ফিরে এসো আমার নতুন পৃথিবীতে ...
‘......... তারপর প্রচণ্ড ঘোর কাটতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম প্রচ্ছন্ন কুয়াশার ধোঁয়াটে অববেয়র নিচে, শিশির সিক্ত ঘাসের কোমল আবেশে। জেগে উঠলাম- আবিষ্কার করলাম নিজেকে বিশাল ইউ গাছের একচ্ছত্র আধিপত্যের নিচে। দিগন্ত পানে কোথাও চাঁদ কিংবা সূর্য নেই, অথচ এক উদ্ভাসিত আলোক গহন বিলিয়ে দিচ্ছে অপার্থিবটাকে। ঊর্ধ্বে, মুক্ত স্বাধীন শত শত নাম না জানা পাখির কলকাকলিতে মুখরিত পরিবেশ। সামনে যতদূর দৃষ্টি যায়- হাজারো রঙ্গের ছড়াছড়িতে নাম না জানা চেনা অচেনা লক্ষ নিযুত ফুলের সমাবেশ আর বিচিত্র বর্ণের সব প্রজাপতির দল’।
এই স্বপ্নটাকে আমি বহুবার দেখেছি। তাই ভাবলাম
এটাও কি স্বপ্নই?
ফুল বাগানের এলোমেলো পথ ধরে সামনে চলা শুরু
করলাম। ধোঁয়াটে অববয়ের মাঝখানের প্রকৃতি এবং তার মাঝখানে আমি। কোমল পাপড়ির আলতো
স্পর্শ কিংবা দখিনা বাতাসে ভর করে আসা কুয়াশা প্রহেলিকার বিন্দু বিন্দু শিশির জল, অথবা
ধোঁয়াটে চাদরের ওপাশের রহস্যময়তা- পুরোটাই কি স্বপ্ন নাকি বাস্তব? সবই যেন ঠিক এ
রকম নয়- অন্য রকম। যেন পৃথিবীর সব বন্ধন ছেড়ে মুক্ত আমি- স্বাধীন আমি অন্য পৃথিবীর
বুকে।
এক সময় প্রান্তরের অসীমতা শেষ হল। কুয়াশার
ধোঁয়াটে সরিয়ে শুরু হল মাতাল সমীরণ।
ঘাসের চাদর বিছিয়ে প্রশস্ত রাস্তা চলে গেছে
উজ্জ্বল সাদা মস্ত অট্টালিকার পানে। বিশাল অববয়ের কৃষ্ণচূড়া গাছের সাড়ির সবুজ
ভূমির উপর রক্তিম কৃষ্ণচূড়া ফুলের দল যেন আগমনীয় আমন্ত্রণ জানাচ্ছে আমাকে।
এক সময় অট্টালিকার পানে পৌঁছলাম। দূর থেকে যতটা আকর্ষণীয় লাগছিল নিকটে এসে দেখি তারও
বেশী। তবে সবকিছুতেই কেমন যেন শূন্য-নীরবতা। ক্ষণিক আগের পক্ষীকুলের কলরব অথবা বাতাসের গুঞ্জন- সব অনুপস্থিত। যেন আমি ছাড়া এ ভুবনে আর কেহ নেই।
নিশ্চুপ অট্টালিকার বিশাল করিডোর পেড়িয়ে
দিগন্ত ছোঁয়া হলরুমে প্রবেশ করলাম এবং চমকে উঠলাম।
হাজারো জনের সমাবেশ। যেন আমার প্রতীক্ষাতেই
ছিল। আপাদমস্তক দ্যুতিময় সাদা পশাকে মোড়া ... এবং নিষ্পাপ চক্ষু-যুগলের মায়াবী
দৃষ্টির সামনে- মুখোমুখি আমার বাক-রুদ্ধতা... চক্ষু পানের আমার প্রসারিত দৃষ্টি
অথচ তন্দ্রাচ্ছন্নের মত সবই দেখা- ঘোর বিহ্বলতার অসীম সমীকরণ।
সময় এখানে স্থির।
বাতাসের ডানার ভর করে এলো এক অপার্থিব সূর।
বিমোহিত আমি। চারদিক থেকে বর্ষিত হতে লাগলো পুস্পঝর্না।
হঠাৎ সবাই একযোগে সম্ভাষণ জানালো- ‘স্বাগতম
হে মানব’!
