একটি রাতের গল্প
আখড়া থেকে পূর্ণদ্যামে সিদ্ধি সেবন করে উদ্ভ্রান্ত লোকটি যখন রাস্তায় নামলো, তখন তার ‘উদ্ভ্রান্ত’ বিশেষণের সাথে আরেকটি বিশেষণ যুক্ত হল- মাতাল। অবশ্য মদখোর দের কেই মাতাল উপাধিতে সর্বোচ্চ ভূষণ-যোগ্য...। কিন্তু উদ্ভ্রান্তের এলোমেলো পদক্ষেপ বিশ্লেষণে ‘মাতাল’ তার সাথে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। তবে এ ব্যতীত অন্যান্য প্রকাশ-মুখী বিশ্লেষণে ‘মাতাল’ না বলাই শ্রেয়।
সুতরাং, উদ্ভ্রান্ত লোকটি তার মাতাল পদক্ষেপে শহরের বিক্ষিপ্ত নোংরা গলি
দিয়ে সন্মুখে পদক্ষীণে ব্যস্ত। পকেটে তার সর্ব সাকুল্যে পনের টাকা ছিল, কিন্তু
আখড়ার বিল বাবদ দশ টাকা দেয়াতে এখন অবশিষ্ট পাঁচ টাকা আছে। গলির মতই অবস্থা-সম্পন্ন
আলো-আধারির ছোট্ট দোকান থেকে দুই টাকার বিড়ি এবং বাসি এক প্যাক পাউরুটি কিনল সে।
নেশার ঘোরে খিদে যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে, পানি সহযোগে রুটিই হবে তার উদর-পূজ্য। তার মত তার উদরও এতে সন্তুষ্ট।
সিদ্ধি সেবনের পর সিগারেট না হলে নেশাটাও ঠিকমতো জমে না। তার সিগারেট কেনার
সামর্থ্য আজ নেই। তাছাড়া বিড়িটাই চড়া এবং দু টাকার বিড়ি দিয়ে অনায়াসে রাত্রি পার
করে দেয়া যাবে।
আখড়া থেক সবার অজান্তে যে দেশলাই তুলে এনেছিল সে, তার একটি মাত্র কাঠি
ব্যায়ে বিড়িতে অগ্নিসংযোগ করল। প্রথম টানেই ফুসফুস পরিপূর্ণ তপ্ত ধোঁয়ার নিকোটিনের
পতি-ক্রিয়ায় মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে শুরু হয়ে গেল তোলপাড় । সেই সাথে
অন্ধকারাচ্ছন্ন রাস্তাটাও যেন এলোমেলো হয়ে গেল। কে জানে, শেষ পর্যন্ত সে নর্দমায় পড়বে কিনা!
নির্লিপ্ত এবং মাতাল পদক্ষেপের মাঝে সমন্বয় সাধনকারী সূক্ষ্ম সূর লহমার
আবেশ ধ্বনিত হচ্ছে অট্টালিকার ধুসর দেয়ালে আছড়ে পরে- শীষ বাজাতে বাজাতে পথ চলছে
উদ্ভ্রান্ত। একটু আগে আলিঙ্গনাবদ্ধ ছিল যে বিড়ি তার দু ঠোঁটের মাঝখানে, অন্ধকার
গলিতে সে মুখ থুবড়ে পরে আছে। হয়তবা পেছন হতে দেখছে উদ্ভ্রান্ত কে- প্রয়োজন ফুরলে
সবাই এভাবে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
জ্যোৎস্না রাত। ভু-চরাচরের প্রতিদিনের সেই ব্যর্থতার গ্লানিকে বিদায় জানাতে
মধ্যগগনে উদিত হয়েছে চাঁদ তার একচিলতে অথচ বৃহৎ ভালবাসার পরশ নিয়ে। কিন্তু বিশ্ব চরাচরের নিয়ম এমনই- যার যা প্রয়োজন,
তা সে কখনই পায় না। অবশ্য তাকে দোষ দেয়ার উপায় নেই, সে তো সবার জন্যই।
স্বার্থপরেরা তার স্বার্থের প্রাচীর তুলে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায় অনাহুতের মত।
প্রাচীরের এ পাশে যারা পরে থাকে, তারা পড়ে থাকে চিরকালই- । দিগন্ত ছোঁয়া অট্টালিকা
গুলো এমনই, জ্যোৎস্নার সে ভালবাসার পরশটুকু লুটে নিয়ে যাচ্ছে, এপারে অন্ধকার গলি।
উদ্ভ্রাতের দৃষ্টি চলে যায় অট্টালিকার সে কংক্রিটের দেয়াল বেয়ে উপরে...
অনেক উপরে। সেখানে চাঁদ নেই কিন্তু তার দীপ্তি আছে, দীপ্তিটুকু সেখানেই থাকে।
অন্ধকার গলিতে হঠাৎ তার পায়ের আঘাতে শূন্য অ্যালমুনিয়াম ক্যানে বেসুর শব্দের ঢেউ
তুলে মিলিয়ে গেল শূন্যে। সে চলছে। মাইল খানেক দূরে সদর প্লাটফর্ম- গন্তব্য সেখানেই।
চাপা-অন্ধকার গলি থেকে উদ্ভ্রান্ত চলে এলো সদর রাস্তায়। সোডিয়াম লাইটের
আলোকিত রাস্তায় সুসজ্জিত গাড়িগুলো তাদের আলোর বন্যা তুলে হিসহিসিয়ে চলে যাচ্ছে পাশ
দিয়ে। ঝলমলে রং চটাদার বিজ্ঞাপনের সাইনবোর্ডগুলোও সুবিন্যস্ত ল্যাম্পস্টের সাথে কিংবা একক ভাবে। একটি বিজ্ঞাপন চিত্রের দিকে
দৃষ্টি আটকে গেল তার। স্বল্প বসনার যৌবনা-দীপ্ত হাস্য-জ্বল সুন্দর রমণী। বাহ, বেশ
তো!
