টাকা দিমু। বাজারে এর চেয়ে বেশি দাম পাবানা।
কি কউ মিয়া?’
‘ আফনে যেডা কন ভাই’।
‘তবে আমার একটা কথা আছে নবা মিয়া, মাছডা যে
তুমি মারছ এইডা কাউরে কইতে পারবা না। যাও, তোমারে আরও পাঁচশো টাকা বেশি দিমু’।
নবারুণ কোন কথা বলল না। সিগারেটের
অবশিষ্টাংশটুকু পানিতে নিক্ষেপ করে উঠে দাঁড়ালো, তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল ছিপ সুতা
গুছাতে। ভদ্রলোকেরেও যেন মনে পড়ল সে কথা।
‘লও নবা মিয়া, তোমারে বাড়িতে নামাইয়া দেই’। -
ভদ্রলোকের গন্তব্য পথেই নবারুণের বাড়ি এবং আগেও কয়েকবার আরোহী হয়েছে নবারুণ। তাই
অনেকটা অন্যদিনের মত পুনরাবৃত্তি করল ভদ্রলোক।
নবারুণ মাছটি তুলে মোটর সাইকেলের পিছনে
চাপাল। ভদ্রলোক শক্ত করে মাছটি বাঁধলেন।
নদীতীরে আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পথ ধরে চলছে
মোটর সাইকেল নিঃশব্দের পৃথিবীতে যান্ত্রিক গাম্ভীর্য তুলে। ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলো ভূভাগে
আসার পূর্বেই কুয়াশার অস্বচ্ছ সুতো ছড়ানো ধোঁয়াটে আবরণ তাকে জাপটে ধরেছে পরাক্রম
শীলতায়- নদীর এ পাড়ের জনপদ তাই ফ্যাকাসে অন্ধকারে ডুবে আছে। কোথাও বা অতি হিম
অন্ধকার- হয়তবা বাঁশ ঝোপ কিংবা আম কাঁঠালের বাগান। সেখানে, অন্ধকারের পটভূমিতে
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোকের সমাবেশ... জ্বলছে-নিভছে ... শত সহস্র জোনাকির দল।
ডানে বাক নিয়ে মোটর সাইকেল বিবর্ণ পাঁজরের
ইট-খোয়া-পীচ ঢালা পাকা রাস্তায় উঠল। নবারুণের বাড়ি আরও মাইল খানেক সামনে, পাকা
রাস্তা থেকে সামান্য দূরে- উওরে। রাস্তা ভাল হলে মিনিট পাঁচেক সময় লাগার কথা।
নবারুণ মোটর সাইকেলের পিছে বসে আছে চুপচাপ।
বাতাসের ঝাঁপটায়-শীতে অনেকটা জর্জরিত। তার উপর পরনের কাপড়
অর্ধেকটাই ভেজা। ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে। এই বয়সে ঠাণ্ডা লেগে গেলে আর রক্ষা নেই।
বাড়িতে পৌঁছেই চুলোয় লাকড়ি চাপিয়ে শরীর গরম করতে হবে। থাকগে, সেটা পরের কথা। কিন্তু নবারুণের মনে কি যেন খচখচ করছে সেই তখন থেকে। একটি
প্রশ্নই বার বার উদিত হচ্ছে মনের মাঝে- কাজটা কি ঠিক হল ?
মনের এ ঠিক বেঠিকের ভাবনার অতলে রাস্তাটুকুও
যেন ফুরিয়ে গেল এক নিমিষে। হালকা ব্রেক কষার ধাক্কায় নবারুণ বাস্তবে ফিরে এলো। তাকে এখানেই নামতে হবে এবং গ্রাম্য কাচা রাস্তা ধরে পাঁচ মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাবে বাড়ি।
মোটর সাইকেল থেকে নামল নবারুণ। ভদ্রলোকও
নামলেন- নবারুণের মাছের দাম এখনও যে মিটিয়ে দেয়া হয়নি।
‘ঠাণ্ডায় জইমা গেছি মিয়া। খারাও একটা সিগারেট
ধরিয়ে নেই’। পকেট হাতড়ে একটা সিগারেট ধরালেন ভদ্রলোক। নবারুণকেও দিলেন সিগারেট।
নবারুণ সস্তা বিড়িতেই সন্তুষ্ট। তদুপরি
বিদেশী ব্র্যান্ডের দামি সিগারেটের তৃপ্তিকর ধোঁয়া তার মনের মধ্য তৃপ্ততা আনতে
ব্যর্থ হল।
তৃপ্তি টুকু কোথায় ?
