My Personal Blog ...

ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। -২



ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। -১


নিত্যকার  অভ্যাস মত সেদিন কুকুরটি পরিচিত এক লোকের পিছু নিয়েছিল খাদ্যের লোভে। পরিচিত অন্যদের মত সে লোকটি অনেকবারই তার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছে কোন খাদ্যদ্রব্যের অংশ। লোকটির পিছু পিছু এক কনফেকশনারীর দোকানের সামনে চলে এলো সে। এ দোকানের মালিককেও খুবই পছন্দ করে কুকুরটি। দিন কিংবা সন্ধ্যার ব্যস্ততার অনেকটা সময় দোকানের সামনে বসে থাকে সে খাদ্যের লোভে। দোকানদার ভদ্রলোক খরিদ্দারদের কেক-রুটি ইত্যাদির উচ্ছিষ্টাংশ তুলে রাখে কুকুরটির জন্য এবং তার জন্য বাড়িতে থেকে পাঠানো টিফিন বক্সের দুপুর কিংবা রাতের আহারাদির সামান্য অংশও পায় সে লোকটির তরফ থেকে।

পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছরের যুবক এই নতুন লোকটি। দোকানদার লোকটির বয়স তার দিগুণেরও বেশি। দোকানের ভিতর দুজন আলাপ চারিতায় মুখর- কুকুরটি একমনে বসে আছে দোকানটির সামনে।

‘লায়ন... লায়ন’- দোকানদার মনিবের নাম শুনে লেজ নাড়তে নাড়তে কুকুরটি উঠে দাঁড়াল এবং একটু সামনে চলে এলোসে তার দিকে পাউরুটি ছুঁড়ে দিল- উড়ন্ত পাউরুটি  খপ করে দাতে আটকিয়ে পূর্বের জায়গায় বসে আরাম করে খেতে লাগল ।

ঘণ্টা খানিক সেখানেই বসে রইল কুকুরটি। পরিচিত লোকটি চলে গেল এবং একটু পর ফিরে এলো নাইলনের মোটা দড়ি হাতে নিয়ে। দোকানদার ভদ্রলোক দোকান থেকে বেড়িয়ে এসে কুকুরটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল। তারপর দুজনে মিলে দড়ি পরিয়ে দিল কুকুরটির গলায়। এবার তাকে ঠেলে-ঠুলে তোলা হল রিক্সায়। কুকুরটি কোন প্রকার প্রতিবাদ করল না, এমনকি লাফিয়ে রিক্সা থেক নামারও চেষ্টা করল না। নতুন মনিবের হাত থেকে পাউরুটি খাচ্ছে সে। নতুন মনিবও খুব ভাল- তার মাথায় হাত বুলচ্ছে নিয়মিত।

আরও এক কি দেড় ঘণ্টা পর কুকুরটি তার নতুন মনিবের বাড়িতে প্রবেশ করল। পথে সামান্য প্রতিবাদও করেনি সে।  

নতুন মনিবের থাকার ঘরের সামনে বেঁধে রাখা হল তাকে। একটু পর পুরনো প্লেটে খাবার পরিবেশন করা হল। কুকুরটির পেতে খিদে নেই- খাবারের গন্ধ বার দুয়েক শুকে মুখ ফিরিয়ে সেখানেই বসে পড়ল এবং রাত্রিটা সেখানেই অতিবাহিত সে করল

অচেনা-অজানা পরিবেশ, রাত্রিবেলায় তাই কোনরকম ডাকাডাকি করেনি কুকুরটি। কিন্তু সকাল বেলায় নিজের উপস্থিতি জানান দেবার জন্য কয়েক বার ঘেউ ঘেউ শব্দ তুলে ডেকে উঠল।
মনিবের রুমের দরজা খুলে গেল। হাই তুলে মনিব কুকুরটির সামনে- রুমের সিঁড়িতে পড়ল বসে। মনিবকে দেখে সে বারবার লেজ নাড়তে লাগল। সে পালিয়ে যাবে না – এ বিশ্বাসে মনিব কুকুরটির বাঁধন মুক্ত করে দিল।

নিত্যকার অভ্যাস মত মনিব সেখানে বসেই সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করল এবং কুকুরটির মাথায় হাত বুলালো কয়েকবার। পূর্বেকার মত লেজ নাড়তে লাগল সে।

‘তারপর কুকুর ভায়া, তোমার একটা নাম দেয়া দরকার। কি নাম দেই বলত’- বলে মনিব কয়েকটি
নাম উচ্চারণ করল নিজের মনে, কিন্তু কোনটিই তার মনঃপুত হল না। সেখানে দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ চিন্তা করল মনিব, তারপর তার মুখে হাসি ফুটে উঠল, ‘পেয়েছি! তুই তো ভোলা ভালা স্বভাবের, তাই তোর নাম দিলাম “ভুলু”। আজ থেকে তোর নতুন নাম হল ভুলু’। বলেই মনিব নামটি কয়েকবার উচ্চারণ করে হাঁক ছাড়ল, ‘আয় ভুলু’। বুদ্ধিমান কুকুরটি বুঝতে পের লেজ নাড়তে লাগল।
‘তাহলে ভুলু মিয়া, চল যাই, আমরা সকালের ভ্রমণটা সেরে আসি’। মনিব সদর দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে এলোভুলু গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল- ঠিক বুঝতে পারছে না, বাইরে যাওয়া ঠিক হবে কিনা। কিন্তু মনিব আরও দু তিনবার ডাক তুললে সে তার পিছু নিলো