হাঁটতে হাঁটতে ল্যাম্পপোস্টের নিচের ফুটপাতে, পয় নিষ্কাশনের জন্য ফেলে রাখা
স্তূপীকৃত আবর্জনার পাশে দৃষ্টি আটকে গেল তার। একটা মানিব্যাগ। লোভে চকচক করে উঠল
তার চোখ দুটো। আশে পাশে কেউ নেই, আর থাকলেই বা কি। সে দ্রুত তুলে নিলো মানিব্যাগটি
এবং সেখানে এলোমেলো কাগজের মাঝে খুঁজে পেল মলিন হয়ে যাওয়া দশ টাকার দুটো নোট।
সে আশা করছিল হয়তবা আরও বেশি মিলবে, কিন্তু বিশ টাকাই বা কম কিসে। ক্ষণিক
মনঃক্ষুণ্ণ বদনে আমার ভেসে উঠল হাসির রেখা। টাকাটা পকেটস্থ করে গন্তব্যের দিকে পা
বাড়াল উদ্ভ্রান্ত।
এখন একটাই চিন্তা, টাকাটার ব্যবহার সে কিভাবে করবে এবং কোন খাতে। চিন্তাকে
অগ্রাধিকার দিতে নেশাটাও হয়তবা নিভু নিভু।
মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে। রেল লাইনের পাশের বস্তিতে বিশ টাকায়
‘জমিয়ে নেশা করার মত’ বাংলা মদ মিলবে। সে যাবে সেখানে।
এ-ই।
চাপা অথচ স্পষ্ট নারী কণ্ঠস্বরে সে ফিরে চাইল এর উৎসের দিকে। শব্দ এসেছে
ফুটপাতের পাশে অন্ধকার জায়গা থেকে।
জ্যোৎস্না এবং ল্যাম্পপোস্টের কৃত্রিম আলোয় আবছা মতন দৃশ্যমান হল মেয়েটি। নিশি
কন্যা।
বিজ্ঞাপন চিত্রের সে স্বল্পবসনা রমণী দৃশ্যে যে কামভাব তার মাথাচাড়া দিয়ে
উঠেছিল, আবার তা নতুন করে পূর্ণমাত্রায় আচ্ছাদিত হল।
সে পথে সে পা বাড়াতে যাবে, হঠাৎ মনে পড়ল পূর্বোক্ত সিদ্ধান্ত-
একটি মনের দুটি সত্তা- তার মধ্য তুমুল বিতর্ক চলছে। কামাচার পূরণে অর্থ তার
আছে, কিন্তু-
বস্তির গন্তব্যে সে দু পা বাড়িয়েছে, এমন সময় হাঁক এলো-
‘শুনন’।
সে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং উচ্চস্বরে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলল, ‘ট্যাকা নাই’।
নিশি কন্যা মেয়েটি জরিপ করছিল উদ্ভ্রান্তকে। অনেকটা এগিয়ে এলো সে এবং বলল,
‘একটু এদিকে আসেন’।
‘আ-মর-জ্বালা’- আপন মনে বিড়বিড়য়ে উদ্ভ্রান্ত উল্টো পথ ধরল এবং চলে এলো
মেয়েটির সামনে।
‘সন্ধ্যার পর একটাও কাস্টমার পাইনি’- নিশি কন্যা বলল মৃদুস্বরে।
চাঁদ এবং সোডিয়াম লাইটের আলোয় মেয়েটিকে স্পষ্টই দেখছিল উদ্ভ্রান্ত। একহার
গড়নের সুন্দরী- কতই বা বয়স হবে, ষোল-সতেরো বড়জোর আঠারো। সাধারণ নিশি কন্যাদের দলে
ফেলতে দ্বিধা হল উদ্ভ্রান্তের। তারপরেও সে নিশি কন্যাই।
‘থাকো কই?’
‘ঐ বস্তিতে’- মেয়েটি হাত তুলে দেখিয়ে দিল, অর্থাৎ যেখানে উদ্ভ্রান্তের
গন্তব্য।
‘শোন মাইয়া, আমার কাছে ট্যাঁকা-পয়সা কিছুই নাই’।
মেয়েটি চোখ তুলে চাইল উদ্ভ্রান্তপানে। এক মুহূর্ত পরে বলল, ‘আফনের
ট্যাঁকা-পয়সা লাগব না’।
উদ্ভ্রান্ত বেশ অবাক হল মেয়েটির এহেন উত্তর শুনে। এবং পর সময়েই যে বাক্যটি
তার মনে উদয় হল, ‘ আমারে তুমি চিন?’
মেয়েটি আবার চোখ তুলে চাইল উদ্ভ্রান্তের চোখের দিকে। একটু সময় নিয়ে বলল,
‘আফনের কাছে একটা মালা বেচছিলাম, দুই ট্যাঁকার মালা আফনে আমারে বিশ টাকা
দিছিলেন...’।
‘শোন মাইয়া, এই বিশ টাকা রাখ আর বাড়িতে চইল্যা যাও। রাইত কইরা আর কাস্টমার
পাবা না’- টাকাটা মেয়েটির হাতে গুঁজে দিয়ে উদ্ভ্রান্ত চলে যেতে উদ্যত হল। কিন্তু
মেয়েটি তার ডান হাত চেপে ধরল শক্তভাবে। উদ্ভ্রান্ত আবারও ফিরে চাইল এবং মেয়েটি
উচ্চস্বরে বলল,
‘আফনের ট্যাঁকা আম এমনি এমনি আমি রাখুম ক্যান? আমি খারাপ মাইয়া, আফনের
ট্যাঁকা লইয়া আফনে চইল্যা যান’।
কথাগুলো শেষ করে মেয়েটি টাকা গুঁজে দিল উদ্ভ্রান্তের হাতের মুঠোয়।
উদ্ভ্রান্ত কিছুক্ষণ চেয়ে রইল মেয়েটির মুখপানে। তারপর বিনা বাক্য
ব্যায়ে চলল তার গন্তব্যে।
অনেকদিন আগের কথা... কতদিন ঠিক মনে নেই উদ্ভ্রান্তের। তবে বছরের হিসাবে
তিন-চার বছর তো হবেই। শহরের প্রশস্ত রাস্তায় যানজটে আটকে পরা
গাড়ি-রিক্সা-ট্যাম্পুর মিশ্রিত সারিতে মেয়েটি তার হাতের বকুল ফুলের মালা বিক্রির
চেষ্টায় ব্রত ছিল। কিন্তু দু টাকার বিনিময়ে কেউ একটি মালা কিনতে আগ্রহী ছিল না।
অথচ সামান্য এই দুই টাকা- ।
দুই রাস্তার আইল্যান্ডে দাঁড়িয়ে সে দেখছিল এই দৃশ্যটি। বেশ মনে পরে... তার
কাছের দামি জিপের আরোহী ভদ্রলোক(!) কে সামনের জানালার ফাঁক গলে অনুনয় করছিল
মেয়েটি- একটি মালা নেয়ার। প্রতিত্তুরে, ‘যা ভাগ’ শব্দটি তার কর্ণগোচর হলে
বালিকাটিকে সে ডাক দেয়। মেয়েটি তার কাছে আসে এবং বলে, ‘মালা নিবেন?’
