সেই ' সাহসী এবং বুদ্ধিমান ' গরুটির সন্ধান চাই।
সাদা জার্সি পরা দলের একজন খেলোয়াড়
বল নিয়ে ছুটছে, তাকে বাঁধা দেয়ার চেষ্টা করছে বিপক্ষ দলের দু তিন জন খেলোয়াড়-
কিন্তু সে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়ল চুন দিয়ে সুন্দর করে দাগ কাটা বিপক্ষ দলের
ডি-বক্সের মধ্য। তার চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে কোলা ব্যাঙের মত লাফাতে থাকা গোলকিপারকে
পরাস্ত করে বল জালে পাঠানো। লক্ষ্য অর্জনে ডানপায়ে জোরসে কিক মারল বারপোষ্টের
উদ্দেশ্যে- ।
মাঠের উত্তর পাশের দর্শক সব হৈ হৈ করে উঠল। তাদের হৈ হৈ থামতে না থামতেই
দক্ষিণ পাশের দর্শকবৃন্দ হর্ষ-ধ্বনি দিল, কেননা তাদের গোলরক্ষক শক্ত দু হাতে
বিপক্ষদলের পাঠানো বলকে প্রতিহত করেছে। গোলকিপার একটু দৌড়ে দু হাতে ধরা বলকে সজোরে
পা চালিয়ে পাঠিয়ে দিলেন মাঝমাঠের ওপাড়ে।
মাঠের উওর পাশে অবস্থান নিয়ে সাদা জার্সি পরে যে দল খেলছে ওরা চড়লপুর একাদশ
এবং নীল জার্সি কালো হাফপ্যান্ট পরিহিত, মাঠের দক্ষিণে অবস্থান নেয়া দলটি হচ্ছে
মিরপুর একাদশ। আসলে খেলা হচ্ছে এই দুই গ্রামের মধ্য এবং তা অনুষ্ঠিত হচ্ছে
প্রতিবেশী গ্রাম সোনালিয়ায়।
গোঁড়ার দিকটা একটু বলে রাখি, তাহলে বুঝতে পারবেন কি খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে
এখানে!
চড়লপুর এবং মিরপুর পাশাপাশি দুটো বৃহৎ গ্রাম। জনসংখ্যায় কেউ কারও চেয়ে কম
নয়, কিন্তু দুটোই দরিদ্র । তাদের চেয়ে অনেক ভাল অবস্থানে আছে প্রতিবেশী গ্রাম
সোনালিয়া। কেননা সে গ্রামে শিক্ষিতের হার
অনেক বেশি। আকারে কিংবা জনসংখ্যায় অন্যদুটো গ্রামের চেয়ে ছোট হলেও তারা সম্পদশালী।
প্রতিবেশী গ্রামগুলোর সাথে সবসময় সুন্দর সম্পর্ক বজায় রেখে চলে সোনালিয়া, সেই সাথে
নিজেদেরও।
কিন্তু অন্য দুটো গ্রামের অবস্থা তাদের মত ছিল না। দু গ্রামের লোকজনের মাঝে
সু সম্পর্ক ছিল না কোন কালে। অতীতে তারা বহুবার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে সামান্য
বিষয়কে কেন্দ্র করে। এখন অবশ্য সবার মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের প্রতি অনীহা সৃষ্টি
হয়েছে কিন্তু পুরনো ঐতিহ্যকে ভুলতে পারেনি কোনদিন। সে গুলোই যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠে
প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় দু গ্রাম। কি বিষয় নিয়ে প্রতিযোগিতা নেই ? খুব সাধারণ বিষয়
থেকে সুরু করে সব বিষয় নিয়েই তাদের প্রতিযোগিতা করতে হবেই। সেবার কুরবানির ঈদে
গ্রামের হাটে সোনালিয়া গ্রামের এক কৃষকের মোটা-তাজা ছাগল অন্য দু গ্রামের দুজন
মুরুব্বীর পছন্দ হয়ে বসল । একজন দর হাঁকলেন পাঁচ হাজার টাকা, অন্যজন পরক্ষণেই বলে
উঠলেন সাত হাজার। তারপর নয় হাজার-বারো হাজার... পনের হাজার... বিশ...। চড়লপুর
গ্রামের মুরুব্বীর কথা, তাদের কি টাকা-পয়সা কম আছে হতচ্ছাড়া মিরপুর গ্রাম থেকে।
মিরপুর গ্রামের মুরুব্বীর একই চিন্তা, টাকাপয়সা হচ্ছে হাতের ময়লা- একবার গেলে আবার
আসবে। কিন্তু মান-সন্মান বলে কথা। ছাগল যদি চড়লপুর কিনে নিয়ে যায় তবে ইজ্জত থাকবে
? শেষ পর্যন্ত ছাগলের দাম উঠল এক লাখ টাকা ! কিন্তু বিপত্তি বাঁধাল সোনালিয়া
গ্রামের সে বিক্রেতা মালিক। ছাগল
তিন বিক্রি করবেন ঠিকই, কিন্তু এক লাখ টাকায় নয়। বেকুব এই গ্রাম দুটো ছাড়া
অন্য গ্রামের কেউ যদি সাত হাজার টাকার ছাগলকে সাত হাজার টাকাই বলে, তিনি বিক্রি
করবেন কিন্তু তাদের এক লাখ টাকায় নয় !
