My Personal Blog ...

জন্ম: অতৃপ্ত আত্মা।



দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ভূমিনিসর্গের-পৃথিবীর এ প্রান্তের ভূমির শেষ সীমানায় নীলাকাশ ছুঁই ছুঁই করছে পর্বতশ্রেণীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গটি। অনেকের কাছে যে মর্ত্যের দেবতাসেই মর্ত্য দেবতার কোল ঘেঁসে বিকেলের রুপালী সূর্য তার শেষ বেলার আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত করেছে বরফাচ্ছাদিত মর্ত্য চূড়াকেনিচে... আরও নিচে, যেখানে সবুজ ভূমি আর মর্ত্য দেবতার সহাবস্থান- সেখানে, এই জনপদের মানুষগুলি সৃষ্টিকর্তার বেধে দেয়া সময়সীমা কে অতিক্রান্ত করে যুগ যুগ ধরে নরম মাটির শেষ ও চিরন্তন আশ্রয়ে আশ্রায়িত করেছে নিজেকে- সেখানে, সেই সমাধিক্ষেত্রের সমাধির বিবর্ণ ফলকে খোদাইকৃত পাঠ সাক্ষী দিচ্ছে সময়ের বহমান নীল স্রোতের...। দূরে, জনপদের কেহ কেহ তাদের এপারের শেষ দিনগুলো গুনে চলেছে আপন মনে। কেউ কেউ জানালা পানে অবারিত দৃষ্টি আরও প্রসারিত করে সমাধিক্ষেত্রে খুঁজে ফিরছে নিজের অবস্থান।

জনপদে জনতার জন-কোলাহলইতস্তত চাপা ফিসফাস- শব্দ চলছে চাপা গুঞ্জন তুলে। কোথাও ভবিষ্যতের অশুভ সঙ্কেতের নীরব হাহাকার। প্রকৃতির উল্লাস যেন থেমে আছে কোন অদৃশ্য ইঙ্গিতে। সাদা আলখাল্লা পরিহিত বুড়ো পাদ্রীটি এক ফাকে দেখে নেয় রাত্রির অন্ধকারের কতটা সময় বাকি। কখনও মনের অগোচরে দৃষ্টি চলে যায় দূরের সমাধিক্ষেত্রে; হঠাৎ চিৎকার করে উঠে ষষ্ট ইন্দ্রিয়- কাঁপা কাঁপা হাতের মুঠোয় শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ক্রুশ ফলক, বুকের মধ্য চেপে ধরে যেন হৃৎপিণ্ডের দ্রুম দ্রুম ক্রমশ উচ্চ লয়ের ছন্দ অমূলে ছন্দপাত হোক।

বিহঙ্গের দল আজ সন্ধ্যাতারা আগমনের পূর্বেই দিশেহারা হয়ে দিগন্ত পানে ছুটে চলেছে আপন নীড়ের সন্ধানে। অন্ধকার তার নিজ সিংহাসনে বসে প্রহর গুনছে বিশ্বচরাচর গ্রাস করার

সন্ধ্যাটা সবে মাত্র শুরু।

ঘাসের উপর শিশির তার চাদর বিছানো শুরু করে দিয়েছে। কুয়াশার বিন্দু বিন্দু শিশির জল ধরিত্রীকে যেন পৃথক করে রেখেছে তার ধোঁয়াটে অবয়ব দিয়ে।  ঊর্ধ্বাকাশে নিভু নিভু নক্ষত্ররাজি পূর্ণতার প্রত্যাশায় উকি দিচ্ছে কুয়াশার ধোঁয়াটে চাদরের মাঝ দিয়েপ্রকৃতি তার সমস্ত আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরেছে রাত্রির আগমনকে স্বাগত জানাতে।

রাত্রি তার পূর্ণতা পেতে ভর করেছে সময়ের কাঁধে। সময় ছুটে চলেছে  বিরামহীন, আপন গতিতে- জনপদ থেকে জনপদে, প্রান্তর হতে প্রান্তরের পথে। আজকের এই রাত্রিতে সময় তার অসীম যাত্রায় এক যন্ত্রণার সাক্ষী- যেন নিষ্প্রাণ এক দর্শকের নাট্যমঞ্চে নাটকের জন্য অধীর অপেক্ষায় চুপচাপ বসে থাকা।