ঘাসে ছাওয়া গ্রামের মেঠো রাস্তা;  গ্রামগুলোর সীমানা পেড়িয়ে শস্যখেত, বিলের প্রান্ত ধরে চলে গেছে অনেকদূর- ওরা দুজন পৌঁছে গেল শস্যখেত গুলোর ঠিক মাঝখানে। নভেম্বরের শীতের প্রারম্ভিকতায় হালকা কুয়াশার চাঁদর ঘিরে ধরেছে চারপাশ কে। মেঠো রাস্তার ঘাসগুলো বিন্দু বিন্দু কুয়াশায় সিক্ত। সূর্যোদয়ের লাল টকতকে সূর্য এখন পূর্ব দিগন্ত সীমার ঠিক উপরে- তার স্বচ্ছ আলোকরশ্মি কুয়াশার চাঁদর ভেদ করে ভূমিতে পৌঁছাবার পূর্বেই সপ্তপর্ণের বর্ণালী ঢঙে সেজেছে। ঘাসের উপর বিন্দু বিন্দু কুয়াশা চিকচিক করছে সোনা আলোয়বিলের ধারে লম্বা পায়ে হেঁটে চলেছে তপস্বী বকের সারি। সেই সাথে নতুন আলোর পরশ ডানায় মেখে উড়ে চলেছে পাখি তার আকাশ আধিপত্যে

মনিব মেঠো রাস্তার শিশির সিক্ত ঘাসের উপর স্যান্ডেল বিছিয়ে বসে পড়েছে আগেই। কিন্তু কুকুরটির ভেজা ঘাসের উপর বসতে আপত্তি ছিল বিধায় মনিবের পাশে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর সে আর স্থির থাকতে পারল নাইতর প্রাণী হলেও সূর্যোদয়ের সৈন্দর্য তার চোখেও ধরা পড়েছে। ছুট লাগাল কুকুরটি। শস্যখেতের ধানগুলো কাটা শেষ হয়েছে আগেই, মাঠগুলো তাই শূন্য। সেখানে শালিক, দোয়েল, বুলবুলি ইত্যাদি পাখির দল বিচরণ করছে। ভুলু কয়েকবার ছুটোছুটি করল মেঠো রাস্তা ধরে, তারপর ফিরে এসে মনিবের পাশে দাঁড়িয়ে জিহ্বা বের করে হাঁপাতে লাগল। মনিব এবার হাতের আঙ্গুল উঁচিয়ে পাখিগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘ ভুলু, ধর!’ বুদ্ধিমান কুকুর মনিবের নির্দেশ বুঝতে পেরে তীব্র গতিতে ছুট লাগাল পাখিগুলোর দিকে। লাফিয়ে লাফিয়ে শূন্য শস্যখেতগুলোর সরু আইল কিংবা বন্ধুর ভূমি পার হয়ার সময় তার পেশীবহুল শরীরের ঢেউগুলো মুগ্ধ করল মনিবকে। সেই সাথে ভুলু ঝাঁপিয়ে পড়ল পাখিগুলোর উপর। পাখিগুলো বিরক্ত হয়ে গিয়ে বসল অন্য জায়গায়, এবং সেখানে আবার হামলা চালাল কুকুরটি। এভাবে কিছুক্ষণ চলল, তারপর একটি পাখিরও নাগাল না পেয়ে হতাশ হয়ে চলে এলো মনিবের কাছে।

মনিব উঠে দাঁড়ালো। উঁচু গ্রাম্য রাস্তা ছেড়ে ক্ষেতের সরু আইল ধরে কিছুদূর হেঁটে পশ্চিমে টিলা-সম উঁচু রেললাইনে পৌঁছে গেল দুজন। কংক্রিটের স্লিপারগুলোতে সন্তর্পণে হাঁটতে হচ্ছে মনিবকে, ভুলুকেও লাফিয়ে লাফিয়ে তাল মেলাতে হচ্ছে মনিবের পিছু পিছু। প্রাতঃভ্রমণকারীদের অনেকেই আছে এখানে। নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-কিশোর-যুবক সবাই আছে, কিন্তু তাদের কারও পিছু পোষা কুকুর দেখা গেল না। একমাত্র ব্যতিক্রম তাদের বেলায়। এবং সবার দৃষ্টি কেড়ে নিলো কুকুরটি, কেননা অত্র এলাকায় এ রকম কুকুর আর একটিও নেই।

রেললাইন থেকে নেমে পূর্বদিকের পাকা রাস্তা ধরে মনিবের পিছু পিছু খোশ মেজাজে চলতে লাগল কুকুরটি। দশ মিনিট পর তারা পৌঁছে গেল দু চারটি দোকান সমেত গ্রাম্য বাজারে। সেখানে গ্রাম্য টি-স্টলের বাঁশের বেঞ্চে বসে চা পান করল মনিব। দোকান থেকে একটি পাউরুটি নিয়ে মনিব ছুঁড়ে দিল তার দিকে। ভুলু বসেই খপ করে উড়ন্ত পাউরুটি মুখে পুরে নিলো, পাউরুটিটি মুখ থেকে নামিয়ে, সামনে মেলে দেয়া দু পায়ের ফাঁকে শক্ত করে ধরে একটু একটু ছিঁড়ে অলস ভঙ্গিমায় চিবুতে লাগল, যেন কোন আগ্রহ নেই খাবারের প্রতি- নেহাতই খাদ্য বলে খাওয়া হচ্ছে। মনিব কুকুরটির এ রাজকীয় স্টাইলে খাওয়া দেখে হেসে দিল
টি-স্টলের পাশেই একচিলতে ছাউনির নিচে লাকড়ির চুলা জ্বেলে গরম গরম ভাপা-পিঠা তৈরি হচ্ছে এবং পাশেই কয়েকজন খেয়ে চলছে ধোঁয়া উঠা গরম ভাপা-পিঠা মনিব সেখানে বসে সাবাড় করে চলল পিঠা একটি পিঠা ছুঁড়ে দিল সে কুকুরটির দিকে ভুলু পূর্বেকার মত আয়েশ ভঙ্গিমায় বসে ছিল দোকানের সামনে পিঠাটি সেভাবেই খপ করে দাতে কামড়ে ধরল এবং পর মুহূর্তেই তড়িৎ দাঁড়িয়ে পড়ল পিঠা ফেলে গরম! তারপর বার তিনেক পিঠের গন্ধ শুকে খুবই সাবধানে সামান্য ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল উপস্থিত সবাই হেসে উঠল কুকুরটির এ নাটকীয় আচরণে