এক গ্রামের ছেলে-ছোকরারা অন্য গ্রামের ইক্ষু খেত সাবাড় করে দেয়। আবার তারাও
সুযোগ পেলে নিয়ে যায় পুকুরের মাছ। বিয়ে
সাদির বালাই পর্যন্ত দু গ্রামের মধ্য ছিল না যদিও এক গ্রামের ছেলে-ছোকরা অন্য
গ্রামের মেয়ে দেখলে পিছু নেয়। কিন্তু চড়লপুর গ্রামের এক ছোকরা মিরপুর গ্রামের এক
মেয়ের প্রেমে পরলে বিপত্তি বেঁধে যায় নতুন করে। আর বাঁধবেই বা না কেন। মিরপুর
গ্রাম তাদের কোন মেয়েকে চড়লপুরের মত উচ্ছন্নে যাওয়া গ্রামে পাঠাবে না। চড়লপুরও
তাদের কোন ছেলেকে মিরপুরের মত বদমাশ গ্রামের সাথে সম্বন্ধ করতে দেবে না !
কিন্তু একদিন ছোকরা ছেলেটি মেয়েকে নিয়ে পালাল। শেষ পর্যন্ত জানা গেল, ওরা
বিয়ে করেছে। দু গ্রাম পরস্পরকে দোষারোপ করতে লাগলো। চড়লপুর গ্রামবাসী বলতে লাগল,
ওই হতচ্ছাড়া গ্রামের মেয়েটাই তাদের ভাল ছেলেটার মাথা চিবিয়ে খেয়েছে! মিরপুর
গ্রামের লোকজন লাফাতে লাগল, আসুক ফিরে ওই বদমায়েশ ছোকরা। ছোকরাকে এমন নাচ নাচাবে
যে জীবনের মত শিক্ষা পেয়ে যাবে, মিরপুর গ্রামের কোন সরল মেয়েকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করার মজা!
এর অল্পদিন পরে বন্যা এলো। গ্রামবাসী সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল বন্যা নিয়ে। বন্যা চলে গেলে কেউ মাথায় হাত দিয়ে
কান্নাকাটি করল, কেউ বা চুপচাপ রইল বসে। ধীরে ধীরে বন্যা
তাদের মন থেকে মিলিয়ে গেল এবং আবার মেতে উঠল সেই পুরনো বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্য
রেষারেষিতে।
সোনালিয়া গ্রামবাসী এবার অতিষ্ঠ হয়ে উঠল।
কাঁহাতক আর সহ্য করা যায় দু প্রতিবেশীর এ নির্লজ্জ আচরণ। মাঠে ময়দানে, রণে-বনে-জঙ্গলে সবখানেই এদের চরম রেষারেষি । একদল আরেক দলকে দেখলেই ঢিল
ছুঁড়ে মারছে, ঢিলগুলো তো তাদের মাথায়ও পড়তে পারে। অতীতে এর যথেষ্ট নজীরও আছে।
না, যেভাবেই হোক গ্রাম দুটোর মাঝে শান্তি
ফিরিয়ে আনতে হবে। এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না, এর একটা বিহিত করতেই হবে।
সোনালিয়া গ্রামের তাবৎ মুরুব্বী বসে গেলেন
আমগাছ তলায়। আলাপ আলোচনা-পর্যালোচনা সবই হল। শেষে সবাই সিদ্ধান্তে এলেন, আগামীকালই
চড়লপুর এবং মিরপুর গ্রামের সব মুরুব্বীকে দাওয়াত করে আলোচনায় বসবেন। তারপর এ
উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন দু গ্রামবাসীদের নিয়ে।
পরদিন দু গ্রামের সব মুরুব্বী নিয়ে মিটিং বসল
আমগাছ তলায়। সোনালিয়া গ্রামের পক্ষ থেকে বলা হল,- ‘দেখুন, আপনারা যদি পরিবর্তিত
হতে না পারেন তবে কোনদিন সুখ-সমৃদ্ধির আশা করতে পারেন না। এর উৎকৃষ্ট উদাহারন
আপনার পাশের রয়েছে, আপনি তা থেকে কোনরূপ শিখাও গ্রহণ করেন না। সে মনোবৃত্তি আপনার
নেই, কেননা, শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে রেখেছেন নিজেকে। আমরা সীমিত, পৃথিবীর
বুকে বীর-দর্পে চলার মত বিশাল সম্পদ অথবা বংশধর রেখে যাইনি; কিন্তু আমারা
সোনালিয়াবাসী প্রত্যেকেই শিক্ষিত। আমার গ্রামের কোন রিক্সা চালককে যদি মোড়ের চায়ের
দোকানে চা পানের ফাঁকে পত্রিকা পড়তে দেখেন তবে অবাক হবেন না। আমার গ্রামের
প্রত্যেক মা বেশ ভালো ভাবেই জানেন পরিবারের স্বাস্থ্য রক্ষা করে চলা যায় কিভাবে।
