একটি ঘুড়ির গল্প
জহিরের বাবার মেজাজ
সাত সকালেই সপ্তমে উঠে আছে। অন্যদিনের চেয়ে আজ জলদি ঘুম থেকে উঠে নিয়মমাফিক প্রথমে
গোয়াল ঘর থেকে গরু বের করে উঠোনের একপাশে শক্ত বাঁশের খুঁটির সাথে বাঁধল ঠিকই,
অল্প সময় পরেই সে দেখতে পেল গরু সিমের মাচার সদ্য বেড়ে উঠা সিমের চারাগুলো গোগ্রাসে
সাবাড় করে চলছে। ভুল কি তার নাকি বজ্জাত গরু দড়ি ছিড়ে ফেলেছে, এ কথা ভাবতে ভাবতে
হাতের কাছে কুড়িয়ে পাওয়া বাঁশের খণ্ড নিয়ে তেড়ে গেল গরুর কাছে। মোটাসোটা
স্বাস্থ্যবান গরুটি তার মত শুকনো চিমসে পাটকাঠিকে পাত্তা না দিয়ে সমানহারে আহার
করতে থাকলে সে আর রাগ সামলাতে পারল না- পটাপট কয়েক ঘা বসিয়ে দিল পিঠের উপর। জহিরের
বাবা যেমন রাগ সামলাতে পারেনি, গরুটিও ক্রোধে পাগল হয়ে ছুট লাগাল। গরুর পিছে পিছে
একটু দৌড়েই সে হাঁপিয়ে ফিরে এল। বেয়াদব গরুর রাগ গিয়ে পড়ল পরিবারের সবার উপর। এত
বেলা হয়ে গেল এখনও সবাই পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে? এদিকে গরু ছুটে যে মানুষের ক্ষেত শেষ
করে ফেলল।
জহিরের বাবার
চেঁচামেচিতে সবার ঘুম ভেঙ্গে গেল। মায়ের পিছু পিছু জহিরও বেড়িয়ে এল ঘর থেকে। চোখ
ডলতে ডলতে উঠোনে মায়ের পাশে এসে দাঁড়াল জহিরের বড় বোন আছিয়া।
মায়ের সাথে দু ভাইবোন
গরু ধরতে চলে গেলে বারান্দার একপাশে রাখা পাটশাক ঝাঁকায় তুলে টিউবওয়েলের পাড়ে নিয়ে
গেল সে ধোঁয়ার জন্য। ভালভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে পাটশাকগুলো আটি বাঁধতে হবে। আজ
হাটের দিন। সকাল সকাল শাঁকগুলো নিয়ে তাকে হাটে যেতে হবে।
উঠোনে বসে পাটশাকের
আটি বাঁধছে জহিরের বাবা। তার নিজের কোন জমি নেই, প্রতিবেশীদের জমিতে ফসল ফলায় সে। ফসল যা উৎপন্ন হবে
অর্ধেক তার নিজের, বাকি অর্ধেক জমির মালিকের। বসতবাড়ি সংলগ্ন পাট ক্ষেতের জমিটি
প্রতিবেশি ইলিয়াস আলীর। সেচের সুবিধা নেই, থাকলে এ জমিতে ধান চাষ করা যেত। অবশ্য
ধানের অভাব অন্যান্য ফসল দিয়ে পুষিয়ে নেয়া যায়। কয়েক বছর ধরে পাটের বাজার ভাল। এ
বছর তাই তার মত অনেকেই পাট চাষ করছে। কচি পাট শাঁক হিসাবে গ্রামের সবাই খায়, হাটে
নিয়ে গেলে ভাল দামে বিক্রি করা যাবে। এই অভাবের সংসারে দুটো পয়সা যেদিক দিয়েই আসুক
না কেন তাই লাভ।
গরু নিয়ে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে পড়তে বসেছে মাত্র
জহির; এমন সময় বাবার ডাক পেল, ‘জহির, কই গেলিরে?’
জহির কিছু বলার আগেই
তার মা ঘর থেকে বলে উঠল, ‘ পোলাডায় পড়তে বসছে, কি দরকার আমারে কও’।
‘ পড়াল্যাহা কইরা জজ
ব্যারিস্টার পরে অইব। তারাতারি হাটে যাওন লাগব। আমার কামে একটু সাহায্য করুক’।
মা কিছু বলার আগেই
জহির ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। সুবোধ বালকের মত লেগে গেল কাজে। পাটশাকগুলো থেকে ঘাস
আলাদা করে আটি বাঁধছে বাবার দেখান মত। সকালবেলা উঠেই বাবার চেঁচামেচি শুনে ভড়কে
গেছে সে। অথচ মনে মনে সুযোগ খুঁজছিল, কখন বলতে পারবে সে কথাটি- বাবার সাথে হাটে যেতে চায়।
জহিরের বাবা বদমেজাজি একজন মানুষ, সেই সাথে স্ত্রী পুত্র কন্যাদের পিটানো সে তার
কর্তব্যের অংশ হিসাবে মনে করে। জহির তাই খুব ভয় পায় বাবাকে। গতকাল রাতে মায়ের কাছে
পিড়াপীড়ি করেছিল বাবাকে বলার জন্য। বাবা চেঁচিয়ে বলছিল, ‘ হাটে গিয়া ও কি কাম
করব?’ জহিরের আর কিছু বলার সাহস হয়নি, চুপচাপ ঘুমিয়ে পরেছিল।
বাবার সাথে মাত্র দু
বার হাটে যাওয়ার সৌভাগ্য তার হয়েছে। আহা, হাটে কত লোকের আনাগোনা। কত কিছুর দেখা
মিলে। তার একটি গোপন সঞ্চয় আছে। সেখানে বত্রিশ টাকা জমেছে। টাকাগুলো সে সাথে নিয়ে
যেত হাটে। তারপর যা খুশি কিনতে পারবে, মিষ্টি-মণ্ডা-মিঠাই খাবে। একটা ‘চিলা
গুড্ডি’ কেনার শখ তার অনেক দিনের। বাবাকে বললে বাবা কিনে দিবে না, শুধু শুধু ধমক
খেতে হবে। দু সপ্তাহ আগে জহিরের বন্ধু শরিফ তার বাবার সাথে হাটে গিয়েছিল, সেখান
থেকে ‘চিলা গুড্ডি’ কিনেছে। আট টাকা দাম। সেই সাথে দশ টাকার নাইলনের সূতা। সূতাও
হাটে পাওয়া যায়। জহির অবশ্য নিজেই লম্বা লেজ ওয়ালা একটা ঘুড়ি বানিয়েছে, কিন্তু
‘চিলা গুড্ডির’ সাথে তার তুলনা হয়না। ‘চিলা গুড্ডি’ দেখতে কি সুন্দর। আবার কি
সুন্দর আকাশে যখন উড়ে তখন চি...চি শব্দ করে ডাকে। শরিফের ঘুড়িটি সে দেখেছে। বাঁশের
ফ্রেমের মধ্য লাল এবং হলুদ এই দুই রঙের পাতলা কাগজে তৈরি। শরিফ তাকে একবার ঘুড়িটি
উড়াতে দিয়েছিল। ‘কি শক্তি চিলা গুড্ডির। সুতার কি টান’- ভাবে জহির। তার ঘুড়ি থেকে অন্তত
দশ গুণ বেশি শক্তি ‘চিলা গুড্ডির’। সে যখন নাটাই হাতে দারিয়ে ছিল, বাতাসের ঝাঁপটায়
সূতা যখন টান টান- তার মনে হয়েছিল, তাকে বোধহয় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। এ রকম একটি ঘুড়ি
তার চাইই চাই।
শেষ পর্যন্ত সাহস করে
বাবাকে সে বলেই ফেলল, ‘ বাবা, আমি হাটে যামু’।
‘হাটে গিয়া তর কাম
নাই। চকে গিয়া গরুর লাইগা ঘাস নিয়া আয়বি। আমি জানি হাটে থিক্যা আইসা তর মায়ের কাছে
না হুনি যে তুই ঘাস আনতে যাস নাই। চাপার দাঁত কিন্তু একটাও থাকবোনা তাইলে’।
জহিরের চোখে পানি আসার
উপক্রম হল। এক দৌরে ঘরের ভিতর চলে গেল সে। চেয়ারের উপর বসে টেবিল থেকে বই টেনে
নিল। বাবার কাজে সাহায্য করার কোন ইচ্ছা তার নেই এখন।
‘ পোলাডার লগে ভাল
কইরা কথা কইবার পারনা ? হাটে যাওয়ার শখ হইছে, নিয়া গ্যালেই তো অয়।’- উঠোন ঝাড়ু
দিতে দিতে বলল জহিরের মা।
‘ উহ, দরদ রে। তাইলে
এক কাম কর। পাটশাক মাথায় কইরা তুই তর পোলারে নিয়া হাটে যা, আমি বাড়িতে বইসা বইসা
বিঁড়ি টানি’। ‘ মাইয়া মানুষ। এত বেশি বুঝস ক্যা?’
