আমাদের স্কুল। - ২ ( শেষ অংশ )
আমাদের স্কুল। - ১
ঢং... ঢং...ঢং... ।
আরেকটি ক্লাস শেষ হল। এবার চলুন আমগাছ তলায়
যাওয়া যাক।
বেশ গরম পড়েছে। চেয়ে দেখুন, সূর্য প্রায়
মাথার উপর। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এ দেশে এই সময়ে গরম পড়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি শহুরে
মানুষ, রোদ-বৃষ্টি ঠাণ্ডা-গরম কোন কিছুই স্পর্শ করতে পারে না আপনাদের আধুনিক জীবন
চলায়। আমরা পল্লী গায়ের মানুষ, এগুলো আলিঙ্গন করেই আমাদের বেঁচে থাকতে হয়। আমরা
চৈত্রের মাঠে লাঙ্গল-বলদ বিশ্রাম দিয়ে কর্ম-ক্লান্ত পা দুটো টানতে টানতে চলে আসি
গাছতলায়। সেখানে বৃক্ষের ছায়ার, নদীর ঠাণ্ডা বাতাসে দু দণ্ড জিরিয়ে নেই। কখনও বা
গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে ডেকে চলা শালিক-চড়ুই-কোকিলের কুহূতানের রেশে ঘুমিয়ে পড়ি
সেখানেই। কখনও এ পথ ধরে যদি কোন গ্রাম্য পথিক যায়, সে ঘুমন্ত আমার পাশে বসে দু
দণ্ড বিশ্রাম নিয়ে চলে যাবে- কিন্তু বিরক্ত করবেনা মোটেই।
অবশ্য আপনার এই ঝিমানো ভাব বেশীক্ষণ থাকবে
না; কেননা দেখতে পাবেন, স্কুল ঘরের আঙ্গিনা-মাঠ পেড়িয়ে একজন লোক হেঁটে আসছে।
ঝিমানো ভাবটা মাথা ঝাড়া দিয়ে ফেলে সোজা হয়ে বসেন- লোকটা ঠিক আপনার দিকেই আসছে যে। তার
পোশাকের দিকে লক্ষ্য করুন, সাদা সার্ট কালো প্যান্ট সাধারণ ভাবে পরা। গোড়ালির উপর
প্যান্টের কিছু অংশ ভাজ করে গোটানো, পায়ে রাবারের সাধারণ স্যান্ডেল। একটু ভালোভাবে
লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন, পোশাকের ভিতরের মানুষটি কিন্তু এই শ্যামল প্রকৃতির আশীর্বাদ-পুষ্ট
সাধারণ মানুষেরই একজন। এ স্কুলের দপ্তরী, ঘণ্টা-বাদক, মালী, পাহারাদার- যাই বলুন না কেন। পুরু গোঁফের
নিচে একচিলতে হাসি টেনে সে আপনাকে সন্মোধন জানাবে, তারপর নিজের পরিচয় বলবে। আলাপচারিতার
সামান্য পরেই বুঝতে পারবেন চল্লিশ ঊর্ধ্ব এই মানুষটি বড়ই দিল খোলা। আপনাকে প্রাপ্য
সন্মান দিয়ে কথা বলবে সে। আপনিও আপনার গাম্ভীর্যের লেবাস খুলে সাধারণ হয়ে যান। না,
না, আমি পোশাকের কথা বলছি না! বলছি, আপনারা শহরের মানুষেরা সব সময় চেহারার মাঝে
জগৎ-সংসারের সবকিছুর উপর ত্যক্ত-বিরক্তের ভাব ফুটিয়ে রাখেন; রাখেন অহংকার সুলভ
গাম্ভীর্য আমাদের দেখে- তার কথা বলছি। একটু সাধারণ হতে চেষ্টা করুন, তাহলেই সাধারণ
মানুষের সাথে খোলা-মেলা ভাবে মিশতে পারবেন; দেখবেন, এই সাধারণের মাঝেই জীবনের কত অসাধারণ
দিক লুকিয়ে আছে। তার সাথে প্রাণ খুলে গল্প করুন, গল্পের মাঝে সে বলবে এই জনপদ,
জনপদের মানুষগুলিকে ঘিরে তার জীবনের কথা।
বিরতির ঘণ্টা বাজানোর জন্য সে উঠে চলে যাবে,
সামান্য পরে আপনি শুনতে পাবেন ঘণ্টাধ্বনি- ঢং ঢং ঢং... ঢং ঢং ঢং... । ঘণ্টাধ্বনির পিলে চমকানো শব্দের পরে শিশুদের হৈ
হৈ রব শুনতে পাবেন, ছোটদের দুটো ক্লাস ছুটি হয়েছে যে। ওরা বই খাতা হাতে মাঠে
বেড়িয়ে আসছে দল বেধে। অন্যদের টিফিন পিরিয়ড বা বিরতির ঘণ্টা। কিন্তু নামেই টিফিন!
