My Personal Blog ...

ফুলশয্যার দর্শনে ! - ২ ( শেষ অংশ )





ফুলশয্যার দর্শনে! - ১ ( প্রথম অংশ )

তালুকদারদের সাথে চৌধুরী বাড়ির বরাবরই একটা শীতল সম্পর্ক ছিল। গ্রামের মধ্য এ দু পরিবারই সবচেয়ে বিত্তশালী এবং এই বংশ-বিত্ত নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে আসছে অনেক আগ থেকে। অবশ্য চৌধুরীদের সবাই অনেক বছর আগে শহরে পাড়ি দিয়েছে, কিন্তু তারপরেও তাদের প্রভাব তালুকদারদের চেয়ে কোন অংশ কম নয় গ্রামে। কনক এগুলো জানত না। গ্রামে আসার কিছুদিন পরেই সে বুঝতে পারে। কিন্তু কনক একে পাত্তা না দিয়ে সহজ ভাবে মিশতে চেষ্টা করে তালুকদারদের সাথে। অবশ্য তারা মোটেই বন্ধু ভাবাপন্ন ছিল না এবং কনককে সবসময় এড়িয়ে চলত চৌধুরী বাড়ির একজন বলে।

সব কিছুই আশ্চার্যভাবে বদলে গেল। কনক অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, তালুকদার সাহেবের পাঁচ ছেলের প্রত্যেকে তার প্রতি হঠাৎই মনোযোগী হয়ে পড়েছে, সেই সাথে আগের মত এড়িয়ে না গিয়ে কথা বলছে বন্ধুত্বপূর্ণ সুরে। এটুকু হলে বোধহয় যথেষ্ট ছিল, স্বয়ং তালুকদার সাহেবও যখন দু বার এসে ঘুরে গেল কনকের বাড়ি থেকে- কনক সত্যি কথা বলতে কি ঘাবড়ে গেল! তার বুঝতে দেরি হল না, তাদের আদরের মেয়ের আবদার মেটাতে তারা প্রস্তুত হয়েই আছেন।

কিন্তু লাবিবার বাবা-মা কিংবা ভাইদের এ দৃষ্টিভঙ্গি কনকের ভাল লাগল না মোটেই। আসলে এ ধরনের চিন্তা কখনই করেনি সে। এখানে এসেছে স্রেফ পরিবর্তনের জন্য। নিজের কাজগুলিকে একান্ত নিরিবিলিতে গুছিয়ে নেয়া যাবে এই ফাঁকে। কতদিন থাকবে- বড় জোর দেড়-দু বছর। তারপরেই ফিরে যাবে শহরে, তার চিরচেনা জীবনে। সেখানে বছর খানিক কাটিয়ে আবার না হয় ফেরা যাবে গ্রামে। দুটো ভিন্ন জীবনধারার স্বাদ পাশাপাশি পরখের ইচ্ছা তার। এখানে এসে গ্রামের ছেলেদের হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে আত্মনির্ভরশীল করার অনুপ্রেরণায় নিজ উদ্যোগে পোলট্রি, ডেইরী ফার্ম, নার্সারি কিংবা মাছের চাষ করেছেসেখান থেকে লাভও পাচ্ছে ভালোই...সবাই হয়তবা ভেবে বসে আছে, তালুকদার সাহেবের মেয়েকে বিয়ে করে কনক এখানে স্থায়ীভাবে থেকে যাবে। না, না, কখনও নয়এ মেয়েকে বিয়ে বিয়ে করলে জীবন তেজপাতা করে ছাড়বে! একদিন তাই লাবিবাকে বলল, ‘দেখ, তুমি আমার এখানে সবসময় আস, রাস্তায় সবার সামনে আমার পিছু নাও, বক্রোক্তি কর- আর গাঁয়ের লোকে নানান মুখরোচক গল্পে মেতে উঠে, যা প্রায়শই আমাকে বিব্রত করে। তাছাড়া... তুমি নিজেই বুঝতে চেষ্টা কর, তোমার এ আচরণ কিংবা এভাবে কারণে-অকারণে এখানে চলে আসা কি ঠিক? আমি মেয়ে হলে অবশ্য কথা ছিল না...’ একটু থেমে লাবিবার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি বা তোমরা যা ভাবছ তা ঠিক না...। তাই বলছি, তুমি কিছু মনে কর না, কিন্তু তুমি আমাকে বিরক্ত বা এখানে এস না’। এটুকু বলেই কনক মাথা নিচু করে বসে রইল।

