My Personal Blog ...

আমাদের স্কুল। - ১



আপনি যদি এ তল্লাটে কখনও এসে থাকেন, তবে প্রথমেই যে জিনিসটি আপনাকে মুগ্ধ করবে (আপনি যদি প্রকৃতি প্রেমিক হন), সে হচ্ছে এই জনপদের একমাত্র নদীটি। অবশ্য বাংলার সব নদীই সুন্দর- মায়াভিরাম। যাই হোক, আমার বলার বিষয় কিন্তু নদী নয়- যদিও নদীর একটি সুন্দর সম্পর্ক আছে ঘটনা প্রবাহের সাথে। ভরা বর্ষায় নদী যখন প্রশস্ততায় দ্বিগুণ হয়, তখন নৌকা চেপে চলে আসুন এ তল্লাটের ঝিনুক নদীতে। শান্ত সুন্দর ঝলমলে প্রকৃতি আপনাকে মুগ্ধ করবে। মৌনতার মাঝে হারিয়ে যাবেন আপনি, ভাববেন হয়তবা অনেক কিছুই। এ বিশ্ব সংসার, আমি-আপনি-আমরা... ভাববেন এই নদী, এই নৌকা, দু তীরের গদ্যভুমি, কাশফুলের ঝোপের উপর ডানা ঝাপটানো শালিকের ঝাঁক... সবকিছুই কত সুন্দর- কত পবিত্র!

আপনার মৌনতা হঠাৎই ভেঙ্গে যাবে, কেননা, বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের শব্দ কিংবা পাখির কলরব অথবা বাতাসের গুঞ্জনের পরিবর্তে সামনে তীর থেকে ভেসে আসবে অন্যরকম কোলাহল। একটু কান পাতুন, শুনতে পাবেন শিশু কিশোরদের কোলাহল। আপনি যদি বিরক্ত হন, তবে নদী ধরে বরাবর সামনে চলে যান। ওখানে বরং অনেক পাখি-প্রজাপতি মিলবে। আর যদি উৎসুক হন, তবে তীরে তরী ভিড়ান। দেখেই আসি ব্যাপারটা কি।

হ্যাঁ, এবার হয়েছে। চশমাটা পকেটে রাখুন। না না জুতো জোড়া খোলার প্রয়োজন নেই। এবার আমার হাতটি ধরুন, ছোট্ট একটি লাফ দিন। আপনি তীরে পৌঁছে গেছেনএখন ভেজা বালির উন্মুক্ত পাড় ধরে হাঁটতে থাকুন। বা পাশে, নদী থেকে অনেকটা উঁচুতে, আপনার চোখে পড়বে শতাব্দী পুরনো তিনটি আম গাছ- অল্প দূরত্বে দাড়িয়ে আছে পাশাপাশি। কোলাহল আসছে সেখান থেকেই।
‘এবার বুঝেছি’ –চশমাটা  নাকের উপর ঠেলতে ঠেলতে বলবেন আপনি। নীল সার্ট- কালো প্যান্ট কিম্বা নীল ফ্রক পরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দেখিয়ে বলবেন, ‘এটা-তো স্কুল’।

হ্যাঁ, একটি স্কুল। গ্রাম্য প্রাইমারী স্কুল।

ঢং ঢং ঢং... ... ঢং ঢং ঢং।

ঘড়িতে সময় দেখে নিন। এখন সময় নয়টা পঁয়তাল্লিশ। অর্থাৎ স্কুলটির প্রাত্যহিক কার্যক্রম শুরু হল।
স্কুল বারান্দা, ক্লাসরুম, রাস্তা, নদী তীরের আনাচে-কানাচে যত খুদে ছাত্র ছাত্রী সবাই সমবেত হতে লাগল স্কুল আঙ্গিনার মাঠের সামনে। সেখানে ছেলেদের তিনটি এবং মেয়েদের দুটি সাড়ি তৈরি হয়ে গেল। শিক্ষক মণ্ডলী সবাই এসে তাদের সামনে দাঁড়ালেন সারিবদ্ধ ভাবে। ... চলুন, ঐ আম গাছটির গোঁড়ায় গিয়ে বসি। আমার কাঁধের গামছা পেতে দিচ্ছি, মোটা শিকড়ের উপর বসে পিঠটিকে এলিয়ে দিন গাছের উপর। এক মিনিট... দাঁড়ান, আগে দেখে নিই গাছের কোন ক্ষতের উপর আঠালো কষ জমে আছে কিনা। আপনার সুন্দর পোশাক নষ্ট হোক, এ আমার কাম্য নয়।