সেখানে টিফিনের কোন ব্যবস্থা থাকে না। আমি যদি কর্তৃপক্ষ হতাম, তবে অন্তত: গ্রামের
শিক্ষালয় গুলোতে এই ব্যবস্থার প্রচলন করতাম। ভেবে দেখুন তো, টিফিনের ঘণ্টাধ্বনির সাথে
সাথে শিশুরা হৈ চৈ করে মাঠে বেড়িয়ে পরছে না, সুশৃঙ্খল ভাবে নিজ আসনেই বসে থাকছে।
তারপর স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে থেকে পাঠানো ‘টিফিন প্যাকেট’ প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে
যাবে। আহামরি না হলেও টিফিন প্যাকেটের দুটো সিঙ্গারা কিংবা একটি কলা খেয়ে পরিতৃপ্ত
হবে। ওদের পাঠের প্রতি আগ্রহ-অনুপ্রেরণা বাড়বে- স্কুল কামাইয়ের কথা ভুলেও চিন্তা
করবে না। সেটা যখন হচ্ছে না এবং বাড়িতে থেকে টিফিন আনার প্রচলনও নেই তাদের মাঝে-
তাই লাফ-ঝাঁপ করে টিফিনের সময়টুকু পার করে দেয়। অবশ্য কাউকে কাউকে ওদের মা আদর করে
পকেটে দুটো টাকা দিয়ে দেয়, তাই নিয়ে ছোটে মাঠের পাশে দাড়িয়ে থাকা আইসক্রিম-ওয়ালা, বাদাম-ওয়ালা
কিংবা ঝালমুড়ি-ওয়ালা কাছে। আইসক্রিমই ওদের সর্বাধিক প্রিয়, যদিও মায়ের কড়াকড়ি
নিষেধ থাকে। নিয়ম ভাঙ্গতেই বেশী পছন্দ তাদের।
ছোটদের যাদের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, তাদের
অনেকেই আপনার পাশ কাটিয়ে যাবে। অবশ্য সবাই যে আড়চোখে আপনাকে দেখছে, আপনিও লক্ষ্য
করবেন। কিন্তু সাবধান! আদর করে কাছে
ডাকতে যাবেন না। তাহলে দেখবেন ছোটখাটো একটা ভিড়ের মাঝখানে বসে আছেন আপনি। ওদের
কৌতূহল মেটানোর জন্য আপনার যান-প্রাণ সেদ্ধ হয়ে যাবে! আপনার গাম্ভীর্য ফিরিয়ে
আনুন, চোখের দৃষ্টি কঠোর করে তুলুন- দেখবেন, সবাই আপনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ব্যস্ত
হয়ে পড়ছে নিজেদের নিয়ে।
নদী-পাড়ে যে ছেলেগুলো জটলা করছে, দৃষ্টি দিন
সেদিকে। তাদের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, কিন্তু বাড়ি যাওয়া ভুলে সবাই মেতে উঠেছে
খেলায়। কেউ একজন ঢিল ছুঁড়েছিল নদীতে, তার ঢিলটাকে অতিক্রম করার জন্য আরেকজন ছুঁড়ল-
ব্যাস, সবাই মেতে উঠল ঢিল ছোঁড়াছুড়ির প্রতিযোগিতায়।
আরেকদল বই-খাতা-স্কেল ফেলে, পড়নের কাপড়-চোপড়
খুলে দিগম্বর হয়ে নেমে পড়লো কাঁদা পানিতে। সেখানে তাদের দুই বন্ধু স্কুল ফাকি দিয়ে কাঁদা পানি সেঁচে মাছ ধরছে। সবার
উৎসাহের কাছে হার মানল কাদা-পানি। তারপর ওরা নেমে পড়লো নদীতে। দুরন্ত সাহস তাদের।
প্রত্যেকেই দক্ষ সাঁতারু, অথচ বয়স আর কতই বা হবে- বড়জোর সাত কিংবা আট। প্রকৃতি
ওদের দুরন্তপনা আর সাহসের মাঝে গড়ে উঠতে শিখিয়েছে, কেননা, প্রকৃতিকেই তাদের
