My Personal Blog ...

ফুলশয্যার দর্শনে! - ১ ( প্রথম অংশ )


বাইরের গেটে করা নাড়ার শব্দ হতেই ছোট্ট ইভা দৌড়ে বারান্দায় চলে এলোরাঙ্গামাটি শহরের নিরিবিলি এক কোনে ওদের একতালা ছিমছাম সুন্দর বাসা- সরকারী কোয়ার্টার। লোকজনের বসতি এখানে অনেক কম- ছোট্ট ইভাদের বাসায় কেউ খুব একটা আসে না, আর এখন দুপুর বেলা। এই সময়ে কে আসতে পারে, অনেক চিন্তা করেও বুঝে উঠতে পারল না ।

নিচু গেটের উপর দিয়ে মাথা উঁকিঝুঁকি দিতে থাকা অগুন্তকের অববয় দেখতে পেল সে এবং খুশিতে লাফাতে লাফাতে চলে এলো গেটের কাছে। ছোট্ট হাত দিয়ে গেট খুলল, তারপর মামা বলে চিৎকার করে তার ঠ্যাং দুটো জড়িয়ে ধরল! ছোট তো, তাই কাউকে জড়িয়ে ধরতে হলে পা দুটোকেই চেপে ধরতে হয়, নাগাল পায়না বলে!

অন্য সময় হলে মামা ছোট্ট ইভাকে ‘ছোট আম্মু’ বলে কোলে তুলে নিত। কিন্তু মামার হাত দুটো যে বাঁধা দুটি বড় ব্যাগে। পিঠের উপর আবার ইভার চেয়ে বড় আরেকটি ব্যাগ। ছোট্ট ইভা বুঝতে পারল না এত বড় ব্যাগে কি থাকে।

‘ছোট আম্মু, কেমন আছ?’

‘আমি ভাল আছি। তুমি ভাল আছ তো মামা? এবার অনেকদিন পরে তুমি এলে- এতদিন বুঝি ছোট আম্মুকে মনে পড়েনি। নানা-নানু কেমন আছে মামা? জান মামা, তোমার বিয়ের জন্য কত কি কিনেছি...’। অনেকগুলো কথা বলল সে একদমে, মামার ঠ্যাং জড়িয়ে ধরেই!

ছোট্ট ইভার শেষ কথাটা শুনে মামা যেন বিষম খেল। পরোক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘কিরে, ভিতরে ঢুকতে দিবি না- পা দুটো ছাড়, আগে ভিতরে ঢুকি। তোর আম্মু কি বাসাতেই?’

‘হ্যাঁ মামা, আম্মু ঘুমিয়ে আছে’। - মামার পা দুটো ছেড়ে দিতে দিতে বলল ছোট্ট ইভা।

‘চল’- বলে মামা ইভার পিছু পিছু গেটের ছোট দরজা দিয়ে ঢুকতে গেল। কিন্তু পিঠে ঝোলানো ব্যাগের লম্বা মাথা দরজার উপরে ঠোক্কর খেল। আঁতকে উঠে মামা পিছিয়ে এলো, তারপর শরীরটিকে দু ভাজ করে ঢুকে পড়ল ভিতরে!

ইভা মাকে ঘুম ছেড়ে কাপড়ের আঁচল কোমরে গুঁজে ঝাড়ু নিয়ে দৌড়ে আসতে দেখে অবাক হয়ে গেল।
মামাও হতভম্বের মত পড়ল দাঁড়িয়ে। একি কথা! তাকে স্বাগতম জানাতে আপা হাসিমুখে আসবে, অথচ কিনা মুখ প্যাঁচার মত করে ঝাড়ু নিয়ে দৌড়ে আসছে! পর মুহূর্তেই যে সম্ভাবনার কথা দ্বিতীয় বারের মত উঁকি দিল মনে, তাতে আরও চুপসে গেল সে।

‘দু দিন পর তোর বিয়ে, আর তুই কিনা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিস। দাড়া...’

এবার ছোট্ট ইভা সব বুঝতে পারল। মামা তাহলে ওদের নিয়ে যেতে আসেনি। পরদিনেই তো সবার নানা বাড়ির গ্রামে যাওয়ার কথা। বাবা-মার সাথে শহর থেকে অনেক কেনাকাটাও করা হয়েছে নানা-নানু, ছোট আন্টি, নতুন মামী- সবার জন্য। আর মামা কিনা পালিয়ে এসেছে। বিয়েতে তো কত মজা হয়, সবাই আনন্দ করে, খাওয়া-দাওয়া করে- মামা এতসব আয়োজন ফেলে কি জন্য পালাল ওর ছোট্ট মাথা কিছুতেই বুঝতে পারল না। ও কখনও বিয়ের সময় পালাবে না!

মামা অর্থাৎ কনক  প্রথমে বুঝতে পারল না, ওর আসার আগেই সে খবর আপাদের বাসায় পৌঁছে গেল কিভাবে। সম্ভবত, মা ফোন করে আপাকে জানিয়েছে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি...বেশ বড় রকম একটা ভুল হয়ে গেল! এ সম্ভাবনার কথা উত্তেজনার সময় মাথাতেই আসেনি, আপাও তো ওর বিয়েতে যোগ দেয়ার জন্য দু একের মধ্য গ্রামের বাড়ি ছুটবে। কে জানে, কাল ই হয়তবা তাকে কান ধরে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবে। তারপর... জীবনটাই শেষ!