একটু পরে সমবেত সঙ্গীত শুরু হয়ে গেল। সে কি সঙ্গীত! সমবেত প্রায় তিন শতাধিক ক্ষুদে ছাত্র ছাত্রী পরম উচ্ছ্বাস নিয়ে  কার চেয়ে কে কতবেশি জোরে গাইতে পারে অর্থাৎ চিৎকার করতে পারে, সে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত হয়ে রইল পরবর্তী পাঁচ মিনিট।       
   
আহা, কি সুন্দর দৃশ্য! সামনে, খোলা আকাশের নিচে পত পত করে উড়ছে সবুজ জমিনের মাঝখানে সূর্যোদয়ের লাল টকটকে সূর্য- আমাদের প্রাণপ্রিয় জাতীয় পতাকা। নিচে, সবুজ ঘাসের জমিনে দাড়িয়ে, ডানহাত কপালে ঠেকিয়ে সালামের ভঙ্গিমায় অভিনন্দন জানাচ্ছে তাদের জাতীয় সত্ত্বাকে; সেই সাথে তারই গুণগান গাইছে অ-প্রকম্পিত আবেগের ধারায়- মাতৃ ভূমির এই অবহেলিত জনপদের অবহেলিত মানুষগুলির ক্ষুদে প্রতিনিধিরা। ওরা ঘুচাবে ওদের রিক্ততাটুকু, সমর্পিত করবে অনাগত সোনালী দিন পল্লী জননীর দুয়ারে।

স্কুল ঘরের আনাচে-কানাচে, বড় গাছের আড়ালে, দু চারজন ছাত্র বই-খাতা-স্কেল হাতে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে। বোঝা গেল ওদের স্কুলে আসতে দেরি হয়েছে। কিন্তু বই-খাতা ক্লাসরুমে রেখে সোজা সমাবেশে-কাতারে দাড়িয়ে পড়তে পারে।

স্কুল ঘরের এক কোনায় দাড়িয়ে যে দুজন ক্ষুদে ছাত্র চোরের মত উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিলো, আচমকা এক শিক্ষক এসে পিছন হতে শক্ত দু হাতে দুজনের কান চেপে ধরলেন! ক্ষুদে ছাত্র দুটির পিলে চমকে উঠল এবং পিছে ফিরে চাইলো। শিক্ষক বেয়াদব ছাত্র দুটোর কান টানতে টানতে মাঠে নিয়ে এলেন। এদিকে সহপাঠীর এ ধরা পরে যাওয়ার দুর্দশা বড় গাছের আড়ালে দাড়িয়ে থাকা ছাত্রটি দেখতে পেল এবং পরক্ষণেই ভয়ার্ত-স্বরে গাছের ডালপালা ভেঙ্গে চোঁ চোঁ দৌড়! বোঝা গেল, সেদিনের মত আর স্কুলে আসবেনা সে। ক্ষুদে ছাত্রের এ পলায়ন সেই শিক্ষকেরও দৃষ্টি গোচর হল।

ঢং... ঢং... ঢং...

স্কুলের ছাত্র ছাত্রী সবাই তাদের প্রাত্যাহিক সমাবেশ সেরে সারিবদ্ধ ভাবে আপন ক্লাসে চলে গেল, সেই সাথে সমবেত শিক্ষকমণ্ডলীও। একটু পর রোলখাতা ডাস্টার বেত হাতে শিক্ষকগণ নিজ নিজ ক্লাসে প্রবেশ করলেন।

পাঁচ মিনিটও পার হয়নি, দু জন ছাত্রকে দেখা গেল ক্লাস রুমের দরজা দিয়ে বেড়িয়ে বারান্দার শেষ মাথায় দাড়িয়ে পরতে। তারপর একটু ইতস্তত করে কান ধরে সোজা দাড়িয়ে রইল! আহা, বেচারা ছাত্র-দ্বয়! কোন গুরুতর অপরাধে সাত সকালে এই লজ্জাজনক শাস্তি জুটেছে কপালে।