তার হাত ধরেই অক্ষর জ্ঞানের পরিচয় লাভ করে প্রতিটি শিশু। আমাদের গ্রামে সব ছোটরা
বড়দের সন্মান করে, বুড়োরা তাদের নিয়ে বেড়াতে যায়- ক্রিকেট খেলে। প্রতিবেশী সবার
সাথে প্রত্যেকেরই সুন্দর সম্পর্ক। কেউ কাউকে গালি দেয় না, ঝগড়া করে না। কোন
সমস্যায় পড়লে সবাই মিলেমিশে সমাধান করে। আমাদের মাঝে আজ যে শিশু বেড়ে উঠছে,
শিক্ষার আলো-সমাজের আলো তাকে গড়ে তুলেছে পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে। একজন পরিপূর্ণ
মানুষের মূল্য আপনাদের সব অর্থ সম্পদ-প্রতিপত্তি কিংবা বিশাল বংশধর থেকে অনেক
বেশি’।
‘আপনারা সবাই পিছিয়ে পরে আছেন কিন্তু কেউ
বুঝতে চাইছেন না। বস্তুত এই অজ্ঞানতাই আপনাদের পিছনের সারিতে ঠেলে রেখেছে। এই
অজ্ঞানতার জন্যই আপনারা শান্ত-সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে পারেন না। প্রতিবেশীর
সাথে কলহে লিপ্ত হন, সামান্য তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে মেতে উঠেন ঝগড়ায়। যদি
শিক্ষিত হতেন, তাহলে জানতেন জীবনের এগুলো কত তুচ্ছ দিক-তুচ্ছ বিষয়’।
‘আপনারা ভুলে যান আপনাদের সকল বিভেদ বৈষম্য।
একজন আরেকজনের হাতে হাত রাখুন... ওই যে পশ্চিমে অস্ত যাচ্ছে সূর্য, ওর দিকে চেয়ে
একটা সময় ভাবুন- আজকের মত এভাবেই আপনাদের সকল দূরত্ব দূর হয়ে গেল। আগামীকাল যখন নতুন
সূর্যোদয় হবে, সে নতুন সূর্যোদয়ের নতুন দিনে, নতুন বন্ধুর হাত ধরে হাঁটুন অবাক
সূর্যোদয়ের সোনালী আভার পিছু পিছু। দেখবেন পাখিরা সব আপনাদের ঘিরেই গান গাইছে’।
সোনালিয়া গ্রামের পক্ষ থেকে রাখা বৃদ্ধ নোটন
মাঝির চমৎকার উপস্থাপন বক্তৃতায় মুগ্ধ সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। মিরপুর এবং চড়লপুর
গ্রামের সব মুরুব্বী এবার উঠে দাঁড়ালেন; প্রত্যেকে প্রত্যেকের দিকে এগিয়ে গেলেন
এবং একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন অনেকক্ষণ। সোনালিয়া
গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে আরেকবার হাততালি দেয়া হল।
এবার অনুষ্ঠানের পালা। এ উপলক্ষে কি অনুষ্ঠান
করা যায়? দু গ্রামের পক্ষ থেকে নানা রকম প্রস্তাব রাখা হল। সোনালিয়ার তরফ থেকেও এলো
একটি প্রস্তাবনা। অবশেষে সবাই সেটাকেই সোল্লাসে সমর্থন জানালো।
চড়লপুর এবং মিরপুর এ দুটো ‘বন্ধু’ গ্রামের
মধ্য অনুষ্ঠিত হবে একটি প্রীতি ফুটবল ম্যাচ। সেখানে প্রীতি ভোজের ব্যবস্থাও থাকছে।
প্রতিবেশী গ্রাম দুটোর মুরুব্বীরা নিজ নিজ
গ্রামে চলে গেলেন। পরদিন সকাল হতেই দু গ্রামের মাঝেই যেন উৎসবের বন্যা বয়ে গেল।
গ্রাম দুটোর সবাই পথে-ঘাটে রাস্তায় নদীপারে সোজা কথায় যেখানেই যাকে পেল, ঠা ঠা
বুকে জড়িয়ে ধরল। একদল ছোকরা চলে গেল অন্য গ্রামে। সেখানে গাছ থেকে ইচ্ছামত ফল পেড়ে
খেল, কেউ কিছু বলল না; উপরন্তু হাতে ধরিয়ে দিল আরও কয়েকটি ফল। এ গ্রামের ছেলে ছোকরারা বসে পড়ল অন্য গ্রামের আম
কাঁঠালের বাগান, পুকুরের মাছ,
খেতের আঁখ-তরমুজ পাহারা দিতে ! মুরুব্বীদের
দেখে সিগারেট টানা তো দূরে থাক, লম্বা সালাম দিয়ে
তাদের পথ ছেড়ে, খেতের আইল ধরে চলে চলতে লাগলো যুবক ছোকরারা । উঠতি বয়সী ছেলেরা পাশের গ্রামের
মেয়েদের দেখে পিছু নেয়া কিংবা শিষ বাজিয়ে গান গাওয়া তো দুরের কথা, সালাম দিয়ে মাথা
নিচু করে আপু আপু বলেই অস্থির !