‘ইস, কি মস্ত বড় গাধা আমি। পালালামই যখন তখন অন্য ঠিকানায় না কেন? এত বড় ভুল কিভাবে হল?’- নিজের মনে ভাবছে কনকএ হতে দেয়া যায় না। ঐই বিচ্ছু মেয়েটা, যে নাকি একবার ট্রেনের তলায় এবং আরও একবার দড়ি নিয়ে আম গাছে উঠে পড়েছিল কনকের প্রত্যাখ্যানে; তারপর কনকের বাবা মা,  মেয়েটির বাবা-মা, এমনকি পুরো গ্রামের সবাই জোর করে আংটি বদল করতে বাধ্য করেছে- সে মেয়েকে বিয়ে করলে ওর বাকি জীবনটাই বরবাদ হয়ে যাবে। এখান থেকে পালাতে হবে- মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে।

‘কিন্তু আংটিই যখন পড়ালি, এখন বিয়ে বাদে পালালি কেন? মা তো বলল, মেয়েটা নাকি সুন্দরী-বুদ্ধিমতী- উনাদের খুব পছন্দ এবং তোকেও নাকি খুব ভালবাসে’।– ড্রয়িং রুমের সোফায় বসতে বসতে বলল আপা।

‘কিন্তু আমি যে চিরকুমার সভার সভাপতি!’- মজা করার জন্য বলল কনকসামান্য বিরতিতে বলল, ‘ আংটিও আমি ইচ্ছা করে পরাইনি, আমাকে পরাতে বাধ্য করা হয়েছে’      
                  
‘ওসব সভা-টভা করে লাভ নেই, শেষ পর্যন্ত সবাই বিয়ে করে এবং বিয়ের পর নিজেদের ধিক্কার দেয়- বিয়েটা কেন আরও আগে করল না। বিয়ের পর তুইও একই কথা বলবি!’

‘দেখ আপা, আমি বিয়েতে কি জন্য রাজি হইছি তুই হয়তবা জানিস। কিন্তু ও মেয়েকে নয়। তুই বাড়ি গিয়ে বাবা-মা কে একটু বুঝা’।

‘আংটি যখন পরানো হয়ে গেছে এখন আর কোন চান্স নেই। বাবাকে তো তুই চিনিসতার মতের বিপরীত বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। শোন ভাই, একবার বিয়েটা করে ফেল, দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে’।

 ‘মাথা খারাপ’- আপার দিকে চেয়ে বলল কনক

‘মাথা খারাপ হোক আর যাই হোক, ওই মেয়েকেই তোর বিয়ে করতে হবে। আর কালই আমাদের সাথে তোর বাড়ি যেতে হবে। খবরদার! এখান থেকে পালাবার চিন্তা করিস না আবার। এখন বিশ্রাম কর, আমি রান্না ঘরে আছি’। - আপা ঝাড়ু হাতে চলে যাবার জন্য পা বাড়াল এবং কি মনে হতেই পিছে ফিরে চাইল। মামার কোলে বসা ছোট্ট ইভাকে বলল, ‘ দেখিস তোর মামা যেন পালিয়ে না যায়’!

ইভা সেই আসার পর থেকেই মামার কোলে বসে আছে, একটু ক্ষণের জন্যও নামেনি। ছোট্ট ইভার এবার নজরে পড়ল দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা মামার সেই বড় ব্যাগের দিকেইভা তার ছোট্ট হাত দিয়ে মামার থুতনি বার দুয়েক নাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘মামা, তোমার ওই ব্যাগের মধ্য কি? আমাকে একটু দেখাও না’।

মামা ইভার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, ‘চল, ব্যাগটি নিয়ে ছাদে যাই। তারপর দেখিস’।
ইভা খুশি হল। মামার হাত ধরে সে চলল ছাদে।

ফু দিয়ে ধুলো সরিয়ে কনক বসে পড়ল মেঝেতে, ছাদের সিঁড়ির দেয়ালে হেলান দিয়ে। ছোট্ট ইভা দাঁড়িয়ে রইল মামার পাশে।  

ব্যাগ থেকে বের হল একটি গীটার। গীটার দেখে ইভা খুশিতে আটখানা। টেলিভিশনে অনেকবার দেখেছে গীটার বাজিয়ে গান গাইতে।


‘আম্মু, তুমি একটা গান গাও, আমি বাজাই’- বলে মামা গিটারখানা কোলে তুলে নিলো
ইভা দারিয়েই গান ধরল ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’... ইভা মাত্র স্কুলে ভর্তি হয়েছে। মামা বেশ খুশি ভাগ্নির সঙ্গীত প্রতিভায়, সেই সাথে টুং টাং শব্দ তুলে বাজিয়ে চলল গিটার।
মামার অনুরোধে আরও দুটি গান গাইল ইভা, সম্পূর্ণ না- একটু করে, এর বেশি জানেনা সে।  মামাকে বলল, ‘মামা, তুমিও একটা গান শোনাও না’।

মামা গাইল, প্রথমে একটা, তারপর আরেকটা, তারপর আরও একটা।

ইভার মা ওদের খোঁজে ছাদে এলোছোট ভাইয়ের গান শুনতে পেয়ে ওদের সামনে না গিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগল। ভাইয়ের সঙ্গীত প্রতিভায় বরাবরের মতই মুগ্ধ। অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে গান শুনতে শুনতে ভাবল ছোট ভাইটির নানা মুখি প্রতিভার কথা। ছেলেবেলা থেকেই খুব সুন্দর গাইতে পারে ও। বড় হয়ে হাতে তুলে নিয়েছে গিটার। দশটি আঙুলের শৈল্পিক কারুকার্যে ছয়টি তার থেকে বেড়িয়ে আসা সূর যখন ওর অপূর্ব কণ্ঠের সাথে যুক্ত হয়- যে কেউ মুগ্ধ হয়ে যাবে শুনে। কিন্তু অনেক কাজ যে পরে রয়েছে-। আসলে সে এসেছে ওদের খোঁজে, দুপুরের আহার পর্বের কথা বলতে। ইভার মা জানত, তাদের ঠিক ছাদেই পাওয়া যাবে। দুপুরের কড়া রোদে এবং না বলে কেউ বাইরে যাবে না।

ইভার বাবা ফিরল বিকেল পাঁচটার পর। ড্রয়িং রুমের সোফায় শুয়ে মাথা-গুজে বই পড়তে থাকা শালাবাবুকে দেখে প্রথমে চিনতে পারল না, কেননা দু হাতে ধরা বই মুখ মণ্ডল আড়াল করে রেখেছে। তিন চার কদম হেঁটে এসে বই খান সরিয়ে ধরতেই চিনতে পেরে সহাস্যে বলে উঠল- ‘আরে শালা সাহেব যে! কখন এলে? কি কাণ্ড! আমাদের আসতে দেরি দেখে বিয়ের আয়োজন ছেড়ে শালাবাবু দেখি নিজেই এসে হাজির। তা তোমার বাড়ির সবাই কেমন আছে শালাবাবু ? আসতে কোন সমস্যা হয়নি তো শালাবাবু’- “শালাবাবু” শব্দটি সবখানেই জুড়ে দিয়ে বলল, কেননা শব্দটি “শালাবাবুর” পছন্দ নয়!