অন্য একটি ক্লাসরুম থেকে দু জন ছাত্র বেরিয়ে এলো বারান্দায়। প্রথমে শাস্তিপ্রাপ্ত ছেলে দুটোর কাছে গেল তারা এবং সেখানে সামান্য দাড়িয়ে মুচকি হেসে এগিয়ে আসতে লাগলো আপনি যেখানে বসে আছেন ঠিক সেদিকেই। ওরা আপনার কাছাকাছি হতেই হাটার গতি কমিয়ে দিল। কৌতুকের চোখে আপনাকে দেখছে। ওদেরকে কাছে ডাক দিন, নাম জিজ্ঞাসা করুন, কোন ক্লাসে পরে সেটাও জেনে নিন। ওরা হয়তবা  একটা নাম বলবে, আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিবে কোথায় তাদের বাড়ি। তারপর হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করেন, ক্লাস বাদ দিয়ে এ পথে কেন। ওরা ছোট্ট মিষ্টি হাসি দিয়ে বলবে, ‘মিলন পালিয়েছে। ক্লাসে আসেনি। তাই স্যার বলেছেন মিলনকে ধরে আনতে’! 

আপনি ওদের দিকে তাকান। একহারা গড়নমাথার চুল তেল জবজবে এবং সিঁথি করে সুন্দর ভাবে আঁচড়ানো। তাদের মায়েরা-পল্লী জননীরা আদরের সন্তান কে পরিপাটি করে সাজিয়ে-গুছিয়ে বই-খাতা হাতে ধরিয়ে, কপালে চুমু একে বলে দেয়- মাস্টার মশাইয়ের কথা শুনতে, দুষ্টুমি না করতে, ফেরার পথে গাছে ঢিল না ছুড়তে, নোংরা না হতে... কিন্তু ওরা এগুলো করতেই সবচেয়ে পছন্দ করে। ওদের পরনের পোশাকের দিকে তাকান। বাজি রেখে বলতে পারি- অন্তত তিন জায়গায় পাবেন জামের কষের দাগ, দু জায়গায় আম কিংবা আমলকীর...। কিন্তু ওরা দুজন খালি পায়ে কেন ? তাদের জিজ্ঞাসা করুন, বলবে,  ‘চপ্পল-জোড়া বেঞ্চের তলে রেখে এসেছি, মিলনকে ধরতে হবে তো!’

ওরা দুজন চলে গেল এবং ঠিক দশ মিনিটের মাথায় মিলন নামের ছেলেটিকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে এলোওদের অন্য হাতে মিলনের বই খাতা ও চপ্পল-জোড়াবেচারাকে এভাবেই ক্লাসে নিয়ে যাওয়া হল

কি, কৌতূহল হচ্ছে, কি শাস্তি ছেলেটির জন্য বরাদ্দ হয়েছে জানার ? তাহলে চলুন যাই দেখেই আসি। না, না, আমি ওদের শ্রেণীকক্ষে যাওয়ার কথা বলছি না- এতে সবাই বিব্রত হতে পারে, এমনকি শিক্ষক মশাইও। বড় কথা হল, কিছু ‘মজা’ থেকে বঞ্চিত হবেন আপনি। তাই আমার পরামর্শ শুনুন, ষোলো আনাই কাজে দিবে। সোজা স্কুল ঘরের পিছনে চলে যান। সেখানে কেউ নেই এবং ক্লাসরুমের পিছের জানালা দিয়ে সব দেখতে-শুনতে পাবেন, আপনাকেও কেউ দেখছে না।

হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছেন ?