বালিকার ডানহাতে বাড়ানো বকুল ফুলের মালাটি হস্তগত করে জিজ্ঞাসা করে সে, ‘কি
নাম তোর?’
তার পকেটে সর্বসাকুল্যে একটি বিশ টাকার নোট ছিল এবং সে নোটটি বালিকাকে দিয়ে
বলেছিল যে, এর বিনিময়ে পুরো টাকাটাই তাকে দিয়ে দিল। মেয়েটি চোখ তুলে তাকিয়েছিল তার
পানে...। সে দৃষ্টিতে ছিল একরাশ দুঃখ কিংবা ভালবাসা বোধের সংমিশ্রণ।
সে বালিকার মাথায় হাত বুলিয়ে সহানুভূতি জানিয়েছিল।
উদ্ভ্রান্তের মনে ছিল না, অথচ এই সামান্য ঘটনা মনে রেখে সে মেয়েটি এতদিন
পরেও উদ্ভ্রান্তকে ঠিক ঠিক চিনে নিয়েছে- এ কম আশ্চর্যের কথা নয়। কিন্তু ‘অবাক
কিংবা আশ্চর্য’ ঠিক
উদ্ভ্রান্তের জন্য নয়, সে এ অনুভূতি গুলো ভুলে গেছে।
রেল লাইনের এই বস্তিটি বিশাল এবং হাজারো লোকের বাস
সেখানে। উদ্ভ্রান্ত বস্তির কাছাকাছি হওয়া মাত্রই দুটো নেড়ি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল।
‘যা ভাগ’ প্রতিত্তুরে; উদ্ভ্রান্ত এসে থামল একটি জীর্ণ কুটিরের সামনে। বস্তির
প্রায় সবাই ঘুমিয় গেছে এবং রাতও অনেকটা গভীর। সুতরাং
উদ্ভ্রান্তের দ্বিধা ছিল কাঙ্ক্ষিত জিনিস সে পাবে কি না।
সে পেল। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের থলেতে পরিপূর্ণ সামান্য ঘোলাটে পানীয়।
প্লাস্টিকের একটা খালি বোতলও সংগ্রহ করেছে সে। তারপর পানীয়টুকু বোতলে চালান করে সে
চলল তার নতুন গন্তব্যে।
রেললাইন ধরে চলছে উদ্ভ্রান্ত। কাঠের স্লিপার গুলোতে দেখে দেখে সতর্ক
পদক্ষেপ ফেলতে হচ্ছে, নতুবা হোঁচট খেয়ে পরে যেতে পারে সে। বস্তির সেই নেড়ি কুকুর
দুটোর একটি তার সাথে সমান দূরত্ব রেখে চলছে সেই তখন থেকেই- উদ্ভ্রান্তের অগোচরে।
ক্ষিদেবোধ হতেই স্লিপারের উপর বসে পড়ল সে। এতক্ষণে সে নেড়িকে দেখতে পেল।
হতভাগার উদরে হয়তবা কিছুই পড়েনি, তাই পিছু পিছু চলে এসেছে। কুকুরটিকে দেখা মাত্রই
চিনেছে সে।
প্যাকেটের দুটো পাউরুটির একটি খেয়ে তৃষ্ণা-বোধের সমাধানতে বিস্বাদ
পানীয়টুকুর সামান্য শুষ্ক-নালীতে চালান করে দিল সে। দ্বিতীয় রুটিটি নেড়িকে দেয়ার
প্রয়াসে ‘আয় আয়’ ডাক তুলল। কুকুরটি আরও কাছে চলে এলো এবং রুটিটি ছুঁড়ে দেয়ার
মুহূর্তে দুষ্টবুদ্ধি উদয় হল তার মনে। পাউরুটিটি সম্পূর্ণ ভাবে পানীয় দ্বারা সিক্ত
করে ছুঁড়ে দিল নেড়ির দিকে। ক্ষুধার্ত নেড়ি বিনা সময় অতিক্রান্তে গোগ্রাসে গিলে
ফেলল রুটি।
আরও খানিকটা পান করে উঠে দাঁড়াল সে, রেল লাইন ধরে চলতে শুরু করল। বেশ লাগছে
তার। নেশাটাও জাঁকিয়ে বসেছে পুরোমাত্রায়। মাতাল উদ্ভ্রান্ত জ্যোৎস্না রাতে চলছে এবং
তার পিছু পিছু হেলে দুলে মাতাল সঙ্গী নেড়ি কুকুর। ‘যাক বাবা! আমিও টাল- তুইও টাল,
দু জনে মিলে এবার চলরে চল!’