‘বড় বোন থাকার এই একটাই জ্বালা। সবখানেই “শালা” গালিটা শুনতে হয়’- দুলাভাইয়ের চোখের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলল কনক 

‘আরে আমিতো গাল দেইনি, দেখনি “শালার” সাথে কি সুন্দর “বাবু” যোগ করে দিয়েছি’- হাসি মুখে বলল দুলাভাই।

‘কিন্তু দুলাভাই, আপনাকে তো হাজার বার বলেছি আমাকে কনক  নামেই ডাকতে’।

‘দেখ, তোমার বোনের মাধ্যমে তোমার সাথে আমার যে সুন্দর সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে; যদি খালি নাম ধরে ডাকি তবে মনে হবে সে সম্পর্ক কোন কালে ছিল না। আবার নামের পরে ওই সম্বন্ধীয় শব্দটি যোগ করতেও আপত্তি তোমার। অথবা, আবার শুধু সম্বন্ধীয় শব্দটা বলে ডাকলে ভাববে গালি দিচ্ছি! তাহলে শালাবাবুই কি ডাকা উত্তম না?’ একটু থেমে বলল, ‘শালা, এদিকে এসো। কনক শালা এদিকে এসো। শালা বাবু এদিকে এসো’- এই তিনটি বাক্যের মধ্য কোনটি শ্রুতিমধুর !’

‘আর বলতে হবে না, পণ্ডিত মশাই স্যার’- দুলাভাইয়ের পেশার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে বলল কনকসেও জানে, তার প্রভাষক দুলাভাই “পণ্ডিত মশাই” নামে পরিচিত হতে মোটেই আগ্রহী নয়। ‘আসুন স্যার, এবার কোলাকুলির পর্বটা সেরে ফেলি’- কনক বলল ।

শালা- দুলাভাইয়ের বয়সের পার্থক্য সামান্যই। “আপা” কনকের মাত্র দু বছরের বড়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ডিপার্টমেন্ট-একই ক্লাসে পড়ত কনকের বোন এবং দুলাভাইসেখানেই প্রেম এবং বিয়ে। সবকিছুই কনকের জানা, সেও একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। কনক তাকে পছন্দ করত। হয়তবা একটু বেশিই করত, তার হবু দুলাভাই ছিল মেধাবী চরিত্রবান এবং সৎ। কিন্তু বাবা-মায়ের ঘোর আপত্তি ছিল। তারা ছিল গরীব, উপরন্তু সে সময় কয়েকটি বড় ঘড় থেকে আপার বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। শেষ পর্যন্ত দুজনে পালিয়ে বিয়ে করে। কনকের বাবা এখন পর্যন্ত সে বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। বিয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কনক ওদের সাথে ছিল। কাজী অফিস থেকে বেড়িয়ে কনকই আপাকে পরামর্শ দেয়, দুলাভাইকে নিয়ে বাবা-মাকে সালাম করে আসতে। মা কাঁদছিল, আর বাবা ‘কোনদিন মেয়ের মুখ দেখব না’ বলে বারান্দার ইজি চেয়ারে গোমরা মুখে বসে রইল। তারপর, আর কোনদিন বাড়ি যাওয়া হয়নি আপার। একদিকে বাবার বংশ-গৌরব-প্রাচুর্য, অন্যদিকে মেয়ের অভিমান- এ দুটোই এ দুজনকে সরিয়ে রাখল টানা পাঁচ বছর। বাবার মত জেদি আর দাম্ভিক জীবনে দ্বিতীয় কাউকে দেখেনি কনকঅবশ্য মা আর ছোট বোনটির কথা আলাদা। ইভার জন্মের সময় দুজনই পাশে ছিল আপার। দুলাভাই যখন কলেজে চাকরি নিয়ে তিনশ কিলোমিটার দূরে চলে এলো আপাকে নিয়ে- তাদের বিয়ের পরপরই; তারপর মা এবং ছোট বোনটি কনকের সাথে কতবার এসে দেখে গেছে আপাকে তার হিসাব নাই। কিন্তু বাবা একবারও না।

রসায়নের মত জটিল সাবজেক্ট নিয়ে আপার বিয়ের এক বছর পরেই মাস্টার্স শেষ করল কনকলেখাপড়াতে দারুণ মেধাবী। স্কুল-কলেজ-বিশ্ব বিদ্যালয় কোন খানেই দ্বিতীয় শ্রেণীর মুখ পর্যন্ত দেখেনি সে। সুতরাং শিক্ষা জীবন শেষ করার আগেই বহুজাতিক সংস্থা থেকে, টেক্সটাইল কোম্পানি হতে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রস্তাব এলোপিএইচডি এর জন্য বিদেশও কোন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু কোন রকম চিন্তা ভাবনা না করে সবগুলো প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে ঘরেই বসে রইল সে এবং এখানে সেখান ঘুরে ফিরে দিন পাড়ি দিতে লাগল। তরুর বাবা দু বছর স্রেফ তাকিয়ে তাকিয়ে সব দেখলেন, তারপর ঠ্যাঙ্গানি লাগাল ছেলেকে। বাবার ঠ্যাঙ্গানি খেয়ে কনক চলে এলো তাদের গ্রামের বাড়িতে। বাবা বেশ মর্মাহত হল কেননা নিজের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিয়ে কনক গ্রামের চাষাভুষার সাথে সময় কাটাচ্ছে দিনকে দিন। তবে এ করেই কনক সময় পার করে দিল না- নিজেদের বিস্তর চাষাবাদের জমি নিজের তত্ত্বাবধানে এনে চাষাবাদ শুরু করে দিল। তাপর পোলট্রি ফার্ম করল, ডেইরী ফার্ম করল, নিজেদের বিশাল বিশাল মজা পুকুর সংস্কার করে শুরু করল মাছের চাষ...
       