জহির খোলা বইয়ের সামনে
মাথা নিচু করে বসে বাবা মায়ের কথা শুনছে। দু ফোঁটা জল টপ করে পড়ল বইয়ের পৃষ্ঠার
উপর। সামান্য হাটে নিয়ে গেলে বাবার এমন কি ক্ষতি হত। সে তো আর বাবার কাঁধে চরে
হাটে যাবে না, নিজের পায়ে হেঁটেই যেতে পারবে। হাটে গিয়ে বাবাকে তো তাকে কিচ্ছু
কিনে দেয়ার দরকার নেই। সে শুধু বাবার সাথে হাটে যাবে, একটু খানি ঘুরাঘুরি করবে;
শরিফের মত একটি ঘুড়ি কিনবে - তারপর আবার বাবার পিছনে পিছনে বাড়ি চলে আসবে। বাবা
যদি তার মাথায় ছোট্ট করে পাটশাকের বোঝাও চাপিয়ে দেয়, তাতেও তার আপত্তি নেই। তার
শুধু হাটে যেতে পারলেই হল। এসব কথা ভাবতে ভাবতে একসময় তার জিদ চেপে বসল মাথায়।
বাবা যদি তাকে হাটে নাও নিয়ে যায়, তারপরেও সে যাবে। কিভাবে ? বাবার পিছে পিছে
লুকিয়ে লুকিয়ে সে যাবে। একটু দূর থেকে বাবাকে লক্ষ্য রাখলেই হবে। কোন ভাবেই তাকে
ধরা পরা চলবে না।
পাটশাকের বোঝা মাথায়
চাপিয়ে, ছাতা হাতে বাবাকে হাটের উদ্দেশ্যে রওনা হতে দেখে চুপিসারে ঘর থেকে বের হল
জহির। মা রান্না করে কাজ করছেন, তাই মায়ের চোখে লুকাতে কোন সমস্যাই হয়নি। জহির তার জমানো টাকা গুলো সাবধানে পকেটে রেখেছে। সেখানে বেশ কিছু খুচরো পয়সা
আছে। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে সে শক্ত করে চেপে ধরে আছে প্যান্টের বা পাশের পকেটটি। বাবার থেকে
বেশ খানিকটা দুরত্ত বজায় রেখে পিছু পিছু চলছে সে। খুব সতর্ক, এক মুহূর্তও চোখের
আড়াল করছে না বাবাকে। আবার বাবা যদি থেমে পিছনে ঘুরে চায়, তবে সে দ্রুত লুকিয়ে পরে
কোন গাছের আড়ালে।
গায়ের মাঝ দিয়ে চলা
দক্ষিণ-পশ্চিমমুখি মেঠো রাস্তা দিয়ে চলছে জহির। বেশ বাতাস বইছে। সূর্য উঠেছে খুব
একটা বেশি সময় হয় নি। কাঁচা রাস্তা ধরে অনেকেই চলছে। এদের মধ্য কেউ কেউ হয়তবা হাটে
যাবে। সামনে একটি নদী। জহিরদের গ্রামের শেষ মাথায় নদীটি। ছোট্ট জহিরের গণ্ডী নদীর এ পারেই সীমাবদ্ধ,
ওপাড়ে মাত্র কয়েকবার যাবার সুযোগ হয়েছে তার। শেষ যে বার বাবার সাথে হাটে গিয়েছিল,
সেও অনেক দিন হয়ে গেছে। সে কল্পনা করে নদীর ঐ পাড়ের রাস্তাটি। রাস্তাটি গ্রামের
শস্যখেতের মাঝ দিয়ে, তারপর আবার গ্রাম, আবার শস্যখেত- এক সময় গিয়ে মিশেছে পাকা রাস্তার
সাথে। তার পরের পথ আর কল্পনা করতে পারে না জহির। পাকা রাস্তার পাশে বড়, সুন্দর
একটি মসজিদ আছে। তাদের গাঁয়ের মসজিদ তো অনেক ছোট। টিনের ঘর। একপাশে একটি টিউবওয়েল,
দুটি কাঁঠাল গাছ। শুক্রবার হলে সে বাবার সাথে নামাজ পড়তে যায়। চটের উপর বসে
হুজুরের কথা শুনতে হয়, নামাজ পড়তে হয়। সে বার বাবার সাথে যখন হাটে গিয়েছিল, তখন ফেরার পথে নামাজের সময় হলে বাবার সাথে সেও
প্রবেশ করে মসজিদের ভিতরে। মসজিদের প্রবেশপথের দু পাশে কি সুন্দর সুন্দর ফুল গাছ।
একপাশে খোলা মাঠ। মাঠের পাশেই উঁচু বড় একটি বিল্ডিং। বাবার কাছে জিজ্ঞাসা করে
জেনেছে ওটা নাকি মাদ্রাসা। সেখানে তার মত অনেক ছেলে পড়াশুনা করে। সেও তো স্কুলে
পড়ালেখা করে। স্কুল আর মাদ্রাসার পার্থক্য সে ভেবে বের করতে পারেনি। সেই মসজিদের
ভিতর আরও সুন্দর- মনে করার চেষ্টা করে জহির। যাওয়ার পথেই সে মসজিদটি দেখতে পাবে।
খুশিতে তার মন নেচে উঠে।
নদীর উঁচু পাড়ের থেকে
সামান্য দূরে একটি মোটা কড়ই গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল সে। বাবা তার মাথার বোঝা
নামিয়ে গামছা দিয়ে মাথা মুছছেন- না লুকিয়ে পড়লে দেখে ফেলতে পারে। ঘাটপাড়ে আরও
কয়েকজন মানুষ দারিয়ে আছে। এদের একজনের সাথে একটি সাইকেল এবং অন্য একজনের সাথে আছে
দুটি ছাগল । নৌকা ঐপাড় থেকে যাত্রী নিয়ে এপাড়ে আসছে। গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
জহির দেখছে। নৌকা তীরে আসলে সবাই নেমে পড়ল এপারে, আর যারা অপেক্ষায় ছিল তার গিয়ে
উঠল নৌকার উপর। জহির দেখল, তার বাবাকে নিয়ে নৌকা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে। ঐপাড়ে
যাওয়ার পর সবাই নৌকা থেকে নেমে গেলে জহির গাছের আড়াল থেকে বেড়িয়ে ঘাটপাড়ের বাঁশের
সিঁড়ির সামনে দাঁড়াল- ঠিক যেখানে এসে নৌকা থামে।
বেশ কিছু সময় ধরে
অপেক্ষা করছে জহির। এপাড়ে আরও কয়েকজন লোক এসে দাঁড়িয়েছেন ঐপাড় যাবে বলে। আশঙ্কায়
তার বুক কাঁপছে- বাবা বেশি দূরে চলে যায়নি তো ? বাবাকে যদি হারিয়ে ফেলে ? নৌকা চলে
এলে আরোহীরা সবাই নামার আগে সে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল নৌকার গলুইতে। ছোট্ট বলে তাকে কেউ
কিছু বলল না। যাত্রীরা সবাই নৌকায় চাপলে মাঝি বাঁশের লগি দ্বারা ঠেলতে ঠেলতে ছোট্ট
নৌকা ভাসিয়ে চলল ওপাড়ের পথে।
দু টাকা ভাড়া মিটিয়ে
জহির নেমে পড়ল নৌকা থেকে। কেউ দেখুক আর না দেখুক, জহিরের তাতে কিছু যায় আসে না- সে