কতদূর কিংবা কতক্ষণ- কোনটাই জানেনা উদ্ভ্রান্ত। ক্লান্ত দেহাবয়ের সাথে পা
দুটোও নিথর হতে চাইছে এক মুহূর্তের জন্য। অবসাদের কাছে শেষ পর্যন্ত নিজেকে সপে দিল
উদ্ভ্রান্ত।
রেল লাইনের স্লিপারের উপর লম্বভাবে দেহখানি পেতে দিয়েছে সে। আরেকটু আয়েশের জন্য জীর্ণ পাদুকা-যুগল খুলে
গুঁজে দিল মাথার নিচে। হ্যাঁ, এখন বেশ আরাম বোধ করছে।
নক্ষত্র খচিত অসীম পানে তার ঘোলাটে চক্ষু-যুগলের নির্বাক দৃষ্টি। কত দূরে
তার... তবুও কত কাছে। তার জীবনটাই যেন
এমনই, জীবনের নাগাল কোনদিন পায়নি সে অথচ জীবন তার সাথেই।
ডানহাতে তার পানীয়ের বোতল এবং বা হাতটা আপনা আপনি চলে আসে নোংরা চাদরে
আচ্ছাদিত বুকের উপর। সেখানে সে অনুভব করে অবিরাম দ্রিম দ্রিম ছন্দের ‘লয়। জন্মের পর থেকে নিরবধি জীবনের সেই ছন্দের হিল্লোল ধ্বনিত
হচ্ছে এবং হবে থেমে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। ‘যাক না থেমে,
কার কি’- আপন মনে বলে উদ্ভ্রান্ত। এ জীবন তাকে ‘উদ্ভ্রান্ত’ করেছে, মানুষ করেনি।
সু-উচ্চ অট্টালিকার মাঝে যাদের বাস, খেয়ে পড়ে নির্বাকের মত বেঁচে থাকা যাদের
জন্য নয়, আপন বিলাসিতার মাঝে যাদের বসাবস- জীবন তো তাদেরই। তার জীবনতো সেই নেড়ি
কুকুরটার মতন, অথচ এই জীবনকে জীবিত রাখতে কত সংগ্রাম। উদ্ভ্রান্তের মনে নেই- কবে,
কোথায়, কোনকালে, কার মাধ্যমে, কার দ্বারা এ জীবনের অনয়ন হয়েছিল নির্বাক এ ধরণীতলে।
তারপর শুধুই হোঁচট খেয়ে পরা- জীবন নামক জরাজীর্ণ বোঝাকে শুধুই বইয়ে চলা। অথচ এ
জীবন তার মূল্যহীন... মূল্যহীন...।
অর্ধেক হয়ে যাওয়া পানীয় ধারকের ছিপি খুলে খানিকটা ঢেলে দেয় উদ্ভ্রান্ত তার
মুখগহ্বরে। বিস্বাদ পানীয় তার অগ্নি তপ্ততার স্বাক্ষর রেখে প্রবেশ করে উদরে। মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠে। সেই সাথে অচেনা ভাবাবেগ আন্দোলিত করে তুলল সত্তা এবং
সত্তার ধারক প্রতিটি বিন্দুকনায়। নির্লিপ্ত- ভারী চোখা-বরন দুটো তার অন্ধকার রাজ্যের সীমানা পেড়িয়ে আবার নতুন করে
প্রবেশ করে আলো আঁধারির নীরব ধরণীতলে। জ্যোৎস্নার আলোয় তার প্রসারিত দৃষ্টি চলে
যায় অজানা শূন্য পথে। সেখানে আলো আঁধারের সহাবস্থান; কিন্তু অন্ধকারের রাহু-গ্রাসে
আলো ম্রিয়মাণ। তবুও যেটুকু তার দ্যুতিময়তা, স্ব-স্থানে সেটুকুই প্রস্ফুটিত। কিন্তু সেই প্রস্ফুটতাকে কয়জনই বা উপলব্ধি
করতে পারে? উদ্ভ্রান্তের মন খারাপ হয়ে যায়। সে মাতাল, চুরি সহ ছোট-খাটো অপকর্ম
করেছে অনেকই। কিন্তু তার সেই পারিপার্শ্বিক প্রকাশাদির পূর্বোক্ততা কেউ
জানে না। আর জানলেই বা কি? সে উদ্ভ্রান্ত...
সমাজের নিচুস্তর থেকেও নিচুতে তার বসাবস। সে অন্ধকারটুকুই সবার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে,
আলোকের দ্যুতিটুকু থেক যায় অচেনা।
জ্যোৎস্না-স্নাত ধরিত্রী নিস্তব্ধ। আধো ঘুম আধো জাগ্রত অবস্থায় উদ্ভ্রান্ত
সময় নিরীক্ষণের চেষ্টা করছে। সদর প্ল্যাটফর্মে তার আজ যাওয়া হবে না। সেখানে যাওয়ার
উদ্দেশ্য একটাই ছিল- আরও শত ছন্নছাড়াদের মত প্ল্যাটফর্মের এক কোনায় শুয়ে রাত্রিটা
পার করে দেয়া। অবশ্য প্রতিদিনের জন্য নয়- যেদিন যেখানে পারে, সেখানেই রাতটুকু
কাটিয়ে দেয়। এখন রাত কতই বা হবে? বড়জোর
দুটো কিংবা আড়াইটা। উদ্ভ্রান্তের সময় এ জন্য জানা প্রয়োজন, শেষ রাতের দিকে পশ্চাৎ-মুখী
একটা ট্রেন আসবে। নেশার ঘোরে সে যদি স্লিপারের উপর ঘুমিয়ে পড়ে তবে সকাল বেলা উঠে
দেখবে যে সে তিন খণ্ড হয়ে পড়ে আছে! যে জীবনকে সে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এনেছে, তার
এখানেই সমাপ্তি হোক; তারপরে আবার নেশার ঘোরে দুর্ঘটনায়- এ মোটেও তার কাম্য নয়।
সুতরাং তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কাটাতে হবে।
ডানহাতে স্লিপারের উপর ভর দিয়ে বসার চেষ্টা করল সে। অনেকটা শ্রমব্যয়ে সে