এসব দেখে সোনালিয়াবাসী মুচকি হাসে। সেই সাথে
তারা দ্বিগুণ উৎসাহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ এবং প্রীতিভোজ অনুষ্ঠানের
আয়োজনে। সোনালিয়ার দিলখোলা মানুষের থেকে বড় রকমের চাঁদা উঠল, সেই সাথে চড়লপুর এবং
মিরপুর গ্রাম থেকেও।
প্রমাণ সাইজের দুটো ট্রফি কেনা হল, একটি চ্যাম্পিয়ন
এবং অন্যটি রানার্স-আপ দলের জন্য। সুন্দর মেডেলও কেনা হল গুনে গুনে ত্রিশটা। আর
কেনা হল প্রমাণ সাইজের একটি গরু। ষাঁড়টি দেখে সবাই সন্তুষ্ট- প্রীতিভোজ তাহলে বেশ
জমবে।
যথারীতি সে দিন এসে গেল। সকাল হতেই তোরজোড়
শুরু হয়ে গেছে সোনালিয়া গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের মাঠকে ঘিরে। চুন দিয়ে সুন্দর
করে দাগ কাটা হয়েছে- মাঠের লম্বা ঘাসগুলো কেটে ফেলা হয়েছে আগেই। সেই সাথে বাহারি
ছোট ছোট বাহারি রঙের পতাকায় সজ্জিত করা হচ্ছে পুরো স্কুল প্রাঙ্গণ। মাঠের পশ্চিম পাশের অনেকটা জায়গা জুড়ে সামিয়ানা টানানো হয়েছে। সেখানে টেবিল, অনেক চেয়ার এবং স্কুল ঘরের বেঞ্চ সারি করে সাজানো হয়েছে।
সামিয়ানার শীর্ষে পিলারের মাথায় চারটি মাইক চার দিকে মুখ করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে।
একটু বেলা হতেই দু গ্রামের দর্শকবৃন্দ সারি
বেঁধে আসতে লাগল। আশে পাশের দু চারটা গ্রাম থেকেও আসতে লাগল অনেক মানুষ- ওদের কানেও
এ খেলার খবর পৌঁছে গেছে অনেক আগেই। সবার মধ্যেই প্রচণ্ড উৎসাহ-কৌতূহল।
খেলা শুরু হওয়ার ঘণ্টা-খানিক পূর্বেই দেখা
গেল, মাঠকে ঘিরে পুরো স্কুল চত্বরের কোথাও তিল ধারণের জায়গা নেই। শিশু থেকে আবাল
বৃদ্ধ-বণিতা সবাই আছে সেখানে। সেই সাথে আছে আইসক্রিম-ওয়ালা, চানাচুর-বাদাম-ঝালমুড়ি-ওয়ালা-
আরও কত কি। এই জনসমাবেশের সুযোগে দুটো পয়সা কামিয়ে নেয়ার ধান্দা ওদের।
বিশিষ্ট অতিথিদের সবাই এসে বসে পড়েছেন
প্যানেলের নিচে আসনগুলিতে। একসময়য় দু দলের খেলোয়াড়রা উপস্থিত হল মাঠে। দর্শকগণ হাত
তালি দিয়ে তাদের স্বাগতম জানালো। প্রত্যেক খেলোয়াড়ই তাদের সবার পরিচিত- গ্রামে
সুনাম আছে ভাল খেলে বলে। সেই সুনামকে অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।
একদল ব্যান্ডপার্টি মাঠে নেমে বাজনা আরম্ভ
করে দিয়েছে। দু দলের খেলোয়াড় মাঠের দু প্রান্তে শেষ বারের মত নিজেদের
প্রস্তুতি আদায়ে নিজেকে ঝালিয়ে নিচ্ছে।
ব্যান্ডপার্টির বাজনা থেমে গেল যখন বিশিষ্ট
অতিথিদের একটি দল মাঠে প্রবেশ করলেন। খেলোয়াড়রা এসে দারিয়ে গেল দু ভাগে, মাঝমাঠে
ঠিক মুখোমুখি।
পরিচয় এবং কুশলাদি শেষে প্রথমে
ব্যান্ডপার্টি, সে দলের পিছু পিছু দু দলের খেলোয়াড়, সোনালিয়া মিরপুর এবং চড়লপুরের সম্মানিত
অতিথি-গন, সবশেষে অতি উৎসাহী ছেলে-ছোকরার দল পুরো মাঠ ঘিরে চক্কর দিল একবার। তারপর
সবাই ফিরে গেল যার যার জায়গায়, রেফারী বাঁশি ফু দিলেন, ব্যস খেলা শুরু হয়ে গেল।
পনের মিনিটও পার হয়নি খেলার, এমন সময়
হট্টগোলের শব্দ ভেসে এলো মাঠ থেকে। কোন সমস্যা নিশ্চয় হয়েছে। দর্শকগণ কি হল-কি হল
বলে অপরজনের কাঁধ পেড়িয়ে উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল মাঠের উত্তর পার্শে। সেখানে
একজন খেলোয়াড় পড়ে আছে। নিশ্চয় বিপক্ষ দলের কেউ তাকে ল্যাঙ মেরেছে। ইতিমধ্যে দু
তিনজন লেগে গেছে আহত খেলোয়াড়টির সেবায়। দলের অন্যরা তাদের ঘিরে জটলা করছে।
মাঠের দক্ষিণের দর্শক-সারি থেকে মিলিত হৈ হৈ
রব ভেসে এলো, তাদের দলের খেলোয়াড়ই মাঠে পড়ে আছে যে। তবে সামান্য পরে সবাই শান্ত
হয়ে পড়ল, কেননা অপরাধী খেলোয়াড়টিকে রেফারী লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বেড়িয়ে
যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
মাঠের উত্তরের দর্শকবৃন্দ এবার চেঁচামেচি
শুরু করে দিল। কেননা ওরা সবাই পরিষ্কার দেখেছে ঘটনাটি। বিপক্ষ দলের খেলোয়াড়ের পায়ে
ওদের দলের সে খেলোয়াড়টির পা লেগেছিল মাত্র, কোন রকম আক্রমণ সে করেনি, আর ওমনি সে
ডিগবাজি দিয়ে মাঠে পড়ে চেঁচাতে লাগল যেন মারা যাচ্ছে! একে স্রেফ অভিনয় ছাড়া আর কি
বলা যায়! আর বোকা রেফারীটা কোন কিছু না বুঝেই লাল কার্ড দেখিয় দিল!