কনকের মা-ছোট বোন এসে বেশ কয়েকবার ঘুরে গেলেও বাবা এলো প্রায় বছর খানিক পর। তাকে আগের চেয়ে বেশ নরম মনে হল। গ্রাম-সুদ্ধ লোকের প্রশংসা কনকের- এটিই মনে হয় প্রধান কারণকনকের  সবকিছু মেনে নিলো বাবা, সেই সাথে শর্ত জুড়ে দিল- এবার ওকে বিয়ে করতে হবে। গ্রামের বাড়িতে এসে ইতিমধ্যে তারা অনেক কিছু শুনেছে কনক কে নিয়ে

বিয়ের কথা উঠতেই কনক তিন লাফ দিল- না-না, আনন্দে নয়! বিয়ের কথা কিছুতেই ভাবতে পারে না সে। নিজের সুন্দর সময়গুলোর সাথে আরেকজনের শেয়ার- না, শেয়ার নয়, ওর কথায়, ‘ভাগ বসাতে’ দিতে চায় না মোটেই।

ছেলের কথা শুনে কনকের বাবা দিল সাত লাফ! একমাত্র ছেলে, আর সে কিনা বিয়ে করবে না। তাকে দাদু হওয়া থেকে বঞ্চিত করবে! কনক কে আবার বাবার দাবড়ানি খেতে হল। বাবার দাবড়ানির চোটে শহর ছেড়ে গ্রামে পালিয়েছে- এখন জঙ্গলে পালাবে কিনা ভাবতে বসল সে

বাবা যেন এবার একটু নরম হল। বলল, ‘তুই যদি বিয়ে করিস, জেসমিনের বিয়েটা আমি মেনে নেব’।  
এবার কনক  রাজি না হয়ে পারল না। ব্যস, মেয়ে দেখা শুরু হয়ে গেল। কিন্তু তাদের চোখ যে ঐই বিচ্ছু মেয়েটার উপরেই পড়বে- কনকের জানা ছিল না।

কনক বিয়েতে রাজি হয়েছে তার অর্থ নয় যে, ঐই বিচ্ছু মেয়েকে বিয়ে করতে হবে। অন্য কোন মেয়ে দেখুক, তাতে কনকের কোন আপত্তি নেই। কিন্তু বাবা-মার এক কথা- ওই মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে। বিচ্ছু মেয়েটাও মা বাবাকে এমন পটিয়ে ফেলেছে, তাদের মাথায় অন্য কোন মেয়ের চিন্তাও ঢুকবে না কোনদিন। এনগেজমেন্টের ঠিক আগে বাবা কনককে বলল, ‘দেখ, তুই যদি আংটি না পরিয়ে দিস তবে তৃতীয় বারের মত আমার স্ট্রোক হবে ইনশাআল্লাহ্‌! এক গ্রাম লোকের সামনে পটল তুলি, সেটা নিশ্চয় তুই চাস না’।

কি আর করবে বেচারা কনক মামা! মাথা নিচু করে কোনরকমে আংটিটি পরিয়ে দিল। একবারের জন্যও মেয়ের মুখপানে চাইল না।  ঐই বিচ্ছু মুখ দেখতে তার বয়েই গেছে!

ঠিক তার পরদিন, ফজরের নামাজ পরে ভোরের হাওয়া গায়ে লাগাতে ধান খেতের আইল ধরে হাঁটছিল কনকসেখান হঠাৎই ভূতের মত উদয় হল মেয়েটি।  পিছন থেকে ধাক্কা মেরে বসল- সূর্যোদয়ের দিয়ে তাকিয়ে থাকা অমনস্ক কনককেএই সাত সকালে বিচ্ছু মেয়েটির মুখ দেখে কনকের পিত্তি জ্বলে উঠল! গতকালই যে মেয়েটিকে সে বিয়ের আংটি পরিয়েছে, মনেই রইল না সে কথা!

কনকের ক্রুদ্ধ মুখের দিকে চেয়ে মেয়েটি বলল, ‘শেষ পর্যন্ত আমাদের বিয়েটা হচ্ছে স্যার’একটু থেমে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘একবার বিয়েটা হয়ে যাক চান্দু সোনা! তারপর...’  বলেই মেয়েটি চলে গেল এবং যাওয়ার পথে অন্তত পাঁচবার পিছে ফিরে চাইল। প্রতিবারেই সে দেখতে পেল, হতভম্বের মত একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে কনক!  

সকাল আঁটটা পর্যন্ত একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইল সে। কত লোক তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল, কিন্তু কারও দিয়ে ফিরে চাইল না সে। ভোরের শ্বেতশুভ্র আকাশের পানে চেয়ে একই কথা ভাবতে লাগল- ‘ বাকি জীবনটা আমার বরবাদ হয়ে গেল!’ এবং বিয়ের ঠিক তিনদিন আগে চিরকুট লিখল মাকে, ‘মা, আমি পালিয়ে যাচ্ছি! তোমাদের পছন্দ করা ওই বিচ্ছু মেয়েকে কোনভাবেই বিয়ে করতে পারব না। আপাত, কোথায় যাচ্ছি বলব না। তোমরা অন্য মেয়ে দেখ- তারপর আপাকে জানিয়ো, আমি চলে আসব। আমার মুরগি-মাছ, খরগোশ গুলোকে দেখে রেখ!... ইতি...’।

চিরকুটটা টেবিলের উপর রেখে খালি হাতে বেরিয়ে এলো কনক। কেউ কোন প্রকার সন্দেহ করেনি! মালপত্র আগেই চালন করে দিয়েছে। কিন্তু একি হল! শেষ পর্যন্ত নিজেকে ভুল ঠিকানায় চালান করে দিল। এরচে, যদি কোন বন্ধুর কাছে চলে যেত। ইস, কি ভুলটাই না হয়েছে। কালই আপার সাথে বাড়ি যেতে হচ্ছে। সবাই কি ভাববে!