এ বিশাল প্রত্যাখ্যানে লাবিবা কনকের পাশে দাঁড়িয়ে রইল পুরো তিন মিনিট। কনক মাথা নিচু করে বসে আছে তো বসেই আছে- নইলে দেখতে পেত, দু চোখের পানি ফোঁটায় ফোঁটায় গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লাবিবারতারপর সে নিজেকে সংযত করল, বলল, ‘ তোমাকে আমি ভালবাসি’। এই প্রথম আপনি থেকে তুমি ব্যবহার করেছে সে। কয়েক সেকেন্ড বিরতি দিয়ে বলল, ‘ একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আমার এ ভালবাসা পৃথক করতে পারবে না’- বলে কোনোদিকে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল সে। কাজের মেয়েটি আজ তার সাথে আসেনি।

পরে আরেকজনের কাছে কনক শুনতে পেল বাকি ঘটনাটুকু। এখান থেকে একছুটে লাবিবা চলে যায় রেল লাইনে। সেখানে পাক্কা দু ঘণ্টা বসে থাকে লাইনের উপর। কিন্তু ট্রেন না আসাতে হতাশ হয়ে অন্য পন্থা খুঁজতে থাকে। মাঠে একটি গরু ঘাস খাচ্ছিল আপন মনে। লাবিবা দৌড়ে সেখানে যায় এবং গরুর গলার দড়ি খুলে নিয়ে উঠে পড়ে পাশের আমগাছে। রাখাল সব দেখতে পেয়ে চিৎকার শুরু করে এবং তার চিৎকারে দু জন গ্রামবাসী এসে উদ্ধার করে লাবিবাকে। পরপর দুটো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ার পর নিজের কপালকে দোষারোপ করা ছাড়া কিছুই করার ছিল না লাবিবার।

কিন্তু এর পরেই একদম চুপচাপ বনে যায় লাবিবাগ্রাম ওর পদচারনায় আগের মত মুখর হয় না। যদি কখনওবা কনককে দেখতে পেত, তবে দূরে দাঁড়িয়ে যেত- আগের মত তার পিছু নিত না। তারপর একটুখানি সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে চলে যেত।

গ্রামবাসী সবাই বেশ মর্মাহত কনকের আচরণে। লাবিবা তাদের প্রাণপ্রিয়, কনককেও সবাই ভালবাসেতাই দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে চেয়েছিল সবাই, উল্টো যখন সেটা বিয়োগফল হয়ে গেল, চুপসে গেল প্রত্যেকে। কয়েকজন তো রীতিমত ক্ষেপে উঠল কনকের উপর। অন্যরা সমবেদনায় মুখর হয়ে রইল লাবিবার।

এর কিছুদিন পর কনকের বাবা-মা চলে এলো গ্রামে। লাবিবার কানেও যেন পৌঁছে গেল সংবাদটি। অনেকদিন পর সেও চলে এলো কনকদের বাড়িতে। কনকের দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসল শুধু, তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল দুই বুড়ো-বুড়ি নিয়ে।

কনকের বাবা-মা লাবিবাকে নিয়ে এমন মেতে উঠল যে ভুলে বসল ফেরার কথা। কনকের জন্য অবশ্য তা ভালোই হল। কনক চায় তারা কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে থাকুক; শহরের ব্যস্ততাকে কিছুদিনের জন্য ছুটি দিক।