মিরপুর গ্রামের অনেকেই রাগে গজরাতে লাগল। রেফারীর চোদ্দ-গুষ্টি পর্যন্ত উদ্ধার করে ছাড়ল কেউ কেউ। এবং দু গ্রামের সম্প্রীতির
কথা বেবালুম ভুলে সেই অভিনেতা খেলোয়াড়টিকে যে সুযোগ পেলে আচ্ছা মতন পিটিয়ে ছাড়বে, সে কথা বলতেও ভুলল না।
খেলা শুরু হয়ে গেল আবার। দশ জন নিয়ে খেলেও
খুব ভাল খেলছে মিরপুর একাদশ। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কয়েকটি শক্ত আক্রমণ গড়ে তুলল
তারা। কিন্তু গোল না পেলেও সমর্থকদের হৈ হৈ-উল্লাস-চেঁচামেচি সবই পেল।
পঁচিশ মিনিটের মাথায় মিরপুর একাদশ প্রথম গোল
পেয়ে গেল। আর যায় কোথায়! মিরপুর গ্রামের সমর্থক দর্শকরা নাচানাচি শুরু করে দিল। আম
গাছের উঁচু ডালে বসে এক পিচ্চি খেলা দেখছিল, অতি আনন্দের চোটে লাফাতে গিয়ে সোজা
পড়ে গেল নিচের ডোবায়! তবুও সে মুখ ভর্তি কচুরিপানা নিয়ে চিৎকার করতে লাগল ‘গোল...
গোল... গোল...’ বলে।
কিন্তু ওদের এ উল্লাস দু মিনিট পরেই থেমে
গেল। মর্মাহত হয়ে সবাই লক্ষ্য করল, সাদা কালো বলখানা তাদের গোলপোস্টের জালে জড়িয়ে
আছে এবং লাইনের উপর বসে সে বলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে বোকার মত তাকিয়ে আছে তাদের
গোলরক্ষক।
তাকে বোকার মত
একই ভাবে বসে থাকতে হল আরেকবার। সে একই শকুন হাড়গিলে পাটকাঠি খেলোয়াড়টি তাকে আবারও
পরাস্ত করে বসল। কি করবে সে, ওই লিকলিকে পা দিয়ে যে এত জোরে শর্ট মারা যায়, এবারও
বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি সে।
কিন্তু ওর এবার মরে যাওয়া উচিৎ! কেননা সেই
পাটকাঠি লিকলিকে খেলোয়াড়টিই বল জালে পাঠাল। ও বোকার মত ডান দিকে ড্রাইভ দিয়েছিল,
আর বল সাঁ করে ঢুকে গেল বা দিকের জালে।
লিকলিকে সে খেলোয়াড়টি তার তৃতীয় গোল মানে
হ্যাট্রিক করার পরেই তার পাটকাঠি পা দিয়ে তিনটি ডিগবাজি খেল। ডিগবাজি শেষে তার
ভক্ত দর্শকদের কয়েকজন ছুটে এসে তাকে মাথায় তুলে নাচতে লাগল। ভলান্টিয়াররা ছুটে এসে
তাদের বের করে দিল মাঠ থেকে। খেলা শুরু হয়ে গেল আবার।
রেফারী বিরতির বাঁশি বাজালেন। ফলাফল: চড়লপুর
একাদশ তিন এবং মিরপুর একাদশ এক।
বিরতির পর খেলা শুরু হল। শুরু থেকেই মিরপুর
একাদশ প্রতিপক্ষের সীমানায় বেশ দাপটের সাথে বল চাপিয়ে খেলছে। পরপর তিনটি গোল
খাওয়ার পর প্রথমার্ধের শেষে তারা ঝিমিয়ে পরেছিল। সমর্থক-দর্শকেরা তাই উৎসাহ হারিয়ে
ফেলছিল ক্রমশ এবং গালি গালাজ করছিল লিকলিকে পাটকাঠি ব্যাটাকে, একই সাথে সেই
অভিনেতা খেলোয়াড়টিকেও। ওর বদমাইশির জন্যই তো একজন কম খেলোয়াড় নিয়ে খেলে তিনটে গোল
হজম করতে হল। প্রথম গোল তো ওরাই দিয়েছিল।
ঝিমিয়ে পরা দর্শক-সমর্থকরা নড়ে চড়ে বসল।
এভাবে খেললে একটা গোল হয়তবা পেয়ে যেতে পারে। তারপর আরেকটা... তারপর আরও একটা...
ব্যস ওরা জিতে যাবে!