রাত দশটা পর্যন্ত এ কথাই ভাবল কনক, কেননা আপার বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল; পালিয়ে যাওয়া দূরে থাক, এক মিনিটের জন্যও একা হতে পারেনি সে। ছোট্ট ইভা তক্কে তক্কে ছিল, কখন মামা পালাবে- মামার পা দুটো শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে, তারপর চেঁচাবে, ‘ আম্মু, মামা পালাচ্ছে। মামাকে ধরেছি’!

আগামীকাল খুব ভোরে রওনা হতে হবে, এ অজুহাতে আপা-দুলাভাই ঘুমাতে চলে গেলে কনক গিটার নিয়ে ছাদে চলে এলো

ধুলোমাখা ছাদের রেলিং এর গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ল কনক। গিটার একপাশে সরিয়ে রেখে পা দুটো বরাবর সামনে মেলে দিলছাঁদ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ফুলের টবগুলোতে ছোট বড় গাছগুলি পূর্ণিমার একরাশ অপার্থিব স্নিগ্ধতায় ছায়া-সঙ্গী হয়ে সঙ্গ দিচ্ছে কনক কে। সেই সাথে জ্যোৎস্নার ম্লান আলোয় আকাশের শত কোটি নিভু নিভু নক্ষত্র। নিজের এই নিঃসঙ্গতার মাঝে প্রকৃতির সঙ্গটুকু খুবই ভালবাসে কনক।

গিটার হাতে তুলে নিলো সে। পুরনো খুব বিখ্যাত একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে তার। সাঁর্ল বোদলেয়ারের কবিতা। কবিতাটি আবৃতি করতে লাগল কনক, সেই সাথে কবিতার সাথে ছন্দ মিলিয়ে গিটারে টুং টাং সূর তুলতে লাগল। এভাবে আরও দু তিনটি কবিতা আবৃতির পর ফিরে এলো গানে। স্করপিয়ন এর উইন্ড অফ চেঞ্জ গানটির সূর গিটারে তুলল এবং সুরের সাথে মিলিয়ে শীষও বাজাল সে। অদ্ভুত সুন্দর ভাবে মিলে গেল শীষ। তবে এ পরিবেশে, এ সময়ে যে গানটি কনকের সবচেয়ে পছন্দ, সে ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে...’ রবীন্দ্রসঙ্গীতের সূর তুলল পরপরই। গান শেষ হলে গিটার বাজানো থামিয়ে দিল, রাতের বুকে নেমে এলো নীরবতা। কনক জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত রাতের দিকে চাইল একবারহঠাৎ কেমন যেন একটা ভালোলাগার শিহরন বয়ে গেল কনকের হৃদয় জুড়ে। এ অনুভূতির সাথে সে বরাবরই পরিচিত- কিন্তু প্রকাশের ভাষা জানা নেই তার। গ্রামের শস্যখেত গুলোতে যখন ধান কাটা শেষ হয়; ছেলে-বুড়ো সবাই মেতে উঠে ঘুড়ি উড়ানর উৎসবে, শস্য খেতের আইলে বসে কনক তাকিয়ে থাকে সে ঘুড়িগুলোর দিকে; তার চারপাশ ঘিরে আকাশে উড়ছে কত শত ঘুড়ি- কোনটি ছোট-কোনটি বড়, কারও লম্বা লেজ আছে, কারও মাথায় দুটো শিং, কোনটি দেখতে শিং ওয়ালা বামন দৈত্যের মত, কোনটি আবার পাখির মত... বিশাল আকাশের বুকে উড়ে চলা এক ঝাঁক ঘুড়ির দিকে চেয়ে, তাদের একটানা বিরামহীন ডেকে চলার শব্দ ইন্দ্রিয়ে ধাবিত করে অদ্ভুত যে শিহরন সমস্ত শরীরে বয়ে যায়, তখন- এ ঠিক তেমনই অনুভূতি; অনুভূতির ভালোলাগার শিহরন। কনকের মন এই ছায়া-সঙ্গী রাতের সাথে খেলা চালাল কিছুক্ষণ, তারপর ওই চাঁদ কিংবা নক্ষত্রলোকের স্পর্শ ছাড়িয়ে... আরও দূরে... নিজের পিছনের দিনগুলোতে ফিরে গেল; সেখানে অন্য আলো, অন্য জ্যোৎস্না।