ঝেড়ে দৌড় লাগাল কাঁচা রাস্তা ধরে। অনেক সময় আগে বাবা এ পথ দিয়ে চলে গেছে। বাবাকে
যেভাবেই হোক দৌড়ে ধরতে হবে।
দু মিনিট জিরিয়ে নেয়ার
জন্য রাস্তার পাশে বসে পড়ল জহির। মাঠের ধানগুলো কৃষকেরা মাত্র কিছুদিন আগে কেটে
নিয়ে গেছে, খোলা শস্যখেত থেকে বইয়ে আসা শীতল হাওয়া জহিরের ঘর্মাক্ত দেহ জুড়িয়ে
দিচ্ছে। কিন্তু বেশি সময় সেখানে বসে রইল না সে। উঠে দাঁড়াল এবং ফের দৌড়াতে শুরু
করল।
ওই তো বাবাকে দেখা
যাচ্ছে। পাটশাকের বোঝা মাথায় ছাতা হাতে বাবাকে দূর থেকেই দেখে চিনতে পারল। খুশিতে
তার দাঁত বের হয়ে এল, বাবাকে দেখে কখনও এত খুশি হয়নি। এখন আর জহিরের কোন চিন্তা
নেই, বাবার পিছু পিছু পৌঁছে যেতে পারবে হাটে।
পাকা রাস্তার কাছে এসে
জহিরের বাবা বোঝা নামিয়ে রেখে কাধের গামছা পেতে বসে পড়ল। সকাল বেলা আবহাওয়া ভালই
ছিল, ঘণ্টা খানিক পূর্বেও ফুরফুরে বাতাস বইছিল। কিন্তু এখন সূর্য বিদায় নিয়ে মেঘ
খেলা করছে। বাতাসও বন্ধ হয়ে গেছে। গ্রীষ্মের এই সময়ে প্রায়ই কাল বৈশাখী ঝড় হয়। সে
রকম ঝড় হলে মুশকিলে পড়তে হবে। চিন্তিত মুখে উঠে দাঁড়াল জহিরের বাবা। পাকা রাস্তার
কাছে যখন চলে এসেছে তখন হাটের আর বেশি দূর বাকি নেই।
বাবাকে সবসময় চোখে
চোখে রাখতে হচ্ছে, তাই আশেপাশের দৃশ্যগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়ার সময় নেই। তার পরেও
চোখ বুলিয়ে দেখে নিল পাকা রাস্তার মাঝ দিয়ে যাওয়া উঁচু রেল লাইন, সেই মসজিদ,
সিনেমা হল, রাস্তার পাশের সারি সারি নানা জিনিসপত্রে ঠাসা দোকান ইত্যাদি আরও কত কি
পিছনে ফেলে এক সময় জহির পৌঁছে গেল হাটে।
হাজার হাজার লোকের
ভিড়ে, কত অলি গলি পার হয়ে এক জায়গায় এসে জহিরের বাবা দাঁড়িয়ে পড়ল। পাটশাকের বোঝা
নামিয়ে শাঁকের আটিগুলোকে আলাদা করে স্তূপাকারে সাজিয়ে রাখল সামনে, তারপর গামছা
পেতে বসে অপেক্ষায় রইল কখন ক্রেতা আসে।
বাবার থেকে কিছু
দূরত্বে দাঁড়িয়ে জহির দেখছে দেখছে পাটশাক বিক্রি। বুড়ো একজন মানুষ দু আটি শাঁক
কিনে নিয়ে গেল তার বাবার থেকে। পাশেই একজন বসে আছে অনেকগুলো বড় লাউ নিয়ে। হাটের এ
অংশে শুধু শাঁক সবজি বিক্রি হয়। পাটশাক বিক্রি করতে বাবার মনে হয় অনেক দেরি হবে। সেবার বাবা সিম নিয়ে হাটে
এসেছিল, অনেক সময় লেগে গিয়েছিল বিক্রি করতে। সে কি একা একা ঘুরে ঘুরে সবকিছু
দেখবে? বেশি দূরে যাবে না, একটু পরেই চলে আসবে।
সবজির হাট এক চক্কর
ঘুরেই জহির এসে বাবাকে দেখে গেল। পাটশাক এখনও স্তূপাকারে পরে আছে। আবার বেড়িয়ে পড়ল
সে। তরকারির হাটের পশ্চিম পাশে সরু একটি খাল চলে গেছে উত্তর দক্ষিন বরাবর। সে
খালের তীরেই হাঁস মুরগির হাট। মাঝে চলাচলের যায়গা রেখে দু পাশে মানুষজন বসে আছে
হাঁস মুরগি নিয়ে। ক্রেতারা দরদাম করছে। ছোট ছোট চার পাঁচটি বাচ্চা সহ অনেকগুলো
রাজহাঁস নিয়ে বসে আছে একজন বিক্রির জন্য। তবে জহিরের চোখ আটকে গেল তুলতুলে সাদা
খরগোশ দেখে। সেখানে দু মিনিট দাঁড়িয়ে আরও সামনে চলে এসে কবুতর দেখতে লাগল। অনেক কবুতরের
ছড়াছড়ি। পাশেই ছাগলের হাট। নাদুস নুদুস ছাগল দেখতে দেখতে সে চলে এল কসাই খানায়।
একটি গরুকে পা বেঁধে মাটিতে ফেলে জবাই করার উপক্রম হয়েছে, জহির সেখান থেকে চোখ
ফিরিয়ে নিল। ভয়ঙ্কর দৃশটি দেখার তার মোটেও ইচ্ছে নেই। কসাইখানার বোটকা পচা গন্ধের
জন্য দ্রুত পা চালাল। ওদিকে লাল লাল কি যেন দেখা যাচ্ছে। কাছে আসতেই উগ্র কেমন যেন
ঝা ঝা একটা গন্ধ এসে জহিরের নাকে ধাক্কা দিল। সেই সাথে তার শুরু হয়ে গেল হাঁচি।
সবাই গনহারে হাঁচি দিচ্ছেন এখানে! লাল লাল সে বস্তুর কাছে আসতেই জহির বুঝতে পারল
এগুলো শুকনো মরিচ। হাটের এ অংশে শুধু শুকনো মরিচ বিক্রি হয়। মরিচের ঝাঁঝ এর জন্যই
এ হাঁচি। জহিরের চোখ দিয়ে পানিও পড়ছে। সার্টের হাতায় চোখ মুছে মনে মনে কয়েকটি গালি
দিয়ে খোলা একটি জায়গায় এসে দাঁড়াল।
গরু মহিষ ছাগল ইত্যাদি
যেখানে বিক্রি হয়, সেই গরুর হাটটি বেশ বড়। পাশেই একটি বুড়ো বট গাছ আছে। সে গাছের
নিচে তাবু টানিয়ে কবিরাজ বিশ্বনাথের আয়ুর্বেদী সালসা বিক্রি চলছে মাইকে গলা
ফাটিয়ে। কুমারেরা মাটির তৈজসপত্র নিয়ে বসে আছে পাশে। চিড়াই কাঠ বিক্রি চলছে অদূরে।
হাটের দক্ষিণের সীমানা এখানেই। দুটি রাস্তা হাট থেকে বেড়িয়ে চলে গেছে অন্য গ্রামের
সীমানায়। রাস্তার দু পাশে বসে আইস্ক্রিমওয়ালা, ঝালমুড়ি, চানাচুর, বাদাম ইত্যাদি
নান খাদ্য সামগ্রী নিয়ে বসে আছে বিক্রেতারা। জহির খুচরো এক টাকার পয়সা দিয়ে একটি
আইসক্রিম কিনল।
হাটের একপাশ দিয়ে
যাওয়া পাকা রাস্তা ধরে আইসক্রিম খেতে খেতে চলছে জহির। রাস্তার দু পাশে খুপরি ঘরের মত ছোট ছোট সারি সারি দোকান।
রুটির দোকান, জিলেপির দোকান,
মিষ্টি-দইয়ের দোকান দেখতে দেখতে এক জায়গায় তার চোখ আটকে গেল। আরে, ওই তো চিলা
গুড্ডি!