উঠে বসল, সেই সাথে কেপে উঠল তার সমস্ত দেহ। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার ভয়ে দু হাত দিয়ে শক্ত করে স্লিপার আঁকড়ে ধরল
উদ্ভ্রান্ত। মাথা আগের চেয়ে বেশি ঝিম ঝিম করছে, যেন সহস্র ঝিঁঝিঁ পোকা অনবরত ডেকে
চলেছে তার মস্তিষ্কের গহ্বরে। একই সাথে জোনাকি যেন লুকোচুরি খেলছে চোখের তাঁরায়।
উদ্ভ্রান্তের কেবলই মনে হচ্ছে, চেনা জানা এ পৃথিবী থেকে অনেক দূরে তার বসাবস।
সেখানে একাকী সে- নিগ্রহ যাতনা কিংবা জীবন সংগ্রাম, কোন কিছুই প্রয়োজন নেই সেখানে।
অনন্ত সময়ের কাঁধে ভর করে, ক্লান্তি-অবসাদ মুক্ত আস্বাদ নিয়ে সপ্নপূরীর কল্প
বিলাসিতার মাঝে চলছে সে। সেখানের সবকিছুই তার একাকীত্বের সারথি...। মহাকালের মাঝে
বিলীন হয়ে গেছে তার অস্তিত্ব... এবং সেই মহাকাল তাকে নিয়ে ছুটছে... ছুটছে...।
ক্লান্ত এবং নেশা-তুর পায়ে উঠে দাঁড়ালো উদ্ভ্রান্ত। পানীয় বোতলের কথা ভুলেই
গিয়েছিল সে। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে বোতল খুঁজে বের করে এক নিঃশ্বাসে অবশিষ্টাংশ উদরে
চালান করে দিল। তারপর ডানহাতে শূন্যে সজোরে নিক্ষেপ করল বোতলটি। বাতাসে শীষ কাটার
পর বোতলের পতনের শব্দে সে নিজেই চমকে উঠল। শব্দ দূরের কোন কুকুরের কানে গিয়েও
থাকবে- বেসুরে ডেকে উঠল দুটি কুকুর। সেই নেড়ি কিন্তু অনেক আগেই উদ্ভ্রান্তকে ছেড়ে
চলে গেছে। না, এখানে আর নয়, এবার তাকে গন্তব্যের পথে দ্রুত এগুতে হবে।
স্লিপারের উপর মাপা মাপা পদক্ষেপে চলছে উদ্ভ্রান্ত। নেশা-বোধ
পুরোমাত্রায় এবং ক্ষণে ক্ষণে পা জড়িয়ে যাচ্ছে। একটু থেমে একটা বিড়ি ধরাল। মুখটা
বিস্বাদ হয়ে আছে, তারপরেও সস্তা বিড়ির তেঁতো ধোঁয়া ভালোই
লাগছে। সামনে, বা পাশের ঢালু জায়গাটার সামান্য দূরের অন্ধকার জুড়ে শত সহস্র
জোনাকির দল। চলতি পথে হঠাৎ থমকে উদ্ভ্রান্ত সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আজকাল শহরে
তো জোনাকির দেখা মেলাই ভার।
হয়তবা, জোনাকিদের দেখে তার মন চলে গেল ফেলে আসা কোন এক সময়ে। সেবার গ্রামে
গিয়েছিল সে। সেখানে, বাঁশ-বাগানে সে দেখেছে এরচেয়ে বহুগুণ জোনাকির দল। গ্রামের কথা
মনে পড়তেই তার মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠল। ধান কাটার মৌসুমে সে গিয়েছিল গ্রামে, ক্ষেত
মজুরের শ্রমিক হিসাবে। তারপর গ্রাম ভাল লেগে যায় তার। গ্রামের আলো বাতাস, দিগন্ত
বিস্তৃত শস্যখেত, অকৃত্রিম মানুষগুলি- সবকিছুই তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। নদীর পাড়ে
বসে সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত অথবা শীতে বিস্তৃত হলুদাভ সরিষা ক্ষেত- সবকিছুই তাকে
দিয়েছিল অকৃত্রিম মুগ্ধতা। এর বিপরীত চিত্র মানে তার শহরের জীবনের চিত্র পাশাপাশি
দাড় করিয়ে এক মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নেয়- থেকে যাবে গ্রামে। কিছুদিন পর তার মনে হয়,
নাহ এভাবে না, ক্ষেত মজুর হিসাবে না- তাকে স্থায়ী ভাবেই গ্রামে থাকতে হবে। স্থায়ী হতে হলে তাকে অনেক টাকা পয়সা সংগ্রহ করতে হবে- কিনতে হবে এক টুকরো জমি। তাই সে আবারও ফিরে এলো শহরে এবং প্রাণান্ত
প্রচেষ্টায় লিপ্ত হয় অর্থ সংগ্রহের। প্রথমে ভাড়ায় রিক্সা শ্রমিক। তারপর উপার্জিত
অর্থে নিজেই একটি রিক্সার মালিক। অচিরেই কাছের গ্যারেজে গিয়ে ট্যাম্পু চালনা শিখে
এবং ভাড়ায়, তাকে ট্যাম্পু সমেত শহরের ব্যস্ত রাস্তায় ছুটোছুটি করতে দেখা যায়। বছর
ঘুরতে না ঘুরতেই রিক্সা বিক্রি করে এবং উপার্জিত সঞ্চয়ী অর্থে ব্যবহার যোগ্য
মোটামুটি পূরানো একটি ট্যাম্পু ক্রয় করে সে। তারপর দৌড় ঝাপের প্রতিযোগিতা এবং স্বপ্নের
হাতছানি। শহরের পীচ ঢালা রাস্তায় হাসু পরিবহন নামক ট্যাম্পুটি ছুটোছুটি করে
সকাল-সন্ধ্যা-রাত্রিতে; সেই সাথে রোঁদ-ঝড়-বৃষ্টি পেছনে ফেলে। স্বপ্নটাও তার রঙ্গিন
হয়ে উঠে। মনের আঙ্গিনা কুঠুরিতে বাঁধানো একটি ফ্রেম- একটি ছবি:
‘নদীতীরে কাশফুল- সেই কাশ ফুলের তীর ঘেঁসে একটি বাড়ি। একচিলতে উঠান। উঠানের