শহরের দিনগুলি তার কেমন ছিল ? সে জীবনধারার কথা মনে হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস চাপে কনকের বুকে; পর মুহূর্তেই তা বেরিয়ে আসে কিছুটা সুখ, কিছুটা দুঃখ, খানিকটা পরাজয়, বাকিটা বিজয়ের মিশেল অনুভূতির ভাষা হয়ে। তবে শহর তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। সেখানে ভাল মন্দ দুটোর সমাহারই অনেক বেশি। অভ্যস্ত হাত ভালটিই টেনে নেয়, বাকিরা মন্দের পসরা থেকে খুঁজে নেয় তাদের উপকরণটি। শহরেই কনকের জন্ম এবং বেড়ে উঠা, তাই অভ্যস্ত হাতে ভালটিই গ্রহণ করেছিল সে। শহর কে সে ভালবাসে- ভালবাসে নিজের আপনের মতই। যে ভদ্রলোক দামি গাড়ি হাঁকিয়ে অফিসে যাচ্ছে, যে কিশোর ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসে আছে, কিংবা দুপুরের কড়া রোদে উঁচু বিল্ডিঙটির ছায়ায় রিক্সা দার করিয়ে রেখে ছিটে বসে ঝিমচ্ছে যে রিকশাচালকটি- সবাইকে ভালবাসে সে। এখানে কনক দেখেছে, কত শত অলি গলির আঁকে-বাঁকে-ফাঁকে কতশত মানুষের আরও কতশত বিচিত্র জীবনের বৈচিত্রধারা। যে কিশোর বৃদ্ধ মায়ের হাত ধরে ঐ বস্তিতে থাকে, সে স্বপ্ন দেখে পাকা বিল্ডিঙের। যে বিলাস বহুল অট্টালিকায় থাকে, সে চায় আরও উঁচুতে- আকাশটা ছুঁয়ে ফেলতে চায়। এই ছুটে চলতে চলতে একসময়য় সবাই হারিয়ে ফেলে সবাইকে। পাশের বাড়ির লোকটিও তার অচেনা লাগে। তাদের চলা শুরু হয় ঐই রাস্তা ধরে, যে রাস্তা অবহেলিত জনপদ-গ্রাম থেকে চলে এসেছে, তারপর মিশে গেছে শহরের পথে। পিছনের রাস্তাটা পড়ে থাকে অতীত দিনের সৃতির মত। সে সৃতি ধরে অনেক টানা হেঁচড়া চলে- কেউ কেউ খ্যাতিমান সাহিত্যিক বনে যায়, কেউ আবার হয়ে যায় ‘নিরন্ন মানুষগুলির প্রতিনিধি’। অনেক সংবর্ধনা হয়, মিটিং মিছিল আলোচনা সমাবেশ সবই হয়, উন্নয়নের ধারা সমান হারে বইয়ে চলে- কিন্তু কেউ ফিরে যেতে চায় না উল্টো রাস্তা ধরে সে পথে, জন্মভূমির সে শিকড়ে।

কিন্তু কনকের গ্রামে চলে আসার কারণ ছিল- আসলে সে চাইছিল একটা পরিবর্তন। চাকরির প্রতি বরাবরই অনীহা তার, সেটা যত বড় মাপেরই হোক না কেন সেই একই কথা- অন্যের গোলামী করা। সেই সাথে একটা দায়িত্ববোধ আছেযে দায়িত্ববোধের কাছে বিসর্জন দিতে হয় নিজের স্বাধীনতাটুকু। শহরে ব্যবসা করার মানসিকতা তার ছিল না, যদিও বাবা প্রচুর অর্থ দিতে চেয়েছিলেন। তবে আফসোস হয় পিএইচডি না করার জন্য। মাস্টার্স শেষে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াল দু বছর। তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলো- কিছু দিনের জন্য গ্রাম থেকে ঘুরে আসা যাক। কিন্তু ‘এই কিছু দিনই’ যে পরবর্তীতে দীর্ঘদিনে পরিণত হবে, কনক জানত না।

গ্রামে এসে পরিবর্তনের প্রথম ধাক্কাটা সহজেই সামলে নিলো কনক। তার আশংকা ছিল গ্রামের সবাই তাকে সহজ ভাবে গ্রহণ করবে কিনা। কিন্তু সে নিজেও সাধারণের সাথে সমান ভাবে মিশতে অভ্যস্ত, তাই এক্ষেত্রে কোন সমস্যা হল না। কনকের ভাল লাগল, স্থানীয় যুব সমাজের তার উপর আগ্রহ দেখে। অল্প দিনের মধ্য সবাই তার একান্ত অনুগত হয়ে গেল, সেই সাথে সবার সাথে বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক। এদের সবাইকে নিয়ে এখন ভাবে কনক, যা আগে ভাবত না।

গ্রামের ভাবনার মাঝে আরেকটি অস্পষ্ট ছবি মনের মধ্য ভেসে উঠল- কনকের ভাষায় ‘সেই বিচ্ছু মেয়েটি’। তার মনে পড়ে, প্রথম যেদিন মেয়েটিকে দেখেছিল এবং তার পরের ধারাবাহিক ঘটনাগুলি...

‘মেয়েদের’ প্রতি কনকের সবসময় একটা ‘দূরত্ব বোধ’ কাজ করত। বস্তুত সমবয়সী সব মেয়েদের এড়িয়ে চলত সে । রোমান্টিকতার মাদকতা তাকে কখনও আচ্ছন্ন করেনি, যদিও সে প্রকৃতই রোমান্টিক ছিল। নিজের এ রোমান্টিকতার জন্য মেয়েরা কনকের প্রেমে পড়ে যেত এবং বরাবরের মত কনকের উদাসীনতায় আগ্রহ হারিয়ে অন্য কারও প্রেমে পড়ে যেত! একেই বুঝি প্রেম বলে! 

গতানুগতিক এ প্রেমের চরিত-ধর্ম কোনদিন বুঝতে পারেনি সে  কিংবা বোঝার চেষ্টা করেনি। তাই গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় মেয়েটিকে দেখে নিজের মাঝে কোন পরিবর্তন খুঁজে পায়নি সে। কিন্তু মেয়েটি দেখছিল কনককে অপলক ভাবে- নিজের পথচলা থামিয়ে দিয়ে। কনক মাথা নিচু করে আপন পথ ধরে চলে গেল। আরও দু তিন দিন মেয়েটির সাথে দেখা হল এভাবেই। সে লক্ষ্য করল, প্রতিবারেই মেয়েটি তার দিকে পলকহীন তাকিয়ে আছে। কি যেন বলতে চায় তার চোখ দুটো – কিন্তু কনক বুঝতে পারে না।