বাঁশের খুঁটির সাথে
দড়ি দিয়ে বেঁধে সুন্দর করে ঘুড়িগুলিকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, যেন দূর থেকেই সবার নজরে
পড়ে। জহিরেরও তাই চিনতে সমস্যা হয়নি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফাঁকা জায়গাটুকু পার হয়ে
সে চলে এল ঘুড়ি বিক্রেতার কাছে। কি সুন্দর সুন্দর চিলা গুড্ডি! লাল, হলুদ, নীল,
সবুজ রঙের কত ঘুড়ি। আরে, ওটা আবার কেমন ঘুড়ি- চিল ঘুড়ি গুলোর পাশে পেটমোটা বিস্তৃত
পাখাওয়ালা একটি ঘুড়ি দেখে অবাক হয়ে গেল জহির। লম্বা লেজওয়ালা ঘুড়ি থেকে শুরু করে
সাপের মতন দেখতে সাপ ঘুড়ি, দুই ঠ্যাং ওয়ালা চং ঘুড়ি, বক্স ঘুড়ি সহ আরেক কয়েক রকমের
ঘুড়ি দেখেছে সে। কিন্তু এ রকম সুন্দর ঘুড়ি দেখেনি।
জহির লাল রঙের একটি
চিল ঘুড়ি হাতে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ঘুড়ি বিক্রেতার কাছে জিজ্ঞাসা করে
জেনেছে ঘুড়িটির দাম আট টাকা। শরিফও আট টাকা দিয়ে কিনেছিল। কিনে ফেলবে নাকি ? পকেট
হাতড়ে টাকা বের করল সে। কি মনে করে আবার টাকাগুলো রেখে দিল প্যান্টের পকেটে।
‘ওই গুড্ডিডা দেখান
তো’, সেই পেটমোটা ঘুড়িটির দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে জহির বলল ঘুড়ি বিক্রেতাকে।
‘ এইডা মাছ গুড্ডি।
মাত্র দশখান বানাইছিলাম। এখন এই একটাই আছে’, জহিরের হাতে ঘুড়ি দিয়ে বলল বিক্রেতা।
মাছ গুড্ডিই তো। মাছের
মত উঁচু পেট। আবার লেজটিও মাছের লেজের মত। ডানাদুটো অবশ্য চিলা গুড্ডির মত,
প্রশস্ত এবং বড়। মাছ গুড্ডির মাথায় আবার ধনুকের মত বাঁকানো ‘বেত’ আছে। চিলা গুড্ডির
মতই তাহলে আকাশে গিয়ে চি...চি করে ডাকবে। দুটি ডানার মাঝখানের বড় অংশ লাল কাগজের।
দু ডানার শেষের টুকু আবার সবুজ। মোটা পেটটি হলুদ কাগজের, লেজের অংশটুকু লাল। জহির
মুগ্ধ দৃষ্টিতে ঘুড়িটি দেখছে।
‘ মাছ গুড্ডিডার দাম
কত?’
‘ বিশ ট্যাকা কইরা
বিক্রি করছি, তুমি নিলে তোমার কাছ থিক্যা পনের ট্যাকা রাখমু। নিবা?’- জহিরের দিকে
চেয়ে বলল ঘুড়ি বিক্রেতা।
এক মুহূর্ত ভাবল জহির।
তারপর পকেট থেকে টাকা বের করে কিনে ফেলল ঘুড়িটি। আট টাকার জায়গায় পনের টাকা চলে
গেল ভেবে মনের মধ্য তার একটু খচ খচ করতে ছিল। কিন্তু এতো সুন্দর একটি ঘুড়ির মালিক
সে- এ কথা ভেবে ভুলে গেল টাকার দুঃখ। এখন ঘুড়ির জন্য সূতা কিনতে হবে। খুঁজতে
খুঁজতে এক দোকানে পেয়েও গেল। দশ টাকার নাইলনের মজবুত সূতা কিনল সে।
পকেটে সূতা আর ডানহাতে
ঘুড়ি নিয়ে খুশি মনে চলছে সে বাবার কাছে। সাবধানে, ঘুড়িটিকে মানুষজনের ধাক্কা থেকে
বাঁচাতে- বুকের সাথে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে সে পৌঁছে গেল সবজির হাটে, যেখানে তার বাবা
বসে পাটশাক বিক্রি করছে। কিন্তু কাছে আসতেই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল- বাবা নেই!
হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে
শত মানুষ জনের ভিড়ে বাবাকে খুঁজতে লাগল জহির দু চোখ দিয়ে। নাহ, কোথাও তার বাবা
নেই। মনে হয় বিক্রি শেষ করে চলে গেছে। এখন একা একা কিভাবে বাড়ি ফিরবে সে ? যদি
হারিয়ে যায়, মা কি অনেক কান্না কাটি করবে? মায়ের কথা মনে হতেই আবার তার চোখ ছল ছল
করে উঠল।
জহির মনে করতে লাগল,
কোন পথ ধরে সে বাবার পিছু পিছু হাটে এসেছে। কিন্তু এত মানুষের ভীরে সবই তার কাছে
গোলমাল লাগছে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে কোন লাভ নেই, তাকে প্রথমে হাট থেকে বের হতে হবে।
তারপর যদি রাস্তা না চিনতে পারে, মানুষজনের কাছে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়া যাবে।
আসার পথে খুব ভাল করে রাস্তা মনে রেখেছে, চিনতে সে পারবেই। লাল ব্রিজ, সিনেমা হল,
রেল লাইন, মসজিদ- সবই তার মনে আছে।
দাঁড়িয়ে থাকার পর আবার
হাঁটতে শুরু করল জহির। হাটের ভিতরের নানা জিনিসপত্রের অসংখ্য ছোট ছোট অস্থায়ী
দোকানগুলো দেখতে দেখতে চলছে সে- যদি বাবার দেখা পাওয়া যায়। বেলা কত হয়েছে বুঝতে
পারছে না জহির। সূর্য মেঘে ঢাকা না থাকলে সময়ের ব্যাপারে অনুমান করা যেত। প্রচণ্ড
গরম পরেছে, এক ফোঁটা বাতাস কোথাও নেই। হাটের মানুষগুলি সব ঘেমে-নেয়ে অস্থির।
জহিরের খুব পানি পিপাসা লেগেছে। একটু পানি খাওয়া দরকার।
ওই তো, মসজিদ দেখা
যাচ্ছে। মসজিদে নিশ্চয় টিউবওয়েল আছে। ঘুরপাক খেতে খেতে জহির চলে এসেছে হাটের একদম
উত্তর-পশ্চিম কোনায়। হাট সংলগ্ন ছোট্ট মসজিদটি এখানে অবস্থিত। মসজিদের প্রবেশপথের
পাশেই টিউবওয়েল দেখতে পেল জহির। হাতের ঘুড়িটি মাটিতে নামিয়ে রেখে টিউবওয়েল চেপে
পানি পান করল সে। ঘুড়িটি আবার হাতে নিয়ে মসজিদের একটু অদূরে ধান, চাল, সরিষা, পাট
ইত্যাদি বিক্রির স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র- এমন সময় কে যেন পিছন থেকে শক্ত হাতে
তার গর্দান চেপে ধরল!
মাথা পিছনে ঘুরিয়ে
বাবাকে দেখে জহিরের চোখদুটো যেন বিস্ফোরিত হল।
‘ হারামজাদা, একলা
একলা হাঁটে আইসস। এত্ত বড় সাহস তর। আবার গুড্ডিও কিনসস’, একহাতে জহিরের ঘাড় চেপে
ধরে উচ্চকণ্ঠে বলল জহিরের বাবা।
‘আবার গুড্ডিও কিনসস?
ট্যাকা কই পাইলি? তারাতারি ক, ট্যাকা কই পাইসোস?’
জহির কিছু বলছে না
দেখে বাবা জহিরের ঘাড় ছেড়ে দিয়ে খপ করে তার বা হাত ধরল, সাথে সাথেই অন্য হাত দিয়ে
দু চার ঘা বসিয়ে দিল তার পিঠে। বাবা কিংবা মায়ের কাছে মার খেলে জহির ভ্যা ভ্যা করে
কাঁদে না, তাই দাঁড়িয়ে বাবার মার সহ্য করল। অবশ্য চোখের পানি আটকাতে পারেনি সে।
‘গুড্ডি কয় ট্যাকা
দিয়া কিনসোস?’