শিশির ভেজা সবুজ রাস্তা চলে গেছে এ প্রান্তের শেষ জনপদে। মুখরিত জনপদ রাত্রির কোলে নিজেকে সমর্পণ করতে যেন নিশ্চুপ। তবে আজকের এই নীরবতা যেন একটু বেশী- একটু গভীর। অন্যদিনের মত রাস্তায়, দোকানে কিংবা লেপের উত্তাপে শুয়ে থাকা বৃদ্ধের অসতর্ক ফিসফাস, ডানপিটে ছেলের মায়ের কাছে বায়না কিংবা উওরের ঐ শেষ গৃহ থেকে ভেসে আসা ভায়োলিনের করুন আর্তনাদ- আজ সবই নিশ্চুপ।

গৃহের মিটিমিটি প্রদীপের আলোগুলি অন্ধকারের কালো পর্দা ছিন্ন করতে না পেরে ক্ষান্ত দিচ্ছে একে একে। অন্যদিকে জোনাকির দল সহস্র আলোর গুঞ্জন তুলে জানান দিচ্ছে- আমারা জেগে আছি। এক ঝলক দমকা বাতাস বইয়ে গেল। ঝন ঝন শব্দে কেঁপে উঠল উন্মুক্ত কোন জানালার পাট। সেই সাথে যেন কেঁপে উঠল আঁধারের হাতে সমর্পিত ঘুমের প্রতীক্ষায় জেগে থাকা না ঘুমনোর দল। কাঁপা কণ্ঠস্বরে কেউ কেউ আউরা-লো সৃষ্টিকর্তার নাম।

ঢং ঢং শব্দে বেজে উঠল গির্জার ঘণ্টা। জানান দিল, রাত্রির প্রথম প্রহর। সমস্ত বিশ্ব চরাচর গ্রাস করে নিয়েছে অন্ধকার। নিশ্চুপ সবকিছুই। ঊর্ধ্বাকাশে কোটি কোটি নক্ষত্রের মেলা। হঠাৎ ধরণীতলে প্রচণ্ড বেগে নেমে আসছে উল্কাপিণ্ড এবং ভু-ভাগের সান্নিধ্যে আসার পূর্বেই নিজেকে নিঃশেষিত করছে শূন্য বলয়ে।

পশ্চিমাকাশে পাহাড়ের চূড়ায় রাত্রির প্রথম চন্দ্রাভায় ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে অন্ধকার। নিকষ অন্ধকারের দর্প চূর্ণ করে আস্তে ধীরে উদিত হচ্ছে রুপালী চাঁদ। পাহাড়ের এ পাশে এখন চন্দ্রের মায়াবী জ্যোৎস্না, ওপারে ধু ধু অন্ধকার। এই মুহূর্তে এক মায়াবী আভায় পরিপূর্ণ যেন সবকিছু। চাদের আলোয় বিশ্বপ্রকৃতির অন্ধকার মিলেমিশে যেন গ্রহান্তরের তৃতীয় কোন জগত তৈরি করেছে। প্রচণ্ড এক মায়া গ্রাস করে নিয়েছে সবকিছু। মায়ার মায়াজালে প্রকৃতি মোহা-বদ্ধ

চাঁদ ছুটছে ক্রমশ মাথার উপরে- মধ্যগগণে।

আজ পূর্ণিমা। উষ্ণ কম্বলের নিচে শুয়ে যে বৃদ্ধ কিংবা যে কিশোরীটি ঠক ঠক করে কাঁপছে, সেও জানে, আজ সেই রাত- যাকে সবাই মৃত্যুর রাত বলে। যুগ যুগ ধরে যে কালো ইতিহাস বয়ে চলছে এবং যুগ যুগ ধরে চলবে- যে ইতিহাসের জন্ম হয়েছে অতৃপ্ত আঁধারের গর্ভ থেকে।