কিন্তু ঐই বুড়ো-বুড়ি দুজন কনকের জীবনটাকেই ছুটি দেয়ার ব্যবস্থা করল। এরপর কনক আর কনক থাকবে না, স্রেফ মরে যাবে- পড়ে থাকবে জড় মাংসের দেহটা বৌয়ের অত্যাচার সহ্য করার জন্য! তার বাবা-মা তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ করে পাকা কথা দিয়ে এলো তালুকদার সাহেবের বাড়ি গিয়ে। সামনের শুক্রবার আংটি বদল এবং তার পরের শুক্রবার বিয়ে। একেবারে পাক্কা কথা।   
  
কনকের বাবা-মা তালুকদার বাড়ি গিয়ে ‘পাকা কথা’ দিয়ে আসার পরদিন থেকেই লাবিবা আবার আগের মত হাসিখুশি এবং গ্রামময় ঘুরে বেড়াতে লাগল। কনক কিন্তু লজ্জায় আর অভিমানে দুদিন বাড়ি থেকে বের পর্যন্ত হল না। তৃতীয় দিন পুকুরের মাছগুলি দেখতে যেতেই বিপত্তি বাধল। লাবিবা এ দুদিন ওদের বাড়িতে আসেনি, তাই দেখা হয়নি দুজনের। সেদিন পুকুরপাড়ের রাস্তায় একদম সামনা-সামনি দেখা হল দুজনের। কনককে দেখে ঠোঁট উল্টিয়ে বিদ্রূপের হাসি হাসল লাবিবা, তারপর সেই বিখ্যাত ভেংচি কেটে চলে গেল রাস্তা ধরে। যাবার পথে পাঁচবার পিছে ফিরে চাইল- প্রতিবারেই কনক দেখতে পেল সেই বিদ্রূপমাখা পিত্তি জ্বালানো হাসি। 

আংটি বদলের আগের দিন পর্যন্ত এ ‘পিত্তি জ্বালানো’ হাসি হজম করতে হল কনককে কয়েকবার। তারপর আংটি বদল হল এবং তার পরের দিনেই লাবিবা কনকের পিত্তিতে আগুন ধরিয়ে দিল এবং কনক পালাল তার আপুর বাসায়- রাঙ্গামাটিতে।

অনেক রাত হয়েছে- এবার উঠা দরকার। গিটার হাতে উঠে দাঁড়ালো কনক। ভোরেই ছুটতে হচ্ছে তিনশো মাইল দুরের গ্রামের বাড়িতে। একটা ঘুম দরকার।


                                                
       

তালুকদার বাড়ি এবং চৌধুরী বাড়িতে আজ খুশির জলসা বসেছে এবং তাদের ঘিরে পুরো গ্রামবাসী নাচছে ধেই ধেই করে। তারা নাচবেই বা না কেন, অনেক ঘটনা-পরি ঘটনার শেষে আজ মধুর সমাপ্তির অনুষ্ঠান হচ্ছে। সে অনুষ্ঠানে একবার নয়, দু দুবার করে দাওয়াত পেয়েছে গ্রামবাসী।

‘তোকে আমরা আমাদের চিরকুমার সভার সভাপতি বানালাম, আর তুই কিনা...’।
‘আমাদের কি হবে!’
‘শালা, একশ ইঁদুর মেরে এখন ধ্যানী সেজে বসে আছিস’।
‘ওর পাছায় দুটো কিক লাগা। শালা আমাদের ছেড়ে এই মতলব নিয়ে গ্রামে এসেছিল’।
‘দোস্ত, আমারে বলতা, শহরের সবচেয়ে সুন্দর মাইয়াডা তুমারে আইন্যা দিতাম’।