গ্রামের পশ্চিমে তালুকদারদের বিশাল পুকুর। কনক একদিন সমবয়সী এক গ্রাম্য ছেলের সাথে হেঁটে যাচ্ছিলো সে পথ ধরে। মেয়েটি শান বাধানো পুকুরের ঘাঁটে বসে বরশি দিয়ে মাছ শিকার করছে। কনক দেখতে পেয়ে চিনতে পারল মেয়েটিকে এবং পাশের ছেলেকে জিজ্ঞাসা করল- ‘মেয়েটি কে?’  কনক গ্রামে আসার মাস খানিক পেড়িয়ে গেছে। এই এক মাসে প্রায় সবার সাথে তার পরিচয় হয়েছে, কিন্তু মেয়েটিকে কয়েকবার দেখলেও পরিচয় জানে না।

‘তালুকদার সাহেবের একমাত্র মেয়ে, কলেজে পড়ে, সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেরায়, ছেলেদের ধরে পেটায়......’ অনেক কথাই কনক জানতে পারল ছেলেটির কাছ থেকে। ইতিমধ্যে মেয়েটির বড়শিতে একটা মাছ আটকেছে এবং সে উড়না কোমরে পেঁচিয়ে কসরত করছে মাছটি ডাঙ্গায় তুলতে। কনক পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। মেয়েটি কনককে দেখতে পেল এবং দু কান পর্যন্ত হাসি টেনে পরক্ষণেই মাছের মুখ থেকে বরশি খুলে, বড় মাছটি নিয়ে দৌড়ে চলে এলো কনকের কাছে। কনক তো হতভম্ব। পাশের ছেলেটিকে কোনপ্রকার পাত্তা না দিয়ে মেয়েটি মাছটি তার দিকে বারিয়ে বলল, ‘আপনার জন্য’। মাছটি তক্ষণও লাফাচ্ছে।  কনক বুঝতে পারছে না, মাছ হাত বারিয়ে নিবে কিনা। মেয়েটি যে তার সাথে রসিকতা করছে না, তা অবশ্য বুঝতে পারছে মেয়েটির চোখের দিকে চেয়েআসলে, মেয়েটির এ আচরণ তাকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। নিজের অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে বুদ্ধিমানের মত বলল, ‘তার চেয়ে ভাল হবে, তুমি যদি মাছটি রান্না করে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দাও’।

মেয়েটি মাছ নিয়ে যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই চলে গেল। সামান্য পরে কনকও ধরল বাড়ির পথ। এবং ঠিক দু ঘণ্টা পরে কাজের মেয়ের হাতে ট্রে সাজিয়ে সে হাজির কনকের বাড়িতে।

কস্মিনকালেও সে চিন্তা করতে পারেনি, মেয়েটি সত্যি সত্যি মাছ নিয়ে হাজির হয়ে যাবে তার বাড়িতে। আগের মতই অপ্রস্তুত সে। অথচ মেয়েটির মধ্য কোন জড়তা নেই।

কনককে বলতে হল না,  পাশ কাটিয়ে তার রুমে প্রবেশ করল মেয়েটি। সম্বিত পেয়ে কনকও তার পিছু নিলো এবং প্রথমেই রুমের অবস্থা দর্শনে লজ্জা পেল নিজের মনে।  ব্যাচেলর মানুষের বেলায় যা হয় তাই। সবকিছুই অগোছালো এবং এলোমেলোমেয়েটি এসে রুমের ঠিক মাঝখানে দাঁড়াল এবং রুমের চারপাশে দ্রুত নজর বুলাল একবার। ‘দাঁড়ান, আপনাকে সাহায্য করছি’- বলে কাজের মেয়ের হাত থেকে ট্রে নিয়ে টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে ছুটো ছুটি শুরু করে দিল রুমের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। পাঁচ মিনিটের মধ্য রুমের চেহারা পাল্টে গেল। তারপর চেয়ার টেনে বসে পড়ল হতভম্ব কনকের পাশে

‘শহরের মানুষেরা সবসময় ফিটফাট বাবু সেজে থাকে, আর আপনাকে দেখছি উল্টা’। একটু থেমে যোগ করল, ‘এরচেয়ে বাবাকে বলুন, একটা বিয়ে করিয়ে দেবে!’

কনক লজ্জা পেল। নিজেকে সামলে প্রশ্ন করল, ‘তোমার নাম কি?’ তালুকদার সাহেবের মেয়ে, কলেজে পরে... ইত্যাদি শোনা হয়ে গেছে অথচ নামটাই জানা হয়নি।

‘সেকি কথা!’- মেয়েটি যেন আকাশ থেকে পড়ল, ‘আপনার জন্য পুকুর থেকে মাছ ধরলাম, কেটে কুটে নিজ হাতে রান্না করলাম... ঘর ঝাড়ু পর্যন্ত দিলাম, অথচ আপনি আমার নামই জানেন না’মুখ গোমড়া করে ফের যোগ করল, ‘ আমার নাম হুতোম পেঁচা’।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের মেয়েটি হেসে দিল। মেয়েটি চেয়ার ছেড়ে উঠে ঠাস করে চড় বসাল ছোট মেয়েটির গালে। তারপর আবার গিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। কাজের মেয়েটি মুখ বেজার করে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল

হঠাৎ মেয়েটির দৃষ্টি পড়ল টেবিলের উপর রাখা ট্রের প্রতি। ‘আরে, সবকিছু ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে। এত কষ্ট করে নিয়ে এলাম- এটুকু বলে কনকের দিকে ফিরে চাইল সে, বলল, ‘যান, হাত মুখ ধুয়ে আসুন- আমি প্লেটে বেড়ে দিচ্ছি’।

‘কিন্তু আমার এখন খাওয়ার ইচ্ছে নেই’- কনকের এ আপত্তি ধোপে টিকল না। সুতরাং বাধ্য ছেলের মত হাত মুখ ধুয়ে বসে পড়ল টেবিলে।