আহা আস্তে হাসুন! মাস্টার মশাই যে বেত হাতে ক্লাসরুমের পিছন দিকেই দাড়িয়ে আছেন। আপনার হাসির শব্দ শুনতে পেলে কেলেঙ্কারি কাণ্ড শুরু হয়ে যাবে।

কি বললেন ? এমন দৃশ্য দেখার পরে আপনি কিছুতেই হাসি দমন করতে পারছেন না ? তা হাসেন। দাঁত কেলিয়ে, হাত পা নাড়িয়ে, যেভাবেই পারেন হাসুন- কিন্তু কোন শব্দ করতে যাবেন না। আরে, আমিও কি পাথরে গড়া মানুষ নাকি। আমারও আপনার মত দু পাটিতে বত্রিশ খানা দাঁত আছে- আমিও কি হাসছি না ? টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে, হাঁটু দুটো ফাঁক করে তার ভিতর দিয়ে হাত দু খানা পেঁচিয়ে নিয়ে পশ্চাৎ-দেশ উঁচু করে যেভাবে দু কান ধরে আছে ক্ষুদে অপরাধীটি- তা না দেখে হেসে উপায় আছে ! ক্লাসের অন্যরা কিভাবে হাসি চেপে আছে, তা আপনি কেন কেউ বুঝতে পারবে না। ওদের মনে হাসি সুড়সুড়ি দিলেও চেহারায় কিন্তু উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট, কেননা ক্লাস নিচ্ছেন তাদের স্কুলের সবচেয়ে বদরাগী স্যারতিনি যদি ক্লাসে না থাকতেন এবং অপরাধী ছাত্রটি একই অবস্থায় থাকত, তবে পুরো ক্লাস যে হাসি-হুল্লোড়ে ভরে যেত এ ভাবাই স্বাভাবিক। একটু পর সে সুযোগও যেন এসে গেল। শিক্ষক মহাশয় শ্রেণীকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেলেন সামান্য সময়ের জন্য। তিনি চলে যেতেই সে ছাত্রটি শাস্তি ফেলে সোজা দাড়িয়ে পড়লো এবং হাত-পা ঝাড়া দিল বার দুয়েক। তারপর ক্লাসের সবার প্রতি দৃষ্টি ফিরিয়ে দৃষ্টিতে ভৎসনা করলো। এবার সে মুখে হাসি ফুটিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে লাগলো অনেকটা সার্কাসের বানরের মত ! পুরো ক্লাস ফেটে পড়লো অট্টহাসিতে। একজন চলে গেল দরজার কাছে, শিক্ষক এলে যেন আগে ভাগেই জানিয়ে দিতে পারে। বিচ্ছু ছাত্রটি এবার নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে স্বীয় বেঞ্চের উপর দাড়িয়ে নাচ শুরু করে দিল। হাসির ঝড় বয়ে গেল ক্লাসে আবার। ‘স্যার আসছে- স্যার আসছে’ সবাই চুপ মেরে গেল এবং অপরাধী ছাত্রটি পূর্বের জায়গায় ফিরে গিয়ে শাস্তি-রত অবস্থান নিলোশিক্ষক মহাশয় কিন্তু গোলমালের শব্দ পেয়েই চলে এসেছেন। শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করেই সবচেয়ে সুবোধ ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন যারা যারা গোলমাল করেছে তাদের নাম।  ইতস্ততা নিয়ে হলেও সে কয়েকজনের নাম বলল এবং তাদের উপর নির্দেশ এলো, ব্লাকবোর্ডের সামনে সারিবদ্ধ ভাবে কান ধরে দাড়াতে! এই ফাঁকে ব্লাকবোর্ডে দেখে নিন এটি কোন শ্রেণী- দ্বিতীয়-চতুর্থ নাকি পঞ্চম। হ্যাঁ, এটি চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের শ্রেণীকক্ষ।

কি, আরও কিছু দেখতে ইচ্ছা করছে ?

তাহলে চলুন, অন্য একটি ক্লাস রুমের দিকে যাওয়া যাক। বাঁ পাশের রুমের জানালার কাছে চলে যান, কিন্তু প্রথমেই উঁকিঝুঁকি দেয়ার চেষ্টা করবেন না। প্রথমে জানালার পাশে মাথা নিচু করে দাঁড়ান, ভিতরের অবস্থাটা একটু বুঝে নিন- তারপর দেখুন

কি মনে হচ্ছে ? এখানে বেশ পড়াশোনা চলছে, না ? শিক্ষক মহাশয়ের ইঙ্গিতে একেকজন বই হাতে দাড়িয়ে, পূর্বের জনের শেষ পাঠ থেকে নতুন করে রিডিং পড়া শুরু করছে ইংরেজি কোন পাঠ্য বই থেকে। এভাবে পালাক্রমে পাঠ চলছে। ওদের পাঠগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন, দেখুন, কি অবলীলায় সুন্দরভাবে সুদ্ধ উচ্চারণ সহকারে প্রত্যেকেই পড়ে যাচ্ছে। সবটুকু পাঠই আপনার পরিচিত, আপনি তাই সহজেই ধরতে পারবেন পাঠগুলো।