বন্ধুদের মন্তব্য গুলো শুনছে কনক জানালার পাশের চেয়ারে বসে। সকালেই সবাই এসেছে কনকের বিয়েতে যোগ দিতে। এখন বসে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছে কনকের রুমেজানালা দিয়ে বাড়ির অনেকাংশ দেখা যায়। সেখানে, সবাই ছুটোছুটি করছে। সদর দরজার সামনে রাস্তার দু পাশে বর্ণিল পতাকায় সাজানো হয়েছে। ইলেকট্রিক মিস্ত্রিরা এসে ডেকোরেশনের লাইট বসিয়ে গেছে আগেই। দুলাভাই-আপাকে গেটের কাছে বার দুয়েক দেখতে পেল। ছোট্ট ইভা হাতে বেলুন নিয়ে নেচে বেড়াচ্ছে খালার সাথে। পটকা ফোটানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে থেকে থেকে।

দুপুরের পরপরই বরপক্ষ রওনা হয়ে গেল কোনে বাড়ির উদ্দেশ্যে। গন্তব্য খুবই কাছে, তাই শুধুমাত্র বরের জন্য চৌধুরী বাড়ির প্রাচীন ঐতিহ্য স্বরূপ একটা ঘোড়ার গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যরা সবাই পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। দশ মিনিট পরেই সবাই পৌঁছে গেল কণে বাড়িতে।

বিয়ে বাড়ির গেটে ওদের সবাইকে আপ্যায়ন করা হলতারপর ফিতে কেটে বেলুন উড়িয়ে বরের পিছু পিছু প্রবেশ করল সবাই। দুজন ক্যামেরাম্যানকেও দেখা গেল ঘুরে ফিরে সবকিছু ভিডিও করতে।
বিয়ে পড়ানোর আসল কাজ কনে বাড়িতেই সম্পন্ন হবে। কাজী সাহেব আগেই এসে বসে আছেন। তালুকদার বাড়ির মেয়ের বিয়ে বলে কথা, আবার বর কিনা চৌধুরী বাড়ির- তাকে আগে আসতে হয় বৈকি।

বিয়ে পড়ানোর মজলিসে বর-কনেকে ঘিরে বসে আছে সবাই। বর মুখে রুমাল চেপে এবং কনে একহাত ঘোমটা টেনে পাশাপাশি বসে আছে। ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’- বলে কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানোর কাজ শুরু করল।

‘কবুল’ শব্দটি উচ্চারণে বর মহাশয় দু বার ঘামল, তিনবার ঢোঁক গিলল। কনে কিন্তু অতি সহজেই বলে ফেলল। একই সাথে পুরো গ্রামবাসী বলে উঠল- ‘আলহামদুলিল্লাহ্‌’।
এরপর দু ঘণ্টা ধরে চলল খানা পিনার পর্ব। কনেকে পাশে বসিয়ে বর একটু একটু খেয়ে চলেছে রীতিরক্ষার খাতিরে। ওদের দুজন কে ঘিরে বসে আছে বরের বন্ধুরা সবাই। বন্ধুদের কেউ কেউ টেবিলের নিচ দিয়ে খোঁচা মারছে বরের পায়ে। বর বেচারা লাজুক মুখে সবকিছু সহ্য করে চলছে, অন্য সময় হলে...।

কান্নাকাটির পর্ব চলল আরও একঘণ্টা ধরে। কনক ভেবে পেলনা, এত কান্নাকাটি যখন, বিয়ে করার কি দরকার ছিল কনককে। তাকে কারেন্ট জালে আটকে ফেলে এখন আবার কান্নাকাটি হচ্ছে লাবিবার। এযে মাছের মায়ের রীতিমত পুত্রশোক!

সন্ধ্যার পরেই কনে নিয়ে রওনা হয়ে গেল সবাই। তাদের আসার পূর্বেই সে খবর পৌঁছে গেছে বাড়িতে। বিয়ে বাড়ির গেটের কাছে দৌড়ে সবাই হাজির হল কনে দেখবে বলে। যদিও ‘কনের দর্শন’ তাদের প্রতাহই করতে হয়, কিন্তু এ দুটো দেখা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