এক পাশে লাউয়ের মাচা...... এক পাশে খড়ের স্তূপ-গোয়াল ঘর... সেখানে, নাদুস নুদুস
গাভীর দুধ দোহানে ব্যস্ত গিন্নী... গৃহাঙ্গনের সামনে একটুকরো জমি... সেখানে সে কাজ
করছে... নদীর ঠাণ্ডা বাতাস জুড়িয়ে দিচ্ছে তার কর্ম-ক্লান্ত দেহ...... ।
তারপর ছবিটি ঘোলাটে থেকে ঘোলাটেতর হয়ে যায় উদ্ভ্রান্তের চোখে। প্রফুল্ল-চিত্তে
হঠাৎই নেমে আসে বিষাদের কালো অমানিশা।
বেশ ভালভাবেই কেটে যাচ্ছিলো তার দিনগুলি। স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মাঝখানের
সুবিন্যস্ত দূরত্ব প্রায়ই চলে এসেছে তার নাগালে, এখন শুধু সমাপ্তির রেখা টানা।
কিন্তু অদৃষ্টে যে লেখা টানা আছে সেটা সমাপ্তিরই। স্বপ্ন বিভোর সে চক্ষু তাঁরায়
হঠাৎই নেমে এলো রুদ্র ঝংকার। যন্ত্র দানবের নিচে চাপা পড়ল তার স্বপ্ন। এরপর আর
স্বপ্ন দেখে না সে। স্বপ্ন গুলোই হাহাকার হয়ে তৈরি করল নতুন এক উদ্ভ্রান্তকে।
আরেকটি বিড়িতে অগ্নিসংযোগ করল উদ্ভ্রান্ত। আখড়া থেক সরিয়ে আনা ম্যাচটি
এইমাত্র সে হারিয়ে ফেলেছে তাই বাধ্য হয়ে আগের বিড়ি থেকে আগুন স্থানান্তর করল দু
আঙুলের ফাঁকে ধরা বিড়িটিতে। প্রচণ্ড খিদে এবং ক্লান্তি- দুটোই ঊর্ধ্বমুখী, কিন্তু
নেশার মাদকতায় অনেকটা ম্লান। তবে তৃষ্ণা বোধ ভাবিয়ে তুলেছে তাকে। এখানে সমাধা হবে
না জানে। দেখা যাক, সামনে কোথাও পাওয়া যায় কিনা।
চলার থমকে পরা গতি আবারও বাড়িয়ে দিল সে। জ্যোৎস্নার আলো এখন অনেকটা ম্লান।
ভেসে যাওয়া মেঘ এবং চাঁদ লুকোচুরি খেলছে। বাতাসের প্রবাহ এতক্ষণ নিথর ছিল, কিন্তু
কোথা হতে আগমনী এক পশলা ধূলিময় বাতাস উদ্ভ্রান্তকে শিহরিত করে গেল । একই সাথে কোথা
হতে ভেসে এলো একঝাক চড়ুই এর কিচির মিচির শব্দ। তারপর সবকিছুই আগের মত নীরব।
শিহরিত সে ভাব কাটানোর জন্য হালকা গলায় পরিচিত গান ধরল উদ্ভ্রান্ত। নীরবতার
মাঝে তার সে গানের লয় বাতাসের দানায় ভর করে ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত আঙ্গিনা জুড়ে- জোরালো
ধ্বনিতে। অবশ্য
ক্ষুধা-তৃষ্ণার পতি-ক্রিয়ায় সে গান থেমে গেল একটু পরেই।
হঠাৎ উদ্ভ্রান্তের মনে হল, সে নারী কণ্ঠ শুনতে পেয়েছে। কেমন যেন চাপা-বিকৃত স্বরধ্বনি। তার চিন্তা-চেতনা এলোমেলো হয়ে গেল। না, এবার সে ঠিকই
শুনতে পেয়েছে। কিন্তু এ পরিবেশে ও এ সময়ে তা অবাস্তব-ভ্রান্ত মনে হওয়াই যুক্তিসঙ্গত হলেও এবং নিজের নেশাচ্ছন্নতার মাঝেও
অবিশ্বাস করতে পারল না সে। শব্দ এসেছে সামনের সামান্য দূর হতে। নিজের করনীয়তা নিয়ে
চিন্তা চলল মনে। যেহেতু শব্দ এসেছে তার যাত্রা পথের দিক থেকেই, সুতরাং চলার গতি
একটু বাড়িয়ে দেয়া যাক।
মিনিট দশেক পরে চাপা কোলাহল এবং গোঙ্গানির শব্দে তার মনে একটিই প্রশ্নের
অবতার হল ঘটনার কৌতূহলে এবং এর দু মিনিট পরে সে আবিষ্কার করল এ শব্দের উৎস-মূল। জ্যোৎস্নার আলো যেভাবে ঢাকা পরেছিল মেঘের উপরে, সে মেঘ কেটে যেতেই প্রস্ফুটিত জ্যোৎস্নায় চার-পাঁচটি মানব আকৃতি ধরা পড়ল উদ্ভ্রান্তের নেশা-তুর
চোখে। ক্ষণিক চিন্তা ভাবনা শেষে অনাহূত এ পরিস্থিতি সে এড়িয়ে যাবে, কিন্তু
রেললাইনের স্লিপারের উপর আবিষ্ট মূর্তির গোঙ্গানির শব্দে পরিবর্তিত হল তার এ সিদ্ধান্ত। একটি মেয়ে।
আরেকটু এগিয়ে যেতেই সে মুখোমুখি হল দৃশ্যটির।
পৈচাশিকতার শ্রেণী বিভাজনে এ অবশ্যই প্রথম শ্রেণীর। উদ্ভ্রান্তের চিন্তা-চেতনায়
যে নেশা-তুর বিভ্রান্তির অবকাশ ছিল সামান্য হলেও, এখন এক মুহূর্তেই নেশাময়তা পাশে
ফেলে মুখোমুখি হল বাস্তবতার এ নাট্যমঞ্চে।
তার করনীয় কি? বিবেক মাথাচাড়া দিয়ে উঠল......।
রাত্রির স্তব্ধতার কোলে ডুব দিয়ে ধরিত্রী হারিয়ে যেত ঠিকই, হয়তবা তার
সহযাত্রী সময়ও- কিন্তু একটা সময়ের বর্তমান: ধরিত্রীকে অন্ধকার ঠেলে জ্যোৎস্না আলোয়
নিয়ে এলো আরও একবার নাট্যমঞ্চের নিষ্প্রাণ দর্শকের ভূমিকায়...।
একটা চাপা কোলাহল... উদ্ভ্রান্তের আর্তনাদ... ক্রমশ ক্ষীণ গোঙ্গানি...