সত্যি, আরেকটি গোল পেয়ে গেল ওরা। ঝিমিয়ে পরা
দর্শকরা নেড়েচেড়ে বসেছিল, এবার দারিয়ে লাফাতে লাগল। চড়লপুর গ্রামের দর্শকরা
সামান্য বিমর্ষ হলেও ওদের এ লাফালাফি কে পাত্তা দিল না। বাছাধনেরা, তোমরা কিন্তু এখনও এক গোল পিছিয়ে আছ।
দ্রুত দুটি গোল খেয়েই চড়লপুর একাদশ সোজা হয়ে
ঘুরে দাঁড়াল। একি কথা! জেতা ম্যাচ তো হাতছাড়া করা যায় না। দাঁড়াও বাছাধনেরা,
তোমাদের আরেকটি গোল দিয়ে মজা বুঝাচ্ছি।
কিন্তু, চড়লপুর একাদশ আরেকটি গোল দিবে কি,
উল্টো খেয়ে বসল। ফলাফল: মিরপুর একাদশ তিন এবং চড়লপুর একাদশ তিন।
খেলার মোড় নাটকীয় ভাবে ঘুরে গেছে। শেষ সময়ের নাটকীয়তা দেখার জন্য উত্তেজিত দর্শক মাঠের প্রান্তে বসে-দাঁড়িয়ে, স্কুল ঘরের বারান্দায়-ছাদে, টয়লেটের ছাদে, আমগাছের ডালে-জাম
গাছের ডালে- যে যেখানেই পারছে, বুকের ধুকধুকানি নিয়ে চোখের প্রতিটি পলক দৃষ্টি
রাখছে বলের উপর। কয়েকজন পিচ্চিকে দেখা গেল সারি বেঁধে সুপারি গাছে ঝুলে খেলা
দেখছে। গণ্য-মান্যরা সবাই আছেন প্যানেলের নিচের আসনগুলিতে।
লিকলিকে লম্বা পায়ের পাটকাঠি খেলোয়াড় বল নিয়ে
ছুটছে বিপক্ষ দলের সীমানায়। প্রতিপক্ষের একজন তাকে বাঁধা দিতে এগিয়ে এলো কিন্তু
পাত্তা পাত্তা পেল না ঐ লিকলিকে পা দুটোর আশ্চর্য কেরামতির কাছে। এবার একই সাথে
আরও তিনজন এলো, কিন্তু সবাই ব্যর্থ হল বল ছিনিয়ে নিতে।
মিরপুর গ্রামবাসী দর্শকদের কেউ কেউ আতঙ্কে
চোখ বন্ধ করে ফেলল, এবারও বুঝি পাটকাঠির হাত থেকে রক্ষা নেই। কিন্তু চোখ খুলেই
দেখতে পেল লিকলিকে পাটকাঠিটা চার হাত পা চারদিকে ছড়িয়ে দিয়ে ঘাসের উপর পড়ে আছে।
আহা, এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য বুঝি জগতে কোথাও নেই!
সামান্য পরে পাটকাঠি খেলোয়াড়টি উঠে দাঁড়ালো।
সাদা জার্সি দিয়ে মুখ মুছল সে এবং জার্সির অংশটুকু তুলে ধরল চোখের সামনে। পুরো মাঠ
দেখতে পেল, সেখানে ছোপ ছোপ রক্তে ভরে গেছে। খাড়া ওপুর হয়ে পড়ার ফলে সোজা নাকে আঘাত
লেগেছে। এবং সে ইচ্ছা করে পড়েনি, বিপক্ষ দলের একজন তাকে অন্যায় ভাবে ধাক্কা দিয়ে
ফেলেছে।
সেই খেলোয়াড়টি বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে
মজা পেলেও রক্তারক্তি আশা করেনি সে। তবে মনে মনে আত্মতৃপ্তি পেল, যাই হোক, দলকে
অন্তত একটি নিশ্চিত গোলের হাত থেকে বাঁচিয়েছে।
পাটকাঠি সে খেলোয়াড়টি এবার সোজা তার দিকে
এগিয়ে গেল। সামনে এসে দাঁড়াল এবং ধম করে একটা ঘুসি বসিয়ে দিল নাকের উপর!
মিরপুর গ্রামের সে খেলোয়াড়টি মাটিতে পড়ে
গিয়েও বিশ্বাস করতে পারল না, ওই চিমসে দেহের পাটকাঠিটার গায়ে এত শক্তি আছে। অথচ সে
ধাক্কা দেয়ার আগেই তো পড়ে গেল! সে উঠে দাঁড়াল এবং বুক চিতিয়ে দু কদম হেঁটে
পাটকাঠির ঠিক সামনে এলো। তারপর বিরাশি সিক্কার একটা ঘুসি ছুঁড়ল পাটকাঠির নাক বরাবর।
পাটকাঠি স্রেফ উড়ে গেল!
এবার দু দলের সব খেলোয়াড় পরস্পরের মুখোমুখি
হল এবং শুরু করে দিল লড়াই।
দু দলের দর্শকবৃন্দ এতক্ষণ নির্বাক-নিশ্চল
হয়ে পরেছিল ঘটনার আকস্মিকতায়। এবং সবার সম্বতি ফিরে এলো, সবাই একযোগে রণহুংকার
ছাড়ল, তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রতিপক্ষের উপর।
এত বড় কুস্তির প্রদর্শনী কোথাও হয়েছে কিনা
আমার জানা নেই। না হয়ে থাকলে নিঃসন্দেহে এটি একটি রেকর্ড! কে না লড়ছে?