দেখুন, আরও একবার দেখুন- আমার দেশের অবহেলিত জনপদের নতুন দিনের সদস্যরা তাদের অন্ধকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ কে এক গামলা পানিয়ে চুবিয়ে পরিষ্কার করার মহান দায়িত্ব ক্ষুদে কাঁধে চাপিয়েছে, তা দেখে আপনিও আশাবাদী হবেন। আশাবাদী হবেন এ জেনে, ওরাও পিছিয়ে পরতে চায় না- তাল মেলাতে চায় সভ্যতার সাথে। সভ্যতার জ্ঞানের পথে ওরা পা বাড়িয়েছে, এই জ্ঞানই একদিন তাদের পরিপূর্ণ করে তুলবে। বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়বে এই পরিপূর্ণ মানুষগুলি। সুদিন তারা ফিরিয়ে আনবেই।

পঞ্চম শ্রেণীর এ ক্লাসরুমের দিকে আরও একবার নজর দিন। আপনার থেকে দু হাত তফাৎ এ বসা, মাঝের সারির শেষের ঠিক আগের বেঞ্চটিতে বসা ছেলেদের দিকে একবার তাকান। এই ক্ষুদে বদমাশ চারজন ক্লাস দিব্যি ভুলে খাতায় কাটাকুটি খেলছে। মাঝে মাঝে চোরা চাউনিতে দেখে নিচ্ছে শিক্ষককে, তারপর আবার মেতে উঠছে খেলায়। একটু অপেক্ষা করুন, কেননা আমাদের মাস্টার মশাই ‘পণ্ডিত মশাইয়ের’ মত গোবেচারা নন- চশমার ফাঁকে বার দুয়েক তিনিও লক্ষ্য করেছেন। তারপর একপ্রস্ত বকা-ঝকা শেষে কান ধরে দাড়িয়ে থাকতে বললেন । ক্ষুদে চারজন কান ধরে দাড়িয়ে রইল সহপাঠীদের বিদ্রূপ দৃষ্টির সামনে।

দাঁড়ান, আরেকটু মজা আছে। কানে ধরে দাড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোর পেছনের বেঞ্চে বসা সবাই তাদের স্বীয় মস্তকগুলো একত্র করে কি ফন্দি আঁটল- বুঝতে পারছেন কি ? না পারলেও অসুবিধা নেই। একটু সবুর করেন, নিজের চোখেই দেখতে পাবেন।

ক্লাস সমাপ্তির ঘণ্টা পড়লো। পাঠে মনযোগী হওয়ার উপদেশ দিয়ে শিক্ষক মহাশয় অপরাধী ছাত্র চারজনকে বসতে বললেন। শিক্ষকের কথা শোনা মাত্রই ক্ষুদে চারজন কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা সম্ভাবনার কথা বিবেচনা না করেই বসে পড়লো এবং-

হো হো হো... হা হা হা... হি হি হি...
হো-হো-হো... হা-হা-হা... হি-হি-হি...       
 
বিশ্বাস করুন, আপনার এ হাসি দেখে আমিও চুপ থাকতে পারলাম না। জানেন তো, হাসি হচ্ছে  সংক্রামক। অবশ্য আপনি না হাসলেও আমি হাসতাম! শাস্তিপ্রাপ্ত চারজন যেইমাত্র বসতে যাবে, ওদের পিছনের বেঞ্চের সেই বিচ্ছু ছাত্র চারজন বসার বেঞ্চখানা টান দিয়ে কাত করে ফেললো ; ফলে ওদের পশ্চাৎ-দেশ বেঞ্চ স্পর্শ না করে সরাসরি ভূমি স্পর্শ করলো। এবং চারজনের একই সাথে পতনের ফলে একটি মাত্র শব্দ হল- ধপাস ! কেউ কিছু বুঝতে পারলো না যে কিভাবে কি ঘটলো। কিন্তু সমেবত ক্লাস তাদের চার সহপাঠীকে ভূমিতে চিৎপটাং দেখে, ক্লাসে শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও ফেটে পড়লো অট্টহাসিতে। ডাস্টার টেবিলে আছড়ে ‘এই চোপ, এই চোপ’ বলে শিক্ষক বেড়িয়ে গেলেন ক্লাস থেকে। পরবর্তী পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সবাই মেতে রইল ফুর্তি-হুল্লোড়ে