এটা সেই ইতিহাস যে ইতিহাস রঞ্জিত হয়েছে রক্তের লাল স্রোতে। এটা সেই ইতিহাস যে ইতিহাস লেখা হয়েছে লক্ষ দেশপ্রেমিকের রক্তে। ইতিহাস। আমার ভাইয়ের রক্তের ইতিহাস। আমার বোন, আমার মায়ের নীরবে মুখ থুবড়ে পড়ার ইতিহাস। এ সেই ইতিহাস- যে ইতিহাস এখনও হাহাকার করে উঠে আজকের এই সময়ে, যখন দেখে পিচাশ দেশদ্রোহীরা ক্ষমতা লুটেপুটে খাচ্ছে আর দেশপ্রেমিকরা মাথা ঠুকে মরছে অসহ্য যন্ত্রণায়।

এ ইতিহাস এই সমাধিক্ষেত্রের। যেখানে শুয়ে আছে শত শত দেশপ্রেমিক। অতৃপ্ত দেশ প্রেমিক।
ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজল। এখন রাত্রি দ্বি-প্রহর। পিনপতন নীরবতার মাঝে ডেকে উঠল শিয়ালের দল হুক্কা হুয়া কলরবে। হালকা বাতাস বয়ে এলো উত্তর থেকে। হঠাৎ এক খণ্ড মেঘ গ্রাস করে নিলো চাঁদকে- সেই সাথে নেমে এলো অন্ধকার।

বিশাল অশ্বত্থ বৃক্ষ থেকে ভেসে এলো ডানপিটে কোন শকুন ছানার  কান্না। সে কান্না অবিকল মানব শিশুর মত। একটু পরে মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো চাঁদ। আবার উন্মোচিত হল অন্ধকারের বেড়াজাল।

সমাধিক্ষেত্র। এক ঝলক দমকা বাতাস। দমকা বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে কেহ চিৎকার করে উঠল সমাধিক্ষেত্রে। একটা গুঞ্জন। সে গুঞ্জন ক্রমশ বেড়ে চলল সেখানে। হ্যাঁ। এখন ‘তাদের’ প্রত্যাবর্তনের সময় হয়েছে। অন্ধকারের থেকে- সমাধিক্ষেত্রের কফিনের ঢাকনা ঈষৎ সরিয়ে মুক্ত পৃথিবীতে বেড়িয়ে আসছে অতৃপ্ত আত্মার দল।

আজ সেই রাত। যে রাত্রির অন্ধকারে পশুর মত হত্যা করা হয়েছিল হাজারো দেশপ্রেমিককে। এরা সেই মহান দেশপ্রেমিকের আত্মা, যারা চিৎকার করে উঠে- হাহাকার করে উঠে- আজও স্বাধীনতার মূল্য পায়নি বলে। তারা চিৎকার করে উঠে দেশদ্রোহীর রক্ত চক্ষুর আস্ফালন দেখে।

মুক্তা-কাশে ডানা মেলে উড়ে চলে অতৃপ্ত আত্মার দল। সন্মুখপানে, একটি গন্তব্যে।

যেখানে আজ অনুষ্ঠিত হবে একটি সময় পালা- আরও একটি নীল ইতিহাস।

লোহার গারদ। গারদের ফাঁক গলে একচিলতে জ্যোৎস্নায় উদ্ভাসিত ভিতরের নারকীয় পরিবেশ। নোনা দেয়াল ক্ষয়ে উঠে এসেছে আস্তরণ ভেতরের এই কঙ্কালের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে আরেক জীবন্ত কঙ্কাল। একজন বন্দী।