শিশু-আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই। একগ্রামের পিচ্চি অন্য গ্রামের পিচ্চির সাথে মাটিতে
গড়াগড়ি খাচ্ছে। লুঙ্গি কাছা মেরে এক গাঁয়ের যুবক অন্য গাঁয়ের যুবকের দিকে রণহুংকার
ছেড়ে আয় টক-টক-টক কোরাস তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের ঠ্যাঙ ধরে টান মেরে চিৎপটাং
ফেলে দিচ্ছে। এক গ্রামের বৃদ্ধ অন্য গ্রামের বৃদ্ধর সাথে হাতের ছড়িখানা দিয়ে
তলোয়ারের মত যুদ্ধ করছে। প্রতিপক্ষের ছড়ি পড়ে গেলে নিজের ছড়িখানা উল্টো করে ধরে,
প্রতিপক্ষের গলা পেঁচিয়ে নিজের দিকে সামান্য টেনে এনে, ডানহাত উঁচুতে তুলে সদর্পে
নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করছে! গ্রাম দুটোতেও এ খবর পৌঁছে গেল, সেখানে দু গ্রামের
মায়েরা কিংবা মেয়েরা কাঁথা সেলাই করছিল একত্রে বসে। সুই সূতা ফেলে সবাই উঠে
দাঁড়ালো, কাপড়ের আঁচল কোমরে গুঁজে রান্নাঘরের
বড় ঝাড়ুটা টেনে নিলো এবং একজন আরেকজনকে পরিষ্কার কাজে লেগে গেল! এমনকি দু
গ্রামের গরুগুলো পর্যন্ত মাঠের ঘাস খাওয়া ভুলে পরস্পরের সাথে গুঁতোগুঁতি শুরু করে
দিল!
সোনালিয়া গ্রামের মুরুব্বীরা ভীষণ মর্মাহত
হয়ে প্যানেলের নিচে চুপচাপ বসে আছেন। সেখানে অন্য দু গ্রামের মুরুব্বীরাও ছিল,
কিন্তু সবাই এখন মাঠে গিয়ে নিজ নিজ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের শূন্য আসন গুলিতে
সোনালিয়া গ্রামের অন্যরা বসে আছে।
হায়, তাদের আলোচনা-পরিকল্পনা সব ভেস্তে গেছে।
দু গ্রাম আবার পরস্পরের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এ ঝগড়া থামানো দরকার।
বিষণ্ণ চিত্তে একজন আরেকজনের মুখপানে চাইলেন।
তারপর একজন উঠে চলে এলেন মাইক্রোফোন রাখা টেবিলের সামনে। সেখানে ভাষ্য দেওয়ার কেউ
ছিল না। মাইক্রোফোন হাতে তুলে নিলেন তিনি।
‘চড়লপুর এবং মিরপুর গ্রামবাসী, তোমরা তোমাদের
এ হীন কার্যালাপ বন্ধ কর। নিজেদের বিবেকের দিকে একবার একবার তাকাও, দেখ, তোমরা কি
করছ। তোমরা কি ভুলে গেছ সে প্রতিজ্ঞা, যা আমাদের সাথে করেছিলে। তোমার যদি এ
ঝগড়া-ফ্যাসাদ বন্ধ না কর, তবে জেনে রাখো, সোনালিয়া গ্রাম চিরদিনের জন্য তোমাদের
ত্যাগ করবে। সোনালিয়ার জন্য সেটাই হবে মঙ্গলজনক এবং তোমাদের জন্য দুর্ভাগ্য
স্বরূপ’।
সামান্য বিরতি দিয়ে তিনি আবার বললেন, ‘তোমরা
ঝগড়া বন্ধ কর। আবার খেলা শুরু হোক, এক দল জয়ী হও- দু দলই পুরষ্কার (শব্দটি তিনি
উচ্চারণ করলেন বিদ্রূপের সাথে) গ্রহণ কর এবং যোগ দাও প্রীতিভোজ অনুষ্ঠানে’।
‘পুরষ্কার’ এবং ‘প্রীতিভোজ’ শব্দ দুটো কানে
যেতেই লোকগুলোর মধ্য হুঁশ ফিরে এলো। দু দলের মুরুব্বীরা এবার সবাইকে থামাতে উদ্যোগ নিলেন। সবাই
মাঠ ছেড়ে বেড়িয়ে গেল একে একে। খেলা আবারও শুরু হয়ে গেল।
শেষ পর্যন্ত চড়লপুর একাদশ চার-তিন গোলে জয়লাভ
করল। তারা মাঠের এ মাথা ও মাথা বেড়ালো নেচে কুঁদে। এবং মিরপুর গ্রামের সবাই
‘জোচ্চুরি করে জিতেছে’ বলতে লাগল। ‘পরে দেখে নেব’ বলে চড়লপুর বাসী মেতে রইল আনন্দ
উৎসবে।
এবার পুরষ্কার বিতরণের পালা। এ পর্ব শেষ হলে
প্রীতিভোজ অনুষ্ঠানের রান্না-বান্নার কাজ শুরু হবে। হাড়ি-ডেচকি মসলা নিয়ে সোনালিয়া
গ্রামের বুড়ো বাবুর্চিরা বসে আছেন প্যানেলের পিছনে তাঁবু দিয়ে ঘেরা জায়গায়।
প্যানেলের পিছনে ষাঁড়টিও বাঁধা আছে, এখান থেকে দেখা যায় নাদুস নুদুস বিশাল
গরুটিকে। সবাই পরিতৃপ্তির চোখে দেখছে। পুরষ্কার পর্ব শেষ হলে গরুটিকে জবাইয়ের
মাধ্যমে সূচনা হবে প্রীতিভোজ অনুষ্ঠানের জন্য রান্না-বান্না আয়োজনের।
দু দলের সবাই এসে দাঁড়াল পুরষ্কার বিতরণী মঞ্চের
সামনে। প্রত্যেকের গলায় লাল ফিতের সুন্দর মেডেল ঝুলিয়ে দেয়া হল। রানার্স-আপ দলের
হাতে তুলে দেয়া হল ছোট ট্রফিটি। এখন চ্যাম্পিয়ন দলের পালা।
গরুটাকে সারাদিন ধরে অনেক কিছুই সহ্য করতে
হয়েছে। সকাল থেকে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে ঠিক একই জায়গায়, কোন রকম নড়াচড়ার সুযোগ
পায়নি সে। সেটা না হয় বাদ দেয়া গেল, কিন্তু সকাল থেকে একটা দানাপানিও খেতে দেয়া
হয়নি। খিদের জ্বালায় বেচারা অস্থির। তার উপর এই হৈ-হট্টগোল-চিৎকার-চেঁচামেচি- একেবারে
নারকীয় পরিবেশ!