মোকাবেলা করতে হয় সবচেয়ে বেশী।
মাঠের পাশে বড় কড়ই গাছের নিচে, যেখানে আইসক্রিম-ওয়ালা
আইসক্রিম বিক্রি করছে, তার পাশে কয়েকজন মিলে ডাংগুলি খেলছে। পাশেই জামগাছে উঠে
পড়েছে চার পাঁচ জন। নিচে ভীর করে দাড়িয়ে আছে অনেকে, সেখানে আছে ছোট ছোট মেয়েরাও।
এবার দেখতে পাবেন ঘণ্টা বাদক দপ্তরীকে-
ব্যস্ততার সাথে ছুটোছুটি করছে। টিফিন পিরিয়ডে শিক্ষকদের পান-চুন-নুন সবই আনতে হয়
তাকে রাস্তার পাশের দোকান থেকে। তবে নিশ্চিত থাকুন, একটু পরেই সে চলে আসবে আপনার
কাছে।
টিফিন পিরিয়ড শেষের ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেল। ক্ষুদে
শিক্ষানবিশরা সবাই চলে গেল নিজ নিজ ক্লাসে। আর মাত্র দুটি ক্লাস, তারপরেই ছুটি।
দপ্তরী ছুটে এলো এবং বসে পড়লো আপনার পাশে।
সেই সাথে কৈফিয়ত দিতে ভুলল না দেরির জন্য- কেননা সে আপনাকে বলেছিল একটু পরেই ফিরে
আসবে। তাকে হাসি মুখে গ্রহণ করুন।
তারপর আরেকটি ঘণ্টা পড়ার আগ পর্যন্ত সে আপনার সাথে গল্প করবে। এবার আপনি তাকে বলুন
আপনার শহরের জীবন চলার কথা- শহরের কথা। সে আগ্রহী শ্রোতা হয়ে সবকিছু শুনবে, বলবে-
শহীদ মিনার-স্মৃতিসৌধে গিয়েছিল, চিড়িয়াখানা দেখেছে কিংবা ফার্মগেটের মোড়টা ঘুরে
এসেছে কয়েকবার। তারপর আফসোস করবে, অনেকদিন রাজধানী শহরে যাওয়া হয়নি। আপনি বলবেন,
সেখানে কত নিত্য নতুন জিনিস গড়ে উঠেছে; কতশত উঁচু দালানকোঠা, প্রশস্ত রাস্তাঘাট,
ফ্লাইওভার পর্যন্ত তৈরি হয়েছে। সে অবাক হবে, গর্বে তার বুকটা ভরে যাবে এই ভেবে যে
তার দেশ আজ কতটা এগিয়ে গেছে। তারপরেই তার চোখ দুটিতে নেমে আসবে বিষণ্ণতা। সে হয়ত ভাববে, তার দেশ আজ ঠিকই উন্নত হয়েছে, কিন্তু তাদের অবস্থা সেই একই রয়ে গেছে। আজও
প্রতিবেশীর ঘরে শিশুদের মাঝে কান্নার রোল উঠে অন্নের জন্য। কৃষকেরা সেই আগের মত
লাঙ্গল কাঁধে জমি চাষ করতে যায়। বৃষ্টির দিনে এখনও তাদের কুটিরের চাল চুইয়ে পানি
পরে। এখনও সামান্য বিষয় নিয়ে প্রতিবেশীরা ঝগড়া বিবাদ চেঁচামেচি গালিগালাজ করে। ঠিক
একই রকম- কোন পরিবর্তন নেই।
এবার আপনাকে সে আমন্ত্রণ জানাবে স্কুল
পরিদর্শনের। মাস্টার মশাইরা যে আপনাকে পেলে ধন্য হবে, বারবার বলবে সে কথা। ছাত্র-ছাত্রীদের
সম্বন্ধে বলবে, ওরা দুষ্ট কিন্তু সবাই খুব ভালো। ওদের চরিত যে আপনি আগেই জেনে
গেছেন সে কথা বলার প্রয়োজন নেই। তারচেয়ে চলুন আরেকবার ঘুরে আসি।
প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের অফিস রুমের একটি চেয়ার
টেনে আপনাকে বসতে বলে একছুটে সে বেড়িয়ে যাবে খবরটি তাকে জানানোর জন্য। ফিরে এসে