জহির কিচ্ছু বলে না।
বাবা আবার মারার জন্য হাত উঁচু করলে সে বলল, ‘পনের টাকা’।
‘পনের ট্যাকা দিয়া
গুড্ডি কিনসোস,’ আকাশ থেকে যেন পড়ল জহিরের বাবা। ‘ ট্যাকা কি গাছে ধরে...’, বলতে
বলতে আবারও চর বসিয়ে দিল জহিরের পিঠে।
‘ পনের ট্যাকার
গুড্ডির কাম নাই। গুড্ডি দে। গুড্ডি দিয়া ট্যাকা ফেরও আনমু’। জহিরকে ছেড়ে দিয়ে তার
দিকে হাত বাড়িয়ে দিল জহিরের বাবা, গুড্ডি দেয়ার জন্য। জহির বাবার দিকে উল্টো ঘুরে
দু হাত দিয়ে ঘুড়িখানা চেপে ধরল বুকের সাথে- বাবার প্রসারিত হাত থেকে ঘুড়িকে রক্ষা
করার প্রচেষ্টা জহিরের। কিছুতেই ঘুড়ি দিবে না সে।
‘ গুড্ডি দিবি না ?
গুড্ডি ফেরত তো দিমুই, তারপর তরে বাড়ি নিয়া লই। আম গাছের লগে বাইন্ধা তরে আমি
পিটামু’, ক্রোধে পাগল হয়ে কথাগুলো বলল জহিরের বাবা। জহিরের হাত আবার চেপে ধরল সে।
তাকে টানতে টানতে নিয়ে চলল বাবা হাটের সরু পথ ধরে। বাড়ির পথে নয়, সেই ঘুড়ি
বিক্রেতার কাছে- যেখানে থেকে জহির ঘুড়ি কিনেছে।
কব্জি আগলা হতেই ঘুরে
বাবার দিকে চাইল জহির। বাবা দাঁড়িয়ে পড়েছে। লুঙ্গির কোঁচা থেকে বিঁড়ি বের করতে
দেখেই সে দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে নিল বাবার চোখে। জহিরের বাবা ঠোঁটে বিড়ি রেখে দু
হাত দিয়ে দিয়াশলাইয়ের কাঠিতে অগ্নিসংযোগ করবে মাত্র, জহির উল্টোপথে ঝেড়ে দৌড় দিল।
বিড়িতে টান মেরে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে জহিরের বাবা তাকিয়ে দেখে, জহির নেই!
হাটের উত্তরের শেষ
মাথায় গোল একটি যায়গা ঘিরে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সাপের খেলা হচ্ছে সেখানে। ফনা
তুলে আছে বিশাল এক গোখরো, সাপটির পাশেই ছোট ছোট অনেকগুলো কাঠের বাক্স রাখা আছে। সে
বাক্সগুলোর ভিতরেও আছে নানা ধরনের সাপ। সাপের খেলা দেখাবার পাশাপাশি গাছ-গাছড়ার ওষুধ
বিক্রি করে চলেছে সাপুড়ে। জহির সাপের খেলা দেখছে, মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনছে সাপুড়ের
কথা। ঘণ্টা খানিকও পার হয়নি বাবার হাত থেকে পালিয়েছে সে, অথচ বাবার কথা পুরপুরি
ভুলে গেছে। মনে নেই বাড়ি ফেরার কথাও।
গোখরো সাপটি কাঠের
বাক্সে রেখে সাপুড়ে আরেকটি বাক্স থেকে মাটি রঙের অন্য একটি সাপ বের করল। সাপুড়ে
একটি করে সাপ বের করছে, তারপর চলছে কথাবার্তা এবং সবশেষে ওষুধ বিক্রি। জহিরও স্থির
দাঁড়িয়ে আছে- একটি একটি করে সবগুলো সাপ দেখবে বলে। এক সাথে এতগুলো সাপ দেখার সুযোগ
তার জীবনে আর আসেনি।
পাঁচ কি ছয়টি সাপ দেখা
শেষ হয়েছে মাত্র, এমন সময় দমকা বাতাস শুরু হল। সাপুড়ে সাপের খেলার সমাপ্তি টানল।
দর্শকেরাও চলে গেল দ্রুত। এক ফোটা দু ফোটা করে বৃষ্টি পড়ছে। যে কোন সময় মুষলধারে
শুরু হয়ে যাবে বৃষ্টি। অন্য লোকজনের সাথে জহির দৌড়ে আশ্রয় নিল একটি খালি টিনের
চালার নিচে। বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল সাথে সাথে।
তুমুল ধারায় বর্ষণের
আধাঘণ্টা পরে বৃষ্টি থেমে গেল। দমকা বাতাস নেই, হালকা বেগে বাতাস বইছে। আকাশ এখনও
মেঘে পরিপূর্ণ। যে কোন সময় আবার বৃষ্টি শুরু হতে পারে।
হাট ফাঁকা হতে শুরু
করেছে। খারাপ আবহাওয়ার আশঙ্কায় হাটে আসা মানুষগুলো দ্রুত ফিরতে শুরু করেছে বাড়ির পথে।টিনের
চালা ছেড়ে বেড়িয়ে এল জহির। পিছনে হাট, তাই সামনের রাস্তা ধরে চলা ছাড়া তার কোন
উপায় নেই। অনেক মানুষ এ পথ ধরেই যাচ্ছে। চারপাশের কোন কিছুই তার পরিচিত লাগছে না।
মনে হয় এ পথ ধরে বাবার সাথে হাটে আসেনি সে। আর কিছুদূর যাওয়ার পরে না হয় কাউকে
জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়া যাবে।
জহিরকে দাঁড়িয়ে পড়তে
হল, কেননা জহির যে রাস্তা ধরে চলছে সে রাস্তাটি মিলিত হয়েছে অন্য তিনটি পাকা
রাস্তার সাথে। এখন কোন রাস্তা ধরে চলবে সে ? রাস্তাগুলো তার কাছে অচেনা। নাকি আবার
ফিরে যাবে হাটের রাস্তার পথে? ওইতো, কড়ই গাছের নিচে একটি দোকান দেখা যাচ্ছে।
সেখানে গিয়ে কি জিজ্ঞাসা করে জেনে নিবে?