ভুলুর পিঠে খাওয়া শেষ হলে দুজনে বাড়ির পথ ধরল দূরে- সামনে একটি গ্রাম্য কুকুর হয়তবা ভুলুকে দেখে থাকবে কুকুরটি চিৎকার জুড়ে দিল তার আহবানে হাজির হল আরও দুটি কুকুর এবার তিনটি মিলে ঘেউ ঘেউ দিল শুরু করে ভুলু মনিবের পিছনে ছিল, ভয়ঙ্কর চাপা গর গর শব্দ তুলে সামনে চলে এলো বিদেশি রক্ত তাকে শান্ত সুবোধ আচরণের অধিকারী করে তুলেছে, সেই সাথে দেশীয় রক্তের ক্ষিপ্রতা-হিংস্রতা রয়ে গেছে পুরো মাত্রায় এক পা দু পা করে সন্তর্পণে এগুচ্ছে ভুলু আগের মত শব্দ তুলে। তিনটি কুকুরের দলে আরও দুটো জুটল। এতক্ষণে কুকুরগুলো সামনে চলতে শুরু করল তাদের এলাকার অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে।

ভুলু মনিবকে ছেড়ে বেশি সামনে এগুতে সাহস পেল না, কেননা এতগুলো শত্রুর বিরুদ্ধে সে একা পেরে উঠবে না কিছুতেই- একটির গলা কামড়ে ধরলে অন্নগুলো তার পিছনের ঠ্যাং কিংবা ঘাড় কামড়ে ধরবে। আসলে মনিব সাথে না থাকলে সামনে এগুনোর সাহস তার হত না।
কুকুরগুলো মনিবের পরিচিত- স্থানীয় কুকুরের জোট। এগুলো তাদের বেশ উপকারেই আসে। গৃহপালিত হাস-মুরগিগুলোকে রক্ষা করে শেয়াল  বনবিড়াল এদের থেকে। রাত্রিবেলা অচেনা অনুপ্রবেশকারীর বিরুদ্ধে কুকুরগুলো নরকের সেপাই স্বরূপ- অথচ স্থানীয় সবাই এদের পরিচিত। মনিবের ইচ্ছা ছিল না কুকুরগুলোর সাথে ভুলু মারামারি বাধিয়ে দিক কিংবা কুকুরগুলো তার পোষা কুকুরটির কোন প্রকার শারীরিক ক্ষতি করুক। কুকুরগুলো কাছাকাছি হতেই মনিব সেদিকে ডানহাত বাড়িয়ে পরিচিত ডাক তুলল। প্রতিউত্তরে কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে উঠল। তবে এ ‘ঘেউ ঘেউ’ পূর্বের চেয়ে নমনীয় অর্থাৎ আপোষের সূর। ভুলুও একই স্বরে ঘেউ ঘেউ করে চলল। কুকুরগুলিকে অতিক্রম করল দুজন সতর্ক দৃষ্টি রেখে। সামান্য পর দুটি কুকুর পিছু নিতে চাইল ওদের, অন্যগুলো একই স্থানে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করছিল। ভুলু মনিবের পিছে পিছে আসছিল, একটু দূরত্বে কুকুর দুটির ডাক শুনে সে থেমে উল্টো ঘুরে ঘর ঘর আওয়াজ তুলে দু কদম এগিয়ে এলোকুকুর দুটি পিছিয়ে গেল সভয়ে। ভুলু সেদিক হতে মনোযোগ ফিরিয়ে দৌড়ে কাছে চলে এলো মনিবের। কুকুর দুটি সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল, এবার আর পিছু নেয়ার সাহস পেল না।

বাড়িতে পৌঁছে গেল দুজন। টিউবওয়েলের পানিতে হাত-পা ধুয়ে বদ্ধ তালা খুলে রুমে প্রবেশ করল মনিব। ভুলু বসে পড়ল দরজার সামনে, গতরাতে যেখানে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল।
মনিব তার রুম ছেড়ে বেড়িয়ে এলোতারপর ভুলু মিয়া, চল, তোমার সব বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই’- মনিবের এ কথার অর্থ ভুলু না বুঝলেও লেজ নাড়তে নাড়তে তার পিছু নিলোবেশ বড় একটি ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো মনিব। ভুলুও দাঁড়িয়ে পড়ল সেখানে। এ ঘর থেকে পরিচিত গন্ধ তার নাকে এসেছে নতুন মনিবের বাড়িতে আসার সাথে সাথেই। সেই সাথে আরও পাঁচ মিশালি গন্ধ সে পাচ্ছে আসে পাশের বাতাসে। ঘরের ভিতর থেকে প্রাণীগুলোর কোলাহল ভেসে আসছে।
দরজা খুলে মনিব ভিতরে প্রবেশ করলে ভুলু সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং এক মুহূর্তে বিস্ময়ের ঘোরে ঘেউ ঘেউ ডেকে উঠল। ভিতরের দু পেয়ে সাদা প্রাণীগুলো তার দাকে ভয় পেয়ে শুরু করে দিল ছুটাছুটি এবং চমকিত প্রাণীগুলো একে অপরের ঘা ঘেঁসে জড়ো হল ঘরের কোনায়। মনিবের ধমক খেয়ে চুপ মেরে গেল কুকুরটি, কিন্তু বিস্ময় কাটল না কিছুতেই।