চলুন, এবার দেখে আসি সবচেয়ে ছোটরা কি করছে।

ম্যাডাম ক্লাস নিচ্ছেন। তাকে অল্প বয়সী এবং সুন্দরী মনে হল। বাচ্চাদের কাছে তিনি জনপ্রিয়, তাই যে রকম দুষ্টুমি করার কথা ছিল তারা তা মোটেও করছে না। সবাই বেশ মনযোগী এবং উৎফুল্ল। কি জানেন, ওরকম অল্প বয়সে আমিও এক ম্যাডামকে খুব পছন্দ করতাম! সারাক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম, ইস, ম্যাডাম যদি আমায় কোলে তুলে আদর করত! আমার চুলগুলো এলোমেলো করে নাকটা টিপে দিয়ে বলত, ‘... খুব ভালো ছেলে’। ম্যাডামের পড়া গুলো তাই আগে শিখতাম এবং ক্লাসে তার কথা গুলো শুনতাম খুব মনোযোগ দিয়ে। দুষ্টুমি করার তো কোন প্রশ্নই আসে না। যদি কোন কারণে ম্যাডাম শাস্তি দিতেন, অতিশয় অভিমানে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে ফেলতাম! তখন কিন্তু ম্যাডাম আমার চুলগুলো এলোমেলো করে নাকটা টিপে বলতেন, ‘... খুব ভালো ছেলে’!

প্রথম শ্রেণীর ক্লাসরুমের দিকে চলুন নজর ফেলি। টাক মাথার, ধবধবে সাদা লম্বা দাড়িওয়ালা যে বুড়ো ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছেন- তিনিই এ স্কুলের প্রধান শিক্ষকপ্রায় এক শতাব্দী পুরনো প্রতিষ্ঠানের অর্ধ শতাব্দীর সেবক তিনি। সেই যুবক বয়সে শিক্ষার মহান আলো ছড়াবার ব্রত নিয়েছিলেন, বয়স-সীমার শেষ প্রান্তে এসে এখনও তার হাল ধরে রেখেছেন, যদিও চাকরির বয়স তার অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। এ জনপদের একজন নির্বাক মানুষও তাকে ভালবাসে-শ্রদ্ধা করে, সমাজের সবচেয়ে উঁচু তলায় স্থান দেয়। তারাও জানে, এই মানুষ গড়ার কারিগরটির হাত ধরে একদিন তাদের সন্তানেরাও ‘মানুষ’ হবে, পরিচিতি লাভ করবে সভ্য সমাজের একজন হিসাবে। ব্যক্তিগত ভাবে তিনি সৎ-ধার্মিক এবং নিষ্ঠাবান। সংসারে একাকী মানুষ তিনি, স্ত্রী গত হয়েছেন বিশ বছর পূর্বে। দু ছেলে মেয়ের আলাদা আলাদা সংসার। মাঝে মাঝে তারা বেড়াতে আসে এবং প্রতিবারেই বলে, চাকুরী ছেড়ে শহরে গিয়ে তাদের সাথে বাস করতে। কিন্তু তিনি হেসে উড়িয়ে দেন, গ্রামের মানুষ গুলো তাকে বড়ই ভালবাসে। এ ভালবাসা ধরণীর অন্য কোথাও পাবেন না তিনি। তাইতো নিজেকে বিলিয়ে দিতে চান সবার মাঝে। সবাইকে তিনি পরামর্শ দেন- স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা সব বিষয়েই। সেনেটরি পায়খানা থেকে শুরু করে শিশুদের টিকা দান- সব বিষয়ের ক্যাম্পেইনে গ্রামবাসী তাকেই মুখ্য ভূমিকায় পায়। রোগ-শোক-খরা-বন্যা সবখানেই আছেন তাদের এই প্রিয় মানুষটি।