হাতের ঘড়ির সময় একবার দেখে ঘণ্টা বাজাবে। আরেকটি ক্লাস শেষ হল। এবার সে এসে দাড়িয়ে
পড়বে আপনার পাশে। একটু পরে চলে আসবেন মাস্টার মশাই।
প্রধান শিক্ষক মহোদয়ের সাথে কুশল বিনিময় এবং
পরিচয় পর্ব সেরে ফেলুন। দপ্তরী লোকটি কোন ফাঁকে বেড়িয়ে যাবে আপনি টেরই পাবেন না।
পাঁচ মিনিট পর সে যখন ধূমায়িত চা-বিস্কিটের ট্রে হাতে ফিরবে তখন এদের সৌজন্য বোধে
মুগ্ধ হয়ে যাবেন আপনি। চায়ের চুমুকের ফাঁকে ফাঁকে চলা বৃদ্ধ শিক্ষক মশাইয়ের সাথে আলাপচারিতা
আপনাকে পরিতৃপ্ত করবে। সে এবার আপনাকে নিয়ে আসবে পাশের রুমে, সেখানে অন্যান্য
শিক্ষকদের পাবেন আপনি। সবার সাথে কুশলাদি সেরে প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের পিছু পিছু
চলে আসুন ছাত্রদের ক্লাসরুমে।
দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্লাসরুমে শিক্ষক মহাশয়ের
পিছনে ঢুকে পরুন। আপনার পিছে দপ্তরীও আছে। ক্ষুদে ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই দাড়িয়ে
পড়েছে, স্যার বসতে বললে বসে পড়বে; কিন্তু সবগুলো চোখের দৃষ্টি তাকে ছাড়িয়ে আপনার
উপর নিবদ্ধ হবে। ছাত্রদের সাথে পরিচয় পর্বটা তিনিই সেরে ফেলবেন। ওদের কেউ কেউ
আপনাকে আমগাছ তলায় দেখে থাকতে পারে। যা হোক, বিব্রত না হয়ে হালকা কথাবার্তা বলুন সবার সাথে। ওরাও আপনাকে ছোট্ট
সুন্দর মুখের মিষ্টি হাসি ফিরিয়ে দিবে। পড়াশোনা নিয়ে দু চারটে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা
করুন, এই যেমন- এ্যালিফ্যান্ট কিংবা হর্স অর্থ কি। ওরা কেউ কিন্তু গরু অথবা গাধা
বলবে না ! আরেকটি বিষয় আপনি খেয়াল করে থাকবেন, ছোটরা সবাই চুপচাপ বসে আছে, কেউ
অন্যজনের সাথে কথা বলছে না কিংবা দুষ্টুমি করার চেষ্টা করছে না। সবাই কত শান্ত
সুবোধ! অথচ এই ক্লাসটিকেই আপনি দেখেছিলেন সবচেয়ে বিশৃঙ্খল অবস্থায়।
অন্য দুটি ক্লাস পরিদর্শন শেষে প্রধান
শিক্ষকের সাথে তার অফিস রুমে চলে আসুন। সে আপনার সাথে গল্প করার ফাঁকে স্কুল ছুটির
ঘণ্টা বাজবে। আপনি চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াবেন, কিন্তু সে বারবার অনুরোধ করতে
থাকবে তার গরিব কুটিরে আথিতিয়তা গ্রহণের। আপনি বিনয়ের সাথে
প্রত্যাখ্যান করে বিদায় নিয়ে পা বাড়াবেন দরজার দিকে- অনেক দেরি হয়ে গেল যে। চলুন, আপনাকে নদী-পাড় পর্যন্ত এগিয়ে দেই।
আপাত বন্ধু এখানেই বিদায়।
কিন্তু আমি আরও অনেকটা সময় বসব নদী পাড়ে।
দুপুরের রোদে চিকচিক করছে নদীর স্বচ্ছ পানি।