অট্টহাসি পিচাশের... ।
রুপালী চাঁদের আলোয় যান্ত্রিক রেললাইন চলে গেছে ক্রমশ দৃষ্টিসীমার বাইরে,
যেন নিশ্চল কোন সরীসৃপ জ্যোৎস্নার আলোয় এবং ধরণীর নরম মৃত্তিকার আলিঙ্গনে
আবেশিত-সুদূর প্রসারিত। সেই নিশ্চল যান্ত্রিক সরীসৃপের দেহ কাঠামোর উপর পরে আছে
দুটো প্রাণ- দুটো দেহ।
রেললাইনের লোহার পাতের সাথে হাত পা বাঁধা অবস্থায় পরে আছে একটি নগ্ন নারী
দেহ। চাঁদের আলোয় সে ফর্সা রমণী দেহের আহত যন্ত্রণাগুলো আছড়ে পড়ছে অমসৃণ স্লিপারের
উপর। শরীরে অমানুষিক যন্ত্রণার চিহ্ন, সেই সাথে দেহের ক্ষতগুলো থেকে অবিরাম রক্ত
ঝরছে। তারপরেও স্বীয় চেতনার বিলুপ্তি ঘটেনি তার বেলায়।
পরিধেয় বস্র দ্বারা তার হাত পা বাঁধা এবং মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টায় লোহার
পাতের সাথে ঘর্ষণে হাতের চামড়া ছিলে গিয়ে রক্ত ঝরছে। এবার দেহটিকে অনেক কষ্টে
বাকিয়ে মুখ নিয়ে এলো ডান হাত বাঁধা উড়নার কাছে। অবশেষে দন্ত সহযোগে বিশ মিনিটের
অমানুষিক পরিশ্রমের ফসল হিসাবে খুলে ফেলল ডান হাতের বাঁধন।
নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করতে আরও কিছুটা সময় পার হয়ে গেল তার। ক্ষতস্থান
থেকে রক্ত পড়ছে, সেই সাথে নিঃশেষিত হচ্ছে তার প্রাণ শক্তি- সেদিকে মেয়েটির
ভ্রুক্ষেপ নেই, নেই পাষণ্ডদের অত্যাচারে দোমড়ানো-মোচড়ানো তার প্রায় অসাড় দেহটির
দিকে। চক্ষু-যুগলের নির্বাক দৃষ্টি রাতের শূন্যতাকে ছাড়িয়ে বিদ্ধ হয়েছে আরেকটি
দেহের উপর।
উদ্ভ্রান্ত পড়ে আছে। নিশ্চল- নিথর।
দু হাত দিয়ে স্লিপার আঁকড়ে ধরে সরীসৃপের মত দেহটিকে টেনে হিঁচড়ে মেয়েটি চলে
এলো উদ্ভ্রান্তের দেহের পাশে। আরেকটু পরিশ্রমে তার মাথাটি রাখল উদ্ভ্রান্তের বুকের
উপর। হ্যাঁ, এখনও প্রাণ আছে।
ক্লান্ত-অবসন্ন-জন্ত্রনাদগ্ধ দেহটি পড়ে রইল আরেকটি দেহকে আঁকড়ে ধরে। সে
দেহটির প্রাণের স্পন্দন আছে কিন্তু নেই তার অনুভূতি কিংবা অনুভূতির প্রকাশ। থাকলে
দেখতে পেত আরেকটি প্রাণ তার স্বীয় চেতনা ভুলে মিশে গেছে তার সাথে- তার চেতনায়,
সেখানে সে চিৎকার করে ডাকছে তাকে। উদ্ভ্রান্ত হয়ত শুনতে পাচ্ছে সে চিৎকার, কিন্তু
নিথর দেহ সাড়া দিতে অপারগ।
আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বিশাল একখণ্ড মেঘ গ্রাস করে নিয়েছে চাঁদকে। সেই সাথে
দমকা বাতাস। আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা গেল সামান্য পরেই। বজ্রপাত- সে আর্তনাদে
প্রকম্পিত ধরণী। একটু পরে নেমে আসে ফোঁটায় ফোঁটায় ঐকতানে রিমঝিম বৃষ্টি। বৃষ্টি
ক্ষত-বিক্ষত শরীরে মায়ার পরশ বুলিয়ে যায়। অবসাদ নেমে আসে ইন্দ্রিয়ে। মেয়েটি পরে
থাকে উদ্ভ্রান্তের বুকের উপর- একইভাবে।
বৃষ্টি পড়ছে, সেই সাথে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে উষ্ণ রক্তের প্রবাহ। হঠাৎ
উদ্ভ্রান্তের চোখের পাতা কেঁপে উঠে। নড়ে উঠে তার বা হাতের অসাড় আঙ্গুলগুলি। হ্যাঁ,
চেতনা ফিরে পেয়েছে সে।
মাথার ভিতরটা তার অসম্ভব শূন্য লাগছে। সেখানে যেন কোন কিছুর অবস্থান নেই,
কেবলমাত্র ঝিম ঝিম একটা অনুভূতি। অনুভূতির আরও গভীরে চলে গেল সে। সেই সাথে বুঝতে
পারল ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হতে শুরু করেছে। চোখ মেলে চাইল সে। বৃষ্টি হচ্ছে।
মুহূর্তেই সব কিছু মনে পড়ল উদ্ভ্রান্তের।
মেয়েটির দিকে চাইল সে। যার জন্য এ পরিণতি, সে মেয়েটিকে চেনে না উদ্ভ্রান্ত-
অন্ধকারে তাকে চেনার উপায় নেই। সে অচেনা মেয়ে পড়ে আছে তার বুকের উপর- দু হাতে তাকে
শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। মেয়েটির উষ্ণতা সে টের পাচ্ছে বারিধারার শীতলতার মাঝেও। বেঁচে
আছে মেয়েটি।
বৃষ্টি থেমে গেছে।
পাথরের উপর পরে থাকা ডানহাত উঠানোর চেষ্টা করল সে। আঙ্গুলগুলো ঠিকই নাড়াতে
পারছে, কিন্তু সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে হাত সেখানেই পরে রইল। বা হাতটিও চাপা
পরে আছে মেয়েটির দেহের নিচে। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে মোচড় দিল দেহাবয়ে। অলস
সরীসৃপের মত একটু কেঁপে উঠল দেহ। সেই সাথে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় দ্বিতীয় বারের মত
জ্ঞান হারাল সে।
তবে মেয়েটির চৈতন্য হল। সে তার দেহটিকে টেনে হিঁচড়ে আরেকটু উপরে নিয়ে এলো। উদ্ভ্রান্তের তপ্ত নিঃশ্বাস সে টের পাচ্ছে। একটু দম নিলো সে। মেয়েটি চেনে না এ মানুষটিকে। পিচাশরা যখন তার দেহটাকে নিয়ে একখণ্ড