‘ভুলু মিয়া, তোমারে বাড়িতে আনছি এই ফার্মের মুরগি গুলারে পাহারা দেবার জন্য। মনে থাকবে তো?’- তার দিকে চেয়ে বলা মনিবের কথাগুলো কুকুরটি বুঝল না, শুধুমাত্র লেজ নাড়তে লাগল আনুগত্য প্রকাশে।

সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই মনিব চলল সেদিকে। ভুলু একই স্থানে দাঁড়িয়ে পরম মনোযোগের সাথে নাদুস-নুদুস ব্রয়লার মুরগিগুলোকে দেখতে লাগল, মনিবের পিছু নিলো না।

‘বস, এইডা কি!’- আগুন্তুক বলল।

মনিব কোন উত্তর দিল না। কুকুরটিকে নাম ধরে ডাক দিল সে। ভুলু মনিবের সামনে এসে লেজ নাড়তে লাগল। সেই সাথে নতুন আগুন্তুককে দেখে আনুগত্য প্রকাশের স্বরে ডেকে উঠল একবার।

‘ফার্মের পাহারাদার। তোর কি মনে হয়, চলবে?’

‘চলবে মানে বস, অবশ্যই চলবে’- লোকটি বলল। ভুলু তার মনিবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত বুলালে আনন্দে তার পা চেটে দিল লেজ নাড়তে নাড়তে।

‘বস, কুত্তা ডা খুব সুন্দর। কি নাম কুত্তা ডার?’- লোকটি ভুলুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল।

‘ভুলু’।

‘বস, কুত্তা ডার নাম টাইগার রাখন যায় না?’

‘তোর ইচ্ছা হলে তাই ডাকিস, এখন যা ফার্মের কাজগুলো শেষ কর’।

লোকটি কয়েকবার টাইগার শব্দটি উচ্চারণ করল কুকুরটির সামনে। বুদ্ধিমান ভুলু বুঝতে পারল তার এই মনিব তার নাম দিয়েছে টাইগার। কুকুরটিকে এ নামে ডেকে ডেকে লোকটি নিয়ে গেল ফার্ম ঘরের পিছনে। ফার্ম শেডের বাইরের প্লাস্টিক-চটের পর্দা তুলে দিল সে। এবার আর মুরগিগুলোকে দেখে ঘেউ ঘেউ করল না ভুলু।

মনিবের ‘ভুলু’ ডাক শুনতে পেয়ে সে দৌড়ে তার কাছে চলে এলোমনিবের পিছু পিছু চলে এলো অন্যত্র। সামনে একটি নিচু ছোট ঘর- সে ঘর থেকে ভুলুর অপরিচিত প্রাণীগুলো থেকে থেকে ডেকে উঠছে বিকট স্বরে। ভুলু আগের চেয়ে সতর্ক এবং কৌতূহলী, কেননা পূর্বের কোন মনিবের বাড়িতে এ প্রাণীটির গন্ধ সে পায়নি। মনিব ঘরের ছোট দরজা খুলে দিতেই প্রাণীগুলো দানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে লম্বা গলা শূন্যে তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়িয়ে এলো নিত্যকার মত। তাদের বিশাল ডানা এবং লম্বা গলা দেখে ভুলু ভড়কে গেল এবং ডেকে উঠল ঘেউ ঘেউ করে।

পুনর্বার মনিবের ধমক খেয়ে থামল সে। রাজহাঁসগুলো ভয় পেয়ে সড়ে এলো একপাশে। কিন্তু যে রাজহাঁস দম্পতির ছোট ছোট চারটি ছানা ছিল, তারা উভয়ে তেরে গেল কুকুরটির দিকে। ভুলু অবাক হল, কিন্তু এবার ঘাবড়ে না গিয়ে ধমকে উঠল রাজহাঁস দুটোর প্রতি। সে দুটো থমকে চিৎকার জুড়ে দিল, সেই সাথে অন্য গুলোও যোগ দিল তাদের সাথে। বাচ্চা চারটি পর্যন্ত প্রতিবাদ করতে লাগল।
মনিব ভুলুকে শান্ত করল, সেই সাথে রাজহাঁসগুলোর প্রতি পরিচিত ডাক ছাড়লরাজহাঁসগুলো
যেন এবার বুঝতে পারল, চারপেয়ে ঐ রোমশ প্রাণীটির তাদের কোন ক্ষতি করার ইচ্ছা নেই, মনিব আছে যে।

রাজহাঁসগুলোর ঘরের পাশে একই রকম আরেকটি ছোট ঘর। এ ঘরের বাসিন্দাদের শরীরের গন্ধ ভুলুর পরিচিত- পরিচিত তাদের মিলিত ধ্বনি কিংবা পুরুষগুলোর উচ্চ স্বরের ডাক।