নদীও পরিপূর্ণ- কানায় কানায় ভর্তি। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, সে বাতাসে সৃষ্টি হচ্ছে
ঢেউ শান্ত জলরাশিতে। একটি ঢেউয়ের উপরে আরেকটি আছড়ে পড়ছে, সেখানে আবার সৃষ্টি হচ্ছে
নতুন ঢেউ। ঢেউগুলো যেন অনবরত পাল্লা দিয়ে ছুটছে বাতাসের সাথে। চিকচিক জলরাশির নিচে
কতশত জলচর প্রাণী-মাছ ছুটে চলছে, কিন্তু কেউ লক্ষ্য করছে না- তাদের মাথার উপর
বিশ্ব ব্রক্ষান্ডের অসীম দুটো শক্তির কি সুন্দর খেলা চলছে। আবার এ দুটোই যখন
মহাপরাক্রমশীলতার রুদ্র মূর্তিতে নেচে উঠে তখন সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর করাও সাধ্য নেই
নিয়ন্ত্রণের। তারপরেও মাঝি তার তরী নদীতে ভাসায়, বাতাসে ছিঁড়ে যেতে চায় নৌকার পাল, বিশাল ঢেউ গ্রাস করতে চায়- শক্ত হাতে
হাল ধরে মাঝি, অবশেষে পৌঁছে যায় গন্তব্যে।
সৃষ্টির শক্তি গুলোকে পরিবর্তনের সাধ্য নেই মানুষের, নেই নিয়ন্ত্রণের- কিন্তু সে
শক্তিগুলোকে জয় করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তাই মানুষ কে দিয়েছেন। বস্তুত, এই জয় করার
মধ্য দিয়েই তাকে বেঁচে থাকতে হয়।
আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত অশিক্ষা-অজ্ঞানতার
অন্ধকার জয় করতে পারব না, আমারা ততক্ষণ পর্যন্ত সভ্যতার আলোর মুখ দেখার আশা করতে
পারি না। আমারা তাই পারি না নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের।
স্কুল ঘর এখন ফাঁকা। ক্লাসরুমগুলোতে তালা
ঝুলছে। শূন্য মাঠে ঘাস খেয়ে চলছে দুটো গরু। জাতীও পতাকাটি উড়ছে আগের মতই- কিন্তু
কেমন যেন বিষণ্ণ। প্রাণের যে কোলাহল তাকে মাতিয়ে রেখেছিল, তারই অনুপস্থিতিতে
বিষণ্ণ সে। কিন্তু একই সাথে সে গর্বিত হতে পারে কেননা কতশত আলোকিত প্রাণ এখানে
জন্ম নিয়েছে এবং নিবে। তারাই একদিন সমাজের সব অন্ধকার দূর করতে পারবে। সে এ ভেবে
গর্বিত হতে পারে, যে স্থানটিতে সৃষ্টিকর্তার আরাধনার জন্য ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো সমবেত
হয়- সে মসজিদ মন্দির গির্জার পরেই জগতে সে সবচেয়ে পবিত্র তীর্থভূমি।
মনে পড়ে, মা যেদিন নতুন পোশাক পড়িয়ে, মাথায়
তেল দিয়ে সিঁথি কেটে বর্ণমালার একখানা বই-স্লেট হাতে ধরিয়ে, কপালে চুমু এঁকে,
‘কারও সাথে দুষ্টুমি করবে না, ঠিক মত পড়াশোনা করবে, মাস্টার মশায়ের কথা শুনবে’
উপদেশ দিয়ে স্কুলে পাঠাল- সেদিনের কথা।
খুব ছোট ছিলাম। স্কুল সম্বন্ধে কোন ধারণাই
আমার ছিল না, কেননা, আমার বেড়ে উঠার গণ্ডি ছিল সীমিত এবং ইতিপূর্বে কখনও স্কুলে