না, প্রথমেই মুরুব্বীরা কাউকে কনে দর্শন করতে দিল না। কিছু নিয়ম রীতি পালন করা হল, তারপর একগুচ্ছ ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে ধরা হল কনের মুখের সামনে- উঁচু ঘোমটাও সরিয়ে ফেলা হল।
‘বাহ, বাহ, অপূর্ব!’ – সবাই কনের প্রশংসায় মুখর। কনকের মনে হল সবাই বাড়িয়ে বলছে! একবার দেখবে নাকি সে, নাহ, থাক। নতুন বৌকে নিয়ে মেতে উঠল সবাই। তারপর থাকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয়া হল ফুলশয্যার ঘরে।

কনক বসে আছে বন্ধুদের নিয়েইতিমধ্যে কনকের আপা এসে দুবার তাগাদা দিয়ে গেছে, কিন্তু যাচ্ছি যাচ্ছি বলেও কনক উঠার নাম করছে না। বন্ধুদের কারও বিয়ের অভিজ্ঞতা হয়নি, তবু তারা অকাতরে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে কনককে অভিজ্ঞজনের মত। হাসি-রস-ঠাট্টার কথা বলছে তাকে নিয়ে।

কনকের মনোযোগ কিন্তু নেই বন্ধুদের দিকে। সেই দুপুরের পর থেকে একই কথা ভেবে চলেছে- বিয়ে তাহলে হয়ে গেল! এতদিন বাবা-মায়ের দাবড়ানি খেয়েছে, এখন এর সাথে যোগ হবে বৌয়ের। এখন থেকে উঠতে-বসতে-শুতে বৌয়ের নাকানি-চুবানি খেতে হবে। রাত করে বাড়ি ফেরা যাবে না, না বলে কোথাও  যাওয়া যাবে না, এ কাজ কেন করেছ- সে কাজ কেন করলে, ঐই মেয়ের দিয়ে কেন তাকিয়েছ- ইত্যাদি শুনতে বাকি জীবনটাই পার করে দিতে হবে। আহা, বেচারা কনক! আজকেই বিয়ে নামা মানে মৃত্যু নামা লেখা হয়েছে তোমার। এখন যাও, বাসর ঘর নামক কফিনে চুপচাপ ঢুকে পর- সেখানে আজরাইল প্রতীক্ষায় আছে ‘জান’ কবজের!

আপা এসে আরেকবার তাগাদা লাগালে কনক দুর দুর বুকে উঠে পড়ল। বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে চুপচাপ রান্নাঘরে চলে এলোচারপাশ একবার দেখে পকেট হাতড়ে পাঁচ মিলিগ্রামের ডায়াজিপাম ট্যাবলেট বের করল দুইটা। এক গ্লাস পানি নিয়ে ট্যাবলেটগুলো গিলে ফেলল। সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এক ঘুমেই পার করে দিবে ফুলশয্যার রাত।

বাসর ঘরের দরজার কাছাকাছি হতেই দুলাভাইয়ের দেখা পেয়ে গেল কনক। দুলাভাই তার দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘ তা শালাবাবু, বাসর ঘরে যে বেড়ালটা ঘাপটি মেরে বসে আছে, ম্যাও ম্যাও করার আগেই ওর গলা টিপে ধরো কিন্তু!’

‘ জি স্যার!’- বলে কনকও হাসি ফিরিয়ে দিল দুলাভাইকে।

ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল কনক। ছোট্ট ইভা, কনকের ছোট বোন এবং আরও কয়েকটি মেয়ে কনেকে ঘিরে বসে আছে। তাকে দেখে সবাই হাসি মুখে বেড়িয়ে গেল, ছোট্ট ইভা অবশ্য আবদার জুড়েছিল যাবে না বলে। তাকে বু ঝিয়ে সুঝিয়ে অন্যরা নিয় গেল।