অস্তমিত সূর্যের শেষ আভা বিদায় নিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃথিবীকে একমুঠো মায়াবী আলোর পরিপূর্ণ তৃপ্তি অনয়নে রুপালী চাঁদ উদিত হয়েছে অনেক আগেই, কিন্তু তার দুয়ারে সঁপে দিতে অপারগ মানুষগুলি নিজেকে আশ্রায়িত করেছে ঠিক অন্ধকারের মাঝেই। কিন্তু জ্যোৎস্নার তাতে কিছু যায় আসে না। তার ভালবাসাটুকু বৃহৎ, ক্ষুদ্র হৃদয়ে তা অনুপলদ্ধিত। সে বৃহৎ ভালোবাসার সন্ধানে হোক বা না হোক, সে বসে আছে ঠিক সে আলোকেরই মাঝখানে। ঝাপসা প্রতিবিম্ব পরছে তার পিছনে। প্রতিবিম্বটিও যেন অচেনা। নিজেকে নিয়ে ভাবে সে... শৈশব... কিশোর... যৌবন।

শৈশব তার বেশ কেটেছে। শহর থেকে অনেক দূরে ... শ্যামল প্রকৃতির বুকে ছোট্ট একটা জীবন। সে জীবনের উল্লাসে মিশে আছে তার সময়ের সবটুকু পূর্ণতা। বাবা-মা-চাচা-দাদীমা সহ আরও অনেককে নিয়ে তার শৈশবের মুখরিত জীবনটি চোখের সামনে ভেসে উঠে। কৈশোরের সেই দুরন্ত দিনগুলিকে কখনও ভোলার নয়। স্কুল পালিয়ে, চৈত্রের দুপুরের প্রচণ্ড দাবদাহকে শিকেয় তুলে, বাঁধ দিয়ে পানি সেঁচে নিচু জমি থেকে মাছ ধরা কিংবা বিকেলের সোনা রোদে, দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেতের আইলে বসে ঘুড়ি উড়ানো... সেই দল বেধে নদীতে গোসল কিংবা জঙ্গলে একাকী গুলতি হাতে পাখি শিকার করতে যাওয়া...।

প্রকৃতি তাকে আগলে রেখেছিল, সেই সাথে বিকশিত করেছিল তার মনন পথকে। পথগুলোও আঁকাবাঁকা- সঠিক ভাবে বিন্যস্ত নয়, কিন্তু একটি জায়গায় এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সেখানে জন্ম নিয়েছে পরিবার। মনে পরে দাদুর কথা, দিদিমার কথা। দাদুকে সে দেখতে পারেনি, তার জন্মেরও বহু পূর্বে মারা গেছেন তিনি। কিন্তু দাদুর শূন্যতা বরাবরের মতই পুষিয়ে দিয়েছিল প্রকৃতিতবুও দাদুর সম্বন্ধে একটা ধারণা অর্জন করেছে সে সবার কাছ থেকে শুনে শুনে। সেই ‘ধারনা’টুকু মিলিয়ে শৈশবেই দাদুর ছবি অংকন করেছিল মনের ফ্রেমে- কাগজ কলম পেন্সিলে। ছবিটিও সাদামাঠা। দাদুর চোখ। সে চোখের তারায় ফুটে উঠেছে তার কঠোর ব্যক্তিত্ব, আর ন্যায়ের ধারালো চাবুক। জমিদারি প্রথার বিরোধিতা করে ইংরেজদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। অসহায়দের কাঁধে হাত তুলে দিয়েছেন, কিন্তু হাতিয়ার তুলে দেননি। তুলে দিয়েছিলেন সেই ধারা- ‘আগে নিজেকে পরিবর্তন কর। হাতিয়ারের পরিবর্তে কলম(জ্ঞান) ধর, কেননা, তাই তোমাকে শেখাবে সুন্দর ভাবে কিভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে থাকা যায়’।

প্রচলিত এ ধারা গুণীজনরা আগেই দিয়ে গেছেন- বহু শতাব্দী পূর্বে। দাদুর মত সাধারণ মানুষগুলি তা নিজেদের মাঝে জিইয়ে রেখেছেন শতাব্দীর পর শতাব্দী। তারি ধারাবাহিকতায় উপমহাদেশ স্বাধীন হল। কিন্তু স্বাধীনতার মূল্য দিতে হল দাদুর মত সাধারণ মানুষগুলিকে। ইতিহাসের সেই ধর্মীয় বিভেদ অনয়ন কারী  দাঙ্গার কথা কেউ ভুলবে না