এ ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীরাও সমান মনযোগী। স্কুলের তিনিই সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক এবং তার ক্লাসে গোলমালের কোনরূপ প্রশ্নই উঠে না। ক্লাসের শিক্ষার্থীরা তার অমায়িক শিক্ষা পাঠদানের গভীরতায় সম্পূর্ণ ডুবে যায় ফলে দুষ্টুমির চিন্তা মাথাতেই আসে না।

কি ভাবছেন আপনি, এই বৃদ্ধ শিক্ষক মশাইয়ের কথা? তার মত পরিপূর্ণ মানুষ প্রতিটি স্কুলে-জনপদে প্রয়োজন সে কথা ?

তাহলে কিছু কথা বলছি শুনুন। নেপোলিয়ন বলেছিলেন একজন মায়ের কথা; তার সাথে আমি বলব একজন পরিপূর্ণ শিক্ষকের কথা, যে একটা পরিপূর্ণ জাতি উপহার দিতে পারে। আমাদের সমাজে দু জন সভ্য আছেন, একজন স্কুল শিক্ষক, অপরজন মসজিদের ইমাম। একজন আমাদের ধর্মীয় নৈতিকতার শিক্ষক এবং অপরজন সেই, ধর্মে যেখানে শহীদের রক্তের সাথে তুলনা করা হয়েছে- তার শিক্ষক। সমাজে এই দু সভ্যের ভূমিকা সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী, কেননা সমাজে অন্যদের চেয়ে তাদের অবস্থান সবচেয়ে কাছে। এ জন্য একজন শিক্ষক কিংবা ইমামকে পরিপূর্ণ হতে হবে। কিসে একজন মানুষ পরিপূর্ণ হয় ? একমাত্র যখন সে নিজেকে অন্যের মাঝে বিলিয়ে দিতে পারে, তখনি সে পরিপূর্ণ। একজন ইমাম কিংবা স্কুল শিক্ষককে মসজিদ-স্কুলের গণ্ডীর মধ্য সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। তাকে শুধু ধর্মীয় কার্যকলাপের মাঝেই থাকলে চলবে না, দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতে হবে ধর্মীয় নৈতিকতা বোধগ্রামবাসী কে স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সচেতন করে তুলতে হবে, বলতে হবে শিক্ষার কথা, কুসংস্কারের কথা। এইডস এর মত বিষয় যদি মসজিদে আলোচনা করা হয় তাহলে কারও ধর্ম যাবে না, উপরন্তু ধর্মপ্রাণ মানুষগুলির অজ্ঞানতা দূর করে তার কল্যাণই বয়ে আনবে। তাদেরকেই প্রথমে বলতে হবে মেয়েদের শিক্ষার কথা, সম অধিকারের কথা- ধর্মে কিন্তু তার পূর্ণ নির্দেশ আছে। বলতে হবে বাল্য বিবাহের কথা, যৌতুকের কথা, কেননা ইসলাম কিন্তু যৌতুক প্রথা সমর্থন করে না। একজন শিক্ষককে হতে হবে তার সমাজেরও শিক্ষক, একজন ইমামকেও। তবেই তার একটি পরিপূর্ণ জাতি উপহার দিতে পারবে।

অনেক কথা হল, এবার চলুন শেষ ক্লাসরুমটি থেকে ঘুরে আসি।

দ্বিতীয় শ্রেণীর এ ক্লাসরুমে কোন ক্লাস চলছিল না শিক্ষকের অনুপস্থিতির জন্য। ক্ষুদে ছাত্র-ছাত্রীদের তাই কি দোষ বলুন, ওদের এ আচরণ স্বাভাবিক বলেই ধরে নিন। শ্রেণীকক্ষের প্রতিটি শিক্ষার্থীই মহা ফুর্তিতে আছে। আসুন, ওদের কার্যকলাপ অল্প সময়ের জন্য উপভোগ করি।