অলীক সম্ভাষণের বিহ্বলতায় কিংকর্তব্যবিমুঢ
আমি এবং একই সাথে আবিষ্কার করলাম আমার পোশাকও অন্য সবার মত- একই।
সবার মাঝখান থেকে কয়েকজন এগিয়ে এলো আমার
দিকে। বেশ কয়েকজন কে চিনতে পারলাম। অন্যদের কেউ ঠিক চেনা চেনা মনে হচ্ছিলো।
দাদু-দাদীমা- নানা... সেই রিকশাচালক বৃদ্ধ ফালুচাচা... চার বছরের পৃথিলা- আরও
অনেকে।
প্রচণ্ড একটা চিন্তা আমার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
তার চেয়েও নির্মম সত্য- সময়ের আগে কিংবা পরে, আজ সবাই মৃত।
তবে কি আমিও- ?
হটাৎ মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে প্রচণ্ড তোলপাড়...
ধীরে ধীরে চোখের সামনে অলীকময় দৃশ্য গুলোর পরিবর্তে সিনেমার পর্দার মত বাস্তব
চিত্র ভেসে উঠল।
আজ তোমার জন্মদিন। অনেক দ্বিধা সংকোচ কিংবা
আত্মাভিমানের শেষ পর্যায় কাটিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা এবং
সতেরটি রক্তাভ গোলাপ ব্যস্ততম শহরের প্রশস্ত রাস্তা পাড় হচ্ছি আমি। ... হটাৎ
মুখোমুখি আমি র যান্ত্রিক দানব। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপর পিচের রাস্তায় টায়ারের
কর্কশ আর্তনাদ... প্রচণ্ড শব্দ... আকাশ বাতাস প্রকম্পিত চিৎকার... সন্মুখপানে জমাট
অন্ধকার এবং হটাৎ নীরবতা।
আমার মৃত্যু হয়েছে । এই নির্মম সত্য মেনে
নিয়ে হলরুম পেড়িয়ে অট্টালিকার সামনে স্বর্গোদ্যানে প্রবেশ করলাম। এখানে ইউ গাছের
প্রশস্ত ছায়ায় স্বর্গীয় সবাই অফুরন্ত আয়েশিতে নিমজ্জমান। মায়াবীরা নিয়ে এলো
স্বর্গীয় পানীয়ের পেয়ালা। দোলনচাঁপা ফুলের সুবাসে ভর করে আমি চলে গেলাম ফেলে আসা চেনা সেই পৃথিবীতে। মনে
পড়লো সবাইকে। যাদের সাথে অনেক অনেক সময় বন্ধ-নিত করেছি নিজেকে। সবাইকে আবার দেখতে
ইচ্ছা করছে। ইচ্ছে করছে পৃথিবীর সময়ে ফিরে যেতে। প্রচণ্ড সে চাওয়া অভিব্যক্তি। সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা জানালাম। মহান সৃষ্টিকর্তা আমার প্রার্থনা
মঞ্জুর করলেন।
চলে এলাম সেই পৃথিবীতে।
ধরিত্রীর মাঝে আমার শেষ অবস্থান- আমার গৃহের
খোলা সদর দরজার সামনে থমকে দাঁড়ালাম। যে দরজা জীবদ্দশায় খোলা ছিল সবসময়- সবার জন্য। সদর দরজা পেড়িয়ে প্রবেশ
করলাম গৃহের উন্মুক্ত আঙ্গিনায়। উঠোন পরিপূর্ণ- সেখানে শত জনের সমাবেশ। পৃথিবীর
সেই সময়গুলোতে মানুষের ক্ষণীয় সুখগুলো না হোক, দুঃখগুলো পরিপূর্ণ ভাবে ভাগাভাগি
করে নিয়েছি সবার সাথে। যে দুঃখ গুলোর মাঝেই জীবনকে খুঁজে ফিরেছি পরিপূর্ণ ভাবে।
নিয়তির আজকের বাস্তবতায় আমার দুঃখগুলিও যেন বিশ্ববিধাতা ভাগাভাগি করে দিয়েছেন সবার
মাঝে। উঠোনের আমগাছের গোঁড়ায় অবহেলায় ফেলে রাখা ভাঙ্গা ফুলদানির টুকরো গুলো থেকে
বিবর্ণ হলুদ ফুলগাছগুলো পর্যন্ত যেন শোকে নিথর। আমগাছের ডালে বসে থাকা পাখিগুলি-