সবকিছুই পরিবেশন করা হয়েছে। কিন্তু সে খাচ্ছে আর মেয়েটি হা করে তাকিয়ে দেখছে, এ চিন্তা মোটেও ভাল লাগছে না কনকের। মেয়েটিকেও তাই তার সাথে বসে পড়তে বলল। মেয়েটি কনকের দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে নির্দ্বিধায় প্লেট নিয়ে বসে পড়ল।

সব মিলিয়ে তিন বার বিষম এবং আরও দুইবার হেঁচকি উঠল কনকের। ‘বাপরে, কি ঝাল!’ তিন গ্লাস পানি খাওয়ার পরেও মনে হল কিছুই হয়নি। অথচ মেয়েটি কি অবলীলায় খেয়ে চলছে। থেকে থেকে আবার কাঁচা লঙ্কায় কামড় বসাচ্ছে।

কনকের খাওয়া শেষ। এখনও মুখ আড়াল করে ফুঁপিয়ে চলছে। মেয়েটি খাওয়া শেষ করে, বাসি প্লেটগুলো ধুয়ে ট্রেতে সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘আপনি বেশ স্বার্থপর তো। এত কষ্ট করে রান্না করে খাওয়ালাম, অথচ একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দিলেন না’।

ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি- কনকের মনের ভাষা হলেও মুখে, ‘চমৎকার এবং তোমাকে ধন্যবাদ’ বলে একই সাথে তার দুটি প্রশ্নের উত্তর দিল।

কনক কে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে মেয়েটি ট্রে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলে সে আবার বলল, ‘তোমার নাম এখনও যে জানা হল না’।

‘শেষ পর্যন্ত আপনি যখন ধন্যবাদ দিলেন তখন বলতে পারি নাম’- দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে বলল মেয়েটি। সামান্য বিরতি দিয়ে কনকের চোখে চোখ নাচিয়ে, ‘আমার নাম’ বলে সূর ধরল, ‘লা...লা...লা...লাবিবা!’  তারপর দৌড়ে চলে গেল। সেদিকে চেয়ে রইল কনক।

সেদিন থেকেই শুরু হল লাবিবার উৎপাত- কনকের ভাষায়। মেয়েটা নিয়ম করে আসতে লাগল তার বাড়িতে। কোন মেয়েকে কিভাবে কি বলতে হয়, কনকের জানা নেই- লাবিবাকে তাই কিছুই বলতে পারল না সে। শুধু গোমড়া মুখে বসে রইল এবং মাঝে মাঝে সে মুখের উপর কষ্টকর হাসি টেনে লাবিবার প্রশ্নের উওর দিত। সে এসে কনকের অনুমতির তোয়াক্কা না করে সরাসরি তার রুমে চলে যেত এবং বডি-গার্ডের মত কাজের মেয়েটি দারিয়ে থাকত দরজার কাছে। তারপর না না বিষয় নিয়ে কথা শুরু করে দিত।  কথা বলত অনেকটা সে নিজের মনেই, কেননা কনককে দশটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে সে উওর দিত দুটোর। বসে বসে বইগুলোর পাতা উল্টাতো সে। বেশির ভাগই লেভ তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাস কিংবা যাযাবরের মত লেখকদের বই। ঠোঁট উল্টিয়ে লাবিবা বইগুলো দেখিয়ে বলত, ‘ এ সব মোটা মোটা বই পরে কি লাভ বলুন, আপনি তো একটু চালাক চতুর হতে পারলেন না- সেই বোকাই রয়ে গেলেন। আপনার ঘরে সুন্দরী একটা মেয়ে বসে আছে, আর আপনি কিনা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন!’

এবার কনক দেখতে পেল, পুরো গ্রামবাসী চেহারায় হাসির ঝিলিক তুলে কৌতুকের চোখে তাকে দেখছে। কনকের সহজ সরল ব্যবহার, মুগ্ধ বাক্যালাপ কিংবা সর্ব সাধারণের সাথে চলাফেরা- সবই অল্প দিনের মধ্য তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে গ্রামবাসীর মাঝে। সেই সাথে চৌধুরী বাড়ির ছেলে বলে আলাদা আগ্রহ কিংবা শ্রদ্ধাবোধ আছে সবার। গ্রামের পথে কনক যখন হেঁটে চলত, গ্রামবাসী কেউ তার সামনে পরলে হাসি মুখে তাকে শুভেচ্ছা জানাত কিংবা পূর্বপুরুষীয় জ্ঞাততায় স্ব শ্রদ্ধায় পথ ছেড়ে দিত। কিন্তু এগুলোর সাথে এই কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টি কিংবা হাসি যোগ হলে কনক প্রথম বারের চিন্তায়ই বুঝে ফেলল, তালুকদার সাহেবের একমাত্র মেয়ে যে ওর প্রেমে মজেছে, একথা কারও অজানা নেই। সেই সাথে কনককে ভাগ্যবান মনে করছে সবাই।


আসলে, তালুকদার সাহেবের এ মেয়েটি পুরো গ্রামের মধ্যমণি। পাঁচ ছেলের পর একমাত্র মেয়ে হয়ার জন্য তালুকদার সাহেব-বিবি দুজনেই অনেক ভালবাসে তাকে। আদরের মেয়ের কোন আবদারই অপূর্ণ রাখে না তারা। তাদের আহ্লাদী মেয়েটাও কলেজের সময়টুকু বাদে সারাদিন গ্রামময় বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বেড়ায়, তারাও হাসিমুখে সবকিছু মেনে নেয়। আর পাঁচ ভাইতো পারলে বোনটিকে মাথায় তুলে নাচে। গ্রামবাসীও একই চোখে দেখে- সেই ছোট বেলা থেকেই তার এই স্বভাব, তারাও অভ্যস্ত, বড় হয়ে এখনও আগের মতই রয়ে গেছে লাবিবা। 

ফুলশয্যার দর্শনে ! - ২ ( শেষ অংশ )