সবাই চলে যেতে কনক দরজার খিড়কি তুলে দিল। প্রথমেই নিজের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত আঁটল- অবশ্য সে যতক্ষণ জেগে থাকে। ওষুধের ক্রিয়া যে শুরু হয়ে গেছে বুঝতে পারছে কনক। কেমন যেন ঘোর ঘোর ভাব তৈরি হয়েছে... মাথা ঝিমঝিম করছে, সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় সবকিছু কেমন যেন অন্যরকম ঠেকছে তার কাছে। আসলে, গতরাতে ঘুমাতে পারেনি সে, তার উপর সারাদিনের ধকল-টেনশন, এর উপর আবার এই ওষুধের প্রভাব হয়তবা একটু বেশিই পড়েছে। ড্রেসিং টেবিলের উপর পিরিচে ঢাকা পানির জগ-গ্লাস ছিল। বার তিনেক চোখ মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে দৃষ্টির স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করল সে। তারপর এক গ্লাস পানি গিলে প্রবেশ করল ফুলের মালা দিয়ে ঘেরা সে জায়গাটিতে, যেখানে একহাত ঘোমটা টেনে চুপচাপ বসে আছে লাবিবা।

সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নিল মনে হচ্ছে কনকের কাছে। মখমলের মত নরম বিছানা- তার উপর বড় বড় ফুল আঁকা লাল চাঁদর, সেখানে অজস্র গোলাপের পাপড়ি, সারি সারি ঝোলানো গোলাপ-গাঁদা-বেলি ইত্যাদি ফুলের মালা, মাথার উপরে ফুলের মালার সারির মাঝে বাঁধা রং বে রঙ্গের বেলুন... এবং ঠিক তার মাঝখানে সোনালী শাড়ির চিকচিক করা আঁচলে ঢাকা রক্ত- মাংসের মেয়েটি।
কনকের হঠাৎই ইচ্ছা হল ঘোমটাখানি সরিয়ে ফেলতে। কি দেখবে সে? শতবার দেখে সে একই দুষ্টুমি ভরা মুখ, নাকি অন্যকিছু?

সেই অন্যকিছু কনক আর ভাবতে পারল না কিংবা ভাবতে চাইল না। নিজের অদম্য ইচ্ছার তাগিদ পূরণে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল ঠিক কনের সামনা সামনি। লাবিবার থেকে এতটা আশা করেনি সে, ঘোমটা খুলে, শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে, এতক্ষণ তার উপর ঝাঁপিয়ে পরে নি কেন সেটাই আশ্চর্য কথা! তাই এই অন্যকিছুর প্রত্যাশায় বাম হাত দিয়ে লাবিবার ঘোমটা সরিয়ে ফেলল কনক।

লাবিবা চোখদুটো কোলের উপর নামিয়ে রেখেছে- দৃষ্টিতে সেখানে তার মেহেদীর আলপনায় শৈল্পিক হাত দুটো। কনক ঘোমটা সরানোর পরেও এভাবে মাথা নিচু করে চেয়ে রইল সে। কনক লাবিবার থুতনি হাত দিয়ে উঁচু করে ধরলে সে চোখ বন্ধ করে ফেলল পাঁচ সেকেন্ডের জন্য, তারপর চোখ খুলল এবং চাইল ঠিক কনকের চোখে চোখ রেখে।

লাবিবার চোখের দিকে চেয়ে বিশাল এক ধাক্কা খেল কনক। তার মনে হল, পাঁচশো কিমি. বেগে ছুটে আসা ট্রেন তাকে ধাক্কা মেরে উড়িয়ে ভারত মহাসাগরে নিয়ে ফেলল। কিন্তু সেখান থেকেও সে চেয়ে আছে সন্মহিতের মত- লাবিবার চোখে চোখ রেখে।