যাইনি-দেখিনি। পাড়ার এক বড় ভাইয়ের হাত ধরে মাইল তিনেক পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে এসে
উপস্থিত হলাম। এখানে এসে সবকিছু বুঝতে পারলাম। মাস্টার মশাই আমার নাম ঠিকানা জেনে
নিয়ে ইয়া বড় এক খাতায় টুকে নিলেন, ব্যস আমি ভর্তি হয়ে গেলাম স্কুলে।
আমাকে নিয়ে আসা হল আরেকটি কক্ষে। সেখানে
সমবয়সী অন্যদের পেলাম, জানলাম ওরাই আমার সহপাঠী এবং সবাইকে একত্রে মাস্টার মশাইয়ের
কাছে পড়তে হবে। মায়ের উপদেশ মেনে দিব্যি পাঠে মন দিলাম।
তবে মজার ঘটনা ঘটলো এর কিছু দিন পরেই। মায়ের
হাত ধরে যেদিন বর্ণমালার প্রথম বর্ণ শিখলাম এবং শিক্ষকের হাত ধরে যখন পূর্ণতা হতে
চলছে, এমন সময় একদিন শুনতে পেলাম- স্কুলে আমাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। জীবনের প্রথম পরীক্ষা। মা শিখিয়ে দিলেন, ‘তোমাকে প্রশ্নপত্র দেয়া হবে এবং সেখানে যা যা বলা হবে সব খাতায় সুন্দর
ভাবে লিখবে’- ব্যাস এটুকুই। আমিও সুবোধের মত খাতায় প্রথমে নাম-শ্রেণী-রোল লিখে
প্রশ্ন হাতে নিয়ে একবার পড়ে লিখতে বসলাম- প্রশ্নপত্র হুবহু কপি করে তুলে দিয়ে
আসলাম পরীক্ষার খাতায়! একবারও চিন্তায় এলো না, প্রশ্নপত্রের প্রশ্নগুলির উওর খাতায়
লিখতে চাওয়া হয়েছে। ফলাফল, জীবনের প্রথম পরীক্ষায় বড় বড় দুটো রসগোল্লা পাওয়া!!
তারপর একটু একটু করে বড় হতে লাগলাম এবং পার
হতে লাগলাম একটির পর একটি ক্লাস। সেই সাথে ক্ষুদ্র আমার জ্ঞানের পরিধি বাড়তে লাগলো
অল্প অল্প করে। জগতের সবটুকু সৈন্দর্য ধরা দিতে চাইলো আমার চোখে। প্রশ্নগুলোও একে
একে তৈরি হতে লাগলো মনের আঙ্গিনায় ভেসে। আসলে সেটিই ছিল আমার শুরু।
এই সেই স্কুল, যে স্কুলের ছাত্র ছিলাম আমি
অনেক-অনেকগুলো বছর পূর্বে। ঐই আমগাছ আমার সময়েও ছিল, কিন্তু নদী ছিল খানিকটা দূরে।
ভাঙ্গা গড়ার খেলায় এখানে চলে এসেছে, কিন্তু ঠিক আগের মতই আছে নদী। অবশ্য নদী
প্রশস্ততায় ছিল এখনের চেয়ে অনেক বেশী, সেই সাথে প্রচণ্ডতায়। অদূরে, ডানপাশে
কংক্রিটের যে সেতুটি তৈরি করা হয়েছে নদীর উপরে, সে ব্রিজটি সে সময় ছিল না- ছিল ঘাট
পাড়। সে ঘাট-পারে কত বিচিত্র নমুনার নৌকা
দাড়িয়ে থাকত। ছোট ছোট দোকানও ছিল অনেকগুলো। আর সবচেয়ে বেশী ছিল মানুষ। ছোট বড়
মাঝারি- কত বিচিত্র পোশাকের মানুষগুলি। তাদের সাথে থাকত নানা রকমের জিনিসপত্র। মা
আমাকে খুচরো পয়সা দিতেন খিদে লাগলে কিছু কিনে খাওয়ার জন্য, কিন্তু আমি কিছুই
কিনতাম না। টিফিন পিরিয়ডে পয়সাগুলো নিয়ে সোজা চলে যেতাম ঘাট পাড়ে- চেপে বসতাম ওপাড়