ছোট দরজা খুলে দিতেই প্রাণীগুলো বেড়িয়ে এলো প্রতিযোগিতা করে। প্রথমে বের হল বাদামি রঙের সবগুলো মুরগি। ভুলু অবাক হয়ে গেল কেননা এ রঙের এতগুলো মুরগি সে দেখেনি কখনও। বেশ নাদুস নুদুস। তবে ভুলু আরও অবাক হল, রাজহাঁসগুলোর চেয়েও উঁচু সোনালী সাদা পালকের লম্বা লাল ঝুঁটিওয়ালা মোরগগুলোকে দেখে। কিন্তু এবার আর ঘেউ ঘেউ করে উঠল না। মুরগিগুলো ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়েই হঠাৎ করে কুকুরটিকে দেখে লাফিয়ে সরে কক কক ডাকতে লাগল। 

মোরগগুলোর সেদিকে দৃষ্টি পড়তে সতর্ক হয়ে উঠল- তাদের ঘাড়ের লম্বা সোনালী কেশরগুলো ফুলে উঠল যোদ্ধান্বেহি ভঙ্গিমায়। কিন্তু কুকুরটির সামনে আসতে সাহস হল না কারও।

মনিবকে তার ঘরে প্রবেশ করতে দেখে ভুলু দরজার কাছে বসে পড়ল। রুমের সামনে একচিলতে উঠোন, তার পরেই ছোট একটি পুকুর। পুকুরের এ পাশে তৈরিকৃত ইট কংক্রিটের পাকা সিঁড়ি ক্রমশ ধাপে ধাপে উপরে উঠে উঠোনের সামনে শেষ হয়েছে। রুমের বা পাশে সিমেন্টের চারটি খুতির উপর উঁচুতে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছোট ঘর। সে ঘরে অনেকগুলো খুপরি মত রুম এবং এর বাসিন্দারা সেই সাত সকাল থেকে একটানা বাক বাকুম করে ডেকেই চলছে। এ প্রাণীটিও ভুলুর পরিচিত, কিন্তু আগ্রহ নেই এদের প্রতি।

মনিব একটি পাত্র হাতে রুম থেকে বেড়িয়ে এলোপাত্রটি নিয়ে মই বেয়ে সে পৌঁছে গেল উঁচু ঘরটির সামনে। কয়েকটি তাকের উপর সজ্জিত ক্ষুদে পাত্রগুলো হাতের পাত্রের খাদ্যশস্য দ্বারা পূর্ণ করে খুপরি রুমগুলোর দরজা খুলে দিল। কবুতর গুলো বেড়িয়ে এলোকেউ বা উড়ে গিয়ে বসল টিনের চালের উপর, গাছের ডালে, পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে। অন্যগুলো ছোট পাত্র থেকে খাদ্যশস্য তুলে খেতে লাগল। মনিব মই বেয়ে নিচে নেমে এসে পুকুর পাড়ের সিঁড়িতে খাদ্যশস্য ছিটিয়ে দিল, সেখানের কবুতর গুলো খেতে লাগল খুঁটে খুঁটে।

ভুলু চুপচাপ বসে কবুতরগুলোকে দেখছে। একবার তার ইচ্ছে হয়েছিল কবুতর গুলোর মাঝখানে ছুটে যেতে- কিন্তু সেদিকে গেল না সে মনিবের ধমকে। সামান্য দূরে মুরগি এবং রাজহাঁসগুলো জটলা করছে। অন্যদিনের মত কবুতর গুলোর জন্য বরাদ্দকৃত শস্যকণায় ভাগ বসাতে সিঁড়িতে কেউ ছুটে যাবার সাহস পাচ্ছে না। কুকুরটির সাথে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি, ভয় পাচ্ছে রোমশ জানোয়ারটিকে।
মনিব চলে গেল রুমে এবং একটু পরে ফিরে এলো ধূমায়িত কফির মগ হাতে নিয়ে। পুকুরপাড়ের সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে বসে পড়ল সে। কবুতর গুলোর মাঝে কোন ভাবান্তর হল না। ভুলু সামান্য এগিয়ে মনিবের পাশে বসে পড়ল, মুখ উঁচিয়ে নিজস্ব ভঙ্গিতে ডেকে উঠল দুবার।

‘ভুলু মিয়া, এগুলো আমার পরিবারের সদস্য- আজকে থেকে তুমিও যুক্ত হলে। ও হ্যাঁ, আরও একজন আছে- বদমায়েশ মিনি! শয়তানটা গতকাল আমার ভাজা মাছ চুরি করে খেয়েছিল, তাই ধোলাই দিয়েছিলাম। সেই পালিয়েছে তার আগের মনিবের কাছে। ও ব্যাটা আজই দেখবে ঠিক ঠাক হাজির হয়ে যাবে’। মনিবের ঠোঁটে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। ‘বদমাশটা আসলে তোকে যা বলব তাই করবি, ঠিক আছে?’