যাদের কলরব আমি উপভোগ করতাম বারান্দায় আমার ব্যবহৃত ইজি চেয়ারে বসে, আজ সে
পাখিগুলোও বসে আছে চুপচাপ। হয়তবা সেও জানে পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে পরিবর্তিত হয়েছে
আরেকটি দৃশ্য-ভূমির পট। তার সমাপ্তির প্রস্তুতি চলছে- চির সমাপ্তি।
শত মানুষের ভিড়ে খুঁজে পেলাম নিজেকে- আমার
সমাপ্তির পথে। সমাপ্তি আমার সে দেহটির। যে দেহের জন্য জীবদ্দশায় পাথর ভেঙ্গে
মুক্তা কুড়াতে আমরা পিছপা হই না। জীবনধারার সে সংগ্রামটুকু শুধুমাত্র দেহটির জন্য
অথচ চির সমাপ্তি তারই। সাদা কাপরে মোড়া আমার দেহটিকে তোলা হল তার শেষ পরিভ্রমণ যান
এ।
মৌন মিছিলের পথে সবাই চলছে আমাকে আমার শেষ
গন্তব্যে পৌঁছে দিতে। দুঃখগুলো বাতাসে ধুলো-ঝড় তুলে হারিয়ে যায় অজানায়, পড়ে থাকে
দু ফোঁটা চোখের জল সবুজ ঘাসের উপর; অশ্রুগুলতো আমার জন্যই, অথচ আমাকেই আর ছুঁয়ে
যায় না। অশ্রুর মূল্য আমার কাছে অমূল্য, সেই অমূল্য সম্পদ আমাকে বিলিয়ে যাচ্ছে
সবাই অকাতরে। জীবদ্দশায় আমিও চেয়েছিলাম অশ্রু দিয়েই গড়ব আমি আমার রাজত্ব। আমার রাজ সিংহাসন থাকবে সবার মাথার ‘পরে। আমার
সিংহাসনে বসে আমিই হব অগ্রপথিক-পেছনে আমার অগণিত সহযাত্রীগণ। আমার সে চাওয়া আজ
পূরণ হয়েছে। খাটিয়ায়- রাজ সিংহাসনে করেই চলছি আমার গন্তব্যে। পেছনে আমার
সহমর্মিতার সহযাত্রীগণ। মানুষের মাথার উপর উঠলে আকাশটা একটু নিচে নেমে আসে, তখন
পৃথিবীটাকে অন্যরকম লাগে- জীবদ্দশায় পড়া কোন এক সাহিত্যিকের উক্তিটি মনে পড়লো।
হ্যাঁ, সত্যিই অন্যরকম লাগে। এই অন্যরকম প্রাপ্তির প্রত্যাশায় ধরিত্রীর মাঝে যে দর্শন
চলে, ধরিত্রীয় দর্শনে টা সে সময়েরই- আমাদের চাওয়া পাওয়ার সব হিসেব নিকেশ এই সময়েরই
আবর্তে। এখানে আমাদের অর্থ প্রতিপত্তি সবই এই অন্যরকম প্রাপ্তির উন্মাদনা। অথচ
আমারা ভুলে যাই, আমাদের চিরন্তন প্রাপ্তিই এই শেষ যাত্রা। এখানে সৃষ্টিকর্তা কাউকে
কাউকে সিংহাসনে বসিয়ে নিয়ে আসেন তার স্বর্গের রাজত্বে। আবার কাউকে কাউকে ছুঁড়ে ফেলে দেন- তারা পরে তাদের
জাগতিকতার নিচে চাপা পড়ে। অথচ তাদেরকেও
আসতে হয় এভাবেই। কিন্তু তারা কি অনুভব করে তাদের আকাশটা একটু নিচে নেমে আসে? না,
হয়তবা না, তাদের আকাশ নেমে আসে মাটিতে ঠিক পিষে ফেলতে।
সবাই চলে গেছে। রয়ে গেছে শুধু একজন- একাকী।
সে কি টের পাচ্ছে, যে জমিনের উপর সে দাপটের সাথে চলত সে জমিন আজ তাকে গ্রাস করে
নিয়েছে তার চিরচেনা অন্ধকার গহ্বরে? সে মিশে যাবে সেই মাটির সাথে, যে মাটি থেকেই
সে সৃষ্ট হয়েছিল আত্মার অমরত্বের পথে।
তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
দিনগুলিকে খুব মনে পড়ে। ক্যাম্পাসের বিশাল
কৃষ্ণচূড়া গাছটি যখন ফুলে ফুলে রঙ্গিন হয়ে যেত, নীল আকাশের নিচে সবুজ ধরণীর যেন