এর বর্ণনা কনক কিভাবে দিবে। এত সাহিত্য চর্চা করছে, মাতৃভাষার সাথে গভীর ভাবে পরিচিত হয়েছে, কিন্তু সব মিলিয়ে তবুও এর বর্ণনা সামান্য মনে হল কনকের- লাবিবার এ চাউনি। প্রশান্ত  মহাসাগরের চেয়ে গভীরতা এ দৃষ্টির, আর গভীরতার সবটুকু জুড়ে আছে নিখাদ ভালবাসা। অব্যক্ত সে চাউনির ভালবাসাটুকু অর্জনে পথিক হাজারো মাইল পথ পাড়ি দিবে হাসিমুখে- মরুভূমির তপ্ত বালুকাবেলায় বারবার আছড়ে পড়বে, আবার উঠে দাঁড়াবে তারপর চলবে দ্বিগুণ উৎসাহে। কনক দেখেছে, দেখেছে সকালের সূর্যোদয় কিংবা দিন শেষে অস্তমিত সূর্যের আলোকচ্ছটার রূপের বন্যা, দেখেছে পাহাড়ের পাদদেশে সমুদ্রের বিশাল আছড়ে পরা ঢেউ কিংবা তার উপরে উড়ে চলা সহস্র অ্যালবাট্রাসের ঝাঁক, দেখেছে জ্যোৎস্নার পরশ নিয় অপরূপ রাতের ধরিত্রীকে- সবটুকুরই বিস্তৃতি আছে অসীম, কিন্তু গভীরতায় এ চোখের কাছে তুচ্ছ; এতটুকু ভালবাসা জগতের কোথাও নেই, যতটুকু ভালবাসা সমর্পণের জন্য অধীর হয়ে বসে আছে লাবিবা কনকের সামনে। বিধাতা নদীকে দিয়েছেন ভালবাসা, আর নারীকে সৈন্দর্যএ নদী যখন কোন নারীর হৃদয়ে বইয়ে চলে, তখন তার চোখদুটোতে খেলা করে চঞ্চল ভালবাসা; বিশ্ব ব্রক্ষান্ড তার সামনে নত হয়ে যাবে, সে আরেকবার বুঝে নিবে- বিধাতা সৈন্দর্য এবং ভালবাসার অপূর্ব সংমিশ্রণে তাকেই(নারী) তৈরি করেছেন তার প্রতিরূপ মানুষের(পুরুষ) জন্য।

সেই সৈন্দর্য এবং সমর্পিত ভালবাসার মুখোমুখি হলে যে কেউ নিজেকে হারিয়ে ফেলবে বারংবার- বিলীন করতে চাইবে এর মাঝে নিজেকে। তার সবটুকু ঘিরে নেচে উঠবে অজানা উল্লাস। তারপর সে জেগে উঠবে- জেগে উঠবে সেই অচেনা দ্বীপের মত একদিন যে ঘুমিয়েছিল অসীম সাগর তলে। তার বুকে ভালবাসার নরম পরশে গজিয়ে উঠবে বৃক্ষরাজি, বনে বনে পশুরা নেচে বেড়াবে, পাখিরা গাইবে, নীল সমুদ্রের বিশাল ঢেউ তার পায়ে আছড়ে পড়বেসে পুলকভরা দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে চাইবে, বলবে, ‘আমিই সেরা’। সমুদ্র বলবে, ‘তুমি নও, আমিই, কেননা আমিই তোমাকে জাগিয়ে তুলেছি, তুমি তো আমার বুকেই ঘুমিয়ে ছিলে’। তারপর সে বলবে, ‘হ্যাঁ, তুমিই আমাকে জাগিয়ে তুলেছ, আর আমি তুলেছি আমাদের; আবার তুমিই আমায় ডুবিয়ে দাও, আমি ডুবে যাই সবকিছু নিয়ে।