ভুলু লেজ নাড়তে লাগল যেন মনিবের কথাগুলো ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছে। একটি কবুতর উড়ে এসে মনিবের কাঁধে বসে পড়ল। ভুলু ঘাড় বাকিয়ে কবুতরটিকে কামড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করল। কবুতরটি সামান্য উড়ে গিয়ে ফের বসে পড়ল মনিবের কাঁধে।

‘ভুলু, এ হচ্ছে জনাব সিরাজি, মিসেস সিরাজি আসে পাশেই আছেন’- কুকুরটির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলল মনিব। ‘ঐই যে সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে আছে- ও হচ্ছে নোটন বাবু। আর ওগুলো হচ্ছে মহাশয় জালালী। ওরা হচ্ছে... । ভুলু ভায়া, তুমি কিন্তু কাউকে কামড়ে দেবে না’।    
 
রাজহাঁস এবং মুরগিগুলো দল বেঁধে আরও কাছে চলে এসেছে। নিত্যকার মত মনিবের নিকট থেকে আহার করবে বলে তার কাছে আসার চেষ্টা করছে- কিন্তু বাঁধ সাজছে কুকুরটি। ব্যাপারটি মনিবও লক্ষ্য করল এবং ওদের উদ্দেশ্যে পরিচিত হাঁক ছাড়ল, ‘আয় প্যাঁক প্যাঁক, আয় তি তি...মনিবের ডাক শুনে রাজহাঁসগুলো সমস্বরে ডেকে উঠল একবার। মুরগিগুলোর মাঝেও প্রকাশ পেল চাঞ্চল্য। একটু সামনে এসে রাজহাঁসগুলো কুকুরটির দিকে গলা বাড়িয়ে দিল- যেন মিতালি করতে চাইছে। ভুলু আগের মত ঘাড় বাকিয়ে কামড়ে দেবার ভঙ্গি করল। দম্পতি রাজহাঁস-দুটো সবার সামনে এবং ও দুটো সাপের মত হিসহিস শব্দ তুলে ভয় দেখাল কুকুরটিকে। ভুলু সামান্যও না ঘাবড়িয়ে আবার কামড় দেয়ার অভিনয় করল।

কফি পান শেষে উঠে দাঁড়াল মনিব। কফির মগ সিঁড়ির উপরে রেখে ফার্ম হাউসের দিকে রওনা দিল সে, পিছুপিছু বিশ্বস্ত ভৃত্যের ন্যায় ভুলু। কুকুরটিকে সামনে আসতে দেখে রাজহাঁসগুলো পিছিয়ে রাস্তা ছেড়ে দিল এবং সামান্য দূরত্ব রেখে আসতে লাগল ওদের পিছু পিছু। মোরগ-মুরগীগুলোও অনুসরণ করছে তাদের। আসলে যতক্ষণ পর্যন্ত না মনিব ওদের সবার আহার পরিবেশন করবে- তার পিছু ছাড়বে না কোনোভাবেই প্রাণীগুলো।                                                                                                        
‘বস, দুইডা ইন্নালিল্লাহ’- ফার্ম হাউসের ভিতর থেকে ভেসে এলো কথাগুলো। মনিবের পিছনে ভুলুও পৌঁছে গেল ফার্ম হাউসের দরজার সামনে। কর্মচারী লোকটি দু হাতে দুটো মৃত মুরগি নিয়ে বেড়িয়ে এলো ঘর ছেড়ে।

‘যা, রুমের সামনে রেখে আয়’- মনিব বলল তাকে।

ভুলু সামনে এসে মৃত মুরগি শুঁকতে লাগল। আহ, কি উপাদেয়! খুশিতে লেজ নাড়তে লাগল কুকুরটি। কিন্তু মৃত মুরগি তার দিকে ছুঁড়ে না দিয়ে কর্মচারী লোকটি অন্যত্র নিয়ে যেতে উদ্যত হলে ভুলুও পিছু নিলো তার সে মৃত মুরগি দুটো পাকা মেঝেতে নামিয়ে রাখলে ভুলু গিয়ে বসল সেখানে সামান্য পরে বসা অবস্থাতেই বিশেষ ভঙ্গিমায় এগিয়ে এলো সামনেটাইগার খবরদার’- নতুন মনিবের ধমক খেয়ে লোভ সংবরণ করে সেখানেই বসে রইল কুকুরটি

কর্মচারী লোকটি চলে গেল ভুলু কিন্তু মুরগি স্পর্শ করল না এক ধমকেই বুঝে নিয়েছে- এটি খেতে তাকে নিষেধ করা হয়েছে

মনিব এসে ব্লেড দিয়ে মুরগি-দুটো কাটাকুটি করল পোস্টমর্টেম তারপর একটি মুরগি ছুঁড়ে দিল পুকুরে মুহূর্তেই পানির মধ্যে সৃষ্টি হল আলোড়ন বিশাল বিশাল বিদেশী মাগুরগুলি ঝাঁপিয়ে পড়েছে সাদা মৃতদেহের উপর আস্ত মুরগিটি এই পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে আবার ভুস করে ভেসে উঠছে ভুলু এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেদিকে

দ্বিতীয় মুরগিটি তার দিকে ছুঁড়ে দেয়া হল দেশি নেড়ি কুকুরগুলোর মত হামলে পড়ল না সে খাদ্যের উপর খেতে লাগল নিজের স্বভাব সিদ্ধ আয়েশি ভঙ্গিমায়

ভুলুর কাছাকাছি রাজহাঁস এবং মোরগ-মুরগিগুলো রীতিমত চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে খাদ্যের জন্য মনিব এবার গামলায় করে তাদের জন্য খাদ্য নিয়ে এলো সবগুলো প্রাণী একই সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল গামলার উপর রাজহাঁসগুলো লম্বা গলা বাড়িয়ে গপগপ করে গিলতে লাগল দানাদার পোলট্রি ফিড মোরগগুলো তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে খেয়ে চলল কিন্তু মুরগিগুলো সুবিধা করতে পারছে না মনিব আঁচল ভর্তি খাদ্য নিয়ে মুরগিগুলোকে ডাক দিল- মুরগিগুলো এসে মনিবের হাত থেকে খেয়ে চলল অন্যদিনের মত