তবে ধর্মই কি আমদের মাঝে বিভেদ রেখা রেখা টেনে দেবে ? দাদুর আশঙ্কাই সত্য হল। কিন্তু তাতে আমাদের প্রাপ্যতা যতটুকু ছিল, তার চেয়ে বেশী দায়ী ছিল বিভেদকারীরা।  তবুও আমরা খুশি। 
আমারা স্বাধীন।

কিন্তু সত্যিই কি তাই ?
দাদু বেঁচে থাকলে বলতেন, না।
বাবাও বললেন- না।

শুরু হল এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। আমাদের সত্যিকারের স্বাধীনতা আর মুক্তির সংগ্রাম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের যুদ্ধে আমরা ত্রিশ লক্ষ মা বোনদের হারালাম।

আমাদের ত্যাগ, আমাদের সংগ্রাম, আমাদেরই হয়ে ধরা দিল- মুক্ত আকাশের নিচে পত পত করে উড়তে থাকা আমাদের রূপক- সবুজ আর লাল জমিনের পতাকা। আমারা আমাদের ত্যাগটুকু জমিয়ে রেখেছি বুকের মাঝখানে। আমরাই চির সবুজ।

গরাদের ফাঁক গলে আসা আলো হঠাৎই মিলিয়ে গেল। বন্দীর চারপাশে এখন শুধুই আঁধারপলাতক রূপালি চাঁদ তার প্রয়োজনীয়তার সমীপে উপলদ্ধিকরনে এই মুহূর্তে পলাতক যেন। বন্দীর চোখ দুটো আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে যায়। সেখানেও অন্ধকার। 

বাবার কথা বেশ মনে পড়ে। শত অন্ধকারের মাঝে এক পশলা আলোর পরশ বুলিয়ে দিয়েছিলেন তার দু চোখে। বাবার চারপাশেও ছিল শুধু অন্ধকার। বাবা একদিন আফসোস করে বলেছিলেন, ‘ স্বাধীনতা এখনও আমাদের জন্য অর্থবহ হয়নি’।

একজন মানুষের মনে, একজন মুক্তিযোদ্ধার মনে, কতটা দুঃখ-কষ্ট- যন্ত্রণা চাপা ক্ষোভ থাকলে এ কথাটা বলেন। তবে কাদের জন্য স্বাধীনতা অর্থবহ হয়েছে ? যাদের জন্য আমরা আমাদের তিরিশ লক্ষ যোদ্ধা হারিয়েছি- তাদের ? যারা আমাদের মা বোন দের ধর্ষিত হওয়া দেখে প্রভুত্ববাদের গোঁফের আড়ালে অট্টহাসি হেসেছে শোষণ বৃক্ষের ছায়ায় বসে- তাদের ?

বাবাকে সান্ত্বনা দেয়ার কোন ভাষা আমার ছিল না। শুধু আমি কেন, একটা বিবেকও এর জবাব দিতে পারবে না। বাবার কথা গুলো শুধুই শুনে যেতাম, আর ভাবতাম- আমিও ঠিক বাবার মতই হব। আমার এ ছোট্ট জীবনে বাবাই একমাত্র আদর্শ।

আমার সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছি সবার জন্য- সাধারণ মানুষের জন্য। মনে পড়ে ক্যাম্পাসের সেই দিনগুলির কথা। নেতা আমার হাতে হাতিয়ার তুলে দিয়েছিলেন দলকে জেতাবার জন্য। কিন্তু বাবার উপদেশ আমি ভুলিনি। বাবা বলতেন, ‘হাতিয়ার  দিয়ে দেশ-কাল-সময় হয়তবা জয় করা যায়, কিন্তু মানুষের মন নয় কখনও। মানুষের অন্তর জয় করতে হলে প্রয়োজন নিখাদ ভালোবাসা। যখন তুমি দেখবে পাপীরা জাল বিস্তার করে চলছে, তাদের শোধরাবার চেষ্টা কর; কিন্তু কোন উপায় না দেখলে হাতিয়ার ধ- যেমন আমরা ধরেছিলাম একাত্তরে’।  