সংসারে এই মুহূর্তে নবারুণের টাকার প্রয়োজন
সবচেয়ে বেশি- অতীতে ছিল কিংবা ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু এ টুকুই কি সব হল ? মাছটি
বিক্রি করে নবারুণ অনেকগুলো টাকা পাবে- পাবে দারিদ্রতা থেকে সামান্য সময়ের জন্য
মুক্তি। অন্যদিকে, নিজের জীবনের স্মরণীয় আনন্দের ভাগাভাগি করে নিবে তার
সংসার-পরিজনদের সাথে। তাদের চোখে মুখে যে আনন্দের অনাবিল ধারা বর্ষিত করতে পারবে
নবারুণের বৃহৎ মৎস্য শিকারের গল্পে- সে সুখ কি নবারুণ পারবে এই টাকাগুলো দিয়ে
কিনতে? তৃপ্তিটুকু কি এখানেই?
ভদ্রলোক সিগারেট শেষ করে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।
অতঃপর ব্যস্ত হাতে মানিব্যাগ বের করলেন পকেট হতে। আর বিলম্ব নয়, তাকে তাড়াতাড়ি
গন্তব্যে যেতে হবে।
‘আলী বাই, একটা কথা আছিল’ –নবারুণ কাঁচুমাচু
মুখে বলল। ভদ্রলোক পাঁচশ টাকার ব্যাংক নোটগুলো মাত্র বের করেছেন মানিব্যাগ হতে।
নবারুণের কথায় ভ্রু কুঁচকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চাইলেন নবারুণের প্রতি।
‘আলী বাই, আমি চিন্তা করছি’ – একটু বিরতি
দিয়ে বলল নবারুণ, ‘মাছটা আমি বেচমু না। বাড়িতে নিয়া যামু’।
ভদ্রলোক হা করে নবারুণের মুখপানে তাকিয়ে
রইলেন পাক্কা এক মিনিট। তারপর ম্লান মুখে বললেন, ‘তোমার যা ইচ্ছা নবামিয়া’।
‘তয় ভাইজান, আপনি সাহায্য না করলে মাছটা তীরে
উঠাতে পারতাম না’। একটু থেমে আবার বলল, ‘আমার একটা কথা রাখন লাগব আলিবাই’-
ভদ্রলোকের মুখপানে চাইল নবারুণ। ভদ্রলোক ভ্রু নেড়ে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলেন নবারুণের
কি কথা বলার।
মিনতি ঝরে পড়ল নবারুণের কণ্ঠে, ‘আগামীকাল এই
গরিবের বাড়িতে দাওয়াত নেন’। কিন্তু ভদ্রলোকের ইতস্ততা দেখে আবার বলল নবারুণ, ‘আলী
বাই, আফনেরে রাইখা মাছটা আমি খাইতে পারমু না। কথা দেন আসবেন’।
ভদ্রলোক এবার নরম হয়ে বললেন, ‘যাও নবারুণ,
আগামীকাল তোমার দাওয়াত গ্রহণ করলাম। তোমার বাড়িতে দাওয়াত খাইয়া ফের তোমারে নিয়া
একসাথে নদীতে মাছ মারতে চইল্যা যামু’। একটু থেমে চোখ মুখে কৌতুকময় হাসি ফুটিয়ে
আবার বললেন,
‘বালা কতা, কাইল মাছ মারতে যাইবা তো ?’
নবারুণ শব্দ করে হেসে উঠল।
যান্ত্রিক যান এর ইঞ্জিন চালু করলেন ভদ্রলোক।
নবারুণ মাছটি কাঁধে নিয়ে বিদায় জানাবার জন্য এসে দাঁড়ালো মোটর সাইকেলের পাশে।
‘তাইলে খোদা হাফেজ আলী বাই। কাইল একটু সময়
নিয়া আইসা পড়বেন কিন্তু’।– এবারও মনে করিয়ে দেয়ার জন্য বলল নবারুণ।
‘আরে আমার বন্ধু এত বড় মাছ মারছে আর সে মাছ
খাইতে আমি আসুম না, কি কও নবামিয়া ?’
মোটর সাইকেলের ইঞ্জিনের শব্দ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে
এলো, সেদিকে একটা সময় চেয়ে রইল নবারুণ। ভদ্রলোকের শেষ কথাটুকুর রেশ এখনও কানে
বাজছে তার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নবারুণ।
অন্ধকারে গ্রাম্য কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটছে
নবারুণ। আর মাত্র মিনিট খানেক, তারপরেই পৌঁছে যাবে বাড়ি। পরিবারের সবাই হয়তবা
চিন্তিত কেননা সন্ধ্যার পরে কখনও বাড়ি ফিরেন না তিনি। থাক চিন্তা। যখন বউ-পোলাপান
সবাই দেখব তার সাধের শিকারকে...
আনন্দটুকু ভাগাভাগির কল্পনার সুখে আপনা আপনি
চোখ মুদে এলো নবারুণের। এ আনন্দ তার জীবনে অনেক অনেক বেশি দামি।
(রচনাকাল: ২০০৬)