ভুলু একবার এদিকে চাইল, তারপর আবার মনোযোগ দিল নিজের খাওয়ায় রাজহাঁসগুলো খাওয়া শেষে ডানা ঝাপ্টালো কয়েকবার এবার দল বেঁধে পুকুরের কার্নিশে দাঁড়িয়ে পানি পান করতে লাগল পান শেষে সবগুলো রাজহাঁস সারি বেঁধে পুকুরের পাশ দিয়ে চলে গেল খোলা জায়গায় সারাদিন ওরা ঘাস খেয়ে বেড়াবে মাঠে মাঠে তারপর বিকেল হলেই ঠিক ফিরে আসবে প্রতিদিনের মত
মুরগিগুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে দু একটা অতুৎসাহী মুরগি ভুলুর খেয়ে চলা মৃত মুরগির নাড়িভুঁড়ি ধরে টানাটানি করতে লাগল রোমশ প্রাণীটিকে ওরা আগের মত ভয় পাচ্ছে না কুকুরটি দাঁত খিঁচিয়ে ধমকে উঠল ওদের প্রতি

ভূরিভোজন শেষ হলে পুকুরের সিঁড়ির নিচের ধাপে নেমে পানি পান করল ভুলু এবার সিঁড়ির ধাপগুলো লাফিয়ে পার হয়ে এসে বসে পড়ল মনিবের রুমের দরজার সামনে চার পা মেলে শুয়ে পড়ল সেখানে নতুন জায়গা-নতুন পরিবেশে সারারাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি অজানা ভয় কিংবা উত্তেজনায় ঘণ্টা খানিক ঘুমিয়ে নিলো সে মনিবের পায়ের শব্দে ঘুম ভাঙল তার ফার্মের কর্মচারীকে কিছু বলে সদর দরজা দিয়ে মনিবকে বেড়িয়ে  যেতে দেখে সেও চলল হেলে-দুলে কিন্তু মনিব ধমক লাগাল কুকুরটিকে ভুলু থমকে দাঁড়াল এবং আবারও তার পিছু নিতে চাইল এবার মনিবযা ভাগবলে তেড়ে এলো ভুলু ভয় পেল না, জানে, সে ধরনের কোন আশংকা নেই এ মনিবের কাছ থেকে মনিবের পায়ের কাছে বসে লেজ নাড়তে লাগল সে মনিব হাঁক ছাড়ল কর্মচারী লোকটির উদ্দেশ্যে গেট পেড়িয়ে ছুটে এলো লোকটিব্যাটাকে আটকে রাখবলে মনিব চলে গেল

টাইগার, টাইগার, টাইগার’- দ্বিতীয় মনিবের ডাকে তার পিছনে চলল কুকুরটি দুজনে চলে এলো বাড়িতে     

‘টাইগার ভায়া, আমার যে ফার্মে কাম করন লাগব। চল যাই’- কুকুরটির উদ্দেশ্যে বলল সে। ফার্ম ঘরের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করল সে। ভুলু আগের মত দাঁড়িয়ে পড়ল সিঁড়িতে এবং ভিতরের মুরগিগুলোর প্রতি হাঁক ছাড়ল ‘ভ অ উ’। মুরগিগুলো চমকে উঠে মাথা উঁচিয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে চাইল চারপাশ।

ফার্ম ঘরের মেঝেতে তিন ইঞ্চি পুরু কাঠের গুঁড়ার বিছানা- তার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে শত শত ব্রয়লার মুরগি। সেখানে লাল-লাল প্লাস্টিকের খাদ্য পানির পাত্রগুলি তিনটি সারিতে সুন্দর ভাবে বিন্যস্ত অবস্থায় আছে। গোলাকার পাত্রগুলোর চারপাশে বৃত্ত রচনা করে খেয়ে চলছে নাদুস নুদুস মুরগিগুলো- ঠোঁট ডুবিয়ে মাথা উঁচিয়ে পান করছে পানি। ভুলু এক দৃষ্টিতে সবকিছু দেখছে। এ রকম দৃশ্য ইতিপূর্বে কোন মনিবের বাড়িতে দেখেনি সে।

‘টাইগার ভায়া, এই বজ্জাত মুরগিগুলো সারাদিন খালি খায় আর ফুচর ফুচর পায়খানা করে। দেখ, লিটারগুলো (কাঠের গুঁড়ার বিছানা) এক্কেবারে ভিজ্যা গ্যাছে। এগুলা এখন বাইরে ফালাইয়া দিয়া নতুন গুলান বিছান লাগব। তুমি বইসা বইসা দ্যাখো, আমি কাম করি’।

এ মনিবের কথা গুলো ভুলু বুঝতে না পারলেও সেখানে দাঁড়িয়ে তার কাজ কর্ম দেখতে লাগল।
পুরনো লিটার কোদাল দিয়ে তুলে বাঁশের ঝুড়ি ভর্তি করে তারপর সেটা মাথায় চাপিয়ে বেড়িয়ে এলো সে। নষ্ট লিটার গুলো ফেলে দেবে পুকুরের উত্তর পাশে তৈরিকৃত গর্তে।

ভুলু পুকুরপাড় পর্যন্ত গেল তার পিছু পিছু, তারপর উৎসাহ হারিয়ে মনিবের রুমের দরজার সামনে এসে বসে পড়ল। দ্বিতীয় মনিব ফার্মে যাওয়ার সময় তাকে আর ডাকল না, ভুলুও সেখানে শুয়ে পড়ল চার পা ছড়িয়ে।