দোকানের কাছে চলে এল
সে। দোকানদার একজন বৃদ্ধ মানুষ। জহির তাকে জিজ্ঞাসা করল, তার গায়ে যাওয়ার পথ।
দোকানদার তাকে পথ দেখিয়ে দিল। মাঝের রাস্তাটি ধরে যেতে হবে। সে রাস্তা ধরে কিছুদূর
যাওয়ার পর লোহার লাল ব্রিজ পড়বে, তারপর সামনেই পড়বে স্থানীয় বাজার। কয়েকটি গলি পার
হবার পরে মিলবে সিনেমা হল। সিনেমা হল থেকে সোজা পূর্বদিকে পাকা রাস্তা ধরে যাওয়ার
পর পড়বে উঁচু রেল লাইন। রেল লাইন পার হবার পরে আরও কিছুটা দূরে পড়বে সেই মসজিদ।
তারপর কাঁচা রাস্তা ধরে নদী। জহিরের মন থেকে হারিয়ে যাওয়ার ভয় দূর হয়ে গেল। নাহ,
সবকিছু দেখে দেখে সে অবশ্যই বাড়ি ফিরতে পারবে।
পাকা রাস্তার উপরে বহু
পুরানা লোহার লাল ব্রিজ পার হয়ে স্থানীয় বাজারের কাছে চলে এল সে। এখানে আবার
অনেকগুলো রাস্তা বাজার থেকে বেড়িয়ে বিভিন্ন দিকে চলে গেছে। জহির আবারও ধাঁধায় পরে
গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তা করল, প্রথমে সিনেমা হল খুজে বের করতে হবে। সিনেমা হল
মিললে বাকি রাস্তা সহজেই চিনে নিতে পারবে সে।
দাঁড়িয়ে থাকা এক
রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল জহির, সিনেমা হলে যাওয়ার পথ। রিক্সাওয়ালা তাকে একটি
রাস্তা দেখিয়ে বলল যে, প্রথমে এই রাস্তা ধরে যাওয়ার পর ডান দিকে মোড় নেয়ার পর ফের
বা দিকের রাস্তা ধরে যেতে হবে। ফের ডানে, তারপর আবার বায়ের দিকের রাস্তায় বেশ
খানিকটা যাওয়ার পরে সোজা উত্তরের রাস্তা ধরে যেতে হবে। মোটামুটি কিছুদূর যাওয়ার
পরে রাস্তার পাশের গলি ধরে সামান্য যাওয়ার পর মিলবে সিনেমা হল। জহিরের কাছে বেশ
গোলমেলে লাগল। কিন্তু কি আর করা যাবে। সে রিক্সাওয়ালার দেখানো পথ ধরে চলতে লাগল।
রাস্তার দুটি বাঁক পার
হবার পরে, পথ ভূলে জহির অন্য একটি রাস্তায় গিয়ে উঠল। তার মনে হল, রিক্সাওয়ালা এই
রাস্তার কথাই বলেছে। অনেকবার ডানে, বায়ে যাওয়ার পর সিনেমা হলের দেখা পেল না সে।
মনে মনে ভাবল, সামনে কোথাও আছে সিনেমা হল। সাধের ঘুড়ি ডান হাতে আঁকড়ে ধরে আরও
দ্রুত চলতে লাগল পথ।
আকাশের অবস্থা বেশ
খারাপ। যে কোন সময় আবার বৃষ্টি শুরু হতে পারে। যদি বৃষ্টি শুরু হয়ে যায় তবে বেশ
মুশকিলে পড়তে হবে জহিরকে। রাস্তাটি নির্জন, আশে পাশে কোন দোকানপাট বা ঘরবাড়ি
কিচ্ছু নেই- যেখানে জহির বৃষ্টির হাত থেকে না ভেজার জন্য আশ্রয় নিতে পারে। তার
বৃষ্টিতে ভিজতে কোন সমস্যা নেই, কাপড়-চোপড় ভিজে গেলেও শুঁকিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু
ঘুড়িটিতে বৃষ্টির পানি পড়লেই সর্বনাশ। পাতলা কাগজের ঘুড়িটিতে পানি পড়লেই ভিজে
ছিঁড়ে যাবে। তার এত সব পরিশ্রম বৃষ্টির পানিতে নষ্ট হয়ে যাবে, কিছুতেই ভাবতে পারে
না জহির।
কিন্তু প্রকৃতি কারও
কথা শোনে না, আবার শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। জহির বড়সড় একটি গাছের নিচে আশ্রয়
নিল। যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে গাছের পাতা খুব
একটা সময় রক্ষা করতে পারবে না জহির এবং
ঘুড়িকে। পড়নের সাদা সার্ট খুলে ঘুড়িকে আবৃত করে দিল, সে ভিজে
ভিজুক- ঘুড়িটি যেন রক্ষা পায়। জহিরের সার্টের তুলনায় ঘুড়িটি অনেক বড়, তাই সার্ট
অর্ধেকও ঢাকতে পারল না ঘুড়ির।
আকাশ ভেঙ্গে যেন
বৃষ্টি নেমেছে। গাছের নিচে দাঁড়িয়েও জহির
ভিজে চুপসে একাকার হয়ে গেল। কিন্তু ঘুড়ির দশা দেখে এবার সত্যি সত্যি কেঁদে দিল সে।
দু চোখ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি গড়িয়ে পড়তে লাগল গাল বেয়ে। বৃষ্টিতে তার চোখের জল
যেমন ধুয়ে মুছে যাচ্ছে, তেমনি ঘুড়ির পাতলা কাগজ ভিজে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ধুয়ে মাটিতে নেমে
যাচ্ছে বৃষ্টির পানির সাথে। সেই সাথে রঙ্গিন কাগজের রঙে সাদা সার্টটিও লাল হয়ে
গেছে। এখন আর সার্ট দিয়ে ঘুড়ি জড়িয়ে রেখে লাভ নেই। সার্টটি আগলা করে গায়ে চাপাল
সে।
ঘুড়িটির ফ্রেম বা
খাঁচার সাথে সামান্য কিছু কাগজ লেগে আছে। বাকি সব ধুয়ে গেছে বৃষ্টির পানিতে। এখানে
আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ নেই। ঘুড়ির কঙ্কালটি ফেলে দিল না জহির, ডান হাতে কঙ্কালটি
নিয়ে ভিজতে ভিজতে চলল সামনের পথে।
আরে, রেল লাইন! কিভাবে
কিভাবে সে রেল লাইন পর্যন্ত চলে এসেছে। কিন্তু এই রাস্তাটি তো তার গায়ে যাওয়ার
রাস্তা নয়। সিনেমা হল- রেল লাইন-
মসজিদ রাস্তাটি তার মনে আছে। তাহলে এক কাজ করা যাক, এই রেল লাইন ধরে চললেই এক সময়
মিলবে সেই পথ। রেল লাইন উত্তর দক্ষিণে বরাবর চলে গেছে, কোন দিকে যাবে সে ? জহিরদের
বাড়ি থেকে দক্ষিণে হয় রেল লাইন, তাহলে উত্তরদিকে গেলেই মিলবে বাড়ি যাওয়ার সে
রাস্তা। এই বৃষ্টির মধ্য যে কাউকে পাওয়া যাবে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেয়ার জন্য, সে
আশাও করতে পারছে না জহির। রেল লাইনের দু পাশে ফাঁকা, কোন বাড়ি ঘর নেই। তুমুল
বৃষ্টিতে কোথাও গিয়ে যে আশ্রয় নিবে, সে সম্ভাবনাও আপাতত নেই। অবশ্য কোথাও থামার
ইচ্ছে জহিরের নেই। আচ্ছা, সন্ধ্যা হতে আর কত সময় বাকি? মনে মনে আঁতকে উঠে জহির।
যদি সন্ধ্যা নেমে আসে, তাহলে কিভাবে বাড়ি যাবে সে ? এখনও যে বাড়ি যাওয়ার রাস্তা
চিনতে পারে নি। আরও দ্রুত চলতে হবে, বৃষ্টির তোয়াক্কা করলে চলবে না। হাটার গতি
বাড়িয়ে দিল সে।
প্রচণ্ড শব্দ শুনে
আঁতকে উঠে থেমে গিয়ে, পিছন ফিরে চাইল জহির। ট্রেন আসছে। আকাশের সবটুকু জুড়ে কালো
মেঘ- অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশ, তাই সামনে আলো জ্বালিয়ে আসছে ট্রেন। আলো দেখে বুঝতে