ঠিক মাঝে ব্যাপ্ত সে রক্তিমতার দিকে তাকিয়ে থাকতাম কেমিস্ট্রি ক্লাসের একঘেয়েমিতার
মাঝ দিয়ে। লেকচারারের বিষয়বস্তুর মাঝে অন্যরা যখন মূল্যবান ‘মূল্য’ খুঁজতে ব্যস্ত;
আমি ভাবতাম- ঐই রক্তিমাটুকু আমার সময়ের আমারই প্রতিচ্ছবি। প্রতিচ্ছবিটা ঘোলাটে হতে
হতে মনের দর্পণে পূর্ণ রূপ নিত, সেখানে দেখতাম একটাই ছবি- তুমি। প্রথমে অবাক হয়ে
গিয়েছিলাম। নিজ সত্ত্বা শতভাগে ভাগ হয়ে যেন নিজেদের মাঝে লুকোচুরি খেলছে অথচ সবাই
জানে চরম সত্যটি। ... তারপর তোমার ছবি মায়া-মন্ত্রের মত আমায় ভুলিয়ে নিয়ে গেল চেনা
পথে, তবুও পথটা অচেনা মনে হয়। সে পথের শেষ প্রান্তে হিমালয়ের মত মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে
প্রাচীরের ধূসর দেয়াল। আমি হটাতই থমকে
পড়ি। দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে বুঝে নেই- ওপাড়ে প্রবেশাধিকার
আমার নেই। কিন্তু চিৎকার করে উঠে আমার বিগ্রহ সত্ত্বা- কেন আমার প্রতিচ্ছবি আমা
হতে পৃথক থাকবে? কেন এই সংস্কারের প্রাচীর ?
নিজেকে প্রবোধ দেই, কিন্তু প্রবোধটাও হাস্যকর
মনে হয় যখন দেখি তোমার পরিচ্ছদটুকুও সে সংস্কারের আলপনায় বোনা। আমার সত্ত্বা আমাকে
টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে সে প্রাচীর পেছনে ফেলে। তবুও পিছে ফিরে দেখি আমি- তুমি
তাকিয়ে আছ করুণার চোখে, আর তোমার চোখে সংস্কারের বিলাসিতা।
আমার পৃথিবীটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। যে
ভ্রান্ত পৃথিবী মোহাচ্ছন্নের মত তৈরি করেছিল আমার ভ্রান্ত প্রতিচ্ছবি। ভুলে যাওয়া
আপনাকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করি। পরিচিত হই নিজের সাথে। দেখি ফালু চাচা-
পৃথ্বীলারা আমার পথ চেয়ে বসে আছে। পথ চেয়ে বসে আছে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলি।
কিন্তু তুমি কেমন আছ ?
হ্যাঁ, তাই তোমাকে দেখতে গিয়েছিলাম- তোমার
জন্মদিনে। তোমার সংস্কার ভ্রান্ত, আমার পৃথিবীটাও ভ্রান্ত হতে পারে- কিন্তু
ভালবাসাটুকু নয়। আমার সংস্কার-আমার ভালবাসা- তুমি। তোমার সংস্কার- তোমার বিলাসিতা।
তাই বিলাসিতার কাছে নয়, আমার সংস্কার সতেরটি রক্তাভ গোলাপ নিয়ে আমার ভালোবাসার
কাছেই চেয়েছিলাম যেতে। আমার শেষ ভালবাসাটুকুও তোমার কপালে মিলল না। তোমার জন্য করুণা
হয়, কিন্তু বেশ ভালো আছ তুমি তোমার ভ্রান্তের আবর্তে।
চলে এলাম অন্য ভুবনে, আমার নতুন পৃথিবীতে।
সৃষ্টিকর্তার এ জগতটাতে শুরু হবে চিরন্তন নতুন জীবন। সবাইকে আসতে হবে এখানে, আজ
কিংবা আগামীকাল- তোমাকেও। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা জানালাম- ‘আমাকে তন্দ্রা
দাও- প্রচ্ছন্ন গভীর তন্দ্রা এবং সেই দিন জাগিয়ে দিও, যেদিন আসবে তুমি- অশ্রু দিয়ে
বরণ করে নিব তোমাকে আমার নতুন পৃথিবীতে।
(রচনাকাল- ২০০৪)