আমার সেই বাবা আমারই চোখের সামনে দারিদ্র্যতার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করেন। আমি বাবার জন্য কিছুই করতে পারিনি। মানুষের কাছে আমি অনেক মিনতি করেছি, এমনকি দু হাত তুলে সাহায্যও চাইছি আমার মুক্তিযোদ্ধা বাবার জন্য।

কিন্তু হায় ! কেহ আমার বাবার দিকে মুখ ফিরে তাকায়নি।

আমি ঘৃণা করি সেই উপাধিকে, যে উপাধি বাবাকে দেয়া হয়েছিল। বীরের সন্মানহাহ! যেদিন একজন বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা বিনা চিকিৎসায় মারা যায় সবার চোখের সামনে, সেদিনই বাবার কফিনের সাথে কবর দিয়েছি সেই উপাধিকে।

তারপরেও আদর্শচ্যুত হয়নি আমি। সংগ্রাম করে গেছি বাবার আদর্শের বীজ রক্ষা করতেজানি একদিন সে বীজ-বৃক্ষ থেকে জন্ম নেয়া একটি সন্তান তার আদর্শের ডালপালা বিস্তার করে ক্রমশ ঊর্ধালয়ে স্থান করে নিবে- মুক্ত-স্বাধীন আকাশের নিচে, একছত্র আধিপত্যে।
আমি প্রতিজ্ঞা করলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, সে স্বর্ণলতাকে উপড়ে ফেলব; যে মাতৃ গাছ কে শোষণ করে নিজেকে জিইয়ে রেখেছে, বিনিময়ে থমকে দিয়েছে মাতৃ গাছের আকাশ দিগন্তের মিলন কে।
বাবা, তোমরা স্বাধীনতার স্বাদ পাওনি কারণ ঘাতক রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলে। আজ তারাই কলঙ্কিত করছে স্বাধীনতাকে। কিন্তু আমি তোমাদের সে ভুল শুধরে দিব।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যে হাতিয়ার তুলে নেইনি, আজ তাই তুলে নিলাম। তোমরা হাতিয়ার তুলেছিলে স্বাধীনতার জন্য, আজ আমি তুললাম সে স্বাধীনতা রক্ষার্থে।

আমার ফাঁসি হয়েছে।

অতৃপ্ত আত্মার দল পৌঁছে গেছে নাট্যমঞ্চে। এখানে আজ সবাই দর্শক, একজন অভিনেতা। এখনেই আজ রচিত হবে আরেকটি অন্ধকারের ইতিহাস

অসহনীয় নীরবতাআকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে- পশ্চিমাকাশে মেঘের আনাগোনার ভেসে উঠছে মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি... ।

হ্যাঁ, মৃত্যু চাই। বাস্তব মৃত্যু।

অতৃপ্ত আত্মার দল অপেক্ষা করছে রুদ্ধশ্বাসে। বিশ্ব চরাচর আজ শুধুই দর্শক। একজন অভিনেতা।
অভিনেতা চলে এলো মৃত্যু-মঞ্চে

একটা অশুভ ইঙ্গিত...

লুটিয়ে পড়লো অভিনেতার দেহ। কালের ইতিহাস সাক্ষী হয়ে রইল অনাদিকাল। জন্ম নিলো আরেকটি অতৃপ্ত আত্মা।

আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে এ বিশ্ব চরাচরের নষ্ট সময়কে পেছনে ফেলে উড়ে চলছে অতৃপ্ত আত্মার  দল

প্রান্তর হতে প্রান্তর, জনপদ হতে জনপদ পেছনে ফেলে উড়ে চলেছে অতৃপ্ত আত্মার দল।

হঠাৎ পিছনে ফিরে তারা-

অন্ধকার সময়... ...
আর নির্বাক পৃথিবী।    

                                                                            (রচনাকাল: ২০০৩)