পারল জহির, খুব দূরে নেই ট্রেন। লাইন ছেড়ে ঢালু পাড়ের সামান্য নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে
পড়ল সে। পাশ কাটিয়ে ট্রেন চলে যাওয়ার সময় বাতাসের ধাক্কায় পড়ে যাওয়ার উপক্রম হল
জহির। সেই সাথে শীত যেন চাবুকপেটা করে গেল তার শরীরকে। জবুথবু হয়ে সেখানেই বসে রইল
কিছু সময় সে।
রেল লাইনের কাঠের
স্লিপারের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে বেশ অসুবিধাই হচ্ছে জহিরের। দুটো স্লিপারের মাঝের
দূরত্ব জহিরের পদক্ষেপের চেয়ে বেশি, তাই অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে হচ্ছে জহিরের।
মাথার উপর অবিরাম ধারায় পড়ছে বৃষ্টি- মনে হচ্ছে এ বৃষ্টি আর থামবে না। ঠাণ্ডায়
শরীর কাঁপছে তার, সেই সাথে তার পা কাঁপছে ঠকঠক করে। ঘুড়ির ফ্রেমটি যদিও তার হাতে
ধরা আছে, কিন্তু মনে ঘুড়ির চিন্তা একদম ভুলে গেছে সে। বাবার কথাও মনে নেই- বাড়ি
ফিরলে বাবা তাকে কি রকম পিটাবে, সে ভয়ও আসছেনা মনে। আগে বাড়ি ফিরতে পারলে তো। যদি
এই রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে রাত নেমে আসে, যদি সে হারিয়ে যায়। মা কি অনেক
কান্না কাটি করবে? বাবা মনে হয় কাদবে না। জহিরের বাবার মত নিষ্ঠুর বাবা আর কারও
নেই।
সামনে রেল ক্রসিং,
আশায় নেচে উঠে জহিরের বুক। সেখানে ছোট ছোট দু তিনটি দোকান আছে- দোকান গুলো দেখে নিশ্চিত
হল সে। হ্যাঁ, এটিই তার গায়ে যাওয়ার পথ। সে পথ ধরে কিছুদূর যাওয়ার পরে সেই মসজিদটি
দেখতে পেল। মসজিদের ভিতরে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। শরীর বেশ খারাপ লাগছে তার। ভিজে,
ঠাণ্ডায় মনে হয় জমে গেছে সে। নাহ, তারপরেও কোথাও বিরতি দেয়া যাবে না। সন্ধ্যার
আগেই তাকে বাড়ি পৌছাতে হবে।
পাকা রাস্তা ধরে
এতক্ষণ বেশ ভালই চলছিল জহির, কিন্তু এখন চলে এসেছে নদীর পাড়ে যাওয়ার কাঁচা
রাস্তায়। বৃষ্টিতে রাস্তা পিচ্ছিল এবং কর্দমাক্ত। পায়ের স্পঞ্জের চপ্পল খুলে হাতে
নিল সে। আগের মত দ্রুত চলতে পারছে না, কাদায় সাবধানে পা ফেলে ফেলে এগুতে হচ্ছে।
একসময় সে পৌঁছে গেল নদীর পাড়ে।
ছোট্ট ঘাটপাড়ে
পারাপারের জন্য একটি মাত্র নৌকা। নৌকা এ পাড়ে দেখে আশ্বস্ত হল জহির। ছাতা মাথায়
নৌকাতেই বসে আছে মাঝি। কিন্তু পারাপারের জন্য কোন যাত্রী নেই। জহির গিয়ে নৌকায়
উঠল। মাঝি দয়া পরবেশ হয়ে নৌকা ছেড়ে দিল।
বাকি রাস্তাটুকু কিভাবে
পার হয়ে এল, জহিরের আর মনে নেই। জহিরের বাবা এখনও হাট থেকে ফিরেনি দেখে বাবার ভয়
কাটিয়ে ঘরে প্রবেশ করল জহির। ঘুড়ির খাঁচাটিকে রান্না ঘরের লাকড়ির মাচার নিচে
লুকিয়ে রেখে এসেছে সে। জহিরকে দেখে আঁতকে উঠল তার মা এবং বোন। থর থর করে কাঁপছে
সে। ভেজা কাপড় পাল্টে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল জহির। মায়ের কথা যেন
অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। টিনের চালে একটানা বৃষ্টি পতনের শব্দ হচ্ছে...। গভীর ঘুমে হারিয়ে গেল জহির।
(২)
গ্রীষ্মের দুপুরের
প্রখর রোদে সবকিছু কেমন যেন ঝিমিয়ে পরেছে। আম গাছ- জাম গাছে দু চারটি পাখির
ডাকাডাকি ছাড়া আর কোথাও কোন কলেরব নেই। জহিরদের উঠোনে ধান শুকাতে দিয়ে পাশের আম
গাছের নিচের ছায়ার বসে ঝিমুচ্ছে জহিরের মা। কাল অনেক রাত জেগে তাকে ধান সিদ্ধ করতে
হয়েছে। সিদ্ধ ধানগুলো সেই সকাল বেলায়ই শুকাতে দিয়েছে উঠোনে। এখন গাছের ছায়ায় বসে বসে পাহারা দিচ্ছে ধান। প্রতিবেশীদের হাঁস
মুরগির যা উৎপাত- একটু চোখের আড়াল হলে গপ গপ করে গিলে ফেলে। ঝিমুনি রেখে জহিরের মা
উঠে দাঁড়াল। অনেকক্ষণ হল, ধান নেড়ে নেয়া দরকার।
সূর্যের প্রখর আলোর
হাত থেকে মুখমণ্ডল রক্ষার জন্য লম্বা ঘোমটা টেনে, খালি পায়ে উঠোনের সেদ্ধ ধান
নাড়তে নাড়তে হাক ছাড়ল জহিরের মা, ‘ জহির, কই গেলিরে। ধানের কাছে একটু আইসা বয় বাপ।
তর বাপে আসার আগেই রান্নার কাম শেষ করা লাগব। তুই ধানগুলা একটু পাহারা দে বাপ’।
জহিরের মা আরও কয়েকবার
চেঁচাল, ‘জহির, অই জহির। কনে গেলিরে’।
জহিরের কোন সাড়া না পেয়ে জহিরের মা চলে এল ঘরের ভিতরে। সেখানেও নেই জহির।
ছেলেটি বেশ ভোগাচ্ছে তাকে। এক সপ্তাহ পড়ে ছিল জ্বরে, এখন সেড়ে উঠেছে মাত্র। সকাল বেলা স্কুলে গিয়েছিল,অর্ধেক বেলায় স্কুল থেকে ফিরে তারপর কোথায় কোথায়
ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে।
জহিরদের বাড়ির সামনে
ছোট্ট একটি পুকুর আছে, অবশ্য পুকুর না বলে ডোবা বলাই ভাল। সে ডোবার পাড় ঘেসে
প্রতিবেশীদের বাঁশ বাগান। সেখানে বড় একটি আম গাছ আছে। যায়গাটি নির্জন, সচারচর কেউ
আসে না এখানে। জহির সেই আম গাছের নিচে বসে আছে। জহিরের সামনে রাখা সেই ঘুড়ির
খাঁচাটি। খাঁচাটির পাশেই পড়ে আছে পুরনো একটি লেখার খাতা। একপাশে কাগজের উপর
মুঠোখানি সাদা ভাত। একটি কাগজ কাটার কেঁচিও আছে সেখানে। মায়ের চোখ লুকিয়ে
কাগজ-কেচি নিয়ে এখানে বসেছে ঘুড়িটি ঠিক করবে বলে। ঘুড়িটির বাঁশের ফ্রেম ঠিকই আছে,
কোথাও ভেঙ্গে যায়নি। এখন শুধু কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে দিলেই হবে। তবে কাজটি মোটেও সহজ নয়
জহিরের কাছে।
আজ স্কুলে গিয়েছিল সে।
মাস্টার মশাইকে বলতে হয়েছে স্কুল কামাইয়ের কারন। অবশ্য সহপাঠী বন্ধুদের বলেছে তার
ঘুড়ি কেনার গল্প। বন্ধুরা সবাই আফসোস করেছে ঘুড়িটির জন্য। ওদের অনেকেরই সুন্দর
সুন্দর ঘুড়ি আছে। তবে সবচেয়ে সুন্দর ঘুড়ি আছে রাশেদের। তার বাবা বিদেশ থাকে,সেখান