যাওয়ার নৌকায়। নৌকা যখন মাঝ দরিয়ায় চলে যেত, ভয়ে কাঁপন ধরত আমার ছোট্ট বুকে। বিশাল
বিশাল ঢেউয়ে নৌকা যদি ডুবে যায়, যেভাবে দুলছে! কিন্তু আমার এ ভয় ছাড়িয়ে অদ্ভুত
শিহরন জাগত মনে, যে শিহরনের সাথে পরিচিত ছিলাম না কোন কালে। আজ বুঝতে পারি এ
শিহরনের নেশায় ঘর ছাড়ে মানুষ।
কতদিন বই-খাতা-স্কেল ফেলে নদীর এ পাড়ে বসে
ভেবেছি, ঐই যে, ওপাড়ের দূরের তালগাছটি, ছোট ছোট বাড়িগুলো কিংবা নদীর বিশাল চরে ঘাস
খাচ্ছে গরুর পাল- কত দূরে সেগুলো, কোনদিন আমি সেখানে যাইনি। সেখান থেকে আরও
দূরে... অনেক দূরে... সেখানে আরও অনেক বাড়িঘর
আছে, মানুষ আছে- নদী আছে...।
তাই যেদিন নদীর ওপাড়ে প্রথম পা রাখলাম- মনে
হল, বিশ্বজয় করে ফেলেছি। মাকে বলা যাবে না, ধমক লাগাবেন। প্রথম দিকে ঘাট পাড়ে ঘুরে
ফিরেই সন্তুষ্ট থাকতাম। দূরে যেতে ভয় লাগত। কিন্তু পরে দূরের পথগুলো হেঁটে চলে
যেতাম বহুদূর পর্যন্ত। তারপর ফিরে চলে আসতাম।
এভাবে নেশার মত হয়ে গিয়েছিল আমার, সেই সাথে
টিফিনের পরের ক্লাসগুলো মিস হতে লাগলো দিনকে দিন। টিফিনের ঘণ্টা পড়লে পুরো ক্লাস
যখন ফাঁকা হয়ে যেত, সেদিনের মত স্কুলকে গুডবাই জানিয়ে বই খাতা স্কেল হাতে চুপি
চুপি পালিয়ে যেতাম। তারপর নদী পাড়ি দিয়ে ওপাড়ে অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে স্কুল
ছুটির সময় ঠিক ঠিক বাড়ি চলে আসতাম। মা ঘুণাক্ষরেও জানতে পারত না, তাকে কোনদিন
বলিনি- মা, আজকে কত কি নতুন জিনিষ দেখে এসেছি- কত দূরে গিয়েছিলাম। বলতে পারিনি
আমার সে শিহরনের কথা।
কিন্তু একদিন ঠিকই ধরা পড়লাম মাস্টার মশাইয়ের
কাছে। নদীর ওপাড়ে ইতস্তত ঘোরাফেরা করছি, এমন সময়
যমদূতের মত হাজির হলেন মাস্টার মশায়। তিনি আমাকে, আমার বাবাকে এমনকি দাদার
খবর পর্যন্ত রাখতেন। কান ধরে সোজা নিয়ে এলেন স্কুলে, তারপর ক্লাসরুমে বসিয়ে দিয়ে
গেলেন এবং এও বলতে ভুললেন না, পরের বার আমাকে দেখলে বেতিয়ে পিঠের চামড়া তুলে
নিবেন। ব্যস, আমার ছোট্ট জীবনের রোমাঞ্চটুকু সেদিনের পর বন্ধ হয়ে গেল।
প্রায়শই নদী পাড়ে বসে থাকতাম, কখনও ক্লাস
পালিয়ে। বইয়ে চলা নদী, পাল তোলা নৌকা, সবই মুগ্ধ করত আমাকে। ওপাড়ের দূর দিগন্তের
দিকে তাকিয়ে থাকতাম, ঐ যে অনেকদূরে যে উঁচু তালগাছটি দেখা যাচ্ছে- সেখানে আমি ঘুরে
এসেছি কিংবা ঐই বাড়িগুলো, ওগুলোর পিছনে একটি রাস্তা আছে, রাস্তার পাশে একটি দোকান
আছে- সে দোকান থেকে আমি বাদাম কিনে খেয়েছি।
সবচেয়ে ভালো লাগতো বর্ষাকালে কিংবা বর্ষা
শেষে- নদী যখন কানায় কানায় পরিপূর্ণ থাকত। জোরে বাতাস উঠত যখন, সৃষ্ট হত বড় বড় ঢেউ