কিন্তু তার থেকে দশ হাত তফাৎ-এ প্রধান অতিথি যখন চ্যাম্পিয়ন ট্রফিটি তুলে
দিলেন বিজয়ী দলের হাতে এবং সোনালী-লালের
অপূর্ব ট্রফিটি যখন উঁচু করে ধরল- পড়ন্ত দুপুরের ঝিলমিল আলো ট্রফির কাঁচে
প্রতিফলিত হয়ে সোনালী-লাল আলোয় ভরিয়ে দিল গরুটির চোখ; সে আর সহ্য করতে পারল না।
কোথায় পরে রইল বাঁশের খুঁটি, কোথায় পরে রইল
বেঁধে রাখার দড়ি! প্রচণ্ড ক্রোধে সবকিছু ছিঁড়ে-ছুঁড়ে গরুটি ঝাঁপিয়ে পড়ল ট্রফির
উপর। ট্রফিটি ভেঙ্গে চুরমার করে দিল, আহত করল ট্রফি বহনকারী দু জনকে।
রানার্স-আপ দলের খেলোয়াড়রা ছোট ট্রফিটি নিয়ে
সেখানেই বসে ছিল চুপচাপ। এবার গরুটির নজর পড়ল সে ট্রফির উপর। ট্রফি রেখে সবাই দৌড়ে
পালাল, ছুটে এসে শিং দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলল ট্রফি।
পলায়ন রত দু দলের খেলোয়াড়দের ধাওয়া করে
শিং দিয়ে গুঁতাতে লাগল গরুটি, কেননা ওদের
গলায় ঝোলানো মেডেলের সাথে লাল ফিতে দেখতে পেয়েছে সে!
এবার এক মাঠ দর্শককে গুঁতোতে শুরু করল রাগী
গরুটি। দর্শকদের সবাই চড়লপুর কিংবা মিরপুর গ্রামের বাসিন্দা। অন্য গ্রামের অতিথি
দর্শকেরা ঝগড়ার সময়ই কেটে পড়েছে। সোনালিয়া গ্রামের সবাই অবস্থান নিয়েছে প্যানেলের
নীচে এবং প্যানেলের উওর পার্শে। সেখানে আক্রমণ করেনি গরুটি।
গুঁতোগুঁতিতে তার বোধহয় ক্লান্তি এসে গেছে।
কতজন কেই তো মনের সুখে গুঁতানো গেল! এবার পালাতে হবে।
মাঠের পূর্বপাশ দিয়ে কেটে পড়তে চাইল গরুটি।
ঝেড়ে চার পায়ে দৌড় লাগাল সে।
এতক্ষণে সবাই সম্বতি ফিরে পেল, তাদের
প্রীতিভোজের গরুটি পালিয়ে গেল যে! পরক্ষণেই সবাই লাঠি-সোটা হাতে ছুট লাগাল বেয়াদপ
গরুটার পিছনে।
ঝোপ-জঙ্গল, ফসলের ক্ষেত-আইল মাড়িয়ে ছুটছে
গরু; তার পিছনে পিছনে ছুটছে সবাই- সে এক দেখার মত দৃশ্য রে ভাই!
কিন্তু ঐই চার পা ওয়ালার সাথে দু-পেয়েরা
পারবে কিভাবে। একসময়য় অনেক পিছিয়ে পড়ল সবাই। তারপর বড় আইলটির ওপারে নেমে গরুটি
স্রেফ হাওয়া হয়ে গেল।
কেহ আর কোনদিন সে গরুটির সন্ধান পায়নি।
এবার আপনাকে বলছি, সেই সাহসী এবং বুদ্ধিমান
গরুটির সন্ধান চাই। যদি কখনও আপনি তাকে দেখে থাকেন, তবে অবশ্যই আমায় জানাবেন। আপনার জন্য পুরষ্কার থাকছে আমার পক্ষ থেকে।
(গরুটির বর্ণনা দিচ্ছি, লিখে রাখুন। গরুটির চারটি ঠ্যাং একটি লেজ এবং দুটো শিং আছে। মাথার দু
পাশে দুটো কানও আছে......।)
(রচনাকাল: ২০০৬)