থেকে ঘুড়িটি পাঠিয়েছে। এ রকম ঘুড়ি জীবনেও দেখেনি জহির। ঘুড়িটি সুন্দর কাপড়ের তৈরি,
লোহার ফ্রেম- আবার ভাজ করে ছোট করা যায়। ঘুড়িটি দেখতে অবিকল ইগল পাখির মত। এ রকম
একটি ঘুড়ি পাওয়ার সপ্ন তার জীবনেও পূরণ হবে না। রাশেদ যেদিন স্কুল ব্যাগে করে
ঘুড়িটি নিয়ে এসেছিল বন্ধুদের দেখানোর জন্য, তার পর থেকে সবাই রাশেদ কে কি রকম সমীহ
করে! রশিদের বাবা রশিদকে সুন্দর একটি চং
গুড্ডি বানিয়ে দিয়েছে। সেই গুড্ডিটির মাঝখানে আবার লাল, চারপাশে সবুজ- দেখতে জাতীয়
পতাকার মতন। লম্বা লেজওয়ালা ঘুড়ি জহিরের বন্ধুরা সবাই বানাতে পারে। একটি কাগজের
পৃষ্ঠায় বাঁশের সরু কাঠি বাকিয়ে কাগজের সাথে আটকে দিয়ে আরেকটি কাঠি লম্ব ভাবে
দিলেই হল। অবশ্য লম্বা লেজ জুড়ে দেয়া লাগে সাথে। কিন্তু জহিরের এই মাছ ঘুড়ির
খাঁচাটি সে রকম সহজ নয়। এ রকম ঘুড়ি বন্ধুদের কারও কাছে নেই, কেউ মনে হয় বানাতেও
পারে না। জহির যদি নিজে নিজে এ রকম একটি ঘুড়ি বানাতে পারত, তবে বন্ধুদের সবাইকে
ঘুড়ি বানিয়ে দিত। এই ঘুড়িটির ফ্রেমে কাগজ লাগানো হয়ে গেলে যদি ঘুড়িটি ঠিক ঠিক উড়ে,
তবে ঘুড়িটি নিয়ে যাবে রাজু ভাইয়ের কাছে। রাজু ভাই অনেক রকমের ঘুড়ি বানাতে পারে,
দেখে দেখে অবিকল আরেকটি ঘুড়ি নিশ্চয়ই সে বানাতে পারবে। আর রাজু ভাইয়ের কাছ থেকে
শিখে নেয়া যাবে ঘুড়ি বানানের বিদ্যাটি।
প্রথমে মাছ ঘুড়িটির
মাথা এবং লেজের মাপে কেচি দিয়ে খাতার কাগজ কাটল সে। তারপর ভাত দিয়ে ডলে ডলে সে
কাগজ আটকে দিল বাঁশের ফ্রেমের সাথে। পাখাদুটো বেশ বড়, কয়েকটি পৃষ্ঠা লেগে যাবে।
পেটের মাঝের অংশ উঁচু, দু পাশে সরু- একই মাপে কাগজ কেটে নিতে হবে প্রথমে। জহির মনে
মনে হিসাব করছে কিভাবে পেটের অংশটুকু কাগজ দিয়ে আবৃত করবে। পাখাদুটো সবশেষে, কেননা
এ কাজটিই সবচেয়ে কঠিন।
টানা দু ঘণ্টা
পরিস্রমের ফসল হিসাবে জহিরের ঘুড়িটি ফের আকাশে উড়ার জন্য পূর্ণরূপ ফিরে পেল। দেখতে
অবশ্য খারাপ লাগছে না ঘুড়িটিকে, কিন্তু প্রথমবারের সেই রঙ্গিন ঝলমলে রূপ আর নেই।
এখন উড়তে পাড়লেই হবে। তারপর না হয় কাগজ ছিঁড়ে গেলে রঙ্গিন কাগজ লাগানো যাবে। ওদের
স্কুল সংলগ্ন ছোট্ট দোকানটিতে নানা রঙের রঙ্গিন কাগজ পাওয়া যায়। রাজু ভাইয়ের
সাহায্য নিয়ে আরও সুন্দর করে মাছ ঘুড়িটিকে নানা রকম রঙ্গিন কাগজ দিয়ে আবৃত করবে।
যদি ঠিক ঠিক উড়ে, তবে কালকেই রাজু ভাইয়ের কাছে ঘুড়িটি দেখাতে নিয়ে যাবে।
ঘুড়ি মেরামতের কাজ
শেষ, এখন সুতো গোছাতে হবে। জহির মায়ের চোখ লুকিয়ে ঘর থেকে সেই হাট থেকে কেনা
নাইলনের সূতার বান্ডিল নিয়ে এল। পুরনো নাটাইটিও সাথে করে নিয়ে এসেছে। নাটাইয়ে সূতা
গোছানোর কাজ শেষ হলে, নাটাইসমেত সূতা এবং ঘুড়িটি লুকিয়ে রেখে এল রান্নাঘরের লাকড়ির
মাচার নিচে। বিকেল হলেই মাঠে নিয়ে যাবে উড়াতে। এখন একটু পড়াশোনা করা যাক
টেবিল-চেয়ারে বসে! বাবা অবশ্য মাঠে কাজ করতে গেছে, সন্ধ্যার আগে ফিরবে না। পড়াশোনা
করতে দেখলে মাও কিছু বলবে না যে এতক্ষণ সে কোথায় ছিল!
মসজিদ থেকে আসরের
নামাজের আযানের ধ্বনি জহিরের কানে যেতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে। গুটি গুটি পায়ে
উঠোনে এসে একবার দেখে নিল মা কোথায় আছে। টিউবওয়েলের পাড়ে মাকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে
রান্নাঘরে প্রবেশ করল সে। এক হাতে নাটাই, অন্য হাতে কাগজের ঘুড়িটি নিয়ে দ্রুত চলে
এল বাড়ির আঙ্গিনার বাইরে।
জহিরদের বাড়ির অদূরেই
জহিরের বন্ধু রায়হানের বাড়ি। রায়হান বাড়িতেই ছিল। জহিরের ডাক শুনে সে বেড়িয়ে এল
ঘরের ভিতর থেকে। জহিরের হাতে এ রকম একটি ঘুড়ি দেখে রায়হান কম অবাক হল না।
সেই সাথে সে নিজেও সাথে নিল তার লম্বা লেজওয়ালা ঘুড়িটি। দু বন্ধু মিলে আরও
কয়েকজনের বাড়ি গিয়ে তাদের ডেকে সাথে নিয়ে নিল। গাঁয়ের কাঁচা রাস্তা ধরে মাঠে যাবার
সময় ছোট ছোট আরও কয়েকজন ভিড়ল জহিরদের দলে। সবাই মিলে ঘুড়ির মিছিল করে পৌঁছে গেল গাঁয়ের খোলা শস্যখেতে।
ধান কাঁটার মৌসুম শেষ
হয়েছে কিছুদিন আগে। গ্রামের বিশাল শস্যখেত তাই এখন ফাঁকা। একদল ছেলে ফুটবল খেলছে
উত্তরে- জহিরদের থেকে অনেক দূরে। গ্রামের এ শস্যখেতের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে
প্রশস্ত কাঁচা রাস্তা, জহিরের দল সে রাস্তার মাঝামাঝি এসে থামল। জহির বিলম্ব না
করে নাটাইয়ের সূতা বাঁধল ঘুড়ির সূতার সাথে। বাতাস প্রবাহের দিক নির্ণয় করে একজনের
হাতে ঘুড়ি তুলে দিল দূরে নিয়ে গিয়ে উড়িয়ে দেয়ার জন্য। নাটাইয়ের দু প্রান্ত ধরে
জহির নাটাই থেকে সুতো ছাড়ছে- ঘুড়ি এবং নাটাইয়ের মাঝে মোটামুটি একটা দূরত্ব তৈরি
হলে নাটাই থেকে সূতা ছাড়া বন্ধ করল সে। চিৎকার করে ঘুড়ি উড়িয়ে দিতে বলল
বন্ধুকে।
জহিরের বন্ধু ঘুড়ি
উড়িয়ে দিলে জহির নাটাই হাতে দৌড় দিল। সূতার টানে ঘুড়ি ক্রমশ উঠতে লাগল উপরে। ঘুড়ি
আকাশে উঠে গেলে দৌড় থামিয়ে উল্টো ঘুরে ঘুড়ির দিকে চাইল জহির। কি সুন্দর আকাশে
উড়ছে তার ঘুড়ি। খুশিতে বুক ফেটে যেতে চাইছে তার!
জহিরের বন্ধুরা তাদের
নিজেদের ঘুড়িও আকাশে উড়িয়ে দিয়েছে। জহিরদের দলের ঘুড়ি ছাড়াও আরও অনেক ঘুড়ি উড়ছে
আকাশে। তবে অন্য ঘুড়িগুলো দূরে দূরে- আকাশের অনেক উঁচুতে উড়ছে। জহির যখন নিশ্চিত
হল, গোত্তা খেয়ে তার মাছ ঘুড়ি আর মাটিতে নামবে কিংবা পড়ে যাবে না- সে নাটাই থেকে
সূতা ছাড়া শুরু করল। জহিরের ঘুড়ি ক্রমশ উপরে উঠছে... আরও উপরে...।
নাটাই হাতে সে ঘুড়ির
দিকে একমনে চেয়ে আছে জহির।
রচনাকালঃ জুন, ২০১৫।