এবং ঢেউগুলো সশব্দে আছড়ে পরত ঠিক আমার পায়ের উপর। আমার ছোট্ট পা দুখান বারবার
ধুইয়ে দিত। চেয়ে থাকতাম ঢেউ গুলোর দিকে- কত কি ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। একবার দেখলাম
দুটো কলাগাছ, একবার পুরো একটা বাঁশঝাড়। গাছও ভেসে যেতে দেখেছি অনেকগুলো। একবার
দেখেছি পুরো একটি মৃত গরুর দেহ ভেসে যেতে। সেটিকে ঘিরে উড়ছে অনেকগুলো কাক এবং
শকুন। তবে সবচেয়ে অবাক হয়েছি শিশুক দেখে। ঢেউগুলোর মাঝখানে কালো কালো শিশুকের মাথা
ভুস করে ভেসে উঠত আবার পরক্ষণেই যেত
তলিয়ে। আমি অপেক্ষায় থাকতাম আবার কখন অগুলো ভেসে উঠবে। শিশুকগুলো ভেসে উঠত আবার
এবং ডুবে যেত- এভাবেই চলত তাদের খেলা। শিশুকগুলোকে নিয়ে কতকিছু ভাবতাম- কত ভয়ের
গল্প শুনেছি। কিন্তু আমার ভয় লাগতো না, দেখতে কালো এই যা!
এ নদী অতীতে যা ছিল, এখনও সেই নদীই আছে। স্কুল
ঘরটি আগে যেখানে ছিল এখনও সেখানেই আছে, কিন্তু হারিয়ে গেছে শিশুকগুলো। এখনও সে
ছোট্ট বেলার মত নদী পাড়ে বসে থাকি, কিন্তু সে দিনগুলির পর আর কোনদিন দেখা পাইনি
শিশুকের। সময়ের মিনিট-সেকেন্ড-ঘণ্টার অতল গহীনে হারিয়ে গেছে তারা... যেভাবে হারিয়ে
যাচ্ছি আমি, আপনি, সবাই।
মনে পড়ে, সহপাঠী সেই সব বন্ধুদের কথা। ওদের
সে সময়ের সৃতি এখন আর মনে নেই। মনে নেই মাস্টার মশাইদের কথা; কিন্তু সবাইকে নিয়ে,
এ স্কুলকে নিয়ে, ক্ষুদ্র আমির দিনগুলি ঠিকই চোখের সামনে ভেসে উঠে। বন্ধুদের সাথে কতদিন ঢিল ছোড়ার প্রতিযোগিতায় মেতেছি নদী পাড়ে। কতদিন জামগাছে চড়ে জাম খেয়েছি, আম খেয়েছি, ক্লাসরুমে বসে শিষ বাজিয়েছি কতদিন, দুষ্টামি করেছি, মাস্টার
মশাইয়ের কানমলা খেয়েছি!
বিকেলের স্বর্ণালী সূর্যটা যখন ওপাড়ের পথে
অস্তমিত যাবে, সেই যে অতীতের উঁচু তালগাছ বাড়িগুলোর মাথার উপর- আমি তাকিয়ে থাকব সে
অস্তমিত সূর্যের পথে। বসে বসে ভাববো...
শিশু বয়সে যখন সেখানে গিয়েছিলাম, মনে মনে তখন ভেবেছি- বাড়ি থেকে কত দূরে
চলে এসেছি, যদি হারিয়ে যাই, ফিরতে না পারি, মা খুব কান্নাকাটি করবে। আজ জীবনের কত
সহস্র হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়েছি, ঐই অস্তমিত সূর্যের পথ ধরে কত নদী-শহর-জনপদ
পেড়িয়ে গেছি, কতবার পরিচিত হয়েছি শৈশবের সে শিহরনের সাথে- কিন্তু সেই ছোট্ট আমিকে
আর পাইনি কোনদিন। সে হারিয়ে গেছে। পড়ে আছে তার ক্ষণকালের সৃতি আজকের আমির মাঝে। সে
সৃতির মাঝেই বেঁচে আছে সেদিনের সে জনপদ... সে নদী... তিনটি আমগাছ... এবং আমাদের
স্কুল।
(রচনাকাল- ২০০৬)