প্রথমেই সমতল ব্লাকবোর্ডের দিকে নজর দিন। এক ক্ষুদে ছাত্র শিক্ষকের বসার চেয়ারের উপর দাড়িয়ে আপনমনে ছবি আঁকছে। আঁকা শেষ হলে ছবির নিচে অঙ্কিত প্রাণীটির নাম লিখল এবং সে নামের পূর্বে বসিয়ে দিল আরেকটি নাম। নামটি তার সহপাঠী বন্ধুর। সম্পূর্ণ নাম মিলে দাঁড়াল, মহিম গরু! মহিম নামের ছেলেটি কিন্তু চুপচাপ বসে রইল না, সে আসন থেকে উঠে এসে বন্ধুটির সাথে শুরু করে দিল কুস্তি। ক্লাসের সবাই মজা পেয়ে উৎসাহ জোগাতে লাগলো চিৎকার করে। ওদের ঝগড়ার সময় সেই ছেলেটির হাত থেকে চকখড়ি পড়ে গেল, অন্যজন তা তুলে এগিয়ে গেল ব্লাকবোর্ডের দিকে। শীঘ্রই উধাও হয়ে গেল মহিম গরুর ছবি, সেখানে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল কিম্ভুতাকার মানুষের ছবি। এবার সে মাথায় শিং এঁকে দিল, দুটোর জায়গায় তিনটে চোখ আঁকলো স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বড় করে। আনাড়ি হাতে দাঁত গুলোও আঁকলো বড় করে। শিশুরা বুঝতে পারলো এটা একটি ভুতের ছবি। আরেকজন আরেক খণ্ড চক নিয়ে অংকন করলো কঙ্কাল ভুতের ছবি। শেষ পর্যন্ত পুরো ব্ল্যাকবোর্ড ভরে গেল হরেকরকম ভুতের ছবিতে। কেউ একজন কাগজের প্লেন বানিয়ে উড়িয়ে দিল বাতাসে, প্লেনটা বো করে নেমে এসে আঘাত করলো আরেকজনের নাকে! এবার দেখতে দেখতে সম্পূর্ণ ক্লাস ভরে গেল প্লেনে-প্লেনেঅনেক আবার প্লেনের পিছনে লেজ জুড়ে দিয়েছে, সেগুলো তুলনামূলক বেশী সময় ভেসে রইল বাতাসে। ছোট মেয়েরা প্লেন সংগ্রহ করে সে কাগজ দিয়ে বানাল নৌকা। কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটি তৈরি করলো একজন পিচ্চি মেয়ে- কাগজের পাখি। পাখিটি সব মেয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে, এক বিচ্ছু ছেলে ছোঁ মেরে পাখিটি তুলে নিয়ে দরজা দিয়ে দিল দৌর! কেউ একজন শুরু করে দিল গান- কয়েকজন তাল মিলালো তার সাথে এবং সামান্য পরে উৎসাহ হারিয়ে মেতে উঠল অন্য একটি খেলায়। পিছনের দিকে বসা দুজনকে দেখা গেল  মাথা নিচু করে কি যেন খেয়ে চলছে। একজন বেঞ্চের উপর দাড়িয়ে হাত তুলে শুরু করে দিল ভাষণ। পিছন থেকে কেউ একজন তার পশ্চাৎ-দেহে জোরে ধাক্কা দিল, সে পড়ে গিয়ে কাঁদতে লাগলো। এক পিচ্চি কি যেন আঁকড়ে আছে শক্ত দুহাত দিয়ে। অন্যরা জটলা করছে তা দেখার জন্য। অবশেষে সবাইকে দেখতে দিল- বড়সড় একটি ঝিনুক। নদী-পাড় থেকে সংগ্রহ করেছে সে। সবাই বলল ভেঙ্গে দেখতে, মুক্তা থাকতে পারে। ছোট ছেলেটি সায় দিল এতে। দরজার কাছ থেকে আধ-খণ্ড ইট নিয়ে এলো একজন। ছেলেটি ঝিনুক মেঝেতে রেখে সজোরে ইট চালালঝিনুকের পিচ্ছিল একটা অংশ ছিটকে এসে গালে পড়লো উৎসুক একজনের। আরেক জনের অজান্তে তার সার্টে মুখ মুছে নিলো সে। ছোট্ট ছেলেটি এক খণ্ড কাঠি দিয়ে ঘাটতে লাগলো ঝিনুকের মাংসপিণ্ড, কিন্তু কিছুই পেল না। 


আমাদের স্কুল। - ২ ( শেষ অংশ )