সামান্য তন্দ্রা-মত এসেছিল কুকুরটিবিশালাকার সাদা মোরগদের একটি কৌতূহল-বশত তার কাছে এলো এবং কি মনে করে কুকুরটির রোমশ শরীরে ঠোকর বসিয়ে দিল। ঠোকরের মাত্রা অবশ্য বেশি জোরে ছিল না, ভুলু তাই প্রথমে শ্বাস-প্রশ্বাস সংক্ষিপ্ত করে দু চোখ মেলে চাইল। মোরগটিকে চিনতে অসুবিধা হল না, দাঁত খিঁচিয়ে ঘর ঘর করে ভয় দেখাল বেয়াদব মোরগটিকে।

এরপর আরও দুটি মুরগি তাকে বিরক্ত করল এভাবে। কবুতরদের একটি কি মনে করে উড়ে এসে বসল তার শরীরের উপর। ভুলু চোখ মেলে চাইল মাত্র, কবুতরটিকে সামান্য চমকে না দিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।

বিকেল পর্যন্ত ঘুমল কুকুরটি। রাজহাঁসগুলো ফিরে এসেছে এবং এসেই সবগুলো মিলিত রবে বাড়ি মাথায় তুলেছে। ভুলু দাঁড়িয়ে পড়ল, সামনের পা দুটো সামনে বাড়িয়ে শরীরটাকে মাটির সমান্তরালে বাঁকিয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে নিলো একবার, তারপর সোজা হয়ে রাজহাঁসগুলোর দিকে হেঁটে গিয়ে লেজ নাড়তে লাগল। রাজহাঁসগুলো কিন্তু ভুলুর বন্ধুত্বের আহবানে সারা না দিয়ে হিস হিস শব্দ করে ধমকে উঠল দম্পতি দুটোর একটি লম্বা গলা বাড়িয়ে ভুলুর কানে ঠোকর বসিয়ে দিল কুকুরটিও ফেলল মেজাজ হারিয়ে- ঘর ঘর শব্দ করে তেড়ে গেল  রাজহাঁসগুলোর প্রতি রণে ভঙ্গ দিয়ে প্রাণীগুলো চলে গেল অন্যত্র সেখানে দল বেঁধে কেউ বসে, কেউবা একপায়ে দাঁড়িয়ে লম্বা ঠোঁট খানা পালকে গুঁজে চুপচাপ বিশ্রাম নিতে লাগল মনিব ফিরে আসার আগমুহূর্ত পর্যন্ত

গেটের বাইরে মনিবের সারা পেয়ে ভুলু দৌড়ে গেল সেখানে এবং দীর্ঘ লয়ের ভউ ডাক তুলে লেজ নেড়ে আমন্ত্রণ জানালো মনিবকে

আইতাছি বস’- বলে ফার্মের কর্মচারী লোকটি দরজা খুলে দিল ভুলু সরু মুখখানা নামিয়ে আনল মনিবের বুটজুতো পরা পায়ের উপর, কিন্তু চেটে দিল না, জানে মনিবের সেটা মোটেই পছন্দ নয়
 
তারপর ভুলু মিয়া, আছো ক্যামন’- বলে মনিব ভিতরে প্রবেশ করল কুকুরটির মাথায় একবার হাত বুলিয়ে

মনিবের কণ্ঠ রাজহাঁসগুলোর কানে যেতেই সবগুলোর মাঝে চাঞ্চল্য প্রকাশ পেল বার দুয়েক ডেকে উঠল একযোগে তারপর দানাগুলো প্রশস্ত করে বাতাসে ঝড় তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে চলল মনিবের কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মোরগ মুরগিগুলোও চলে এলো সেখানে সবগুলো মিছিল করে চলল মনিবের পিছু পিছু- খাদ্য চাই, খাদ্য চাই!

দরজা খুলে মনিব রুমে প্রবেশ করলে প্রাণীগুলো অভ্যাসমত সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ল, তবে থেমে থাকল না তাদের মিলিত কোলাহল কুকুরটিও বসে আছে দরজার সামনে একটি মুরগি কি মনে করে ভুলুর পিঠে চরল, পর মুহূর্তেই ডানা ঝাপটে নেমে পড়ল ভুলুর কোন ভাবান্তর হল না
মনিব প্রাণীগুলোর উদর পূর্ণ করালে সেখান থেকে সবগুলো চলে গেল হেলে-দুলে রাজহাঁসগুলো তাদের থাকার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে-বসে বিশ্রাম করতে লাগল

বিকেলে মনিবের পিছু পিছু বাইরে বেড়াতে বের হল কুকুরটি মেঠো রাস্তা শস্যখেত ইত্যাদি পেড়িয়ে দুজন পৌঁছে গেল নদী পাড়ে মনিব চিকচিক জলরাশির সামনে শুকনো বালির উপর বসে পড়ল ভুলুও বসল মনিবের পাশে

সন্ধ্যা হয়ে আসছে, অথচ মনিবের ফেরার কোন নামগন্ধ নেই ভুলু ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে ফেরার জন্য অবশ্য মনিবকে ফেলে একচুল নড়ারও ইচ্ছা তার নেই

অন্ধকার গ্রাস করে নিলো সবকিছুকে তারপর অন্ধকার ঠেলে বেড়িয়ে এলো ক্ষয়িষ্ণু পূর্ণিমার চাঁদ মনিব এবার রওনা হল বাড়ির পথে- খুশি মনে ভুলু চলল আগে আগে ফেরার রাস্তা চিনতে তার কোন সমস্যাই নয়- গন্ধ শুকে শুকে পথ দেখিয়ে চলছে মনিবকে


ভুলু (একটি কুকুরের নাম) এবং মনিব। - ৩