কনক নিজে মাঝে পুলক অনুভব করল। তার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবকিছু নিয়ে ডুবে যেতে চাইল এ অতল গভীর ভালবাসার মাঝে। নিজের সবটুকু তার বিলীন হয়ে যাক- সে বেঁচে থাকবে লাবিবার মাঝে। তার আজকের দেখা জ্যোৎস্নার ছায়াসঙ্গি অরণ্য, নদীর সবটুকু ভালবাসা নিয়ে তীরের বুকে আছড়ে পরা ঢেউ কিংবা অবাক সূর্যোদয়ের অগ্নিসাক্ষী সে দিগন্তের উপর উড়ে যাওয়া একঝাক পাখি, বসন্তের মাতাল সমীরণে পত্র-পল্লবের চুপচাপ ঝড়ে পরা, বর্ষায় ছাতিম গাছের ডালে ভেজা হলুদ পাখিটি- আগামীর দেখায় সে দেখবে লাবিবার অবাক দুটো চোখ দিয়ে। আজকের হলুদ পাখিটি আগামীর বর্ষায় এভাবেই ছাতিম গাছের ডালে চুপচাপ ভিজে যাবে, আজকের প্রশ্নের উত্তর সে আগামীতে পেয়ে যাবে, জানবে, সে পাখিটির ছোট্ট বুকেও এ পৃথিবীর চেয়ে বিশাল ভালবাসা আছে, তাইতো সে চুপচাপ বসে ভিজছে- কখন বৃষ্টি থামবে, উড়ে গিয়ে মাটি থেকে ছোট পোকাটি ঠোঁটে তুলে নিয়ে বাসায় ফিরবে, সেখানে তার প্রতীক্ষায় আমগাছের পাতার ফাঁকে টুপটাপ বৃষ্টির দিকে চেয়ে আছে অভুক্ত তিনটি ছানা... আগামীর সে ছানাগুলো বড় হবে, তাদের বুকে সঞ্চিত মায়ের ভালবাসাটুকু বেড়ে উঠবে। এ ভালবাসার জন্যই অনাগত দিনের কোন বর্ষায় ছাতিম গাছের ডালে বসে চুপচাপ ভিজবে... । ভালবাসার কোন ধর্ম নেই, জাত নেই, আকার নেই-আয়তন নেই; কিন্তু সে অবিনশ্বর। এক হৃদয় থেকে আরেক হৃদয়ের প্রবাহের মাধ্যমে সে বেঁচে থাকবে সৃষ্টির অনাদিকাল পর্যন্ত; মৃত্যু কখনও তাকে স্পর্শ করতে পারে না- কেবল মাত্র তার পূর্ণতা অনয়নে সাহায্য করে মাত্র।

সে মৃত্যুহীন ভালবাসা নিয়ে কনক বেঁচে থাকবে লাবিবার মাঝে... অনাগত বংশধরদের মাঝে...।
ঢং ঢং ঢং... । দেয়াল ঘড়িতে রাত দুটোর ঘণ্টাধ্বনি পরতেই লাবিবার যেন চৈতন্য ফিরে এলোকনকের অব্যক্ত আবেগের মণিকোঠায় সেও ডুবে গিয়েছিল অনাগত দিন গুলিকে নিয়ে। কিন্তু বেচারা কনক(লাবিবার ভাষায়) হাঁ করে একইভাবে তাকিয়ে আছে তো আছেই, এদিকে রাত্রি যে শেষ হতে চলল সে খেয়ালই নেই। হাজার হোক ফুলশয্যার রাত বলে কথা!

কি করবে লাবিবা। হঠাৎ তার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি উদয় হল। চোখ দুটোতে খেলে গেল দুষ্টুমির ঝিলিক। আগের মত ভ্রু কুঁচকে বা চোখ বন্ধ করে ডান চোখে চাইল কনকের দিকে, তারপর ঠোঁট উল্টিয়ে সেই বিখ্যাত ভেংচি কাটল!

কনক আবারও যেন ধাক্কা খেল। ওর মনে হল, সেই এক্সপ্রেস ট্রেনটি পাঁচশ কিমি. বেগে ছুটে এসে তাকে খড়কুটোর মত উড়িয়ে নিয়ে ফেলল ভারত মহাসাগরে। কিন্তু কনক বুঝতে পারল না, নীল সমুদ্রের বুকে নয়; লাল চাদরের উপর গোলাপ-গাঁদার অসংখ্য পুষ্প পল্লবের নরম বিছানায় পড়েছে সে !

বেচার কনক মামা স্রেফ অজ্ঞান হয়ে গেল!



(রচনাকাল: ২০০৬)