জড় মাংসপিণ্ডের মত লোফালুফি করছিল, তখন এই মানুষটিই এগিয়ে আসে তাকে সাহায্য করতে।
লোকটির পরিণতির জন্য সেই দায়ী। অন্ধকারে তাকে চিনতে না পারলেও হৃদয়ের অন্তঃস্থল
থেকে শ্রদ্ধা-ভালবাসা সে অনুভব করছে লোকটির জন্য। পুরুষ মানুষকে ঘৃণা করে সে, ঘৃণা
করে তার এ দেহটিকেও। অথচ এ দুটোই টিকিয়ে রেখেছে তার জীবন কে।
হায়রে জীবন। নষ্ট জীবন।
সে নষ্ট জীবনেও একজনকে ভালবেসেছে সে। অবহেলায়, মানুষেরা যখন তাকে মানুষ
ভাবতে পারেনি, সেখানে, সামান্য সহানুভূতি তার ডালপালা বিস্তার করে ভালবাসা হয়ে চির
অবস্থান নিয়েছে তার অন্তরে। সে অনেক দিন আগের কথা। তারপর অনেকবারই দেখেছে সে
মানুষটিকে কিন্তু মুখোমুখি হয়নি। অবশেষে যেদিন তার মুখোমুখি হল, তখন তাকে দেবার মত
কিছুই ছিল না বিনিময়ে। যে নষ্ট দেহ- যার প্রতি পুরুষের হায়েনা লোলুপ দৃষ্টি, সে
দেহটিও তাকে দিতে চেয়েছিল রিক্ত প্রত্যয়ে। সে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কিন্তু এ
প্রত্যাখ্যান সে মানুষটিকে নিয়ে গেছে আরও উপরে- মনের সর্বোচ্চ অসীনে। যেখানে এই
মুহূর্তে বসে আছে এই অচেনা মানুষটি।
উদ্ভ্রান্তের জ্ঞান ফিরল আরও সামান্য পরে। মুখের ভিতর তার নোনতা স্বাদ। খুক
করে কেশে উঠল সে। চোখ বন্ধ অবস্থায় টের পেল মেয়েটি তার দেহের পাশে সরে যাচ্ছে।
মেয়েটির দেহের উষ্ণতায়ই এখন পর্যন্ত টিকে আছে উদ্ভ্রান্ত। বা হাতটি সে নাড়াতে
পারছে। মেয়েটি তার ডান হাতখানা চেপে ধরে আছে শক্ত করে। মাথাটা সামান্য বা পাশে কাত
করল সে। চোখ মেলে চাইল। অন্ধকারে ঝাপসা একটা অববয় ধরা পড়ল তার চোখে।
উদ্ভ্রান্ত কথা বলার চেষ্টা করল, কিন্তু মুখ দিয়ে বের হল গোঙ্গানির মত
শব্দ। সেই সাথে এক ঝলক তাজা রক্ত। মাথাটা পুরোপুরি বা পাশে নিয়ে এলো সে। হর হর করে
বমি করে দিল স্লিপারের উপর।
‘আফনের কি খুব কষ্ট হইতাছে?’- উদ্ভ্রান্তের মুখের কাছে মাথা নামিয়ে
জিজ্ঞাসা করল মেয়েটি।
উদ্ভ্রান্তের উত্তর দেয়ার মত অবস্থা ছিল না। মেয়েটির কথাগুলোও সে পরিষ্কার
শুনতে পায়নি। কিন্তু অনুভূতি দিয়ে বুঝতে পারছে, পরম মমতায় উঠানামা করছে দুটো হাত
তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট দেহের উপর।
রাত্রি শেষ হতে কতটা সময় বাকি কেউ জানে না। দু জন পরে আছে পাশাপাশি-
চুপচাপ।
হঠাৎ, উত্তরে বহুদূর থেকে ভেসে এলো একচিলতে অথচ জোরালো আলো। সে আলোয়
মুখোমুখি দুজন- মুখোমুখি দু জোড়া চক্ষু। অচেনাকে চেনায় মুখোমুখি।
উদ্ভ্রান্ত চিনতে পারল মেয়েটিকে। বকুল ফুলের মালা বিক্রেতা সেই বালিকা-
আজকের নিশি কন্যা। মেয়েটিও চিনতে পারল- যাকে সে অনেক আগেই তার হৃদয়ের উচ্চাসনে বসিয়ে রেখেছে।
মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়ল উদ্ভ্রান্তের বুকের উপর, কিন্তু তা এক মুহূর্তের জন্য।
পরক্ষণেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ল উদ্ভ্রান্তকে রেল লাইনের উপর থেকে সরাতে।
উদ্ভ্রান্তের দেহে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। পিচাশেরা ধারাল অস্র
দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করেছে তার দেহটিকে, সেই সাথে মেয়েটিরও। আহত মেয়েটি নিজের প্রতি
তোয়াক্কা না করে প্রাণপণে চেষ্টা চালাচ্ছে। পরিশ্রমে সে হাঁপিয়ে উঠেছে, ক্ষতগুলো
থেকে তার নতুন করে বইছে রক্তধারা। এক সময় মেয়েটি বুঝতে পারল, না সম্ভব নয়।
উদ্ভ্রান্তের পাশে সে এলিয়ে দিল তার নগ্ন দেহখানি।
‘ফালানি তুই চইল্যা যা’- অনেক কষ্টে কাঁপা কাঁপা স্বরে বাক্যটি উচ্চারণ করল
উদ্ভ্রান্ত।
উত্তরে, ফালানি ডানপাশে ফিরে লম্বভাবে জড়িয়ে ধরল উদ্ভ্রান্তকে। দু হাত দিয়ে
পেঁচিয়ে ধরল তার গলা।
‘আমারে তুই ভালবাসিস?’- জীবনে কারও ভালবাসা পায়নি সে। পায়নি কোন নারীর একটু
ভালবাসার আলিঙ্গন। অথচ তারও একটি স্বপ্ন ছিল- নদীতীরে কাশফুলের তীর ঘেঁসে একটি
বাড়ি... একটি সংসার। আজ মনের ফ্রেমে বাঁধা সেই ছবিটা আবার দেখতে পাচ্ছে। সেখানে
দেখছে ফালানিকে।
‘না, আমি কাউরে ভালবাসি না। আমি বেশ্যা। বেশ্যারা কাউরে
ভালবাসে না’- উদ্ভ্রান্তের গলায় মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠল সে।
আলোটা ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে এবং এগিয়ে আসছে দ্রুত।
ফালানি মাথা উঁচু করল। উজ্জ্বল আলোয় দুজন দেখছে দুজনকে। এক মুহূর্ত পরে
ফালানির রক্তশূন্য ঠোঁট দুটো নেমে এলো উদ্ভ্রান্তের রক্তমাখা ঠোঁটের উপর।
রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে চিৎকার করে উঠল যন্ত্রদানব।
শেষ রাতের ট্রেন।